পূর্ব প্রকাশের পর-
আরমান ফোন রেখে দেয়। জয় এখনো ঘুমে অচেতন। একজন ওয়েটারকে ডাকলো। ছেলেটার নাম দবির। এগারো বারো বছর বয়স। তবে খুব চটপটে। আরমান তাকে বলল, শোন, এখন তোর ডিউটি এখানে। এই বাচ্চাটাকে পাহারা দিবি। যদি ঘুম থেকে জেগে যায়। কান্নাকাটি করে তাহলে আমার কাছে নিয়ে যাবি অথবা আমাকে সংবাদ দিবি।
দবির ঘাড় নেড়ে সম্মতি জানালো। আলি আরমান বলল, যদি কোনো রকম ত্রুটি করো, তাহলে তোমার চাকরি নট।
দবির হাসিমুখে ঘাড় নাড়লো। জ্বি আচ্ছা। আপনি ভাববেন না।
আলি আরমান নিচে নেমে এলো। লবিতে অপেক্ষা করতে লাগলো। এজিএম যাচ্ছিল হন্তদন্ত হয়ে, তিনি আরমানকে লনে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে এগিয়ে এলেন। জিজ্ঞাসা করলেন, স্যার আপনি এখানে দাঁড়িয়ে আছেন?
-এমডি আসছেন। আপনারা একটু চারিদিকে খেয়াল রাখেন।
-জ্বি। এজিএম আর দাঁড়ালো না। যেমন যাচ্ছিল তেমনি চলে গেলো। কারণ, এই হোটেলে তার চাকরির বয়স পনেরো বছর। সে জানে কোন ফুল দিয়ে কোন দেবতাকে পূজো দিতে হয়।
আরমান নিজের সমস্যা নিয়ে বেশ বিব্রতই ছিল। তার একটাই ভয় ছিল ব্যাপারটা অনন্যা কেমন ভাবে গ্রহন করে। জয়কে দেখে তার মুড চেঞ্জও হয়ে যেতে পারে। যে এতটুকু বাচ্চাকে আরমান তার মায়ের কোল থেকে কেড়ে এনেছে।
একটু পরেই অনন্যা এসে পৌছালো। গাড়ি থেকে নেমে এলো অপরূপা এক রাজ কন্যার মতো। অনন্যার সাজগোজ নজর কাড়ার মতো হলেও তার কপালে চিন্তার ছাপ পরিস্ফুট। গাড়ি থেকে নামলে আরমান নিচুস্বরে বলল, অফিস রুমে চলো।
অনন্যা আগে। আলি আরমান তার পেছন পেছন কর্মচারিদের সালাম নিতে নিতে অফিস রুমে পৌছে গেলো। অনন্যা নিজের চেয়ারে ধপাশ করে বসে পড়ে জিজ্ঞাসা করল, বলো। কি হয়েছে তোমার? এক মাসের ছুটি নিয়ে অনেকদিন পরে বাড়িতে গেলে, দুদিনও পার হলো না, আবার ঢাকা ছেড়ে চিটাগাং-এ চলে এলে। ব্যাপার কি?
আরমান তার সামনের সোফায় বসে পড়লো। অনন্যার পারমিসন ছাড়াই সিগারেট জ্বালালো। এরপরে ধীরে সুস্থে ফিরে আসার কাহিনী বলল। অনন্যা চুপ করে আরমানের সমস্ত কথা শুনে গেলো। একটা মন্তব্যও করলো না। আরমানের কথা শেষ হলে জিজ্ঞাসা করলো, তোমার বাচ্চাটা কোথায়?
-আমার রুমে রেখে এসেছি। ঘুমিয়ে পড়েছিল।
-তাকে কি একবার দেখতে পারি?
-অবশ্যই। চলো।
ওরা গিয়ে দেখলো জয় জেগে গেছে। দবিরের সাথে খেলা করছে। ওরা ঢোকামাত্র জয় খেলা থামিয়ে অনন্যার দিকে প্যাটপ্যাট করে চেয়ে থাকলো। কারণ, এরা সবাই তার অপরিচিত। এমনকি নিজের বাবাও তার কাছে তেমন পরিচিত নয়। জন্মের পর থেকে জয় তার বাবাকে কতটুই বা দেখেছে। তারপরও গুটিগুটি পায়ে আরমানের কাছে চলে এলো। বাবার কোলে ঝাপিয়ে পড়ল।
একেই বলে রক্তের টান। নাড়ির যোগ। অনন্যা জয়ের মুখের পানে চেয়ে থাকতে থাকতে বলে, এমন সুন্দর ছেলেটাকে ওর মায়ের বুক থেকে ছিনিয়ে আনলে? সে বেচারি কি এতক্ষণ জ্যান্ত আছে?
-ওর কথা আমার সামনে আর বলো না অন্যা। তুমি নিশ্চয় বুঝতে পারছ কতটা নিরুপায় হয়েই আমি তাকে ছেড়ে এসেছি।
অনন্যা আরমানকে রোজি সম্পর্কে আর কোনো প্রশ্ন করে না। জিজ্ঞাসা করে এই দুধের বাচ্চাকে তুমি সামলাবে কি করে?
-সেটাই তো বুঝতে পারছি না। তাই তো তোমাকে ডেকেছি। এব্যাপারে আমি তোমার পরামর্শ এবং সাহায্য চাই।
অনন্যা দেখল ওয়ার্ডবয় দবির তাদের মাঝে মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে আছে। আরমান সেটা খেয়াল না করলেও অনন্যা নিজের চারপাশ সম্পর্কে যথেষ্ঠ সচেতন। সে দবিরকে বলল, তুমি এখন যাও, দরকার হলে আবার তোমাকে ডাকা হবে।
সাথে সাথে দবির বেরিয়ে গেলো। অনন্যা হাত বাড়িয়ে দিলো, বাবু তুমি আসবে আমার কাছে?
জয় অনন্যাকে ভালো করে দেখে নিয়ে তার কোলে চলে এলো। অনন্যা জয়কে কোলে নিতে নিতে বলল, এই তো লক্ষি বাবু। অনন্যা বা আরমান কেউই ভাবেনি জয় এত তাড়াতাড়ি অনন্যার কাছে চলে আসবে। জয়ের মাঝে কোনো দ্বিধা সংকোচ নেই দেখে দু’জনেই খুশি হলো।
আরমানের চেয়ে অনন্যা অনেক বেশি সচেতন। কারণ, এটা হোটেল। হোটেলে আরমানের রুমে বেশিক্ষণ থাকলে নানা গুজব ছড়াবে। হোটেল কর্মচারীরা পরচর্চা করতে অদ্বিতীয়। ফলে হোটেলের মালকিন আর ম্যানেজারকে নিয়ে গল্পের শাখা প্রশাখা প্রসারিত হোক অনন্যা তা চায় না। অনন্যা জয়কে নিয়ে অফিস রুমে চলে এলো।
অফিস রুমে এসে জয় অনন্যার কোল থেকে নেমে খেলায় মেতে উঠলো। অনন্যা আরমানকে প্রশ্ন করল, এবার বলো ছেলেকে নিয়ে তুমি কি পরিকল্পনা করেছ?
-আমি তো কিছুই ভাবতে পারছি না। ওকে লালন পালন করার জন্য কি ধরনের আয়োজন অথবা ব্যবস্থা নিতে হবে তার একটা ছক তুমি আমাকে দাও।
অনন্যা কিছুক্ষণ চুপ করে বসে থাকে। শেষে কপালের চুল সরিয়ে কানের দুপাশে গুজে দিতে দিতে বলে, যেখাবেই করতে চাও না কেন, কাজটা তোমার জন্য মোটেও সহজ হবে না।
-সেটা আমিও জানি। কাজটা যত কঠিন হোক এখন আমাকেই তা করতে হবে। যেহেতু সে আমার একমাত্র সন্তান।
-যেভাবে হোক তুমি তোমার ছেলেকে বড় করে তুলতে পারবে। কিন্তু ওর মায়ের কি হবে?
-আমার সিদ্ধান্ত আমি তাকে জানিয়ে এসেছি। এখন সে তার জীবন তার মতো করেই সাজিয়ে নেবে।
অনন্যা চুপ করে যায়। গভীরভাবে কিছু ভাবে। এই এক বছরে আলি আরমানকে সে যতখানি চিনেছে তাতে তাকে আর প্রশ্ন করার দরকার নেই। কারণ, একটা জিনিস অনন্যা খুব ভালো করেই বুঝেছে যে, আলি আরমান বাইরে যতটা সহজ সরল ভেতরে ভেতরে ততটাই জেদি, একরোখা, গোয়ার। তার ইচ্ছার বিরুদ্ধে কোনো কাজ তাকে দিয়ে করানো যাবে না। অনন্যা খুবই গম্ভিরভাবে বলল, ঠিক আছে। চলো, ওকে নিয়ে বাসায় চলো। হোটেলের কামরায় রেখে তো আর ছেলে মানুষ করতে পারবে না। তার জন্য পারিবারিক আবহাওয়া দরকার। তাছাড়া মাঝরাতে যখন ‘আম্মু যাবো’ বলে কান্না ধরবে, তখন দুনিয়ার যাবতীয় জিনিস এনে ওর সামনে জড় করলেও কান্না থামাতে পারবে না।
এর জবাবে কি বলবে আলি আরমান তা ভেবে পেলো না। অনন্যার কথামতো জয়কে কোলে তুলে নিয়ে অনন্যাকে অনুসরণ করল। অনন্যা রুম ছাড়ার আগে এজিএমকে ফোনে বলল, আরমান সাহেব আজ রাতে আর হোটেলে ফিরবেন না। আপনি সবদিক সামলে নেবেন।
-জি আচ্ছা।
ওরা গাড়িতে এসে বসলো। গাড়ি চলল বাসার দিকে। পথে দুজনের মাঝে আর একটা কথাও হলো না। এই মুহূর্তে অনন্যাকে বেশ চিন্তিত মনে হচ্ছে। অনন্যার গাম্ভীর্য দেখে আরমান খুব অসহায় বোধ করছিল। রাগের বশে যে কাজ সে করেছে, তার জন্য যে তাকে ভীষণ মূল্য দিতে হবে তাতে কোনো সন্দেহ নেই। এই বয়সে বাচ্চাটা মাতৃহারা হলো।
আরমান ভাবতে লাগল জীবনটা এ কেমন গোলক ধাধা। সেই গোলক ধাধার চোরা গলি পেরিয়ে সবাই সরল জীবনে ফিরে আসতে পারে না। যেমন সে নিজেই পারছে না। একটুখানি আশার আলো যেখানে দেখছে সেটাকেই সে আঁকড়ে ধরে সামনে এগোনোর চেষ্টা করছে। কিন্তু দুর্ভাগ্য তাকে পাগলা হাতির মতো তাড়া করে নিয়ে বেড়াচ্ছে।
গাড়ি থেকে নেমে অনন্যা বলল, জয়কে কেন বাসায় নিয়ে এসেছি সে বিষয়ে তোমার কাউকে কিছু বলার দরকার নেই। যা বলার আমিই বলবো।
আলি আরমান সম্মতিসূচক ঘাড় নাড়ল। এবাড়িতে সে নতুন নয়। সবাই তার পরিচিত। সবাই তাকে খাতির যত্ন করে। আজও তার ব্যাতিক্রম হলো না। আগে যে ঘরটাতে থাকতো সেই ঘরেই আরমানের থাকবার ব্যবস্থা হলো। জয়কে বুকে জড়িয়ে নিয়েই ঘুমিয়ে পড়লো। কিন্তু গোল বাধল মাঝ রাতে। জয় ঘুম থেকে জেগে কান্না শুরু করলে।
আলি আরমান ছেলের কান্না শুনে জেগে দেখল সে হিসি করে সব নষ্ট করে দিয়েছে। এখন সেই ভিজে জায়গায় সে আর থাকতে পারছে না। এটা তার অভ্যাস না। রোজি তাকে রাতে নির্দিষ্ট সময় অন্তে তুলে তুলে হিসি করায়। কোনো কারণবশত যদি সে জায়গা নষ্ট করে ফেলে, রোজি তখনই তা পাল্টে দেয়। আজ এসব কি হচ্ছে! বাবা তাকে ঘুম থেকে তুলে হিসি করায়নি। অকাজ করে ফেলার পরেও বাবা তার জায়গা বদলে দিচ্ছে না। মা কোথায়?
জয় মা যাবো, মা যাবো বলে চিৎকার করতে শুরু করলো। আরমান কাঁথা পাল্টে শুকনো কাঁথা বিছিয়ে দিলো। কিন্তু জয়ের কান্না থামার কোনো লক্ষণ দেখা যাচ্ছে না। বরং ক্রমেই তা বাড়ছে।
ছেলেকে থামাতে না পেরে আরমান যখন প্রায় দিশেহারা ঠিক তখনি জানালায় অনন্যার ঘুম জাগা মুখ দেখা গেলো। ঘুমের জড়িত কণ্ঠে বলল, এই যে ছেলের বাবা, আর কষরত করে কাজ নেই। দরোজাটা খুলে দাও।
আরমান বলল, খোকার চিৎকার নিচে পর্যন্ত পৌছে গেছে? সবার ঘুমের ব্যাঘাৎ হচ্ছে নিশ্চয়।
-তা জানি না। তবে তোমার অবস্থা যে এইরকমই হবে, আমি তা জানতাম। তাই টোটোনকে নিয়ে পাশের ঘরেই শুয়ে ছিলাম।
আলি আরমানের আরও একবার অবাক হবার পালা। তুমি পাশের ঘরে ঘুমিয়ে ছিলে? আলি আরমান দরোজা খুলে দিলো। অনন্যা নিঃসংকোচে ঘরে এলো। জয়কে বুকে তুলে নিয়ে আদর করতে লাগলো। বাবু কাঁদে না, বাবু কাঁদে না। বলে বাবুর কানে আস্তে করে গোটা দুই তিন থাবা মারতেই বাবু চুপ। সে আগে যেমন ঘুমিয়ে ছিল, আবার তেমনি ঘুমিয়ে পড়লো।
ছেলের এই রকম আচরণে আরমান বোবা বনে গেছে। অনন্যাকে কি বলে ধন্যবাদ দেবে তা ভেবে স্থির করার আগেই অনন্যা বলল, বাচ্চা পালন করা পুরুষের কাজ না। বুঝলে মিষ্টার?
আলি আরমান মুখ কাচুমাচু করে বলল, তা তো দেখতেই পাচ্ছি।
-এবার ঘুমিয়ে পড়। তোমার বাবুকে আমি নিয়ে যাচ্ছি।
অনন্যা যেমন এসেছিল তেমনি বাবুকে নিয়ে ফিরে গেলো। আরমান অনন্যার আসা এবং ফিরে যাওয়া চেয়ে চেয়ে দেখলো। রাতের পোশাকে অনন্যাকে কোনোদিন দেখেনি। নাইট গাউনের পাতলা আবরণে অনন্যাকে অন্যরকম লাগছিল। অনন্যার দিকে আরমান সরাসরি তাকাতে পারছিল না। অথচ অনন্যা তার এই স্বল্প পোশাকে আরমানের সামনে কোনোরকম অস্বাচ্ছন্দ বোধ করেনি।
…চলবে