আত্মদহন: আহমদ রাজু

রাস্তার মোড়ে মানুষের বৃত্তাকার জটলা দেখে গাড়ি থেকে নেমে ধীরে ধীরে এগিয়ে যান ডাক্তার উর্মিলা ব্যানার্জী। দিনাজপুর সদর হাসপাতাল থেকে গতকালই যশোর সদর হাসপাতালে বদলী হয়ে এসেছেন তিনি।

ঘটনার কেন্দ্রবিন্দু রাস্তার মাঝে না হলেও মানুষের ভীড়ে রাস্তা একেবারে বন্ধ হয়ে গেছে। তিন দিকের গাড়িগুলো একটার পর একটা সাজিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। সবার একই জিজ্ঞাসা- সামনে কী হয়েছে?

মানুষের ভীড় ঠেলে ভেতরে ঢোকার চেষ্টা করেন উর্মিলা ব্যানার্জী। বৃথা চেষ্টা। এত ভীড় ঠেলে ভেতরে যেতে পারেন না। এখানকার মানুষগুলো একে অন্যের সাথে আলাপরত এই বিষয়টা নিয়ে। কেউ কাউকে সুযোগ দিতে মোটেও রাজী নয়।

একজন বললো, “আহা বেচারা! পাগলটা শেষ পর্যন্ত মারাই গেল। কোথায় বাড়ি, বাবা-মা’ই বা কারা তা কেউ জানে না।”

আর একজন বললো- “হ্যা ভাই; খুবই দুঃখজনক ব্যাপার। লোকটা সেই কবে এখানে এসেছে। পাগল হলেও আমাদের বন্ধুর মত আপন হয়ে গিয়েছিল। আমরা কেউ তার ঠিকানা জানতে পর্যন্ত পারলাম না।”

উর্মিলা ব্যানার্জী একজনকে উদ্দেশ্য করে বললো- “এখানে কী হয়েছে, এত মানুষের ভীড় কেন?”

মাঝ বয়সী একজন বললো- “চন্দন পাগলা মারা গেছে।”

নামটা কেমন যেন চেনা চেনা মনে হয় উর্মিলা ব্যানার্জীর। চন্দন! বিস্মিত তিনি।

“বাড়ি কোথায় ওনার?”

“তাতো জানিনা; তাছাড়া আমি কেন, এখানকার কেউ তার ঠিকানা জানে না। তবে চন্দন পাগলা এই গাছতলায় এসেছে সে বিশ বছর হবে। সারাদিন রাস্তায় রাস্তায় ঘুরে বেড়াতো আর রাতে এখানে এসে ঘুমাতো। সময় অসময় বিভিন্ন মানুষকে উপদেশ বাণী শোনাতো। একটি কথা প্রায়ই বিড়বিড় করে বলতো…।

“থামলেন কেন? কী বলতো বললেন না তো।” উৎসুক প্রশ্ন উর্মিলা ব্যানার্জীর।

লোকটা বললো- “কী যেন কথাটা?…” তার উসখো খুশকো চুলের ভেতর ডান হাতের তিন আঙ্গুল ঢুকিয়ে চুলকে বললো, “হ্যা, মনে পড়েছে। প্রায় সে বলতো- তবে কী সে দুয়ারে গজানো ঘাসফুল হয়ে শ্রাবণের প্রতিজ্ঞা ভুলে গেল? পাগলে কী না বলে বলেন? ও পাগল হলেও খুব ভাল ছিল। কারো কোনদিন ক্ষতি করেছে এমন কথা কেউ বলতে পারে না।”

উর্মিলা ব্যানার্জী মনে মনে নামটা খুঁজতে থাকে। নামটা তার খুবই পরিচিত। মনে পড়ে কলেজ জীবনের কথা। এককালের জীবন-মরণ চন্দনের কথা। চন্দন এখন কোথায় তা উর্মিলা ব্যানার্জী জানে না। এ্যাডভোকেট আবু মুছাকে বিয়ে করার পরে তার সাথে আর কোন যোগাযোগ নেই।

“দেখি ভাই, আমাকে একটু সামনে যেতে দিনতো।” কৌতুহল বসতঃ ভীড় ঠেলে ভেতরে প্রবেশ করে উর্মিলা ব্যানার্জী।

রাস্তার পাশের শত বছরের পুরোনো বাইন গাছটার পাদদেশে পড়ে থাকা বেওয়ারিশ লাশটার দিকে চোখ রাখে। চোখ আটকে যায় লাশটা দেখে। হতবাক হয়ে যায় উর্মিলা ব্যানার্জী। চিনতে মোটেও কষ্ট হয় না চন্দনকে।

প্রায় দুই যুগ অতিক্রম হয়ে গেছে কলেজ জীবন। উর্মিলা ব্যানার্জী আর চন্দন ঢাকা মেডিকেল কলেজে একসাথে পড়তো। লেখাপড়া আর ব্যবহারে সবার হৃদয়ের মাঝে বসবাস করতো চন্দন। বাবা টিএনটি বোর্ডের একজন বড় ইঞ্জিনিয়ার। ও বাবা মায়ের একমাত্র সন্তান। বড় লোকের ছেলে হিসাবে যেভাবে চলাফেরা করার কথা তা চন্দনের মধ্যে ছিল না। বরাবরই স্বাভাবিকভাবে চলাফেরা করতো। বিলাসিতা কী জিনিস তা সে জানতো না। বর্তমানে ছেলেরা মেয়েদের দেখলে গা ঘেঁসে দাঁড়াতে চায় আর চন্দন মেয়েদের দেখলে লজ্জায় মুখ ফিরিয়ে নিত। এখন যেমন গায়ে যেচে মেয়েদের সাথে কথা বলার ইচ্ছেটা পোষণ করে ছেলেরা। সেখানে চন্দন কথা বলাতো দূরের কথা ওখান থেকে পালাতে পারলে বাঁচে।

লেখাপড়া নিয়ে ব্যস্ত চন্দন। ওর ইচ্ছে- উচ্চতর ডিগ্রী নিয়ে বিদেশে পড়তে যাবে। সেখান থেকে ফিরে এসে কোন এক গ্রামে যেয়ে ডাক্তারী করবে। সবকিছু এলোমেলো হয়ে যায় যখন পরিচয় হয় উর্মিলা ব্যানার্জীর সাথে।

ময়মনসিংহের এক নিম্নবিত্ত পরিবারের মেয়ে উর্মিলা ব্যানার্জী। বাবা সড়ক দুর্ঘটনায় এক পা হারিয়েছে। পাঁচ ভাই- বোনের মধ্যে উর্মিলা ব্যানার্জী সবার বড়। বড় বলেই দায়িত্বটা তার বেশি। পঙ্গু বাবা অবশ্য নিজের জমি লোকজন দিয়ে চাষ করায়। তাতে সংসার ভালোভাবে চলে না। তার ওপর মেয়েকে মেডিকেল কলেজে পড়ানো! ছোট চার ছেলে- মেয়ে স্থানীয় স্কুলে পড়ে। তাদেরও একটা বাড়তি খরচ আছে।

পঙ্গু বাবার ইচ্ছে, মেয়েকে ডাক্তার বানাবে। তার পরিশ্রম একদিন সার্থক হবে। উর্মিলা ব্যানার্জী বরাবরই উচ্ছৃঙ্খল। সাজগোজে ফ্লিমের নায়িকাদেরও হার মানায়। হঠাৎ বাবা পঙ্গু হওয়ায় দিশেহারা হয়ে পড়ে সে। বাবা সময় মতো টাকা পাঠায় না।

বাবার আশায় বসে থাকলেতো আর চলে না। নিজের রূপ আছে, যৌবন আছে। তা দিয়ে সারা ঢাকা শহরটাকেই জয় করা সম্ভব। ভাবে উর্মিলা। যে ভাবা সেই কাজ। শুরু করে নতুন জীবন। কলেজে শহরের অনেক ধনীর ছেলেরা পড়তে আসে। ছলে বলে কৌশলে তাদের সাথে শুরু করে মন দেওয়া-নেওয়ার খেলা। কাউকে সব দেয়, কাউকে দেয় না। উর্মিলা ব্যানার্জী বিভিন্ন সময় বিভিন্ন অযুহাত দিয়ে তাদের কাছ থেকে অর্থ আদায় করে। তার কিছু অংশ বাড়িতে পাঠায় আর নিজের বিলাসিতার জন্যেতো রাখেই। বাবা একবার চিঠিতে টাকার উৎসের কথা জানতে চাইলে সে জানায়, পড়াশুনার ফাঁকে ফাঁকে কয়েকটি টিউশানি করে সে। বাবা পরে আর কিছু জানতে চাননি।

উর্মিলা ব্যানার্জী প্রথম দিকে হোষ্টেলে থাকতো। পরে ভাগ্য পরিবর্তন করে নিজেই একটি ফ্লাট ভাড়া নেয়। একজনকে অবশ্য দুই-তিন মাসের বেশি মনের কোণে রাখতে রাজী নয়। তাছাড়া সে যাদের সাথে সম্পর্ক স্থাপন করে তারা মান সম্মানের ভয়ে প্রত্যাখিত হয়েও তার বিরুদ্ধে কিছু করতে যায় না। আর প্রমাণইবা কী? উর্মিলা ব্যানার্জী অত বোকা মেয়ে নয়। সে কি কোন প্রমাণ রেখে কাজ করে? শুধু কলেজের মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকে না উর্মিলা ব্যানার্জীর এই মন দেওয়া নেওয়ার খেলা। সে খেলা ছড়িয়ে যায় সাংবাদিক- উকিল- সাহিত্যিকদের মাঝেও। এ বৃহৎ খেলা চললেও পড়াশুনা বন্ধ করে না সে।

চন্দনের দিকে চোখ যায় উর্মিলা ব্যানার্জীর। একদিন দোতলার সিঁড়ি দিয়ে নিচে নামার সময় ইচ্ছে করে চন্দনকে ধাক্কা দেয় উর্মিলা ব্যানার্জী। চন্দনের হাতে থাকা বইগুলি ছিঁটকে পড়ে। উর্মিলা ব্যানার্জী সরি বলে বইগুলি তোলার জন্যে মাথা নিচে করে। এ সময় চন্দনও বই তুলতে গেলে দু’জনের মাথায় ধাক্কা লাগে বাংলা সিনেমার মতো। হেসে ওঠে দু’জন। উর্মিলা ব্যানার্জী বলে, “কিছু মনে করবেন না। আসলে অন্যমনস্ক ছিলাম তো।”

“না না; মনে করার কী আছে? এটাতো এক্সসিডেন্ট মাত্র। আসি।”

“দাড়ান। আপনাকে ধাক্কা দিলাম আর নিজের পরিচয়টা দেবো না, তা কি হয়। আমি উর্মিলা ব্যানার্জী। তৃতীয় বর্ষের সার্জিক্যাল ডিপার্টমেন্টের ছাত্রী।”

চন্দনের মুখের কথা কেড়ে নিয়ে উর্মিলা ব্যানার্জী বললো, “আপনি চন্দন। কলেজের সেরা তৃতীয় বর্ষের মেডিসিন ডিপার্টমেন্টের ছাত্র। ঠিক কিনা?”

“হ্যা; তা ঠিক। কিন্তু আপনি আমাকে কীভাবে…?”

“কলেজের সেরা ছাত্র আপনি আর আমার মতো নগন্য ছাত্রী আপনাকে চিনবে না, তা কী হয়?”

“আসি; আমার ক্লাসের সময় হয়ে এলো।” চন্দন সামনে পা বাড়াতে যাবে এমন সময় উর্মিলা ব্যানার্জী বললো- “আগামীকাল কলেজে আসছেন তো?”

“অবশ্যই আসবো।” স্বাভাবিক উত্তর চন্দনের।

 

কলেজে ছাত্র-ছাত্রীদের পদচারনায় মুখর। কেউ কেউ পড়াশুনার কথা বলছে তো কেউ হাসি ঠাট্টায় মাতোয়ারা। “কেমন আছেন আপনি?” চন্দনকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে উর্মিলা ব্যানার্জী পেছন থেকে জিজ্ঞাসা করে।

“ভাল।” ঘুরে দাঁড়ায় চন্দন।

“ও আপনি। ভাল আছেন তাইনা?”

“না। আর ভালো থাকবো কী করে বলুন?”

“চলুন ওপাশটায় যেয়ে বসি।” কলেজ পাশে পূর্ব পাশের আমগাছের নিচে বসে দু’জন।

“জানেন, গত রাতে আপনাকে নিয়ে আমি একটি স্বপ্ন দেখেছি।” উর্মিলা ব্যানার্জী চন্দনকে উদ্দেশ্য করে কথাটি বলে।

“কী স্বপ্ন?”

“তা আপনাকে বলতে পারবো না।”

“কী আশ্চর্য মিল বলুনতো? আমিও কিন্তু একটা স্বপ্ন দেখেছি গতকাল আপনাকে নিয়ে।”

“কী স্বপ্ন?”

“আগে আপনারটা বলুন।” উর্মিলা ব্যানার্জীকে উদ্দেশ্য করে বলে চন্দন।

“না বললে হয় না?”

“আপত্তি থাকলে বলার দরকার নেই।”

“না না; আপত্তি থাকবে কেন? তবে আমি যে স্বপ্ন দেখেছি তা কখনও হবার নয়। কোথায় আপনি আর কোথায় আমি?”

“আগে স্বপ্নটা কী দেখেছেন সেটা বলুন, তারপরে দেখবো সত্যি হবে কী না।”

“বলবো?”

‍“হ্যা বলুন।”

“বলি হ্যা?”

“আরে বলুনতো। আর ধৈর্য্য রাখতে পারছি না।”

“দেখছিলাম আপনার সাথে আমার বিয়ে হয়েছে।” কথাটা বলে লজ্জায় মুখ অন্যদিকে ঘুরিয়ে নেয় উর্মিলা ব্যানার্জী।

“আপনার স্বপ্ন সত্যি হবে।”

“সত্যি বলছেন?”

“হ্যা সত্যি। আমিও কিন্তু স্বপ্নে দেখেছি, আপনাকে নিয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছি বিভিন্ন স্থানে।”

দিন যত গড়াতে থাকে উর্মিলা ব্যানার্জী আর চন্দনের ঘনিষ্টতা তত বাড়তে থাকে। চন্দন আর উর্মিলা ব্যানার্জী ঘুরে বেড়ায় পার্ক থেকে লোকালয়ে। উর্মিলা ব্যানার্জীর চরিত্র সম্পর্কে চন্দনের বন্ধুরা চন্দনকে বলেছে অনেকবার। ও কিছু বিশ্বাস করেনি কখনও। তার উর্মিলা এমন মেয়েই নয়।

উর্মিলা ব্যানার্জী চন্দনের কাছ থেকে বিভিন্ন সময় মোটা অংকের টাকা নেয়। গহনা তৈরি করিয়ে নেয়। চন্দন সাধ্যমত সব চাহিদা মেটাতে চেষ্টা করে। তবুও যেন চাহিদা অপূর্ণ থেকে যায় উর্মিলা ব্যানার্জীর। সে চন্দনের সাথে এমনভাবে চলাফেরা করে যেন চন্দন ছাড়া সে কাউকে বোঝেনা, কিচ্ছু বোঝেনা।

একদিন এক দৈনিক সংবাদপত্রে উর্মিলা ব্যানার্জীর নামে সংবাদ প্রকাশিত হয়। সে নাকি বিভিন্ন ছেলেদের সাথে প্রেমের অভিনয় করে লক্ষ লক্ষ টাকা হাতিয়ে নিচ্ছে। চন্দন সংবাদটা পড়েছে। বিশ্বাস করেনি। তার কথা- উর্মিলা ব্যানার্জী যে খারাপ তার প্রমাণ নেই আমার কাছে। যার জন্যে তাকে খারাপ বলতে পারি। উর্মিলা ব্যানার্জী চন্দনকে বলে- শত্রুতা বসতঃ কেউ তার বিরুদ্ধে এমন নোংরা সংবাদ প্রকাশ করিয়েছে।

মুখে যাই বলুক, মনে মনে উর্মিলা ব্যানার্জী প্রচণ্ড ভয় পায়। যদি পাছে চন্দন সবকিছু জেনে যায়। আর জানলেইবা কী, সেতো তার জীবনে ক্ষণিকের জন্যে। ক’দিন পরেই উর্মিলা ব্যানার্জী যাকে ড্যাডি বলে ডাকতো সেই এ্যাডভোকেট আবু মুসার সাথে নাকি তার দৈহিক সম্পর্ক আছে, এমন কথা কলেজ ক্যাম্পাসের আকাশে বাতাসে ঘুরে বেড়াতে লাগলো। এ সংবাদটাও কানে যায় চন্দনের। ও বরাবরের মত বিশ্বাস করে না। তার উর্মিলা নিম্পাপ। এমন বিশ্বাসে সে অনন্ত এবং অনড়। এ গভীর বিশ্বাসে চীড় ধরে যখন চন্দনের ক্লাসমেট হাদিউজ্জামান এ্যাডভোকেট আবু মুসার সাথে উর্মিলা ব্যানার্জীর ডুয়েট আপত্তিকর ছবি চন্দনের সম্মুখে ধরে। নিজের চোখকে বিশ্বাস করতে পারে না চন্দন। বার বার পরীক্ষা নিরিক্ষা করে ছবিটা। এমন ছবি বর্তমানে কম্পিউটারে অহরহ করা হচ্ছে। তেমন কিছু কী না। অনেক চেষ্টা করেও কোনভাবে ছবিটাকে ভুয়া প্রমাণ করতে পারেনা চন্দন।

 

বেশ ক’দিন কলেজে আসেনা উর্মিলা ব্যানার্জী। মোবাইল করলেও মোবাইল রিসিভ করে না। ফোন না ধরার বিষয়টা বুঝতে পারেনা চন্দন। কেন সে এমন করছে তার সাথে? নিজেকে আর ঠিক রাখতে পারেনা। উর্মিলার এক বান্ধবীর কাছ থেকে ঠিকানা নিয়ে হাজির হয় উর্মিলার বাসায়। দরজায় নক করে। একবার দু’বার তিনবার। দরজা খোলে না। তবে কী বাসায় নেই? তা কেন হবে। বাসায় না থাকলেতো বাইরে থেকে তালা দেওয়া থাকবে। হয়তো ঘুমিয়েছে। আকাশ পাতাল ভাবতে থাকে চন্দন।

কিছুক্ষণ পরে দরজা খুলে বিস্ময় প্রকাশ করে উর্মিলা ব্যানার্জী। “আরে চন্দনযে, কেমন আছো তুমি? কতদিন তোমার সাথে দেখা হয়না। একটিবার খোঁজও নেবার প্রয়োজন মনে করলে না তোমার উর্মিলা কেমন আছে?”

উর্মিলার চুল এলোমেলো। ঠোঁটের লিপিষ্টিক সারা মুখে বিচরণ করেছে। সে যে ক্লান্ত তা তার কথার মাঝে ফুটে ওঠে।

চন্দন কোন কথা বলছে না দেখে উর্মিলা বলে, “ইয়ে মানে; আমি ঘুমিয়ে ছিলামতো, তাই। আসলে কদিন থেকে শরীরটা ভাল যাচ্ছে না।”

“ঘুমিয়ে ছিলে? এই ভর দুপুরে!” কথা বলতে বলতে ভেতরে যেয়ে বসে চন্দন। সোফার নিচে, সামনের টেবিলটার ওপরে সিগারেটের ছাই, ফিল্টার গড়াগড়ি খাচ্ছে। সেদিকে চোখ যায় চন্দনের। একটি সিগারেটের ফিল্টার দু’আঙ্গুল দিয়ে উঠিয়ে চোখের সামনে ধরে। “উর্মিলা তুমি কি সিগারেট খাও?” জিজ্ঞাসা চন্দনের।

“কী যে বলো না। আমি সিগারেট খাবো কেন। গত পরশু গ্রাম থেকে আমার চাচাতো ভাই এসেছিল, সে খেয়েছে।”

উর্মিলার চাচাতো ভাই আছে তা জানে না চন্দন। উর্মিলাতো একদিন বলেছিল- গ্রামে মা বাবা ভাই বোন ছাড়া আর কোন পড়শী নেই। সে চেনে না। আজ চাচাতো ভাই আসলো কীভাবে? নিজের মনে প্রশ্ন করে বার বার চন্দন।

 

উর্মিলা ব্যানার্জীর বেডরুম একটা থাকলেও ডাইনিং স্পেজ বেশ বড়। হঠাৎ কাশির শব্দ আসে চন্দনের কানে। “কাশির শব্দ আসলো কোথা থেকে?” উর্মিলা ব্যানার্জীকে জিজ্ঞাসা করে চন্দন।

“কাশির শব্দ! তুমি কি পাগল হয়েছো? এখানে আমি আর তুমি ছাড়া আর কে আছে যে সে কাশি দেবে।”

“তোমার বেডরুম থেকে শব্দটা এসেছে মনে হয়।”

“তুমি আসলে পাগল হয়েছো। বেডরুম থেকে শব্দ আসবে কেন?” উর্মিলা ব্যানার্জী এমনভাবে কথা বলছে যেন সে কিছু জানেনা। চন্দন উঠে দাঁড়িয়ে বেডরুমে যাবার জন্যে উদ্যত হলে উর্মিলা ব্যানার্জী সামনে যেয়ে দাঁড়ায়। “কোথায় যাচ্ছো?” উর্মিলা ব্যানার্জীর রুক্ষ্ম কণ্ঠ।

“দেখি ভেতরে কেউ আছে কিনা।”

“না; তুমি আমার বেডরুমে যাবে না।”

“কেন যাবো না?”

“তুমি আমাকে বিশ্বাস করো না?”

“হ্যা করি। আর করি বলেইতো প্রমাণ করতে চাই, আমার উর্মিলা খারাপ মেয়ে নয়।”

চন্দন উর্মিলা ব্যানার্জীকে ধাক্কা দিয়ে বেডরুমে ঢুকেই থমকে দাঁড়ায়। খাটের ওপর শুয়ে সিগারেট টানা অবস্থায় চল্লিশোর্ধ এ্যাডভোকেট আবু মুসাকে দেখে। কিছুই বুঝতে পারে না চন্দন। সত্যি দেখছে নাকি চোখের ভুল!‌ বুঝতে বাকি থাকে না চন্দনের। কেন ঠোটের লিপিষ্টিক সমস্ত মুখমণ্ডলে? কেন মাথার চুল- কাপড় এলোমেলো।

সে ঘুরে দাঁড়ায় উর্মিলা ব্যানার্জীর দিকে। “তোমার চরিত্র যে ফুলের মতো পবিত্র তার প্রমাণ হয়ে গেল।”

“ছিঃ তুমি এমন কথা বলতে পারলে? ড্যাডিতো তোমার আসার মিনিট খানেক আগে এসেছে। প্রচণ্ড মাথা ধরেছিল বলে একটু বিশ্রাম নিচ্ছে।”

“তোমার লজ্জা করে না, যার সাথে তোমার দৈহিক সম্পর্ক তাকে ড্যাডি বলতে? এই লোকটার চরিত্র সম্পর্কে শহরের অনেকেই অবগত। এতদিন তোমার সম্পর্কে যা যা শুনেছি তার সবই তাহলে সত্যি! এতদিন আমি বিশ্বাস করিনি এজন্যে যে, লোকটা তোমার বাবার বয়সী। তাছাড়া তাকে তুমি ড্যাডি বলে ডাকো। আর তার সাথে…ছিঃ।”

 

এখন আর কোন কিছু ভাল লাগে না চন্দনের। উর্মিলার সাথেও দেখা হয় না। হবে কীভাবে? চন্দন কলেজে যায় না দুই মাসের বেশি হয়ে গেছে। বলতে গেলে পড়াশুনা একেবারে বন্ধ। সকালে উর্মিলার খোঁজ নেবার কথা ভেবে ফোন করে চন্দন। ফোন বেজেই চলেছে, রিসিভ করে না। বেশ ক’মিনিট পরে ওপাশ থেকে এক পুরুষের কণ্ঠস্বর- “কে বলছেন প্লিজ?”

“এটা কী উর্মিলা ব্যানার্জীর নম্বর?”

“হ্যা; আপনি কে বলছেন? উর্মিলার বন্ধু নিশ্চই।”

“হ্যা সেরকম-ই। ওকে একটু দেবেন?”

“ও তো বাথরুমে।”

“ও আচ্ছা। আপনি উর্মিলার কী হন?”

“আমি ওর হাজব্যান্ড।”

“আচ্ছা রাখি।” বলতে বলতেই চন্দনের সমস্ত পৃথিবী যেন অন্ধকার হয়ে আসে। মাথা ঘুরছে প্রচণ্ড বেগে। দম বন্দ হয়ে যাচ্ছে। হয়তো একটু পরেই মৃত্যু হবে তার। কিছুতেই বিশ্বাস হয় না লোকটা উর্মিলা ব্যানার্জীর স্বামী।

আবারও ফোন করে চন্দন। “হ্যালো উর্মিলা কী বাথরুম থেকে বেরিয়েছে?”

“হ্যা; একটু ধরুন।”

“হ্যালো, কে চন্দন?”

“হ্যা আমি। বলতো আমি কী এমন দোষ করেছি? এত কষ্ট কেন দিচ্ছো?”

“তুমি কেন দোষ করবে। আসলে হঠাৎ বিয়েটা হয়ে গেল। আমার স্বামী খুব ভাল। সে আমাকে খুব ভালবাসে। অন্তত তোমার মত সন্দেহ করে না। তুমি এখন একটা বিয়ে করো। তোমার একটা সঙ্গী দরকার।”

“বিয়ে; যাকে মন প্রাণ সবকিছু দিয়ে দিয়েছিলাম সে যখন আমার সাথে এমন করলো তবে আমি কেন পারবোনা। আমি আমার জীবনকে এমন উপহার দেবো যা নিয়ে শেষ করতে পারবে না। ভালো থেকো তুমি।”

সেই দিন থেকে মাথায় গোলমাল দেখা দেয় চন্দনের। পাবনা মানসিক হাসপাতালে ভর্তি করে ওর বাবা। সেখান থেকে পালিয়ে কোথায় যে যায় তা কেউ জানে না।

 

উর্মিলা ব্যানার্জী আর এ্যাডভোকেট আবু মুসার সংসার স্থায়ী হয় এক বছর তিন মাস। তারপরে দু’জনের ছাড়াছাড়ি। উর্মিলা ব্যানার্জী আত্মদহনে দংশিত হয়ে আবার কলেজে ভর্তি হয়ে পড়াশুনা শুরু করে। ডাক্তার হয়। চন্দনের পাগল হয়ে যাবার কথা উর্মিলা ব্যানার্জী জানে। মনে মনে খুঁজেছেও। কোথাও পায়নি। আজ চন্দনকে রাস্তার মোড়ে বেওয়ারিশ লাশ হয়ে পড়ে থাকতে দেখে নিজেকে আর সংবরণ করতে পারেনা ডাক্তার উর্মিলা ব্যানার্জী। উম্মাদের মত দৌঁড়ে যায় চন্দনের পাশে। ওর মুখের দিকে তাকায়। কী নিশ্চিন্তে ঘুমিয়ে আছে তার চন্দন। ঠোঁট দু’টি কেঁপে ওঠে ডাক্তার উর্মিলা ব্যানার্জীর। নিজের অজান্তেই ক’ফোটা অশ্রু গড়িয়ে পড়ে চন্দনের পিচ ঢালা বিছানায়।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *