বিদেশে দূতাবাসগুলো এখনো যেন একেকটি আওয়ামী ঘাঁটি!

সুপ্রভাত সিডনি রিপোর্ট : প্রবাসে বসবাসরত লাখো বাংলাদেশির নানাবিধ সমস্যা, সংকট এবং অধিকার রক্ষার জন্য নিয়োজিত থাকার কথা যে প্রতিষ্ঠানগুলোর, সেইসব দূতাবাসগুলো আজ পরিণত হয়েছে একেকটি রাজনৈতিক দুর্গে, বিশেষ করে নিষিদ্ধ ঘোষিত আওয়ামী দলের ঘাঁটিতে। বিশ্বের নানা প্রান্তে ছড়িয়ে থাকা বাংলাদেশি প্রবাসীরা অভিযোগ করছেন, এসব দূতাবাসে এখন জাতির স্বার্থ নয়, বরং দলীয় আনুগত্যই বড় হয়ে উঠেছে।

সেবার বদলে দলীয় চাটুকারিতা এবং বিএনপি -জামাতের লোকদের হয়রানি ।

প্রবাসী বাংলাদেশিদের অভিযোগ, বিদেশের মাটিতে পাসপোর্ট নবায়ন, জাতীয় পরিচয়পত্র সংশোধন, জন্মসনদ, মৃত্যু সনদ, কনস্যুলার সেবা, আইনি সহায়তা— এসব ন্যূনতম সেবাগুলো পেতে তাদের ঘুরতে হয় দিনের পর দিন, মাসের পর মাস। অথচ, দূতাবাসের ভেতরে নিয়মিত আয়োজিত হয় নিষিদ্ধ ঘোষিত আওয়ামী দলের রাজনীতিকদের সংবর্ধনা, জন্মদিন উদযাপন বা বিজয় দিবসের নামে একচোখা রাজনৈতিক অনুষ্ঠান। যেখানে বিরোধী মতালম্বীদের অনুপস্থিতি বা আমন্ত্রণহীনতাই নিয়ম। ফ্যাসিবাদী আওয়ামী সরকারের টানা ১৬/১৭ বছরের শাসনামলে দেশে এমন একটি ক্ষেত্রও অবশিষ্ট নেই, যেখানে দলীয়করণের ছায়া পড়েনি। বিদেশে বাংলাদেশের প্রায় ২০০টি দূতাবাস ও কনস্যুলেট রয়েছে, যার অধিকাংশই এখন দলীয় নিয়ন্ত্রণে।

প্রতিটি দূতাবাস ও কনসাল অফিসে ক্ষমতাসীন দলের প্রত্যক্ষ আশীর্বাদে অনুপ্রবেশ করেছে ছাত্রলীগের চিহ্নিত সন্ত্রাসী এবং আওয়ামী লীগের বিতর্কিত নেতা-কর্মীরা। রাষ্ট্রীয় কাঠামোর বাইরে দলীয় আনুগত্য ও প্রভাবকে ব্যবহার করে তারা এসব গুরুত্বপূর্ণ স্থানে অবস্থান নিয়েছে। সরকার পরিবর্তনের পর অনেকে মুখোশ পাল্টানোর চেষ্টা করলেও, তাদের প্রকৃত পরিচয় একটিই নিষিদ্ধ আওয়ামী সন্ত্রাসী চক্রের সক্রিয় ও ঘৃণিত সমর্থক।

আমেরিকায় নিযুক্ত সাবেক বাংলাদেশী রাষ্ট্রদূত যিনি পূর্বে জাপানে দায়িত্ব পালন করেছেন, তার বিরুদ্ধে রয়েছে গা-সওয়া অভিযোগ জাপানে অবস্থানকালে তিনি নানা ঘৃণ্য কর্মকাণ্ডে জড়িয়ে পড়েছিলেন, যা ছিল নিষিদ্ধ আওয়ামী লীগের স্বার্থ রক্ষায় পরিচালিত। এখন তিনি আমেরিকায়ও একই কৌশলে সাধারণ প্রবাসীদের হেনস্তা করছেন বলে অভিযোগ উঠছে।

দুবাইয়ে নিযুক্ত বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূতকে প্রবাসীরা বর্ণনা করছেন একজন ‘সামাজিক সন্ত্রাসী’ হিসেবে। তিনি আওয়ামীলীগের  প্রতি অন্ধ আনুগত্য প্রকাশ করে প্রবাসী শ্রমিকদের বিরুদ্ধে নানা কঠোর পদক্ষেপ গ্রহণ করেছেন। অতীতে অনেক শ্রমিককে স্থানীয় পুলিশের হাতে তুলে দিয়েছেন, আবার অনেককে জোরপূর্বক দেশে ফেরত পাঠিয়েছেন। বর্তমানে বহু নিরীহ শ্রমিক দুবাইয়ের কারাগারে মানবেতর জীবনযাপন করছেন, যার দায়ভার রাষ্ট্রীয় দায়িত্ব পালনে ব্যর্থ এই দূতাবাস ও দূতাবাস প্রধানের।

অন্যদিকে ব্রুনাইয়ে ঘটেছে আরও উদ্বেগজনক এক ঘটনা। বাংলাদেশি শ্রমিকদের একটি সভায় রাষ্ট্রদূত সবাইকে বাধ্য করেন ‘জয় বাংলা’ স্লোগান দিতে। বিগত দিনে  স্বৈরাচারী শেখ হাসিনার সফরের আগে আয়োজিত একটি ঘরোয়া সভায় তিনি উপস্থিত সকল শ্রমিককে নির্দেশ দেন ‘মুজিব কোট’ পরে আসতে এবং নির্দিষ্ট সময় পর পর স্লোগান দিতে। কেউ অমান্য করলে সরাসরি দেশে ফেরত পাঠিয়ে দেওয়ার হুমকি পর্যন্ত দেন।

সৌদি আরব, কুয়েতসহ মধ্যপ্রাচ্যের অধিকাংশ দেশে নিযুক্ত বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূতদের আচরণে প্রবাসী শ্রমিকরা আজ আতঙ্কিত। দায়িত্বশীল কূটনীতিক হওয়ার বদলে তারা যেন একেকজন কর্তৃত্ববাদী শাসকে পরিণত হয়েছেন।

প্রবাসী শ্রমিকদের সঙ্গে মানবিক আচরণের পরিবর্তে কথায় কথায় তিরস্কার, অপমান এবং ভয়ভীতির আশ্রয় নিচ্ছেন অনেক দূতাবাস কর্মকর্তা। কেউ প্রতিবাদ করলে কিংবা অধিকার নিয়ে কথা বললে, তাদের দেশে পাঠিয়ে দেওয়ার হুমকি দেওয়া হয়এমনকি দেশে ফেরত পাঠিয়ে কারাগারে পাঠানোর ভয়ও দেখানো হয় নিয়মিতভাবে।

অস্ট্রেলিয়ায় প্রবাসীদের হুমকি দেওয়ার তেমন সুযোগ না থাকলেও, এখানে কৌশলী প্রভাব বিস্তার ও দলীয় মেলামেশার মাধ্যমে ক্ষমতার অপব্যবহার স্পষ্টভাবে লক্ষ্য করা যায়। মানবাধিকার ও মতপ্রকাশের স্বাধীনতায় অস্ট্রেলিয়া অনেক দেশের চেয়ে এগিয়ে থাকলেও, দূতাবাসের ভেতরে আওয়ামী লীগের সঙ্গে ঘনিষ্ঠতা এমন পর্যায়ে পৌঁছেছে যে, রাষ্ট্রীয় দায়িত্ব যেন দলীয় আনুগত্যে রূপ নিয়েছে।

শোনা যায় একটি রসালো গল্প, অস্ট্রেলিয়ার বর্তমান রাষ্ট্রদূত অতীতে বিএনপির রাজনীতির সঙ্গে সম্পৃক্ত ছিলেন। বস্তুত তিনি নিষিদ্ধ আওয়ামী লীগের নেতাদের সঙ্গে সখ্যতা গড়ে তুলেছেন। নানা অনুষ্ঠানে তাদের সঙ্গে অংশগ্রহণ এবং প্রকাশ্যে বক্তব্য দিয়ে নিজেকে প্রশ্নবিদ্ধ করে তুলেছেন। তার ‘আওয়ামী ঘেঁষা’ আচরণ নিয়ে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ইতিমধ্যেই ব্যাপক আলোচনা-সমালোচনা হয়েছে -হয়েছে  তীব্র বিরোধিতা। অস্ট্রেলিয়ায় বহু প্রবাসী আছেন, যারা ২০১৭ সালের আন্দোলনে বিএনপি ও অন্যান্য বিরোধী দলীয় নেতা-কর্মী হিসেবে রাজনৈতিক আশ্রয়ে ছিলেন। তারা বর্তমানে পাসপোর্ট পাচ্ছেন না, ফলে অনেকে দেশে যেতে পারছেন না কিংবা পাসপোর্ট নবায়নও করতে পারছেন না। এটি পুরোপুরি ফ্যাসিস্ট শেখ হাসিনার আইনের মাধ্যমে রাজনৈতিক হয়রানির শামিল।

অস্ট্রেলিয়ার একমাত্র বাংলা পত্রিকা সুপ্রভাত সিডনি, দূতাবাসের এই পক্ষপাতমূলক আচরণ দেখে কয়েক মাস আগে রাষ্ট্রদূতকে কিছু গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন ইমেইলের মাধ্যমে পাঠায়। কিন্তু আজ পর্যন্ত তার কোনো উত্তর পাওয়া যায়নি। অস্ট্রেলিয়া, নিউজিল্যান্ড ও ফিজির দায়িত্বপ্রাপ্ত বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূত এক পর্যায়ে দাবি করেছেন যে, তিনি নাকি আমাদের পাঠানো ইমেইল পাননি। অথচ আমাদের পাঠানো সেই ইমেইল ফেরত আসেনি বা বাউন্সও হয়নি।

এতে প্রশ্ন জাগে: রাষ্ট্রদূত কি নিজে ইমেইল দেখেন না? তাকে কি ইমেইল পাঠাতে বা পড়তে অন্য কারও সহযোগিতা নিতে হয়? নাকি দূতাবাসে কর্মরত কিছু আওয়ামী ঘরানার সদস্যই আমাদের প্রেরিত বার্তা রাষ্ট্রদূতের দৃষ্টিতে আসতে দিচ্ছেন না? রাষ্ট্রদূত কিংবা কনসাল জেনারেল হচ্ছেন জনগণের সেবায় নিয়োজিত রাষ্ট্রের প্রতিনিধি। যদি তারা প্রবাসীদের অভিযোগ, প্রশ্ন বা উদ্বেগকে উপেক্ষা করেন, তবে তাদের সে দেশে থাকার যৌক্তিকতা নিয়েই প্রশ্ন উঠবে। একজন বাংলাদেশি নাগরিক যদি সেখানে না থাকেন কিংবা তাদের পাশে না দাঁড়ানো হয়তবে রাষ্ট্রের প্রয়োজন শেষ, দায়িত্বও শেষ। তখন সম্মানের সাথে তাদের উচিত হবে ‘পোটলা-পাটুলি’ গুটিয়ে নিজ দেশে ফিরে যাওয়া।

কূটনৈতিক নয়, রাজনৈতিক ভূমিকা

জাতিসংঘে নিযুক্ত বাংলাদেশের স্থায়ী মিশন থেকে শুরু করে মধ্যপ্রাচ্য, ইউরোপ, জাপান,আমেরিকা, অস্ট্রেলিয়া বা দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার দূতাবাসগুলোতে একই চিত্র রাষ্ট্রদূত বা হাইকমিশনারদের বড় অংশই নিষিদ্ধ ঘোষিত আওয়ামী দলের  সমর্থক হিসেবে পরিচিত এবং তাদের আচরণেও দলীয় পক্ষপাতদুষ্ট মনোভাব পরিলক্ষিত হয়।

বিগত দিনে দূতাবাসের আয়োজিত জাতীয় দিবসের অনুষ্ঠানগুলোতেও রাজনৈতিক পক্ষপাতের স্পষ্ট প্রকাশ দেখা গেছে—দলীয় নেতাকর্মীদের ফুলেল শুভেচ্ছা, প্রবাসের আওয়ামী লীগ নেতা-কর্মীদের অগ্রাধিকার প্রদান, আর বিরোধী দলের প্রতি তাচ্ছিল্যপূর্ণ আচরণ। অনেক দূতাবাসে এমন ঘটনাও ঘটেছে যে, প্রবাসীরা মানববন্ধন, ভিসা সমস্যা বা শ্রমিক অধিকার নিয়ে আন্দোলন করলেই তাদের পাসপোর্ট আটকে দেওয়া হয়েছে কিংবা নানা উপায়ে হয়রানি করা হয়েছে।

গণতন্ত্র, মত প্রকাশের স্বাধীনতা কোথায়?

প্রবাসে মতপ্রকাশের স্বাধীনতাও আজ প্রশ্নবিদ্ধ। অস্ট্রেলিয়া, আরব আমিরাত, যুক্তরাজ্য, জাপান , মালয়েশিয়া কিংবা আমেরিকায় প্রবাসীরা অভিযোগ করেছেন, দূতাবাসের অনুষ্ঠানে ভিন্নমত পোষণ করলে তাদের কালো তালিকাভুক্ত করা হয়। কারও কারও পাসপোর্ট নবায়ন, ভিসা নবায়নে হয়রানি, আবার কারও জাতীয় পরিচয়পত্র আটকে রাখা হয়েছে বছরের পর বছর।

যেসব দূতাবাসের দায়িত্ব হলো প্রবাসীদের স্বার্থে সংশ্লিষ্ট দেশের সরকার বা প্রশাসনের সঙ্গে যোগাযোগ রক্ষা করা, শ্রমিক অধিকার সুরক্ষা, বাংলাদেশের ভাবমূর্তি রক্ষা করা, তারাই এখন নিষিদ্ধ ঘোষিত আওয়ামী রূপে প্রবাসে আওয়ামীলীগের পক্ষে প্রচারণা চালাচ্ছে।

বিরোধীদলীয় নেতা-কর্মীদের জন্য নেই কোনো জায়গা

অভিযোগ রয়েছে, আওয়ামীলীগ ছাড়া অন্য কোনো রাজনৈতিক দলের নেতা বা সমর্থকরা দূতাবাস থেকে ন্যূনতম সম্মানও পান না। কোথাও কোথাও এমনও অভিযোগ পাওয়া গেছে যে, বিএনপি, জামাত, জাতীয় পার্টি কিংবা অন্য যেকোনো দলের পরিচয়ে কেউ সেবা নিতে গেলে কৌশলে তাদের কাজ  আটকে রাখা হয় কিংবা হয়রানি করা হয়।

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক লন্ডন প্রবাসী একজন বলেন, “আমার এনআইডি সংশোধনের জন্য চারবার দূতাবাসে গেছি। অথচ আমার সাথে যিনি প্রথমবার গিয়েছিলেন এবং আওয়ামী লীগের প্রবাসী শাখার পরিচিততার কাজ একদিনেই হয়েছে।”

দূতাবাস নয়, যেন দলীয় অফিস

বিশ্লেষকদের মতে, দূতাবাসগুলোর এই দলীয়করণ প্রবাসীদের মাঝে তীব্র হতাশা ও বৈষম্যের জন্ম দিচ্ছে। রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানগুলোর নিরপেক্ষতা ভেঙে দিলে নাগরিক অধিকার লঙ্ঘিত হয়, বিদেশে বাংলাদেশের ভাবমূর্তিও ক্ষতিগ্রস্ত হয়।

সাংবাদিক ও আন্তর্জাতিক বিশ্লেষক রফিকুল ইসলাম বলেন, “দূতাবাস হলো রাষ্ট্রের প্রতিনিধি। সেখানে কোনো দলীয় রঙ থাকার কথা নয়। দুর্ভাগ্যজনক হলেও সত্য, বাংলাদেশের দূতাবাসগুলো এখন দলীয় বৃত্তে আবদ্ধ হয়ে পড়েছে, যা প্রবাসীদের জন্য লজ্জাজনক অভিজ্ঞতা।”

বিদেশে বাংলাদেশের যে সকল দূতাবাস রয়েছে, তাদের মূল দায়িত্ব হওয়া উচিত প্রবাসীদের সমস্যার সমাধান, বাংলাদেশের ইতিবাচক ভাবমূর্তি তুলে ধরা এবং সংশ্লিষ্ট দেশের সঙ্গে কূটনৈতিক সম্পর্ক শক্তিশালী করা। কিন্তু বাস্তবতা হলো, এসব প্রতিষ্ঠান আজ পরিণত হয়েছে নিষিদ্ধ ঘোষিত আওয়ামী লীগের একেকটি রাজনৈতিক মুখপাত্রে যেখান থেকে দলীয় আদর্শ প্রচার ও বিরোধী মত দমনই যেন প্রধান কর্মসূচি।

প্রবাসীরা আজ যুক্তিসঙ্গতভাবে প্রশ্ন তুলছেন: এই দূতাবাসগুলো কি বাংলাদেশের রাষ্ট্রীয় প্রতিনিধি, নাকি কোনো বিশেষ রাজনৈতিক দলের দপ্তর?

যারা আজ নানা দেশে আওয়ামী স্বার্থ রক্ষায় ‘অস্থায়ী মসনদে’ বসে আছেন এবং ধারণা করছেন তাদের আসল পরিচয় কেউ জানে না তাদের স্মরণ করিয়ে দেওয়া দরকার, আগামী নির্বাচন পর্যন্তই হয়তো এই অনির্বাচিত ক্ষমতা অব্যাহত থাকবে।

একটি নির্বাচিত, জবাবদিহিমূলক সরকার ক্ষমতায় এলে এসব দূতাবাসের ভূমিকা পর্যালোচনার আওতায় আনা হবে বলে বিভিন্ন মহল থেকে ইঙ্গিত পাওয়া যাচ্ছে। অনেক রাষ্ট্রদূতকে জবাবদিহির মুখোমুখি হতে হতে পারে আর যারা অতিমাত্রায় দলীয় পক্ষপাত দেখিয়েছেন, তাদের বিরুদ্ধেও প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়া সময়ের দাবি হয়ে উঠেছে।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *