মুজাম্মেল হোসেন , অটোয়া কানাডা:
ভুমিকা: কিয়ামতের নিকটবর্তী সময়ে ইমাম মাহদী নামক একজন বুজুর্গ ব্যক্তি আসবেন – তিনি বিশ্বকে জয় করবেন, কাফির শক্তি পরাজিত হবে, দিকে দিকে মুসলমানদের বিজয় নিশান পতপত করে উড়বে। এ জাতীয় কথাবার্তা শোনেনি এমন মুসলমান সম্ভবত খুঁজে পাওয়া যাবে না। শুধু তাই নয়, তাঁর পিতার নাম কি, মায়ের নাম কি, ঠিক কোন স্থানে হঠাৎ করে আসমান থেকে নেমে আসবেন, তার হাতে কোন রঙ্গের একটি পতাকা থাকবে তাও বলা হচ্ছে বেশ জোরেশোরে! এমনকি তার মুখমন্ডল কেমন হবে, নাকটি কত লম্বা হবে, কপালের আকার কিরুপ এমনসব খুটিনাটি তথ্যও বর্ণনা করা হচ্ছে বিভিন্ন বয়ানে, হাদীসকে উদ্ধৃত করে।
প্রচলিত ধারনা
কেউ কেউ মনে করেন, ইমাম মাহদী হবেন প্রাচীন কালের সুফী, সাধক কিংবা জনবিচ্ছিন্ন দরবেশ ধরনের কোন ব্যক্তি। হঠাৎ আসমান থেকে ফেরেশতাদের কাধে ভর করে কোন এক মসজিদ কিংবা মাদ্রাসায় অবতরন করবেন। এরপর নিজেই ঘোষণা দিবেন ‘আনাল মাহদী’ বা আমিই হচ্ছি আল্লাহ প্রেরিত সেই প্রতিশ্রুত ইমাম মাহদী । আর অমনি চারিদিক থেকে লোকজন তার কাছে এসে পীরের মুরিদদের মত হাতে হাত রেখে বায়াত গ্রহণ করবে । এর পর লাঠি-সোটা, তীর, ধনুক ইত্যাদি নিয়ে কাফেরদের আধুনিক যুদ্ধাস্ত্র আর আনবিক বোমা কিংবা মিসাইলের মোকাবেলা করতে খাল বিল পার হয়ে ছুটে চলবেন দ্বিগবিদিক !
নিছক দোয়া, দরুদ, জিকির আজকার আর ঝাড় ফুক দেয়ার কারনে কাফেরদের ট্যাংক, মেশিনগান পুড়ে ছারখার হয়ে যাবে, নিঃশব্দে চলা সাবমেরিনগুলো সাগরের অতলে বিকল হয়ে পড়বে, আকাশে উড়ন্ত ড্রোন, মিসাইল কিংবা ভয়ংকর সব পারমানবিক বোমা বহনকারী যুদ্ধ বিমানগুলো নিঃসীম আকাশেই হাওয়া হয়ে যাবে! এ জাতীয় বিশ্বাস বহু মানুষের অন্তরে বদ্ধমূল হয়ে আছে। অথচ আমরা জানি আল্লাহপাকের প্রতিটি কথাই মহাযুক্তি ও বাস্তব ভিত্তিক বোধের উপরে প্রতিষ্ঠিত। ফলে আমাদের ক্ষুদ্র জ্ঞান ও অনুসন্ধান থেকে যা বুঝতে পেরেছি তা ঐসব ধারনা থেকে অনেকটাই ভিন্ন।
ইমাম ও মাহদী কি?
হাদীস, ফিকহ ও আকীদার পরিভাষায় ইমাম শব্দটি খলীফা বা রাষ্ট্রপ্রধান শব্দের সমার্থক। আর মাহদী অর্থ হেদায়াত-প্রাপ্ত।
এজন্য পারিভাষিকভাবে ইমাম মাহদী অর্থ ‘আল্লাহর পক্ষ থেকে হেদায়াত-প্রাপ্ত রাষ্ট্রপ্রধান’। মাহদী কোন হেদায়াত দাতা নন! হাদীসেও কিয়ামতের ১০টি পূর্বভাসের মধ্যে ইমাম মাহদী-র বিষয়টি আদৌ উল্লেখ করা হয় নি। এমনকি ইমাম আবূ হানীফার মত একজন বিশেষজ্ঞ ফিকাহবিদও কিয়ামতের আলামতের মধ্যে বিষয়টি উল্লেখ করেননি। রাসূলুল্লাহ (সা) তাঁর পরের খলীফাদেরকে খুলাফায়ে রাশিদীনী মাহদিয়্যীন বা মাহদী রাশিদ খলীফা বা সুপথপ্রাপ্ত খলিফা বলে আখ্যায়িত করেছেন। এ থেকে আমরা জানি যে, খুলাফায়ে রাশিদীন সকলেই মাহদী বা হেদায়াতপ্রাপ্ত ছিলেন।
মাহদী সংক্রান্ত হাদীস
শেষ যুগে একজন ‘আল্লাহর নৈকট্যপ্রাপ্ত রাষ্ট্রপ্রধান’ ক্ষমতাসীন হবেন বলে অনেকগুলো বানী হাদীসে বর্ণিত হয়েছে। লক্ষ্য করার মত যে, ‘মাহদী’ শব্দটি উল্লেখ করে কোনো হাদীস বুখারী বা মুসলিমে নেই। তবে তিরমিজি সহ কয়েকটি হাদীস গ্রন্থে এ বিষয়ক হাদীসগুলো সংকলিত। ইমাম মাহদী সংক্রান্ত প্রায় অর্ধশত হাদীসের কথা জানা যায়। হাদীসগুলোর বর্ণনা কিরুপ, আমি এর মধ্য থেকে ৪ টি উল্লেখ করছিঃ
১. আব্দুল্লাহ ইবন মাসঊদ বলেন, রাসূলুল্লাহ (সা) বলেছেন: ‘‘দুনিয়ার যদি একটি দিনও বাকি থাকে তবে আল্লাহ সে দিনটিকে দীর্ঘায়িত করে আমার বংশধর থেকে এক ব্যক্তিকে প্রেরণ করবেন যার নাম ও পিতার নাম আমার নাম ও আমার পিতার নামের মতই হবে। তিনি রাষ্ট্রক্ষমতা গ্রহণ করবেন, আরবদের উপর রাজত্ব করবেন এবং জুলুমে ভরপুর পৃথিবীকে ইনসাফে পরিপূর্ণ করে দিবেন।’’ (তিরমিযী, আস-সুনান ৪/৫০৫, ২২৩০, ২২৩১)।
২. আবূ সায়ীদ খুদরী (রা) বলেন, রাসূলুল্লাহ (সা) বলেন: ‘‘মাহদী আমার (বংশধর) থেকে, তার কপাল থাকবে চুলমুক্ত (মাথার সামনের দিকে চুল থাকবে না) এবং তার নাক হবে চিকন। সে জুলুমে পরিপূর্ণ দুনিয়াকে ন্যায়পরায়ণতায় পূর্ণ করবে এবং সাত বছর রাজত্ব করবেন।
৩. হজরত আলী (রা.) থেকে বর্ণিত, নবী করীম (সা) বলেন, ‘মাহদী আসবেন আহলুল বাইত অর্থাৎ আমার বংশ থেকে, আল্লাহ তাঁকে এক রাতের মধ্যে সঠিক পথের সন্ধান দিবেন।’
৪. ‘আলামতে কিয়ামত’ গ্রন্থে মাও শাহ রফীউদ্দিন লিখেছেন, আকাশ থেকে গায়েবী আওয়াজ আসবে ‘ইনিই আল্লাহর খলিফা মেহদী। অতএব তার কথা শোন ও আনুগত্য করো’।
এই হাদীসগুলোর ব্যাপারে ফকীহদের মতামত
ইসলামের ইতিহাস থেকে জানা যায় রাসুলের আগমনেও এরুপ কোন আওয়াজ বা ধ্বনী আকাশ থেকে আসেনি। আরবের কাফেররা দীর্ঘদিন ধরেই রাসূলের (সা) কাছে সরাসরি এমন দাবী জানিয়ে আসছিল যে, তুমি যদি সত্যিই নবী হয়ে থাকো তা হলে তোমার সাথে ফেরেশতা থাকে না কেন? সেই ফেরশেতারা আমাদেরকে বললেইতো আমরা ঈমান আনতাম। আল কোরআনে ঘটনাটি এভাবে বলা হয়েছে, “ওরা বলে, এ কেমন রাসূল, যে খাবার খায় এবং হাটে বাজারে চলাফেরা করে! তার নিকট কোন ফেরেশতা অবতীর্ণ করা হল না কেন; যে সতর্ককারীরূপে তার সঙ্গে থাকত? (সূরা ফুরকান ৭)” ।
মুসাকে (আ) তো বনী ইসরাইলের লোকেরা আরো ধৃষ্ঠতা দেখিয়ে বলেছিল, আমাদের সামনে ফেরেশতা আসলেও কাজ হবে না, বরং আল্লাহকে এখনই আমাদের সামনে এনে দাড় করিয়ে দেখাও! চোখে দেখে তবেই আমরা ঈমান আনবো! কিন্তু মহাবিজ্ঞ আল্লাহ তাআলা কাফিরদের এ হাস্যকর ও অর্থহীন দাবীকে সরাসরি প্রত্যাখান করেছিলেন। কারন ইসলামের সবচেয়ে কঠিন পরীক্ষা হচ্ছে গায়েবে বিশ্বাস। যখন কোন সত্যকে পরিপূর্ণভাবে মানুষের সামনে উন্মুক্ত করে দেয়া হয় সেখানে আর পরীক্ষা করার আর কোন বিষয় বাকী থাকে না। সমুদ্রে ডুবে মরার পূর্ব মুহুর্তে ফেরাউন তার সামনে আজরাইল (আ) কে দেখতে পেয়ে ঘোষণা করছিল, ‘আমি ঈমান আনলাম বনি ইসরাঈলরা যে আল্লাহতে বিশ্বাস করে তাঁর উপরে, তিনি ছাড়া কোনো ইলাহ নেই। আর আমি আজ তাঁর কাছে আত্মসমর্পণকারীদের অন্তর্ভুক্ত’ (সুরা ইউনুস: ৯০-৯২)। তাই স্বভাবতই প্রশ্ন জাগে, নবীদের বেলায় যা ঘটেনি, ইমাম মাহদীর বেলায় মহান আল্লাহ তাআলার এই চিরাচরিত নিয়মের ব্যাতিক্রম ঘটানো হবে কি কারনে?
উপরের তিন নম্বর হাদীসটি লক্ষ্য করুন, মাহদী হবেন আমাদের মত সাধারন মানুষ, কিন্তু এক রাতে ঘুমের মধ্যে আল্লাহ তার সবকিছু ঠিকঠাক করে একদম পাক্কা নির্ভুল মানুষ বানিয়ে দিবেন! কি আশ্চর্য কথা। ইসলাম যেন এক ভুতুরে ম্যাজিক খেলা!
ইমাম মাহদী সংক্রান্ত যতগুলো হাদীস প্রচলিত রয়েছে, হাদীস বিশারদগণ এগুলোর এত বেশী সমালোচনা করেছেন যে, তাদের মধ্যে একটি দল মাহদীর আবির্ভাবকেই স্বীকার করেন না। এ হাদীসগুলোর বর্ণনাকারী রাবীগন প্রায় সকলেই শিয়া সম্প্রদায়ভুক্ত। এসব কারনে হাদীসের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ ভান্ডার বোখারী ও মুসলিম শরীফে ইমাম মাহদী সংক্রান্ত কোন হাদীসকেই জায়গা দেয়া হয়নি। অ-ইমামুকুম মিনকুম – তোমাদের মধ্যে ইমাম বা নেতা এমন বর্ণনা মুসলিম শরীফে রয়েছে কিন্তু ‘ঈমাম মাহদী’ বলে কোন শব্দ এর কোনটিতে নেই।
যুগে যুগে বহু দেশের বহু লোকই নিজেদেরকে ইমাম মাহদী বলে দাবী করে এসেছে, তাদের বই পুস্তকেও সফল ফেতনা সৃষ্টির জন্য উপরোক্ত বর্ণনাগুলো রসদ সরবারহ করেছে বেশ ভালভাবেই। এতে ইমাম মাহদীর নাম, পিতা, মাতা, বাড়ী ঘর সহ তার সাথে ফেরেশতা পর্যন্ত আগমনের কথা বেশ পরিষ্কার ভাবে দাবী করা হয়েছে। অথচ এ হাদীসগুলোর ভাষা, বর্ণনা এবং বক্তব্য অতীত জাতিসমুহের সাথে মহান আল্লাহপাকের আচরনের পরিপন্থী।
মহানবীর (সা) হাদীসের কোন বক্তব্যেই যে কোন বিষয়ের খুটিনাটি তুলে ধরা হয়নি বরং একটি ধারনা দিয়ে দেয়া হয়েছে। এমনকি কেয়ামত বর্ণনার হাদীসগুলোতে গুরুত্বপূর্ণ আলামতের উল্লেখ করা হলেও এর সকল বিষয়ের বিস্তারিত বর্ণনা নেই। ইসা (আ) এর পূনরাগমনের বিষয়েও অতি সংক্ষিপ্ত ধারনা দেয়া হয়েছে । অথচ এই ইমাম মাহদীর বিষয়ে প্রচলিত বানীগুলোতে নবীর চেয়েও বেশী গুরুত্বারোপ করা হয়েছে। তা কি করে সম্ভব? একজন মানুষের গুরুত্ব ও মর্যাদা কিভাবে একজন নবীর চেয়েও বেশি হতে পারে?
সুযোগ সন্ধানীদের মাহদী দাবী
উপরোক্ত হাদীসেগুলোর উপর ভিত্তি করে পৃথিবীর বিভিন্ন দেশের শতাধিক লোক এ পর্যন্ত ইমাম মাহদী বলে দাবী করে এসেছে। এদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হচ্ছেঃ
১. মুহাম্মদ ইবনে মনসুর আল মাহদি আব্বাস (আব্বাসীয় শাসন )
২. ভারতে গোলাম আহমদ কাদিয়ানী
৩. আফ্রিকাতে মাহদী আল সুদানী
৪. ১৯ শতকে সুদানের মুহাম্মদ আহমাদ
৫. ১৯৭৯ সালের ২০শে নভেম্বর পবিত্র কাবা চত্বরে ঢুকে ইমাম মাহদী দাবী করেন জুহাইমান আল-উতাইবি
এভাবে বিভিন্ন সময়ে, বিভিন্ন দেশ যেমন- মরোক্কো, সুদান, ভারত, ইরান ইত্যাদি স্থানে ইমাম মাহদী হওয়ার দাবি উঠেছে। সম্প্রতি গোপালগঞ্জ জেলায় পীর বলে চিহ্নিত ‘নুরাল পাগলা’ নামের একজন লোক মারা যায়। সেও তার জীবদ্দশায় নিজেকে ইমাম মাহদী দাবী করে বহু মানুষকে বিভ্রান্ত করেছিল বলে জানান যায়। সে বিশাল এক খানকাহ ও দরবার শরীফ বানিয়েছিল পবিত্র ক্বাবাঘরের আদলে।
অত্যন্ত বেদনাদায়ক সংবাদ হচ্ছে মাহদী, দাজ্জাল এবং ইয়াজুজ মাজুজ ইত্যাদি অস্পষ্ট বিষয়গুলোর অতিরঞ্জিত ব্যখ্যা গ্রহণ করতে না পেরে অনেক মুসলিম তরুন যুবকের ইসলাম ত্যাগের মত ঘটনা ঘটছে পাশ্চাত্যের দেশগুলোতে। তারা ভাবছে ইসলাম কোন যুক্তি গ্রাহ্য ধর্ম নয় বরং এ হচ্ছে এক অতিপ্রাকৃত (supernatural) বিষয়। ইতিহাস পর্যালোচনা করলে বুঝা যায়, বিভিন্ন সময়ে স্বার্থান্বেষী মহল নিজেদের ধর্মীয় ও রাজনৈতিক স্বার্থ হাসিলের জন্য এ হাদীসগুলোকে ব্যবহার করেছে। বনু ফাতিমা, বনু উমাইয়া ও বনু আব্বাস এর মধ্যকার দীর্ঘ সংঘাতের ইতিহাস থেকে দেখা যায় নিজ নিজ পক্ষে তারা এসব হাদীসকে ব্যবহার করেছে। এগুলোর বর্ণনাকারী ও রাবী তারা নিজেরাই।
৬৬১ থেকে ৭৫০ সাল পর্যন্ত পরিচালিত উমাইয়া শাসনের পতন ঘটিয়ে আব্বাসীয় শাসন প্রতিষ্ঠিত হয় যা ১৫১৭ সাল পর্যন্ত মুসলিম বিশ্বকে শাসন করে। এদেরকে কালো পোশাকের পুরুষদের আন্দোলনও বলা হয়! এই আব্বাসীয় পরিবার নিজেদেরকে নবী (সা) এর চাচা আল-আব্বাসের বংশোদ্ভূত বলে দাবি করে। দীর্ঘ আটশত বছর একচেটিয়া রাজত্বের এক পর্যায়ে তারা পথহারা হয়ে ইসলামের আদর্শ থেকে বিচ্যুত হতে থাকে। তখন নিজেদের ক্ষমতা ধরে রাখতে ইসলামের নামেই মুসলমানদেরকে বিভ্রান্ত করার শত বাহানা এরা খুঁজে বের করতে থাকে। ইচ্ছেমত হাদীস রচনা কিংবা হাদীসের ব্যখ্যা করতে এদের অন্তর কেঁপে ওঠেনি। শুরু হয়। উমাইয়া ও আব্বাসীদের পারস্পরিক দ্বন্দ্ব। উল্লেখ্য মুহাম্মদ ইবনে মনসুর আল মাহদি আব্বাস ১৫৮ হিজরি থেকে ১৬৯ হিজরি (৭৭৫-৭৮৫ খ্রিষ্টাব্দ) পর্যন্ত শাসন করেন। তার রাজত্বের পতাকা ছিল কালো রঙ্গের। উমাইয়া শাসনের পতন এর পরে তাদের বিরুদ্ধে এই ধরনের হাদীস বানিয়ে নিজেকে ইমাম মাহদী দাবী করে ক্ষমতা পাকাপোক্ত করার চেষ্টা করেছেন। এটি আব্বাসীয় শাসন নামে পরিচিত। কালো পতাকা ছিল এই বনু আব্বাসের পতাকা। এই পতাকার আরবী নাম “আয়াতুস সাউদ”। তাই অনেক মুহাদ্দিস হাদীসরুপে এসব বর্ণনাকে দুর্বল হিসেবে আখ্যায়িত করেছেন। কেউ কেউ কালো পতাকা সম্পর্কিত সকল হাদিসকে জাল বলে মন্তব্য করেন। মধ্যযুগীয় ইসলামি পণ্ডিত ও হাদিস বিশারদ ইবনুল জাওজি এই হাদিসগুলোকে সম্পূর্ণ বনোয়াট বলে উল্লেখ করেছেন। যেমনিভাবে আজ এক পরাশক্তি অপর প্রতিদ্বন্দ্বী শক্তির বিরুদ্ধে প্রোপাগান্ডা তৈরী করে, একটি রাজনৈতিক দল আরেকটির বিরুদ্ধে, একটি ধর্মীয় দল অন্য দলের বিরুদ্ধে বিষোদগার করে থাকে, ঠিক তেমনি উমাইয়া ও আব্বাসীয় গোত্র নিজেদের শ্রেষ্ঠত্ব এবং প্রতিপক্ষকে নিকৃষ্ট প্রমান করার জন্য বিভিন্ন বয়ান রচনা করে ইসলামের দোহাই দিয়ে। এই সুযোগটি লুফে নেয় শিয়া জনগোষ্ঠীর ধূর্ত লোকেরা।
শিয়া প্রভাবিত বর্ণনা
অনেক হাদীস বিশারদ বলেছেন, মাহদী সংক্রান্ত হাদীসের বর্ণনা, ভাষা ও বক্তব্য বিশ্বনবীর বক্তব্যের মত নয়। রাসূল (সা) অনেক বড় বড় আলামত আমাদের জন্য বলে গিয়েছেন বটে কিন্তু বিস্তারিত বলেননি। ইসলামী শাসনব্যবস্থা পৃথিবীতে ছিন্নভিন্ন হয়ে যাওয়ার পর সমগ্র বিশ্ব জুলুম নির্যাতনে ভরে যাবে। এর পরে আবার ইসলামকে পূণরুজ্জীবনের জন্য সেখানে একজন ইসলামী নেতৃত্বের প্রয়োজন হবে যিনি হবেন সঠিকভাবে হেদায়েত প্রাপ্ত এক বান্দাহ, তাই তাকে বলা হয় মাহদী বা হেদায়াতপ্রাপ্ত।
কোন কোন হাদীসের বর্ণনায় রয়েছে, ইমাম মাহদী হবেন ঠিক নবীদের মত নিষ্পাপ, তিনি আসমান থেকে ক্বাবা চত্বরে নেমে আসবেন ফেরেশতাদের কাধে ভর করে। তার উপরে ঈমান আনা ফরজ বা ওয়াজিব, তাই যে ব্যক্তি ঈমান আনবে না সে কাফির হয়ে যাবে। এগুলো শিয়াদের বিশ্বাস। এর কোন যৌক্তিক ভিত্তি নেই। শিয়া মতবাদ অনুসারে ইসলামী শাসনব্যবস্থায় খেলাফতকে স্বীকার করা হয় না। তাদের মতে এই পদ্ধতির নাম ‘ইমামত’ এবং মোট বারোজন জন ইমাম দুনিয়াতে ইসলামের মশাল প্রজ্জ্বলিত করবেন। এই ইমামদের প্রথমজন হচ্ছেন হযরত আলী (রা) এবং সর্বশেষ বারোতম ইমাম হচ্ছেন ইমাম মাহদী।
এর মধ্যে এগারোজন ইমাম পৃথিবী থেকে বিদায় নিয়েছেন। শিয়া মতবাদের মোট বারোজন ইমামের তালিকা:
১. হযরত আলী (রা)
২. হযরত হাসান ৩. হযরত হুসাইন ৪. হযরত যাইনুল আবিদীন ৫. হযরত বাকির ৬. হযরত জাফর ছাদিক্ব ৭. হযরত মুসা কাজিম ৮. হযরত আলী রেযা ৯. হযরত মুহম্মদ তকী ১০. হযরত আলী নকী ১১. হযরত হাসান আশকারী ১২. মুহম্মদ ইবনে আব্দুল্লাহ মাহদী (ইমাম মাহদী) |
|
ইমাম মাহদী কোন পদ বা পদবী নয়
“ইমাম” শব্দটি কোথা থেকে এলো? শিয়া বিশ্বাসীগন তাদের ইমামদের নামের শেষে বলে থাকেন “আলাইহিস সালাম”। এই প্রথা তোতা পাখির বয়ানের মত আমাদের মধ্যেও অনুপ্রবেশ করেছে। শিয়া সম্প্রদায়ের বিশ্বাস তাদের ইমামগন হচ্ছেন নবী রাসূলদের মতই নিস্পাপ ও সরাসরি আল্লাহ কর্তৃক হেফাজতের অধিকারী। শিয়া সম্প্রদায়ের সর্বশেষ আবিষ্কার ইমাম মাহদী । কিন্তু এখানেও হরেক বর্ণনা, কেউ বলেছেন তিনি আসবেন মদীনা থেকে, কেউবা মক্কা, সিরিয়া, ইরাক, খোরাসান ইত্যাদি (বর্তমানে খোরাসান ইরানের উত্তরপূর্বের একটি প্রদেশ) শহর থেকে তিনি হঠাৎ করে বেরিয়ে আসবেন।
আসলে হাদীসে উল্লেখিত মাহদী কোন নাম (noun) নয়, বরং একটি টাইটেল। যেমন: বীর, ইমাম, স্কলার, মুফতী, ডক্টরেট, ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়র। খেয়াল রাখতে হবে, কোরআনে মাহদী শব্দটি না প্রত্যক্ষ না পরোক্ষভাবে উল্লেখ করা হয়েছে। বোখারী ও মুসলিম শরীফে ‘মাহদী’ বা এ জাতীয় কোন শব্দ উল্লেখ নেই।
মাহদীর বিশ্বাস কি আমাদের ঈমানের সাথে জড়িত?
আল্লাহপাক কখনো তার বান্দাহদেরকে বিপদে ফেলতে চান না। তাই মাহদী সংক্রান্ত হাদীসগুলোকে রাবারের মত টেনে হিচড়ে যতই ব্যখ্যা করা হোক না কেন, তাকে স্বীকার করা কিংবা না করার ওপর কোন মুসলমানের ঈমান ও নাজাত নির্ভরশীল এমন কোন গ্রহণযোগ্য মতামত কোথাও পাওয়া যায় না। বিষয়টি মুসলমানদের ঈমানের সাথে জড়িত হলে অবশ্যই স্বয়ং আল্লাহপাক পবিত্র কোরআনে বিষয়টি উল্লোখ করতেন কিংবা রাসূল (সা) তা কেবলমাত্র দু-এক জন ব্যক্তির কাছে বর্ণনা করে ছেড়ে দিতেন না বরং অত্যন্ত পরিষ্কার ভাষায় তা আমাদের জন্য সুনির্দিষ্ট করে দিতেন। কারন তাঁকে পাঠানোই হয়েছে মানুষকে হেদায়াতের পথ দেখানোর জন্য, হেদায়াত গোপন রাখার জন্য নয়। বহু হাদীস বিশেষজ্ঞ বলেছেন, ইমাম মাহদি নিজেও জানবেন না যে, হাদিসে উল্লেখিত ব্যক্তিটি তিনিই। নিজে স্বতপ্রনোদিত হয়ে কখনো খিলাফতও কামনা করবেন না। বিনয়বশত তিনি নিজেকে নেতৃত্বের অযোগ্য মনে করবেন। প্রবল অনিচ্ছা সত্ত্বেও মানুষ জোর করে তার হাতে আনুগত্যের বাইয়াত হয়ে যাবে।
সব সহীহ হাদীসই কি সঠিক!
এই আর্টিকেলের শুরুর দিকে যে কটি হাদীসের উল্লেখ করেছি প্রায় সবই সহীহ হাদীস! কিন্তু এখন প্রশ্ন হচ্ছে সহীহ হাদীস বলতে আসলে কি বুঝায়? কেউ কেউ হয়তোবা ভাবছেন, যেহেতু এগুলো সব সহীহ হাদীস ফলে আর কোন কথা বলার অবকাশ থাকে না। কিন্তু আমাদের সমস্যা এখানেই। সহীহ বলতে আমরা অজ্ঞান! এখানেই আমাদের মারাত্মক বিভ্রাট।
সমাজে প্রতিষ্ঠিত এবং প্রচলিত রয়েছে যে সহীহ হাদীস মানে সত্য ও সঠিক হাদীস। আর যেগুলো সহীহ নয় সেগুলো ভূয়া হাদীস। তাই ইমাম মাহদি সংক্রান্ত হাদীসগুলো বুঝার আগে আমাদের জানতে হবে। আসলে হাদীসের পরিভাষায় সহীহ বলতে কি বুঝায়। “সহীহ হাদীস” বলতে হাদীসের বর্ণনাকারীদের অবিচ্ছিন্ন ধারাবাহিকতাকে বোঝায়। সংশ্লিষ্ট হাদীসের বক্তব্যটি সত্য তা কিন্তু বুঝায় না। কেবল হাদীসে আছে স্রেফ এ কারনেই সকল ক্ষেত্রে আক্ষরিক অর্থে তা গ্রহণযোগ্য নয়। সহীহ হলেই তা সত্য হাদীস- তা কিন্তু নয়, আবার যয়ীফ হলেই কোন হাদীস বর্জনীয়- এমনটি নয়। আল কোরআনে যেমন রয়েছে মাক্কী ও মাদানী সূরা, মুতাশাবিহাত (অস্পষ্ট) ও মুহকামাত (স্পষ্ট) আয়াত, তদ্রুপ পবিত্র হাদীসেও রয়েছে মাক্কী ও মাদানী হাদীস এবং রয়েছে মুতাশাবিহাত ও মুহকামাত হাদীস। তাই বুঝতে হবে ভালভাবে।
হাদীস গ্রহণ ও বর্জনের নীতিমালা:
- কোরআন ও সূন্নাহর নীতিমালার সাথে মানানসই কি না?
- ইসলামের ইতিহাসে এমন ঘটনা কখন, কোথায়, কোন পরিবেশে ও কতটুকু বিরাজমান ছিল?
- যদি কোন হাদীস নিশ্চিত ভাবে সহীহ বলে প্রমানীতি হয়, কিন্তু তা নবী (সা) এর কর্মনীতির সাথে মোটেই মানানসই নয় বরং নবীর কর্মপদ্ধতির সম্পূর্ণ বিপরীত তা হলে বুঝতে হবে, হাদীসটির শব্দগত অর্থ ঠিক আছে কিন্তু তার প্রয়োগ ভিন্ন এবং বাস্তব জীবনে তার অনুসরন কেবল ব্যাতিক্রমধর্মী কতগুলো ক্ষেত্রেই প্রযোজ্য।
- বর্ণিত হাদীসটির বক্তব্য মহানবীর (সা) আদেশ নাকি অনুমোদন
- কেবলমাত্র বিশেষ কোন অবস্থার প্রেক্ষিতে বক্তব্যটি প্রযোজ্য নাকি সার্বজনীন
- কতগুলো রয়েছে রুপক অর্থে হাদীস। কোরআনের বহু আয়াতও রয়েছে এমন। সব ভাষাতেই রুপক ব্যবহৃত হয়ে থাকে।
- এর সরল অর্থ করা মারাত্মক রকমের ভুল।
পবিত্র কোরআনের আয়াতের মধ্যে যেমন রয়েছে মুতাশাবিহাত বা অস্পস্ট এবং মুহকামাত বা স্পষ্ট বক্তব্য সম্বলিত আয়াত, তেমনি পবিত্র হাদীসেও রয়েছে মুতাশাবিহাত এবং মুহকামাত। আল কোরআনের সূরার মত এখানেও রয়েছে মাক্কী ও মাদানী যুগের হাদীস। এগুলো বুঝতে হবে নবী (সা) এর সমগ্র জীবনকে সামনে রেখে। স্রেফ আক্ষরিক অনুবাদ আমাদেরকে ভুল পথেও নিয়ে যেতে পারে!
ইমাম মাহদীর আগমনে আমার লাভ কি?
ইমাম মাহদী যদি আমাদের মাঝে আসেনও তাতে আমার বেনিফিট কি? না আসলে আমার ক্ষতি কি? আমার দায়িত্ব কি তিনি পালন করবেন? তিনি কি স্বর্গ থেকে আসা গডের পুত্র- যিনি আমার পাপের বোঝা মাথায় নিয়ে শুলবিদ্ধ হয়ে আমাকে উদ্ধার করবেন? শুধু মাহদী কেন? ইসা (আ) আসার কথাওতো কোরআনে আছে? এতে আমাদের দায়িত্ব কি শেষ হয়ে যাবে? ইমাম মাহদী আগমনের বয়ানগুলো এত বেশী ভুলভাবে উপস্থাপিত হচ্ছে যে বর্তমানে মুসলমানদের মাঝে এই নিয়ে ৩টি গ্রুপের সৃষ্টি হয়েছে:
- হাত গুটিয়ে নিষ্কৃয় বসে থাকো, ইমাম মাহদী এসে সব ঠিক করে ফেলবে
- ইসলামের সকল বিজয় কেবল অলৌকিক ও ভৌতিক নিয়মে অর্জিত হয়েছে, দুনিয়াতে আমাদের কোন দায় দায়িত্ব নেই
- দাজ্জাল ও ইসা (আ) এর আগমন পর্যন্ত মাহদী ৭ বছর জীবিত থাকবেন, যা কিছু করার তিনি এবং ইসা (আ) দুজন মিলেমিশেই সম্পন্ন করে ফেলবেন। আমরা সব দায় দায়িত্ব থেকে মুক্ত!
যেসব প্রশ্নের জবাব নেই
ইমাম মাহদীর মা বাবা কে? জন্ম কোথায়? কোথায় তারা বসবাস করছেন? ইমাম মাহদী কোথায় লালিত পালিত হচ্ছে? হঠাৎ করেই আসমান থেকে এসে কিভাবে সে এই সমাজ সভ্যতা কিভাবে চিনবে? ভূরাজনৈতিক বাস্তবতা সে কি বুঝবে? কে তার সাথে জিহাদ করতে যাবে? ঐ সৈন্যদেরকে কে প্রশিক্ষন দিয়ে তৈরী করে রেখেছে? কোথায় তারা? অন্য দেশে যাবে জিহাদ করতে, তাদের ভিসা কে দিবে? এমন হাজারো প্রশ্ন? দীর্ঘ দেড় হাজার বছর আগেকার ভূ-রাজনৈতিক অবস্থা কি আজও বর্তমান আছে? স্রেফ আবেগ নয়, বরং বাস্তবতা দিয়ে বুঝতে হবে আসমান থেকে নেমে এসে তিনি কিভাবে মানব সমাজের নেতৃত্ব দিবেন?
অথচ সকল নবী রাসূলগন চিরপরিচিত নিজ ভূমি ও সমাজেই জন্ম নিয়েছেন, বড় হয়েছেন। জাতির লোকদের মন মানসিকতা সঠিকভাবে উলব্ধি করেছেন। অথচ শিয়া সম্প্রদায়ের কাছে ইমাম মাহদী নিয়ে এমনসব বিষয় চালু আছে- তা শুনলে মনে হয় ইসলাম এক হাসি তামাশার ধর্ম। অর্থহীন ও অযৌক্তিক গালগল্পে ভরপুর। হিন্দুদের পৌরানিক কাহিনী বর্ণনার সাথে শিয়া বিশ্বাসীদের অনেক বর্ণনার মিল রয়েছে। “ইমাম মাহদীর” গল্প অনেকটা তদ্রুপ। হাজার বছর আগের মত সামনাসামনি তলোয়ারের যুদ্ধ হবে? এ কাজের প্রশিক্ষন নিয়েছে কে, দিয়েছে কে? যুদ্ধের আধুনিক প্রযুক্তির প্রশিক্ষন কোথায়? তা ছাড়া ইসলাম মানে কি কেবল যুদ্ধ আর যুদ্ধ? শুধু রক্তপাত ঘটাবেন ইমাম মাহদী? তার আর কোন কাজ করতে হবে না? তার সহযোগী কে হবেন? কি তাদের যোগ্যতা? হাজারো প্রশ্নের জবাব কি আমাদের সামনে রয়েছে? নাকি ইমাম মাহদীকে নিয়ে আমরাও শিয়াদের মত এক কল্পনার জগতে ভাসছি? সে সমাজ সম্পর্কে তাঁর কোন ধারনাই থাকবেনা সে সমাজ তিনি পরিশুদ্ধ করবেন কিভাবে?
বর্তমান মুসলমানদের অবস্থা
শেষনবী (সা) আসার ভবিষ্যৎবানীও ইহুদীদের কিতাবে ছিল, সে অপেক্ষায় তারা বসে থাকতো। কিন্তু তিনি আসার পরে ইহুদীদের আচরন কি ছিল তা আমরা জানি। বর্তমানে আমাদের চরিত্র কি সেই ইহুদীদের থেকে খুব ভিন্ন কিছু? ইসলাম প্রতিষ্ঠার কাজে আমরাই তো দেশে দেশে বাধার সৃষ্টি করি? ইসলাম বিরোধী সকল সেক্যুলার অপশক্তিকে ক্ষমতার আসনে বসিয়ে রাখার যাবতীয় প্রচেষ্টা ও অপচেষ্টা অতি আন্তরিকতার সাথে আমরাই আঞ্জাম দিচ্ছি। আমরাই ইসলামের দুশমনদেরকে সকল পর্যায়ের সহযোগিতা করে চলছি। এর পরেও আমরা অঅবার ইমাম মাহদীর অপেক্ষায়!
বিশেষ করে উপমহাদেশে ইমাম মাহদীর কথা বেশ জোরেশোরে প্রচারিত হচ্ছে কারন শিয়া মতবাদের অনুসারী মোঘল সম্রাটদের প্রচলিত শিক্ষা ও প্রভাব। সাম্প্রতিককালে এটি অনেক বেশী আলোচিত হচ্ছে। জালিমদেরকে নির্বিঘ্নে ক্ষমতার মসনদে বসিয়ে রেখে নিজেদের কর্তব্য থেকে মানুষকে হাত গুটিয়ে অলস সময় পার করার জন্য রাখার জন্য পরিকল্পিতভাবে এসব ওয়াজ নসীহত করা হচ্ছে কি না এমন প্রশ্ন কি অমূলক? ইসলামের সকল কাজই একটি প্রকাশ্য ও প্রচলিত নিয়মতান্ত্রিক পন্থায় সংঘটিত হয়েছে। সকল নবী রাসূলগণ মানুষের সমাজে জন্মগ্রহণ করেছেন, বড় হয়েছেন এবং ধাপে ধাপে দাওয়াতের মাধ্যমে লোক তৈরী করেছেন, প্রশিক্ষণ দিয়েছেন- এটিই রাসূলের (রা) তের বছরের মাক্কী জীবন, এটিই মাক্কী সূন্নত। রাসূল (সা) জীবনের কোন কিছুই গোপন ছিলনা। কেবল মন্ত্র পড়ে ফুঁ দিয়ে কোন কাজ সংঘটিত করা কিংবা জায়নামাজে চড়ে সমুদ্র পাড়ি দেয়ার মত তেলেসমাতি সৃষ্টি করা নবীদের কাজ ছিল না। যদি ইমাম মাহদী আসার কথা সত্যও হয়, তবে কি আমরা আমাদের উপরে অর্পিত দায়িত্ব কর্তব্য থেকে হাত গুটিয়ে বসে থাকবো নাকি তাঁর অধীনে একজন যোগ্য মুজাহিদ হওয়ার জন্য প্রস্তুতি নিতে থাকবো? বিভিন্ন দেশ থেকে জাতিসংঘ শান্তিরক্ষী বাহিনীতে সৈন্য পাঠানো হয়। সেখানে কাদেরকে নির্বাচন করা হয়? এটি কি যথেচ্ছভাবে হয়ে থাকে? অবশ্যই না, বরং চৌকষ, মেধাবী ও যোগ্য সৈনিকদেরকেই বাছাই করা হয়।
আমাদের কি করা উচিৎ
তাই মাহদীর জন্য অপেক্ষা না করে প্রত্যেক মুসলমানের উচিত নিজের জীবনকে ইসলামের পথে পরিচালিত করা এবং সমাজে ন্যায়বিচার ও শান্তি প্রতিষ্ঠায় সচেষ্ট হওয়া। কমিউনিটিতে ইসলামের চমৎকার সৌন্দর্যকে তুলে ধরতে কোন ফেরেশেতা আসবে না, একাজ আপনার আমার।
কেবলমাত্র নবী রাসূলদেরই এখতিয়ার ছিল দাবী করার মাধ্যমে কোন কাজ শুরু করার। একমাত্র তারাই বলতে পারেন, “আমি আল্লাহপাকের নিযুক্ত নবী এবং আমার আনুগত্য না করলে জাহান্নামে যেতে হবে”। অন্য কোন মানুষকে এ অধিকার দেয়া হয়নি, সে যেই হোক না কেন। কারন, মাহদী দাবী করার কোন বিষয় নয়। কেউ কেউ হয়তোবা বলবেন, ইমাম মাহদী আসার আগেই জিহাদের জন্য যোগ্য সেনাবাহিনী ও সংশ্লিষ্ট সকল পর্যায়ের লজিস্টিকস প্রস্তত থাকবে। তাই তার নিজের কোন যোগ্যতা না থাকলেও সমস্যা নেই। তা হলে পাল্টা প্রশ্ন করতে হয়, যদি সব কিছু অন্যরা আগেই প্রস্তুত করে রাখে তাহলে ইমাম মাহদী আসার প্রয়োজন কোথায়? তিনি কি শুধু ক্ষমতা উপভোগ করার জন্য আসবেন? ইমাম মাহদী যদি তার সমস্ত কাজ কর্ম দোয়া দরুদ পড়েই সফল করে ফেলেন তা হলে তো আর কোন মানুষের সাহায্য তাঁর প্রয়োজন নেই। তিনি একাই যথেষ্ট!
ইমাম মাহদী আসবেন তাঁর দায়িত্ব পালন করার জন্য, অবশ্যই আপনার আমার দায়িত্বের বোঝা তাঁর মাথায় নেয়ার জন্য নয়! অতএব তাঁর আসার অপেক্ষায় বসে থেকে নিজেদের উপর অর্পিত কর্তব্যবোধ থেকে বিমুখ হয়ে বসে থাকা কোন বুদ্ধিসম্পন্ন ঈমানদারের কাজ হতে পারে না। তিনি কোন ইশ্বরের পুত্র নন, যে আপনার পাপগুলো নিজের মাথায় নিয়ে নিজে শুলে চড়বেন, আর আপনি হড়হড় করে বেহেশতে চলে যাবেন। দাজ্জাল সম্পর্কেও এমন বহু মুখরোচক কথাবার্তা বাজারে রয়েছে কোরআন ও হাদীসের নামেই।
মনে রাখতে হবে প্রতিটি মানুষকেই তার দায়িত্ব সম্পর্কে জিজ্ঞাসাবাদ করা হবে। যারা সরল-সঠিক পথে পরিচালিত হবে নিশ্চয়ই তারা তাদের নিজেদের কল্যাণের জন্যই সঠিক পথে পরিচালিত হবে। আর যারা ভ্রান্ত পথে পরিচালিত হবে তারা ভ্রান্ত পথে পরিচালিত হবে তাদের নিজেদের ধ্বংসের জন্যই। কেউ কারও কাজের দায় বহন করবে না। আর আমি রাসূল পাঠিয়ে সতর্ক করা ছাড়া কাউকে শাস্তি দেই না।’ সূরা বনি ইসরাইল: ১৫
——————————————————
গ্রন্থসূত্র:
- দারসে কুরআন – মাওলানা আবুল খায়ের
- ফি যিলালিল কুরআন – সাইয়েদ কুতুব
- The Sirah of the Prophet – Dr Yasir Qad
- তাফহীমুল কুরআন – মাওলানা মওদূদী
- রাসায়েল ও মাসায়েল – মাওলানা মওদূদী
- ইসলামী রেনেসা আন্দোলন – মাওলানা মওদূদী
- সূন্নতে রাসূলের আইনগত মর্যাদা – মাওলানা মওদূদী
- ইসলামী শরীয়তের আইনগত উৎস – মাওলানাআব্দুর রহীম