অধ্যক্ষ আনোয়ার আল ফারুক: রাজনীতি অঙ্গনের মতের ভিন্নতাও একটি রাজনৈতিক সৌন্দর্য। এখানে ভিন্ন ভিন্ন রাজনৈতিক মতের ঐক্যতা কখনো আশা করা যায় না। সাময়িক সময় কিংবা নির্দিষ্ট ইস্যুতে রাজনৈতিক দলগুলো নিজেদের ছোটখাটো মতবিরোধ, দলীয় আদর্শকে গৌণ করে জাতীয় বৃহত্তর স্বার্থে ঐক্যমতে পৌঁছার নজিরও আছে। ৮০র দশকের শেষের দিকে আর নব্বই দশকের শুরুতেই এরশাদ বিরোধী আন্দোলনে ডান বাম ইসলামী ঘরানার রাজনৈতিক দলগুলো এক প্লাটফর্মে এসে স্বৈরাচার বিরোধী আন্দোলন সফলতার চুড়ান্ত পর্যায়ে নিয়ে আসলে নয় বছরের স্বৈরশাসক এরশাদ সরকারের পতন হয়। আবার এরশাদ সরকারের পতনের পর বিএনপি জামায়াতের কোয়ালিশন সরকার গঠন হয়। পরে ১৯৯৬ সালে নির্বাচনপূর্ব কেয়ারটেকার সরকার ব্যবস্থা নিয়ে মতের দ্বৈততায় জামায়াত আন্দোলন শুরু করে, পরবর্তী আওয়ামীলীগসহ বিরোধীদলগুলো একই দাবিতে মাঠে যুগপৎ আন্দোলন করে।পরবর্তী ৯৬ নির্বাচনে আওয়ামীলীগ সরকার গঠন করে। আওয়ামীলীগের ব্যাপক দমন নিপীড়নে বিরোধী মঞ্চ অর্থ্যাৎ বিএনপি জামায়াত সমমনা দলগুলো আবার ঐক্যমতের রাজনীতি রাজনৈতিক সমন্বিত কর্মসূচি নিয়ে মাঠে সরগম হয়ে উঠে।২০০১ সালের নির্বাচনে বিএনপি জামায়াতসহ চারদলীয় জোট সরকার গঠন করে।আওয়ামীলীগ ও সমমনা ১৪ দলীয় জোট গঠন করে।নিকট অতীতে১৬ বছর আওয়ামী দুঃশাসনের বিরুদ্ধে বলতে গেলে বিরোধী জোটের সব দলগুলো সমন্বিত কর্মসূচি পালন করতে থাকে। দলমত নির্বিশেষে দেশবাসী একাট্টা হয়ে উঠে স্বৈরশাসনের বিরুদ্ধে।রাজনৈতিক দলগুলোর সহায়ক শক্তি হিসেবে অভিভূত হয় ছাত্রশক্তি। অবশেষে ২৪ র জুলাই আগস্ট গণঅভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে দেশের শাসন ব্যবস্থার পট পরিবর্তন হয়। এই ছিল বিগত আশির দশক থেকে বর্তমান আব্দি আমাদের রাজনৈতিক অঙ্গনের ঐক্যমত সমন্বিত আন্দোলন সংগ্রামের দৃশ্যমান হালচাল। এখানে রাজনৈতিক আদর্শের ভিন্নতা স্বর্তেও দেশের ক্লান্তিলগ্নে দেশ মাতৃকা ও গণতান্ত্রিক পরিবেশ পুনরুদ্ধারে দলীয় সংকীর্ণতার উর্ধ্বে উঠে ঐক্যমতের ইতিবাচক দারুণ নজির স্থাপন করলেও বর্তমান প্রেক্ষাপটে যেন দলগত রেষারেষি ভুল বুঝাবুঝি, মতের দ্বৈততা গাণিতিক হারে বেড়ে চলছে। রাজনৈতিক অঙ্গনে দলে দলে দুরত্ব দিন বেড়েই চলছে। এতে করে ভিন্ন আদর্শের প্রতি ভিন্ন দলের প্রতি কেন্দ্রিয় পর্যায় থেকে শুরু করে তৃণমুল পর্যায়ের নেতা কর্মীদের মাঝে সহিংষ্ণ মনোভাব সৃষ্টি হচ্ছে। পরস্পর পরস্পরকে দোষারোপের ভাষাও তীর্যক হয়ে উঠছে।যথেচ্ছ শব্দ চয়নের মাধ্যমে আক্রমন করে যাচ্ছে প্রতিপক্ষকে।এখানেই দিনদিন রাজনৈতিক শিষ্টাচারের কবর রচিত হচ্ছে।রাজনৈতিক মতবিরোধ থাকবে কিয়ামত অব্দি কিন্তু দেশের স্বার্থে দেশের কল্যাণে সবার দৃষ্টিভঙ্গিতো এক ও অভিন্ন হওয়া রাজনৈতিক শিষ্টাচারের অংশ। ইদানিং রাজনৈতিক অঙ্গনে ইগু আরো মহামারি হয়ে উঠছে। “অমুক দল এই সিস্টেম চাইলে আমরা তা মানবনা। আমরা মাথা ঠেলে হলেও তার বিরোধীতা করব এবং তা ঠেকানোর জন্য সম্ভাব্য সবকিছুই করব।” এই মানসিকতা প্রকট হয়ে উঠলে জাতীয় ইস্যুতেও দল দলে ঐক্যমত সুদুর পরাহত হয়ে উঠবে। ফলে শাসকগোষ্ঠীও সেই সুবাধে স্বৈরচারি হয়ে উঠার সুযোগ পাবে। ২৪ গণ অভ্যুত্থানের পর মিত্র সংগঠনগুলো যারা দীর্ঘ ১৬ বছর আওয়ামী স্বৈরশাসনের বিরুদ্ধে জীবনবাজি রেখে মাঠে লড়ছে তাদের মধ্যেও ব্যাপক বিভাজন দেখা দিয়েছে। কেউ কাউকে সহ্য করতে পারছে না, মেনে নিতে পারছে না এমন হিংসাত্মক মনোভাব দেখা যাচ্ছে। অথচ রাষ্ট্র সংস্কার রাষ্ট্র মেরামতে অভ্যুত্থান স্বপক্ষ শক্তি ঐক্যমতে থাকার কথা থাকলেও সেটা আর দেখা যাচ্ছে না ফলে অভ্যুত্থান ও অভ্যুত্থানের অর্জন প্রশ্নবিদ্ধ ও ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে উঠছে অন্যদিকে মতের অমিল ও দুরত্বে, পরস্পরের রেষারেষিতে স্বৈরাচার ও তার দোসররা আপকামিং হবার অনাকাঙ্ক্ষিত সুযোগও পেয়ে বসতে পারে।
দেশ ও জনগণের কল্যাণের জন্যইতো রাজনীতি।দেশ প্রেমিক অভ্যুত্থানের স্বপক্ষ শক্তিগুলো এখন দেশের স্বার্থকে গৌণ করে দলীয় স্বার্থকে মুখ্য করাই সময়ের সবচেয়ে জঘন্যতম ভুল। হয়ত এই ভুলের মাশুল গুনতে হবে খুব কঠিনভাবে। মনে রাখতে হবে দেশপ্রেমিক রাজনৈতিক দলগুলোর পরস্পরের রেষারেষি ভুল বুঝাবুঝির খেসারত গোটা জাতিকে দিতে হবে।আমাদের রাজনীতির সৌন্দর্যের আরেকট উল্লেখযোগ্য দিক ছিল অন্য দলের নেতা কর্মীদের প্রতি শ্রদ্ধা ও ভালোবাসা। ইদানিং এই গুণটি হারিয়ে যাচ্ছে রাজনৈতিক ডিকশানারি থেকে। কোন দল কোন দলকে, কে কাকে কতটা আক্রমনাত্মক ভাষায় বিরোধীতা করতে পারছে সেই প্রতিযোগীতা শুরু হয়েছে।এই বদ চর্চা দলের কেন্দ্র থেকে তৃণমূল পর্যায় পর্যন্ত সম্প্রসারিত হয়েছে। ফলে দলে দলে দুশমনি রেষারেষি চরম থেকে চরমে পৌঁছে যাচ্ছে। দেশ ও রাজনৈতিক অঙ্গন হয়ে উঠছে উত্তপ্ত কড়াই। রাজনৈতিক বক্তব্যের মাঠ, টকশো, সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমেও ভিন্ন মত ভিন্ন দলের নেতা কর্মীদের কটু কথা গালমন্দ মিথ্যা অপবাদের চারণভূমি হয়ে উঠছে। সম্মানবোধ ও ভদ্রতা যেন দিন দিন লোপ পাচ্ছে। এটা দেশের রাজনীতির আগা থেকে ঠিক গোড়া পর্যন্ত একই চিত্র বিরাজ করছে।
গণ অভ্যুত্থান পরবর্তী অভ্যুত্থান স্বপক্ষ শক্তির ঐক্যমত ছিল একান্ত কাম্য কিন্তু হালে দেশ জনতা সেই বিষয়ে রাজনীতিবীদদের থেকে চরম আশাহত হচ্ছে। অভ্যুত্থান স্বপক্ষ শক্তির মাঝে বিভাজন স্বৈরাচার আপকামিং সুযোগ হয়ে যেতে পারে।এই বিষয়টা বুঝার অনুধাবন করার সময় এখনই। নচেৎ জাতির কপালে দূর্ভোগ আরো প্রলম্বিত হবে। সময় থাকতেই সময়ের মূল্য দেওয়া উচিত।
একেকটা দলের আদর্শ লক্ষ্য উদ্দেশ্যের ভিন্নতা থাকতেই পারে। সেটার সাথে অন্য দলগুলোর ঐক্যমত হতে না পারা দোষের নয় কিন্তু কোমরে গামছা বেঁধে অশোভন ভাষায় শিষ্টাচার বহিঃভূত বিরোধিতা, বিরোধিতায় অশালীন শব্দ চয়ন রাজনীতিতে কখনো কাম্য নয়। ইদানিং বিরোধী মতের রাজনৈতিক দলগুলোর প্রতি যথেচ্ছভাবে তা হচ্ছে।রাজনৈতিক দলগুলোতে আক্রমণাত্মক ঘায়েল গাণিতিক হারে বাড়ছে ফলে সমমনা রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যেও পপরস্পর অনাকাঙ্ক্ষিত দুরত্ব সীমাহীন আকারে বেড়ে চলছে।অনেকাংশে রাজনৈতিক দলের নেতা কর্মীরা ভদ্রতা ও শিষ্টাচারের মার্জিন অতিক্রম করে চলছেন। এটা আমাদের দেশ জাতি ও রাজনৈতিক সহবস্থানের জন্য এক মারাত্মক অশনি সংকেত বটে।
কোন দেশ জনগোষ্ঠীর ঐক্যে ভাঙ্গন সৃষ্টির প্রধান হাতিয়ার কিন্তু বিভাজন। শত্রুপক্ষ সাধারণত প্রধান দু উপায়ে এই বিভাজন সৃষ্টি করে এবং যুগ যুগ বিভাজন জিইয়ে রাখে। প্রথমত: তারা পরস্পরের মাঝে বিভিন্ন উপায়ে ভুল বুঝাবুঝি সৃষ্টির কাজটি খুব সুক্ষ্ণভাবে করে দ্বিতীয়ত কিছু লোকের মাথা কিনে নেয় আর তাদের পেইড এজেন্ট হিসেবে কাজে লাগায়। অভ্যুত্থান পরবর্তী আমাদের শত্রু চারদিকে। দেশ ও বহিরাগত শত্রুরা এই দু উপায়ের কোনটা হাতছাড়া করবে না নিশ্চয়। তাই দেশপ্রেমিক শক্তিকে সাবধানী চোখে আগাতে হবে এটাই ছিল কাম্য কিন্তু সেই কাম্যের ধারে কাছেও বোধহয় আমরা নেই। এটা কী আমাদের রাজনৈতিক দলগুলো বুঝে না? নাকি ফের গোলামীর জিঞ্জিরকে প্রলম্বিত করার সুক্ষ্ণ কাজটি কেউ কেউ কোন পক্ষই সুকৌশলে করে যাচ্ছে?
কথাটা শুনতে খারাপ লাগলেও দেশপ্রেমিক দলগুলোর নেতা কর্মীদের কথায় লাগাম টানা উচিত। পরস্পর ও ভিন্ন মতের প্রতি উদারতা ও শ্রদ্ধাবোধের জায়গা আরো প্রসারিত করা উচিত।অনুমান নির্ভর অভিযোগ, অপবাদ, দোষারোপ বলয় থেকে সব দল মতকে বেরিয়ে আসা সময়ের অপরিহার্য দাবি।নচেৎ দলে দলে দুরত্ব বাড়বে না কেবল দেশে অস্থীতিশীলতা বিরাজ করবে মারাত্মকভাবে। আর এসব সুযোগ কাজে লাগাবে পতিত স্বৈরাচার ও তার দোসর শক্তি। তাই দেশের স্বার্থে জনগণের বৃহত স্বার্থে রাজনৈতিক নেতা কর্মীদের সংযমী আচরণে অভ্যস্থ হতে হবে। দলে দলে শিষ্টাচার আচরণের অভ্যস্থ হওয়ার বেশি বেশি চর্চা করতে হবে। রাজনৈতিক অঙ্গন হোক ভদ্রতা ও শিষ্টাচারের চারণভূমি।
আসন্ন জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে অর্থবহ ও ফলপ্রসূ করতে দেশপ্রেমিক রাজনৈতিক দলগুলোকে আন্তরিকতার সাথে এগুতে হবে।ছোটখাটো মতবিরোধ ভুলে দেশ জনগণের স্বার্থে ঐক্যমতের জায়গায় আসতে হবে।যে কোন উপায়ে নির্বাচনকে সফলতার দ্বারপ্রান্তে পৌঁছিয়ে গণতান্ত্রিক সরকার ব্যবস্থা কায়েম করতে হবে। তবেই জুলাই আন্দোলন সফল হবে। মুক্তিকামী নিপীড়িত জনতার দীর্ঘ সংগ্রামের তরী কূলে ভিড়বে।
লেখক: কবি ও প্রাবন্ধিক