প্রবাস থেকে জুলাই বিপ্লব

শিবলী সোহায়েল: একটা ঝাঁকুনি দিয়ে ঢাকা এয়ারপোর্টের রানওয়ে ছুঁল প্লেনের চাকা। না, ঠিক ছোঁয়া না, যেন আছড়ে পড়ল। ঝাঁকুনি খেয়ে যাত্রীরা নিজেদের সামলে নেওয়ার চেষ্টা করল। কয়েকজন চমকে উঠে জানালার বাইরে তাকিয়ে হাফ ছাড়ল। কিন্তু শামিম ভাই নিশ্চুপ। চোখে-মুখে কোনো ভাবান্তর নেই। তাঁর ভেতরে তখন ঝড় বইছে। সেই ঝড় বাইরের ঝাঁকুনির চেয়েও বড়।

প্রায় পনেরো বছর পর দেশে ফিরছেন সুপ্রভাত সিডনি পত্রিকার প্রধান সম্পাদক, আব্দুল্লাহ ইউসুফ শামিম। প্রবাসে বসে আওয়ামী ফ্যাসিবাদের বিরুদ্ধে যেসব কণ্ঠ নির্ভীকভাবে উচ্চারিত হয়েছে, তিনি তাদের একজন। তাঁর মতো আরও অনেকে পনেরো বছরেও দেশে ফিরতে পারেননি। মাত্র তিন মাস আগে ফ্যাসিস্ট হাসিনা ক্ষমতা ছেড়ে পালিয়েছে। দেশে এখন অন্তর্বর্তীকালীন সরকার। যেন স্বপ্নের মতো এক সকাল। তবুও বুকের গভীর থেকে দুশ্চিন্তা কিছুতেই যাচ্ছে না। কেন যাচ্ছে না, তা খুব বেশিক্ষণ অজানা থাকল না।

প্লেন থেকে নেমে লম্বা লাইন পেরিয়ে তিনি ইমিগ্রেশন কাউন্টারে পাসপোর্ট জমা দিলেন। ইমিগ্রেশন পুলিশ কম্পিউটারে কিছু একটা চেক করে শামিম ভাইয়ের দিকে তাকাল। পুলিশের মুখটা আগের চেয়ে আরও গম্ভীর হয়ে উঠল। আবার স্ক্রিনের দিকে তাকাল, আবার তাঁর মুখের দিকে। তারপর তাঁকে অপেক্ষা করতে বলে একজন অফিসারকে ডেকে আনল। অফিসার এসে তাঁকে একটা আলাদা ঘরে নিয়ে গেল। শুরু হল পুরোনো ঢঙে জেরা। তখনই শামিম ভাই বুঝে গেলেন, হাসিনা চলে গেছে ঠিকই, কিন্তু তার রেখে যাওয়া শকুনেরা এখনো ওঁৎ পেতে আছে।

পুলিশের অফিসার যখন তাঁকে বসিয়ে রেখে উপরের মহলে, ডিবি, এসবি অফিসারদের সঙ্গে যোগাযোগ করছেন, তখন সুযোগ পেয়ে শামিম ভাই ভিডিও কল করলেন যুক্তরাষ্ট্র-প্রবাসী সাংবাদিক কনক সরওয়ারকে। কনক সরওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই তাঁকে ইউটিউব লাইভে নিয়ে গেলেন। মুহূর্তেই খবর ছড়িয়ে পড়ল চারদিকে। এদিকে মোবাইলের চার্জ প্রায় শেষ। ফোন বন্ধ হওয়ার আগেই তিনি আমাকে ও আরও কয়েকজনকে টেক্সট করে জানিয়ে দিলেন তাঁর অবস্থার কথা।

প্রায় চৌদ্দ ঘণ্টা আটকে রাখার পর, উচ্চপর্যায়ের হস্তক্ষেপে তাঁকে মুক্তি দেওয়া হল। এই ঘটনায় সরকারের টনক নড়ল। তারা বুঝতে পারল শেখ হাসিনার রেখে যাওয়া ডিজিটাল সিকিউরিটি অ্যাক্ট বাতিল না করলে এমন অঘটন ঘটতেই থাকবে। আইন উপদেষ্টা আসিফ নজরুল দ্রুত এই আইন বাতিলের প্রতিশ্রুতি দিলেন। কিছুদিনের মধ্যেই তা কার্যকর হল।

ইউসুফ শামিম ভাইসহ আমাদের ওপর শেখ হাসিনার ক্ষোভের প্রধান কারণ ছিল গত পনেরো বছর ধরে ফ্যাসিবাদবিরোধী আন্দোলনে লন্ডন ও নিউইয়র্কের মতো সিডনির গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা।

ঘটনার শুরু বেশ আগে। ২০১৮ সালের এপ্রিল মাস। শেখ হাসিনা তখন সিডনিতে এসেছে এক তথাকথিত “পুরস্কার”নিতে। অবশ্য পুরস্কার না বলে একে “দেশের টাকায় জাতির লজ্জা” কেনা বলাই ভালো। আমরা সবাই জানি, ফ্যাসিস্টদের বিভিন্ন রকম লালসা থাকে। হাসিনার লালসা ছিল দেশ–বিদেশ ঘুরে ঘুরে পুরস্কার আর ডক্টরেট জোগাড় করা। সেই ধারাবাহিকতায় এক বিদেশি এনজিওকে মোটা অঙ্কের অর্থ দিয়ে এবার সিডনিতে এই ‘পুরস্কার নাটক’মঞ্চায়ন করা হয়।

বাংলাদেশের কিছু লেজুড়বৃত্তিক মিডিয়া, বিশেষ করে The Daily Star, সেই পুরস্কারকে অস্ট্রেলিয়া সরকারের আমন্ত্রণ হিসেবে জাহির করতে উঠে পড়ে লাগে। তারা এমনভাবে খবর করে যেন অস্ট্রেলিয়ার প্রধানমন্ত্রী নিজ হাতে হাসিনাকে মেডেল পরিয়ে দেবেন! অথচ পুরো ঘটনায় অস্ট্রেলিয়া সরকারের কোনো ভূমিকাই ছিল না। পুরোটাই ছিল পয়সার বিনিময়ে বেসরকারি এক এনজিও-র সাজানো নাটক।

এদিকে দেশ থেকে অনেক দূরে থেকেও আমরা ভুলে যাইনি নির্যাতিত বাংলাদেশকে। ভুলিনি গুম হওয়া ইলিয়াস আলি, ব্রিগ. আজমি, চৌধুরী আলম, আরমান, ওয়ালিউল্লাহ, মুকাদ্দাসদেরকে। ভুলিনি শাপলা, সাতক্ষীরা, বগুরা, ঝিনাইদহের গণহত্যার কথা। নির্যাতিত মানুষের রক্তের উপর দাঁড়িয়ে, জনগণের টাকার শ্রাদ্ধ করে বিদেশের মাটিতে এমন একটা নাটক মঞ্চস্থ করা কেউই মেনে নিতে পারেনি। এর কিছুদিন আগেই, ২০১৭ সালের ফেব্রুয়ারিতে, দরিদ্র বাংলাদেশের মানুষের কোটি কোটি টাকা খরচ করে ওয়েস্টার্ন সিডনি ইউনিভার্সিটিতে শেখ মুজিবের একটি মূর্তি বসানো হয়। আর এখন আবার আরেক নাটক! তাই সিডনির প্রবাসী বাংলাদেশিরা ক্ষোভে ফেটে পড়ে।

কয়েকদিন ধরে আমরা লাগাতার প্রতিবাদ করি। রাস্তায় রাস্তায় পোস্টার, ব্যানার আর গর্জে ওঠা শ্লোগানে কাঁপিয়ে তুলি সিডনি শহর। এই বিক্ষোভে অংশ নেয় বিএনপি অস্ট্রেলিয়ার সব গুলো গ্রুপ, জামায়াতের প্রবাসী সমর্থকেরা এবং সবধরনের মত ও পথের মুক্তিকামী মানুষ। শুক্রবার ২৭ এবং শনিবার ২৮ এপ্রিল ২০১৮, দুই দিনের টানা বিক্ষোভে সিডনির রাজপথে নেমে আসে শত শত মানুষ। এই আন্দোলনের মূল উদ্দেশ্য ছিল হাসিনার মানবাধিকার লঙ্ঘনের বিরুদ্ধে আন্তর্জাতিক মনোযোগ টানা এবং তার শাসনামলে বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড, গুম, সংবাদপত্রের স্বাধীনতা দমন এবং বিরোধী মতের ওপর নিপীড়নের প্রতিবাদ।

বিক্ষোভে সবচেয়ে চোখে পড়ার মতো উদ্যোগ ছিল চতুর্দিকে বিশাল ব্যানারে সজ্জিত একটি ট্রাক। হাসিনা যে কয়দিন সিডনিতে ছিল এই ট্রাক সিডনির রাস্তায় রাস্তায় ঘুরে বেড়ায়। ট্রাকটির চারদিকে বিশাল বিশাল ব্যানারে ছবি ও কার্টুন সহ শেখ হাসিনার মানবাধিকার লঙ্ঘনের তথ্য আর ফ্যাসিবাদের বিরুদ্ধে বার্তা। শহরের সর্বত্র সেই ট্রাক ঘুরে বেড়াত আর সবাইকে চোখে আঙ্গুল দিয়ে দেখিয়ে দিত শেখ হাসিনার ফ্যাসিবাদী শাসনের আসল রুপ। সাধারণ মানুষ অবাক হয়ে তাকিয়ে থাকত। কেউ কেউ ভিডিও করত আবার কেউ কেউ ট্রাকের সাথে দাঁড়িয়ে ছবি তুলত।

একদিন তো শেখ হাসিনার গাড়িবহরের সামনেই আটকে গেল সেই ট্রাক। রাগে ফেটে পড়লো হাসিনা। চিৎকার করে ডাকল তার উজির, নাজির, সেপাই, সামন্তদের। কিন্তু তাদের কিছুই করার নেই। তার ফ্যাসিবাদী আচরণ তো আর অস্ট্রেলিয়ায় খাটে না। তবুও সে বাংলাদেশ হাইকমিশনের মাধ্যমে অস্ট্রেলিয়ার কর্তৃপক্ষকে অনুরোধ পাঠালো, যেন ট্রাকটা থামানো হয়। কিছুটা কাজ হলো। কর্তৃপক্ষ আমাদেরকে ভদ্রভাবে অনুরোধ করলো, আমরা যেন প্রতিবাদ ও বিক্ষোভ চালিয়ে যাই, শুধু ট্রাকের চলাফেরাটা একটু সীমিত রাখি।

আমাদের এই প্রতিবাদ সিডনির মূলধারার মিডিয়ার দৃষ্টি আকর্শন করে। এসবিএস ও চ্যানেল ৭-এর মতো গণমাধ্যম আমাদের সাক্ষাৎকার নেয়। জিজ্ঞেস করে, কী হয়েছে বাংলাদেশে? কেন আমরা এমন তীব্র প্রতিবাদ করছি? পুরস্কার বিতরণের অনুষ্ঠানে এক সাংবাদিক শেখ হাসিনার মানবাধিকার লঙ্ঘনের বিষয় তুলে ধরে আয়োজকদের জিজ্ঞেস করেন শেখ হাসিনাকে এই পুরস্কার কেন দেওয়া হচ্ছে ? আয়োজকেরা তাঁকে থামাতে চায়। এমন প্রশ্ন যেন না উঠে। সাংবাদিকও নাছোড় বান্দা।

এদিকে আন্দোলন যখন তুঙ্গে, হাসিনার নিরাপত্তার দায়িত্বে থাকা এক কর্নেল ফোন দিল ইউসুফ শামিম ভাইকে। জানতে চাইল, সুপ্রভাত সিডনির সম্পাদক ড. ফারুক আমিন কে? কোথা থেকে এলেন? কী করেন?

আসলে ফারুক আমিন তাদের নজরে পড়েছিলেন আরও আগে, ২০১৩ সালের শাহবাগ নাটকের সময়। পুরো দেশ যখন উন্মত্ত হয়ে “ফাঁসি চাই” স্লোগানে মেতে উঠেছিল, তখন তিনি অত্যন্ত গোপনে এই শাহবাগি উন্মত্ত স্রোতকে রোধ করতে গুরুত্বপুর্ণ ভূমিকা পালন করেন। দেশের সাধারণ মানুষ তখন কিছুই জানত না, কিন্তু হাসিনার গোয়েন্দারা টের পেয়ে যায়। শুরু হয় নজরদারি। এক সূত্র থেকে খবর পেয়ে আমি তাঁকে বলি, “দেশ ছাড়েন এখনই।”

তিনি তখন অস্ট্রেলিয়ায় পিএইচডি করছেন। গবেষণার কাজে দেশে এসে জড়িয়ে পড়েন শাহবাগের গণউন্মাদনায় পানি ঢেলে দেওয়ার এক বিপজ্জনক মিশনে। শাহবাগ ছিল হাসিনার বৃহৎ রাজনৈতিক প্রকল্প। ভারতের ছায়াতলে, দালাল মিডিয়ার সহযোগিতায়, রাষ্ট্রীয় মেশিনারির সর্বোচ্চ অপব্যবহার ঘটিয়ে নির্মিত এক কৃত্রিম জনস্রোত। সেই স্রোতে বাঁধ দিতে চাওয়া মানেই ছিল হাসিনার স্বপ্নে ছুরি চালানো। এই কাজের সম্মুখভাগে ছিলেন মাহমুদুর রহমান ও আমার দেশ পত্রিকা। আর নেপথ্যে ছিলেন ফারুক আমিনসহ আরও কয়েকজন সাহসী মানুষ। যা হোক, অস্ট্রেলিয়ার ভিসা তাঁর হাতে আগে থেকেই ছিল। আমার সতর্কবার্তা পেয়ে আর দেরি করেননি। ব্যাগপত্র গুছানোরও সময় হয়নি, এক কাপড়ে দ্রুত বেরিয়ে আসেন দেশ থেকে। কিভাবে বের হলেন সে আরেক রোমাঞ্চকর গল্প।

যাই হোক, এই আন্দোলন শুধু একটি প্রতিবাদ নয় একটি ঐতিহাসিক প্রতিরোধ ছিল। নানা মত, নানা পথের প্রবাসীরা এক হয়ে গিয়েছিল ফ্যাসিবাদের বিরুদ্ধে। দেশের মতই প্রবাসেও আমাদের মধ্যে নানা দল-মতের বিভাজন রয়েছে। তবুও এই আন্দোলনে আমার প্রাথমিক চেষ্টা ছিল এমন একটি পরিবেশ তৈরি করা, যেখানে ফ্যাসিবাদবিরোধী সব মত ও পথের মানুষ একটি অভিন্ন লক্ষ্যে একত্রিত হতে পারে। আমি শুরু থেকেই চেয়েছি, এটি যেন কোনো একটি নির্দিষ্ট দলের উদ্যোগ না হয়ে, সকল প্রবাসী বাংলাদেশির অংশগ্রহণে একটি সম্মিলিত প্রতিরোধ হয়ে ওঠে। তাই সিডনির আন্দোলনগুলো বিশ্বের অন্যান্য শহরের তুলনায় অনেক বেশি অন্তর্ভুক্তিমূলক হয়ে ওঠে।

সিডনির এই আন্দোলনের পর শেখ হাসিনা বুঝে ফেললো, দেশের মানুষকে তো গুম-খুনের ভয় দেখিয়ে চুপ করানো গেছে, কিন্তু প্রবাসীরা চুপ থাকবে না। দেশের বাইরে থেকে এরা তার স্বৈরশাসনের মুখোশ খুলে দেবে। আর তাই শুরু হয় নজরদারি। কারা প্রতিবাদ করেছে, কারা ভিডিওতে ছিল, কারা পোস্ট করেছে—সব তথ্য সংগ্রহ করা হয়। প্রবাসী আন্দোলনকারীদের নিয়ে আলাদা তালিকা তৈরি করা হয়। সেই তালিকা ঢুকিয়ে দেওয়া হয় ঢাকা এয়ারপোর্ট ইমিগ্রেশনের ডিজিটাল ফাইল সিস্টেমে, যাতে কেউ দেশে ফিরলেই তাঁকে গ্রেপ্তার করা যায়। এই ফ্যাসিবাদী দুর্নীতিতে সহযোগিতা করে প্রবাসী আওয়ামী সন্ত্রাসীরা এবং বাংলাদেশ হাইকমিশন। তখন হাইকমিশন রাষ্ট্রের প্রতিনিধি হওয়ার বদলে রীতিমতো দলের পোষা ক্যাডারদের মতো আচরণ করতে থাকে।

আমরা সিডনি থেকে আন্দোলনে শুধু সক্রিয়ই ছিলাম না, বাংলাদেশে নিপীড়ন, গুম, বিচারবহির্ভূত হত্যা, সেন্সরশিপ আর মিডিয়ার ওপর দমননীতি নিয়ে নিয়মিতভাবে বিভিন্ন মিডিয়ায় লিখে যাচ্ছিলাম। বাংলাদেশ হাইকমিশন থেকে ফোনে ধমক-টমক দিয়েও খুব একটা লাভ হয়নি। হাসিনার সিডনি সফর ও প্রবাসী বাংলাদেশিদের বিশাল প্রতিবাদ নিয়ে Australasian Muslims Times তাদের প্রথম পাতায় বড় একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করে। হেডলাইন ছিল — “Beware of Despot: Sydney Protests Against Sheikh Hasina”. এই প্রতিবেদন ছাপা হতেই অস্ট্রেলিয়ায় নিযুক্ত বাংলাদেশ হাইকমিশনার সংবাদপত্রটির সম্পাদককে ফোন দেন। কিন্তু তাতেও কিছু হয়নি। কারণ, এ দেশের মানুষরা শেখ হাসিনাকে চিনে ফেলেছিল অনেক আগেই। যখন বিচারিক মঞ্চে রাজনৈতিক হত্যাযজ্ঞ তখন থেকেই। সেসময় মসজিদে মসজিদে ইমামরা ভিকটিম নেতাদের জন্য দোয়া করতেন এবং বাংলাদেশের জনগণের মুক্তির জন্য প্রার্থনা করতেন। একবার পাঞ্চবোউল মসজিদের ইজিপশিয়ান ইমাম দোয়া শেষ করার পর এক আওয়ামী দালাল তাঁকে ধরে বসে, “আপনি দোয়া করলেন, আপনি কি বাংলাদেশ সম্পর্কে কিছু জানেন?” তিনি শান্তভাবে জবাব দেন, “হ্যাঁ, জানি। এবং খুব ভালো করেই জানি।”

কোনোভাবেই মুখ বন্ধ করাতে না পেরে, শেষ পর্যন্ত দেশে আমাদের বিরুদ্ধে ডিজিটাল সিকিউরিটি আইনে মামলা করে। আর সেই মামলার জের ধরেই হাসিনা পালানোর পর দেশে ফিরতে গিয়ে গ্রেফতার হন ইউসুফ শামিম ভাই।

এরপরের দিনগুলো ছিল যেন এক যুদ্ধের প্রস্তুতি। একদিকে অস্ট্রেলিয়ার মূলধারার রাজনীতি ও মানবাধিকার সংগঠনগুলোর সাথে যোগাযোগ, অন্যদিকে প্রবাসী বাংলাদেশিদের ঐক্যবদ্ধ করার প্রচেষ্টা। আমি তখন সাউথ এশিয়ান পলিসি ইনিশিয়েটিভ (SAPI)-এর সাধারণ সম্পাদক, আর ড. মাহমুদুর রহমান সংগঠনের প্রেসিডেন্ট। আমাদের এই ভূমিকা নিয়ে আমরা এগিয়ে যাই আরও বড় কিছুর দিকে।

বিএনপি অস্ট্রেলিয়ার প্রায় সকল গ্রুপ, জামায়াত ইসলামির সমর্থক ও অন্যান্য প্রবাসী বাংলাদেশিদেরকে সাথে নিয়ে আমরা যোগাযোগ শুরু করি অস্ট্রেলিয়ার পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সাথে। বিশেষ করে, ফেডারেল পার্লামেন্টের গুরুত্বপূর্ণ কিছু সদস্য, যেমন পররাষ্ট্রমন্ত্রী পেনি ওয়ং, মন্ত্রী টনি বার্ক, এবং শ্যাডো ফরেন মিনিস্টার সায়মন বার্মিংহাম। তাঁদের সাথে একাধিকবার বৈঠক ও বাংলাদেশের ফ্যাসিবাদী পরিস্থিতি নিয়ে প্রতিবেদন জমা দেওয়া হয়। গ্রিন দলের ডেভিড শুব্রিজ, জ্যানেট রাইস এবং অ্যাডাম ব্যান্ডিটের মতো মানবাধিকারকর্মী সংসদ সদস্যরাও আমাদের পাশে দাঁড়ান। তাঁদের মধ্যে কেউ কেউ বাংলাদেশের পরিস্থিতি নিয়ে সংসদে বক্তব্য দেন, কেউ আবার প্রস্তাব উত্থাপন করেন।

এরই মধ্যে আমরা আয়োজন করি এক ঐতিহাসিক বিক্ষোভের। ২০২৪ সালের ২১ জুলাই, সিডনির রাস্তায় হাজারো মানুষ নেমে আসে বাংলাদেশের ছাত্র-জনতার ওপর চালানো নিপীড়নের বিরুদ্ধে। বাংলাদেশে শহিদদের জন্য এক গায়েবানা জানাজার আয়োজন করা হয়, যেখানে চোখের জলে আর শ্লোগানে প্রকম্পিত হয়ে ওঠে সিডনি শহর। এই আয়োজন নিয়ে খবর ছাপে AMUST, শিরোনাম করে—“Brutal Crackdowns on Students in Bangladesh: Unprecedented Reactions in Australia”। এই বিক্ষোভের মুখ্য পরিকল্পনায় ছিলেন বিএনপি নেতা মোসলেহ উদ্দিন আরিফ, হাবিব রহমান, মুন্নি চৌধুরী মেধা এবং সাথে ছিলেন আবুল হাসান, এ এন এম মাসুম ও আরও অনেকে। জানাজা নামাজ পড়ান সেন্ট মেরিস মসজিদের ইমাম শেইখ আবু হুরাইরা।  অংশ নেন সকল বয়সের সকল প্রবাসী বাংলাদেশীরা এমনকি ছোট ছোট বাচ্চাদের কাঁধে নিয়ে বাবারাও অংশ নেন।

এই আন্দোলনের প্রভাব এতটাই ছিল যে বাংলাদেশের ঘটনাগুলো নিয়ে অস্ট্রেলিয়ার পার্লামেন্টেও আলোচনার ঝড় ওঠে। ডেভিড শুব্রিজ জাতীয় সংসদে বাংলাদেশে মানবাধিকার লঙ্ঘনের বিরুদ্ধে একটি প্রস্তাব পেশ করেন। জ্যানেট রাইস তার দীর্ঘ বক্তৃতায় বাংলাদেশের নিপীড়নের চিত্র তুলে ধরেন। এমনকি প্রধানমন্ত্রী অ্যান্থনি অ্যালবানিজও উদ্বেগ প্রকাশ করেন বাংলাদেশের পরিস্থিতি নিয়ে।

একই সময়ে আমরা যোগাযোগ করি জাতিসংঘ, আমেরিকার স্টেট ডিপার্টমেন্ট এবং ওয়ার্ল্ড ব্যাংকের সাথে। ড. মাহমুদুর রহমানের পক্ষে আমি SAPI-র সাধারণ সম্পাদক হিসেবে এসব আন্তর্জাতিক মহলে প্রাতিষ্ঠানিক বার্তা পাঠাই, প্রতিবেদন দিই।

আমরা শুধু তা-ই করিনি, আমরা সিডনি থেকেই সমন্বয় করি আন্তর্জাতিকভাবে পালিত কয়েকটি বড় কর্মসূচির—যেমন ৩০ আগস্টের গুম প্রতিরোধ দিবস এবং ১০ ডিসেম্বরের আন্তর্জাতিক মানবাধিকার দিবস। ২০২২ ও ২০২৩ সালে এই দিবসগুলো একযোগে পালিত হয় নিউইয়র্ক, লন্ডন, প্যারিস, টরেন্টোসহ বিভিন্ন শহরে। এর কেন্দ্রীয় সমন্বয়ের দায়িত্ব ছিল সিডনি থেকে আমার ওপর, আর নেতৃত্বে ছিলেন সেসময় ইস্তানবুল প্রবাসী আমার দেশ সম্পাদক ড. মাহমুদুর রহমান।

২০২২ সালের আগস্ট মাসে আমরা গুমের শিকার মানুষদের স্মরণে একটি রোড-শো আয়োজন করি। ১৯ আগস্ট থেকে ৩০ আগস্ট পর্যন্ত চলে এই প্রচারণা। শহরের বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ মোড়ে মোড়ে প্ল্যাকার্ড আর ব্যানার নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকেন কর্মীরা, বিলি করা হয় লিফলেট। ৩০ আগস্ট, সিডিনির মার্টিন প্লেসে গুমের বিরুদ্ধে র‍্যালি ও প্রতিবাদ সমাবেশে বহু প্রবাসী অংশ নেন। বাংলাদেশিরা ছাড়াও আরও প্রায় ১৫টি বিভিন্ন কম্যুনিটি ও সংগঠন এতে অংশ নেন। সাউথ এশিয়ান পলিসি ইনিশিয়েটিভের সাথে এমনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল, অস্ট্রেলিয়াও এতে যোগ দেন। একই দিনে সারা বিশ্বের বিভিন্ন শহরেও পালন করা হয় এই কর্মসূচি।

এরপর আসে ২০২২ সালের ১০ ডিসেম্বর—  আন্তর্জাতিক মানবাধিকার দিবস। আমরা সিডিনিতে এক গোলটেবিল বৈঠকের আয়োজন করি, যেখানে প্রবাসী সমাজের বুদ্ধিজীবী, সাংবাদিক, রাজনৈতিক নেতারা বাংলাদেশের মানবাধিকার লঙ্ঘন, গুম, হত্যা এবং এর বিরুদ্ধে আন্তর্জাতিক নিষেধাজ্ঞার প্রয়োজনীয়তা নিয়ে আলোচনা করেন।

২০২৩ সালের ২৬ জুন, জাতিসংঘ ঘোষিত নির্যাতনবিরোধী দিবসে আমরা আয়োজন করি একটি ওয়েবিনার। সেখানে বাংলাদেশে রাষ্ট্রীয় নির্যাতনের শিকার পরিবারের সদস্যরা তাঁদের বেদনার কথা জানান। এই কথাগুলোই ছিল সবচেয়ে শক্তিশালী প্রতিবাদ। চোখের জল ও কণ্ঠের কাঁপুনি যেন ট্রুথ কমিশনের নীরব সাক্ষ্য।

২০২৩ সালের ১০ সেপ্টেম্বর আমরা সিডনিতে আয়োজন করি এক সাংস্কৃতিক প্রহর—‘Cultural Vigil’। সেখানে কবিতা, গান আর আলোকচিত্র প্রদর্শনীর মাধ্যমে আমরা স্মরণ করি গুমের শিকারদের। একই অনুষ্ঠানে আমরা শপথ নেই, এই লড়াই থামবে না।

২০২৩ সালের ১ অক্টোবর SAPI একটি গবেষণা প্রতিবেদন প্রকাশ করে। শিরোনাম ছিল, “Bangladesh Awami League: A Study of its Politics and Crimes Against Humanity”। এতে আমরা তুলে ধরি, কীভাবে আওয়ামি লীগ রাজনৈতিক প্রতিপক্ষ দমন করতে গিয়ে প্রকৃতপক্ষে উগ্রপন্থার জন্ম দিচ্ছে এবং সন্ত্রাসকেই রাজনৈতিক হাতিয়ার হিসেবে ব্যাবহার করছে।

এছড়াও ইংরেজিতে বিভিন্ন ভিডিও ডকুমেন্টারির মাধ্যমে আমরা হাসিনার সর্বগ্রাসী দুর্নিতি, গুমখুন ও নিপীড়নের চিত্র তুলে ধরি। কয়েকটি উল্লেখযোগ্য ডকুমেন্টারি ছিল – The Thieves of Dhaka : A Tale of Grand Corruption in Bangladesh; Enforced Disappearances in Bangladesh: A Shame for Humanity Everywhere; Is Democracy Dying in Despot’s Detention? ইত্যাদি।

এই পুরো সময়জুড়ে আমরা যেমন প্রতিবাদ করেছি, তেমনি প্রমাণ রেখেছি যে প্রবাস থেকেও সঙ্ঘবদ্ধভাবে সংগঠন, দিকনির্দেশনা, এবং কৌশল নির্ধারণ করা যায়। আমাদের পাশে ছিল CPJP, বিএনপি, জামায়াতে ইসলামী, ইউনূস সেন্টারসহ প্রবাসী বুদ্ধিজীবী ও পেশাজীবীদের সংগঠন।

এই পুরো কাহিনি যেন এক দীর্ঘ স্বপ্নযাত্রার মতো। কখনো ক্লান্তি এসেছে, কখনো হতাশা; কিন্তু আমরা জানি শুধু বাংলাদেশের নয়, এটি মানবতার সংগ্রাম। ইতিহাস একদিন লিখবে—অস্ট্রেলিয়ার সিডনি শহরেও একদল প্রবাসী বাংলাদেশি ফ্যাসিবাদের বিরুদ্ধে এক দীপ্ত প্রতিরোধ গড়ে তুলেছিল।

 

(লেখক: অস্ট্রেলিয়া প্রবাসী একাডেমিক, রাজনৈতিক বিশ্লেষক, মানবাধিকার কর্মী ও এক্সিকিউটিভ ডাইরেক্টর, সাউথ এশিয়ান পলিসি ইনিশিয়েটিভ)    

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *