728 x 90

বোধ: আহমদ রাজু

জনি বরাবরই এমন ছিল না। কিছুদিন আগেও মা যখন যা বলেছে সে তখন তাই-ই করেছে অবলীলায়। বসতে বললে বসেছে- উঠতে বললে উঠেছে। কখনও মায়ের কথার অবাধ্য হয়নি। অথচ আজ সে মায়ের মুখে মুখে তর্ক করে বাড়ি থেকে বেরিয়েও গিয়েছে। মা তাকে ফেরানোর চেষ্টাটুকুও করেনি। যদিও তার মায়ের বুকের ভেতরটা ধুধু মরুভূমি হয়ে গিয়েছে তবুও সে

জনি বরাবরই এমন ছিল না। কিছুদিন আগেও মা যখন যা বলেছে সে তখন তাই-ই করেছে অবলীলায়। বসতে বললে বসেছে- উঠতে বললে উঠেছে। কখনও মায়ের কথার অবাধ্য হয়নি। অথচ আজ সে মায়ের মুখে মুখে তর্ক করে বাড়ি থেকে বেরিয়েও গিয়েছে। মা তাকে ফেরানোর চেষ্টাটুকুও করেনি। যদিও তার মায়ের বুকের ভেতরটা ধুধু মরুভূমি হয়ে গিয়েছে তবুও সে নিশ্চুপ! মা শুধু ফেলে আসা সময়ের কথা মনে করে নীরবে চোখের জল ফেলেছে। শুধু এই সন্তানের জন্যেই জীবনের সব সুখ-আনন্দকে জলাঞ্জলি দিয়ে বাবার বাড়িতে পড়ে থাকা!

জনির বয়স যখন তিন বছর তখন তার বাবা দ্বিতীয় বিয়ে করে নতুন বউ ঘরে নিয়ে আসে। বাড়িতে প্রবেশ করে প্রথমেই রুমাকে অর্থাৎ জনির মা’কে তালাক দেয়। রুমার মুহূর্তে মাথায় আকাশ ভেঙে পড়লেও চোখের জল ফেলতে ফেলতে ছেলেকে নিয়ে বাপের বাড়ি চলে আসে সেদিনই। রুমার বাবা সামান্য মুদি দোকানী। তার পক্ষে এতবড় ধাক্কা সামাল দেওয়া কষ্টকর হলেও সে নিজেকে দক্ষ পিতার মত সামলে নেয়। সে মেয়ে সান্ত্বনা দিয়ে বলে, “ভাল হয়েছে মা; আল্লাহ যা করেন তা মঙ্গলের জন্যেই করেন।”

বাবার বুকে মুখ গুজে রুমা ফুপিয়ে কাঁদতে কাঁদতে বলে, “আমার এখন কী হবে বাবা? আমার তো সব শেষ হয়ে গেল!”

মেয়ের মাথায় হাত বোলাতে বোলাতে তার বাবা বলে, “আমি আছি তো। তোর বাবা এখনও মরে যায়নি।”

বাবার কথায় রুমা শাড়ির আঁচল দিয়ে চোখের পানি মুছে একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বলে, “জনির ভবিষ্যৎ কি? ওকে আমি এখন কীভাবে মানুষ করবো?”

“জনি তোর পরিচয়ে মানুষ হবে। ওকে মানুষের মতো মানুষ করা তোর এখন নৈতিক কর্তব্য।” বাবার কথায় নিজের মনকে শক্ত করে আগামীর পথের দিশা খুঁজতে ব্যস্ত হয়ে পড়ে রুমা।

দিনের সাথে পাল্লা দিয়ে দ্রব্যমূল্য লাগাম ছাড়া হয়ে পড়ে। তিন টাকার জিনিস তের টাকায় কিনতে হচ্ছে। মুদি দোকানের আয় দিয়ে সংসার যেন আর চলতেই চায় না। একদিন রুমার বাবা তাদের সাথে আলোচনা করে পৈত্রিক ভিটে বাড়িটা বিক্রি করে ভাড়া বাড়িতে থাকতে শুরু করে। কিছু টাকা দিয়ে দোকানের মালামাল কেনে। বাকী ত্রিশ লক্ষ টাকা সে রুমা আর তার মায়ের নামে ব্যাংকে রেখে দেন। ঐ টাকার লভ্যাংশ বাবদ ব্যাংক থেকে মাসে যে পঁচিশ হাজার টাকা আসে তা দিয়ে ঘরভাড়াসহ সংসারের সিংহভাগ কোনরকম পূরণ হয়। শুধুমাত্র দোকানের আয় থেকে মাসের চাউলটা সে বাড়ি পাঠায়।

জনি এখন অস্টম শ্রেণীতে পড়লেও বয়সের তুলনায় দিন দিন তার চাহিদা বৃদ্ধি পায়। কখনও ভাল মোবাইল সেট, কখনওবা দামী জামা-কাপড়-জুতা। যা তার মায়ের পক্ষে সব সময় পূরণ করা সম্ভব হয়ে ওঠে না। সংসার খরচ থেকে বাঁচিয়ে যথাসম্ভব ছেলের আবদার মেটাতে চেষ্টা করে। শুধু যে আবদার তা নয়, সঙ্গদোষটা প্রবল হয়ে উঠছে। প্রায় মাঝ রাতে বাড়ি ফেরে। মোবাইলে সারাক্ষণ আজেবাজে ভিডিও দেখে- গেইম খেলে। কোন কোনদিন স্কুলও ফাঁকি দেয়। যা নিয়ে মায়ের সাথে তার প্রতিনিয়ত ঝগড়াঝাটি লেগেই থাকে। সে বোঝে না- তাদেরকে তার বাবা তাড়িয়ে দিয়েছে বহু আগে। নিজের ছেলের খবর পর্যন্ত নেয়নি! তার মা তাকে নিয়ে থাকে নানা বাড়িতে। আজ যখন সে বাড়ি ফিরবে না বলে ঘর থেকে বেরিয়ে যায় তখন রুমা তাকে ঠেকাতে চেষ্টাটুকুও করেনি। উপরোন্ত নিজের ওপর ধিক্কার দেয়- কী করলাম এতবছর? যার মুখের দিকে তাকিয়ে নিজেকে তীলে তীলে শেষ করলাম; সে-ই তাকে তুষের আগুণের মতো জ্বালাচ্ছে! নতুন করে সংসার শুরু করতে বাবা-মা তাকে অনেকবার বুঝিয়েছে, সে রাজী হয়নি। সে সবসময় বলেছে, আমি যদি আবার বিয়ে করি তাহলে জনির কী হবে? আমি জনিকে ছাড়া কোনদিন কিছু ভাবতেই পারবো না। ওযে আমার সমস্ত আশা ভরসা।

জনি বাড়ি থেকে বেরিয়ে গাড়িতে উঠে সোজা যায় যশোর শহরে। তার বন্ধু শিমুলকে ফোন করে জানায় গাড়িখানার চায়ের দোকানে আসার জন্যে। বন্ধুর জন্যে চায়ের দোকানের সামনে দাঁড়িয়ে অপেক্ষায় সে। হঠাৎ অদূরে মাঝবয়সী একটা লোকের দিকে চোখ যায় তার। চিত্রার মোড় থেকে সে হেঁটে আসছিল। কোলে তার দুই থেকে আড়াই বছরের একটা বাচ্চা ছেলে। ছেলেটা কিছু একটা নিয়ে বায়না ধরে কান্নাকাটি করছে- হাত পা ছড়াচ্ছে। লোকটি তার বাবা নিশ্চয়। সে হাঁটতে হাঁটতে ছেলেটির কান্না থামাতে চেষ্টা করে। কোন ভাবেই তার কান্না থামে না। ততক্ষণে জনির থেকে দশ-বারো হাত দূরে চলে এসেছে। এমন সময় ছেলেটি তার বাবার মুখে স্বভাব সুলভ কোমল হাত দিয়ে একটা চড় দেয়। তখনই লোকটি বাচ্চাটাকে বুকের সাথে বাম হাত দিয়ে চেপে ধরে ডান হাত দিয়ে দুমাধুম পিঠে- মাথায়- ঘাড়ে কয়েকটি কিল-চড়-থাপ্পড় মেরে কোল থেকে সরিয়ে থপাস করে রাস্তার ওপর ফেলে দেয়। যেন কিছু হয়নি। লোকটি সামনের দিকে স্বাভাবিকভাবে হেঁটে চলে যায়! যেমন করে আমরা মুখ মুছে টিস্যুটাকে ফেলে দিয়ে সেদিকে ফিরেও তাকাই না; ঠিক তেমন।

রাস্তার ওপর পড়ে ছেলেটির কান্না কয়েক সেকেন্ডের জন্যে বন্ধ হয়ে গেলেও পরক্ষণে তার কান্নার মাত্রা আরো বৃদ্ধি পায়। সে চিৎকার করে কাঁদে। অদূরে একটি মহিলাকে আসতে দেখে জনি। যার এক হাতে একটি মাঝারী সাইজের ব্যাগ আর এক হাত দিয়ে ধরা ছয় থেকে সাত বছরের একটি মেয়ের হাত। মহিলাটির চোখে মুখে এক করুণ ভালবাসার চিত্র ফুটে ওঠে যা জনির চোখ এড়ায় না। মহিলাটি নিশ্চয় তার মা। কাছে এসে ব্যাগটা রাস্তার ওপর রেখে ছেলেটিকে কোলে তুলে নিয়ে চোখে-মুখে চুমু দেয় পরম মমতায়। তার কান্না থামে না। সে এক হাতে ছেলেটিকে বুকের সাথে জাপটে ধরে অতিকষ্টে অন্য হাতে মেয়েটির হাত আর ব্যাগ ধরে একসময় জনির সামনে দিয়ে দড়াটানায় ভিড়ের মাঝে অদৃশ্য হয়ে যায়।

ছোট্ট ছেলেটাকে বাবা এভাবে চড়-থাপ্পড় মেরে টিস্যু পেপারের মতো রাস্তায় ফেলে চলে যেতে পারলেও মা তাকে পরম মমতায় কোলে তুলে নেয়- দুই তিন মিনিটের এমন মহা বাস্তব দৃশ্য চোখের সামনে ঘটে যাওয়ায় জনির বুকের ভেতরটা মোচড় দিয়ে ওঠে। তার মায়ের করুণাভরা মুখটা মনে পড়ে। বন্ধুর অপেক্ষায় না থেকে যখন সে বাড়ির দিকে পা বাড়ায় তখন সন্ধ্যা সাতটা।

Read More

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked with *

সর্বশেষ পোস্ট

Advertising