সামসুল ইসলাম টুকু : গতডিসেম্বর/২৩ এ জাতিসঙ্ঘের জলবায়ু বিষয়ক ২৮তম বৈশ্বিক সম্মেলন বা ক্লাইমেট চেঞ্জ কনফারেন্স অনুষ্ঠিত হয়ে গেল দুবাইয়ে । এবারের সম্মেলনে একটি নতুন চুক্তির বিষয়ে সবাই ঐক্যমতে পৌছেছে বলে জানা গেছে ।সম্মেলনে অংশ গ্রহনকারী ১৯৮টি দেশ তেল গ্যাস ও কয়লার মত জীবাশ্ম জ্বালানী থেকে বেরিয়ে আসার বিষয়ে ঐক্যমত । তবে সেটা যে
সামসুল ইসলাম টুকু : গতডিসেম্বর/২৩ এ জাতিসঙ্ঘের জলবায়ু বিষয়ক ২৮তম বৈশ্বিক সম্মেলন বা ক্লাইমেট চেঞ্জ কনফারেন্স অনুষ্ঠিত হয়ে গেল দুবাইয়ে । এবারের সম্মেলনে একটি নতুন চুক্তির বিষয়ে সবাই ঐক্যমতে পৌছেছে বলে জানা গেছে ।সম্মেলনে অংশ গ্রহনকারী ১৯৮টি দেশ তেল গ্যাস ও কয়লার মত জীবাশ্ম জ্বালানী থেকে বেরিয়ে আসার বিষয়ে ঐক্যমত । তবে সেটা যে সবাই নিরঙ্কুসভাবে মেনে নিয়েছে এমনটা বলা যায়না । কারন হঠাৎ করে জীবাশ্ম জ্বালানী থেকে বেরিয়ে আসা সম্ভব নয় কোন দেশের পক্ষেই। বিভিন্ন দেশের ব্যবসা বানিজ্য সহ উন্নয়ন জীবাশ্ম জ্বালানীর উপর নির্ভর করেই দাঁড়িয়ে আছে। তাই এ ব্যাপারে কোন সময় সীমাও বেঁধে দেওয়াও সম্ভব হয়নি । সম্মেলনে বলা হয়েছে বৈশ্বিক নবায়নযোগ্য জ্বালানী সক্ষমতা ৫০% বেড়েছে এবং পাশাপাশি সোলার বিদ্যুৎ প্রকল্প ক্রমশ বৃদ্ধি পাচ্ছে ।গত বছর মিশরে অনুষ্ঠিত ২৭ তম জলবায়ু সম্মেলনেও অংশ গ্রহণ করে ১৯৮ টি দেশের সরকারী প্রতিনিধি,এনজিও কর্মী, জলবায়ু কর্মী্,পরিবেশবিদ , বিজ্ঞানী ও সাংবাদিকগন ।সেখানে জলবায়ু সম্মেলনে ক্ষতিগ্রস্থ দেশগুলকে অর্থ সহায়তা দেবার জন্য তহবিল গঠনের ক্ষেত্রে ঐক্যমত হয় । দীর্ঘ ২৮ বছরে বিশ্ব জলবায়ু সম্মেলনে উল্লেখিত দূটি অর্জন এযাবৎ কালের সবচেয়ে বড় অর্জন বলেও মনে করা হচ্ছে । তবে এগুলো জাতিসংঘের শীর্ষ সম্মেলনে চুড়ান্ত ও বিস্তৃত চুক্তি হিসেবে উপস্থাপন করার জন্য একটি পুর্নাঙ্গ অধিবেশন প্রয়োজন । যেখানে ভোটা ভুটিতে অনুমোদিত হবে ।
সম্মেলনে জাতিসংঘের মহাসচিব আন্তেনিও গুতেরাস বরাবরের মতই বলেন, জলবায়ু বিপর্যয়ের কারনে যুদ্ধের চেয়েও তিনগুন মানুষ ক্ষতিগ্রস্থ হচ্ছে এবং বিশ্বে এক উদ্বেগজনক পরিস্থিতি বিরাজ করছে । বন্যায় পাকিস্তানের এক তৃতীয়াংশ পানির নিচে তলিয়ে যায় , গ্রীষ্ণকালে এত গরম গত ৫০০ বছরেও দেখেনি ইউরোপবাসী ,এ পর্যন্ত বিশ্বের সবচেয়ে উষ্ণ বছর হিসেবে ২০২৩ সালকে চিহ্নিত করা হয়েছে । খরা বন্যা অতিবৃষ্টি ও ঘুর্নিঝড়ে নাস্তানাবুদ ফিলিপাইন, হারিকেন ইয়ানের তান্ডবে লন্ডভন্ড হয়ে যায় যুক্তরাষ্ট্রের অঙ্গরাজ্য ফ্লোরিডা। পৃথিবীর অর্ধেক মানব জাতি ঝুঁকির মধ্যে বাস করছে। ক্রমবর্ধমান গ্রীনহাউস নিঃসরন বৈশ্বিক উষ্ণতাকে তরান্বিত করছে
জলবায়ু পরিবর্তনের বিরূপ প্রভাব কিভাবে মোকাবেলা করা যায় তা নিয়ে উদ্বিগ্ন বিশ্ব নেতাদের এই সম্মেলনে প্রকৃতি, খাদ্য , পানি , কার্বন নি;সরন ও জলবায়ু এই ৫ টি বিষয় নিয়ে তারা মতামত তুলে ধরেন । অবশ্য এটি নতুন কথা নয় । ১৯৯৫ সালে বার্লিনে প্রথম জলবায়ু সম্মেলন থেকে শুরু করে গত ২৮ বছর ধরেই এই ক্রমবর্ধমান সমস্যার কথা তুলে ধরা হচ্ছে । আর প্রতি বছরই বৈশ্বিক উষ্ণতার জন্য দায়ী ধনী প্রভাবশালী ওশিল্পোন্নত দেশের নেতারা অনেক কিছু অঙ্গিকার করে । কিন্তু কোন অঙ্গিকার পালন করেনা এবং সমস্যার সমাধান হয়না । ২০১৫ সালে কয়েকটি দেশের সরকার , ব্যবসায়ী নেতা ও সিভিল সোসাইটির এক্টিভিষ্টরা মিলে একটি গুরুত্বপুর্ন পদক্ষেপ গ্রহণ করেছিল এবং তারা প্যারিস চুক্তি নামে একটি চুক্তিতে স্বাক্ষর করেছিল । এতে বলা হয় বৈশ্বিক উষ্ণতা মোকাবেলায় ও গ্রীনহাউস নিঃসরন কমাতে তারা বৈশ্বিক তাপমাত্রা বৃদ্ধি ২ ডিগ্রী সেলসিয়াসের নিচে রাখতে পদক্ষেপ নেবেন এবং একইসাথে ২০৩০ সালের মধ্যে কার্বন নিঃসরন ৫০% কমিয়ে ফেলার উদ্যোগ নিবে । কয়লা ভিত্তিক বিদ্যুতকেন্দ্র ধীরে ধীরে বন্ধ করবে ,মিথেন গ্যাস নিঃসরন কমাবে , বন উজাড় কার্যক্রম বন্ধ করবে এবং জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবেলায় আরও গুরুত্বপুর্ন পদক্ষেপ নেওয়ার বিষয়ে সম্মত হয় । কিন্তু দু;খের বিষয় আজ পর্যন্ত ঐ দেশগুলকে তাদের দেওয়া অঙ্গিকার অনুযায়ী কোন কাজ করতে দেখা যায়নি । এর ফলে ২০২২, ২০২৩ সাল এযাবতকালের সবচেয়ে উষ্ণ বছরের তালিকায় স্থান করে নিয়েছে । একারনে জলবায়ু এক্টিভিষ্টটরা জলবায়ু সম্মেলনকে অকার্যকর বলে আসছে । তাছাড়া জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবেলায় ধনী দেশগুলো যেসব অঙ্গীকার করে তা বাস্তবায়ন না করার জন্য তাদের কারোর কাছে জবাবদিহি করতে হয়না । ফলে জলবায়ু সম্মেলনে আজ পর্যন্ত কোন ইতিবাচক ফলাফল দেখা যায়নি ।
বিশ্বের ৪০টি ধনী প্রভাবশালী ও শিল্পোন্নত দেশ প্রায় এক শতাব্দীর বেশী সময় ধরে জীবাশ্ম জ্বালানী চালিত শিল্পায়নে বিনিয়োগ করে আসছে। এতে গ্রীনহাউস গ্যাস নিঃসরনের মাধ্যমে বৈশ্বিক উষ্ণতা বেড়ে চলেছে । এবং তাদের কারনেই আজ জলবায়ু বিপর্যয়ের সম্মুখিন ।
বর্তমানে চীনকে বিশ্বে সবচেয়ে বেশী কার্বন নিঃসরনকারী দেশ হিসেবে চিহ্নিত করা হয় । এবছর গ্রীষ্ণে দেশটির তাপমাত্রা ছিল ইতিহাসের সর্বোচ্চ। বিষয়টি চীন সরকারও স্বীকার করে ।চীনের পর উদ্বেগজনক মাত্রায় গ্যাস নিঃসন করে যুক্তরাষ্ট্র। এ বিষয়ে তারা জ্ঞাত। এজন্য দেশটির আইন প্রনেতারা জীবাশ্ম জ্বালানী কমিয়ে নবায়নযোগ্য জ্বালানিতে কয়েক কোটি ডলার ব্যয় করতে সম্মত হয় । যেন প্রতি বছর এক বিলিয়ন টন কার্বন নিঃসরন কমাতে পারে ।এদিকে ইউরোপ ইউনিয়নভুক্ত ২৭ টি দেশ ৮ শতাংশ গ্রীনহাউস গ্যাস নিঃসরন করে । তারাও ২০৩০ সালের মধ্যে ৫৫ শতাংশ কার্বন নিঃসরন কমানো এবং ২০৫০ সালের মধ্যে তা শূন্যে নিয়ে আনার অঙ্গিকার ব্যক্ত করে ।এ ব্যাপারে হয়তো উন্নত দেশগুলোর চেষ্টা আছে । ওপেক দেশগুলি যদি নবায়নযোগ্য জ্বালানীর কথা ভাবে তাহলে তাদের তেল বিক্রি বন্ধ হয়ে যাবে। ফলে তারাই আবার জ্বালানী নিরাপত্তার অজুহাতে কয়লার ব্যবহার বাড়িয়ে দিয়েছে । যার অর্থ হচ্ছে কার্বন নিঃসরনের জন্য দায়ী বহুজাতিক কোম্পানিগুলোর বিরুদ্ধে তারা আপাতত যাচ্ছেনা ।কারন কয়লার ব্যবহার বন্ধ করলে তাদের শিল্প কল কারখানায় উৎপাদিত পন্যের দাম বৃদ্ধি পাবে এবং প্রতিযোগিতায় বিশ্ব বাজার থেকে ছিটকে পড়বে। তাই তারা জলবায়ু পরিবর্তনের লক্ষ্য অর্জনের পথে তাদের কার্যক্রম চালাবেনা ।
অথচ কি বিচিত্র বিষয় যে কোন না কোন বহুজাতিক কোম্পানী জলবায়ু সম্মেলনকে স্পন্সর করে ।তারা সম্মেলনের আয়োজকের ভুমিকা পালন করে । যেমন মিশরে জলবায়ু সম্মেলনের স্পন্সর করেছে কোকা কোলা কোম্পানি। আর ইতোপুর্বে ইউনিলিভার, এম ডাব্লিউ ডি, বিএনপি সহ অন্যান্য বহুজাতিক কোম্পানী স্পন্সর করেছিল। উল্লেখিত কোকাকোলা কোম্পানি প্রতি বছর ১২ হাজার কোটি বোতল উৎপাদন করে। পরিবেশের জন্য অত্যান্ত ক্ষতিকর এসব প্লাষ্টিকের ৯৯ শতাংশ জীবাশ্ম জ্বালানী থেকে তৈরী করা হয় । বিশ্বের এক নম্বর প্লাষ্টিক দুষনকারি হিসেবে চিহ্নিত এই কোম্পানিটি । সম্মেলনে অংশ গ্রহনকারী গরীব দেশগুলোর পক্ষ থেকে এই স্পন্সরকে রীতিমত সন্দেহের চোখে দেখা হয়। পরিবেশবিদরা ক্ষোভ প্রকাশ করে ।অন্যদিকে ধনী শিল্পোন্নত দেশগুলো মুখে কুলুপ এঁটে থাকে ।
ধনী শিল্পোন্নত দেশগুলো কর্তৃক জীবাশ্ম জ্বালানির যথেচ্ছে ব্যবহার ,মত্রাতিরিক্ত কার্বন নিঃসরন এর কারনে বৈশ্বিক উষ্ণতার মাত্রা বৃদ্ধি , জলবায়ুর উপর বিরূপ প্রভাব , মানবজাতি প্রভুত ক্ষতির শিকার , এর প্রতিকার পেতে কি কি ব্যবস্থা গ্রহণ করা যেতে পারে সে সম্পর্কিত নতুন নতুন গবেষনা প্রতিবেদন প্রতি বছরই এই জলবায়ু সম্মেলনে উপস্থাপন করেন পরিবেশ বিজ্ঞানীরা । শুধু তাইনয় জলবায়ু বিপর্যয়ের জন্য কোন কোন ধনী দেশ কি পরিমাণ দায়ী এবং কোন কোন গরীব দেশ কি পরিমাণ ক্ষতিগ্রস্থ হয়েছে ও হচ্ছে তার ফলাফলও এই সম্মেলনে উপস্থাপন করা হয় ।এসব নিয়ে গত ২৮ বছর ধরে আলোচনা হয়েছে দিনের পর দিন। প্রতি বছরই সম্মেলনেই আলোচনা হয়েছে প্রায় দুসপ্তাহ ধরে। কিন্তু ধনী দেশগুলো এবং বহুজাতিক কোম্পানীগুলোকে তাদের জলবায়ু ক্ষতিকারক কার্যক্রম থেকে বিরত করা সম্ভব হয়নি । কারন পুর্বেই বলা হয়েছে যে তাদের জবাবদিহি নেওয়ার ক্ষমতা নেই গরীব দেশগুলোর । এজন্য গরীব দেশগুলো আন্তর্জাতিক আদালতে তথা জাতিসংঘের স্মরনাপন্ন হওয়ার ঘোষনাও দিয়েছে । তথাপি ধনী দেশগুলো প্রতি বছর এই সম্মেলনে অংশ গ্রহণ করে সম্মেলনের প্রশংশা করে , গুরুত্ব দেয় । অন্যদিকে এই বিশাল সম্মেলনের ব্যয় ভার বা স্পন্সর করে বহুজাতিক কোম্পানিগুলো। এটাও আন্তর্জাতিক রাজনীতির একটি ভিন্ন রুপ। তাছাড়া ধনী দেশগুলোর মধ্যেও এব্যাপারে মতানৈক্য তো আছেই ।
গত কয়েকটি সম্মেলনে ক্ষতিগ্রস্থ দেশগুলোকে অর্থ সহায়তা দেওয়ার জন্য ঐক্যমত হয়েছে ধনী দেশগুলো । গরীব্ দেশগুলো অনন্যপায় হয়ে মন্দের ভাল মনে করে অর্থ সহায়তা পাওয়ার বিষয়টিকে গ্রহণ করতে বাধ্য হয়েছে । কিন্তু ধনী দেশগুলো কে কি পরিমাণ অর্থ সহায়তা দেবে সে ব্যাপারে বিতর্ক থেকে গেছে ।তেমনি ক্ষতিগ্রস্থ দেশগুলো কে কতটা অর্থ সহায়তা পাবে সেটাও মিমাংশিত হয়নি । তাছাড়া যে অর্থ সহায়তা দেওয়া হবে সেটা ঋণ হিসেবে না নিঃশর্ত ভাবে দেওয়া হবে সেটাও স্পষ্ট নয় ।সর্বোপরি জলবায়ু বিপর্যয় থেকে রক্ষা পাওয়ার সমাধান এটি নয়। জলবায়ু বিপর্যয়ের ফলে ধনী দেশগুলো যখন নিজেরাই মারাত্নকভাবে ক্ষতির সম্মুখিন হবে , তখনই বোধদয় হবে এবং তারা নিজেদের রক্ষায় এগিয়ে আসবে । জলবায়ু বিপর্যয় থেকে বিশ্ব মুক্তি পাবে ।
Leave a Comment
Your email address will not be published. Required fields are marked with *