প্রতিটি ধর্মেই রয়েছে কিছু সামাজিক নিয়ম কানুন ও শৃঙ্খলা এক কথায় অনুশাসন। যা মেনে চলার উপদেশ ও পরামর্শ দেয়া হয়েছে। এ ক্ষেত্রে বিবেকবোধকে গুরুত্ব দেয়া হয়েছে এবং না মানলে সৃষ্টিকর্তার কাছে জবাবদিহিতার ব্যাপারে হুঁশিয়ার করা হয়েছে। কোন কোন ক্ষেত্রে শাস্তির বিধান দেয়া হয়েছে। ধর্মীয় এই শাস্তির বিধান কার্যকর হয়না বললেই চলে। তবে সৃষ্টিকর্তার কাছে জবাবদিহিতার ভয়ে ধর্মানুসারীরা কম অপরাধ করে।
অপরদিকে বিভিন্ন দর্শন শাস্ত্রেও একই ধরনের নিয়ম কানুন ও শৃঙ্খলা তৈরি করা হয়েছে। যা মেনে চলার জন্য রাষ্ট্রীয় আইন করা হয়েছে। আইন না মানলে শাস্তির বিধান অনুযায়ী ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়। কিন্তু আইনের ফাঁক ফোকর খুঁজে অপরাধীরা অপরাধ করে। আধুনিক রাষ্ট্রীয় ব্যবস্থায় অপরাধ ক্রমাগত বৃদ্ধি পাচ্ছে এবং ক্ষমতাশালী রাষ্ট্রগুলোও অপরাধ দমনে হিমশিম খাচ্ছে।
ধর্ম হচ্ছে বিশ্বাস, সত্য ও সৃষ্টিকর্তার কাছে আত্মসমার্পণের নীতির উপর প্রতিষ্ঠিত। সৃষ্টিকর্তার দেয়া বিধি বিধান সম্বলিত পথই হচ্ছে ধর্ম। ধর্মীয় অনুশাসন মানলে বেহেস্ত বা স্বর্গ পাবার লোভ এবং না মানলে দোজখ বা নরকের শাস্তি ভোগের ভীতি রয়েছে। ধর্মের অন্যতম লক্ষ্য হচ্ছে, সত্য ও ন্যায় কে প্রতিষ্ঠিত করা, অন্যায়কে সমাজ থেকে উৎপাটন করা ও মানুষের কল্যাণ করা। এছাড়াও ইহলৌকিক ও পারলৌকিক মুক্তির পথ দেখায় ধর্ম।
অন্যদিকে দর্শন হচ্ছে- বিশ্ব জগৎ ও ইন্দ্রিয় গ্রাহ্য সব বিষয়ে শাশ্বত জ্ঞান ও সত্যের সন্ধান ও উপলব্ধির উপর প্রতিষ্ঠিত। যেখানে চোখে দেখার সাথে হৃদয়ের উপলব্ধি জড়িত। এর জন্য একে ভাববাদী দর্শন বলা হয়। এ দর্শনের মধ্যে মানুষের কল্যাণ নিহিত রয়েছে। মানব জ্ঞানের যে কোন সত্য বা তত্ব সন্ধানের বিজ্ঞান ভিত্তিক শিক্ষা রয়েছে এ দর্শনে। এখানে ইহলৌকিক বিষয়টি প্রাধান্য পেয়েছে। সত্য ও ন্যায়কে প্রতিষ্ঠা ও অন্যায়কে অপসারণ করাও এ দর্শনের লক্ষ্য। দর্শনের মধ্যে বস্তুবাদী দর্শন-ই সর্বাধুনিক হিসেবে স্বীকৃত। ইন্দ্রিয় গ্রাহ্য বস্তুজগৎ-ই পার্থিব সত্য বলে এ দর্শন দাবি করে। এ বাহিরে কোন জ্ঞানের বাস্তব ভিত্তিক অস্তিত্ব নেই। পরমসত্বা ও অদৃশ্য শক্তি তথা সৃষ্টিকর্তার অস্তিত্বকে এ দর্শন বিশ্বাস করে না। এ দর্শন শ্রেণি সংগ্রামের মাধ্যমে শোষণ ও ধনতান্ত্রিক ব্যবস্থার মূলোৎপাটন করার মতবাদে বিশ্বাসী। এরা প্রকৃতিদত্ত সম্পদের বাস্তবতার প্রেক্ষিতে প্রয়োজন, চাহিদা, জোগান ও সুষম বণ্টনের মাধ্যমে মানব জীবনকে সুন্দর ও কল্যাণকর করতে চায়। এরা মূলত সমাজতন্ত্রে বিশ্বাসী।
ধর্মের সামাজিক প্রয়োগ মূলত বিবেক নির্ভর এবং দর্শনের প্রয়োগ রাষ্ট্রের তৈরি আইন নির্ভর। ধর্ম ও দর্শনের মধ্যে তত্ত্বগত বিষয়ে বিস্তর পার্থক্য থাকলেও মৌলিক বিষয় ও লক্ষ্য এক ও অভিন্ন। তা হচ্ছে- সমাজবদ্ধভাবে জীবন যাপনের জন্য একটি সুশৃঙ্খল জীবন ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা করা। আর এর অনুশাসনগুলো হচ্ছে- সত্য কথা বলা, মিথ্যা পরিহার করা, অন্যের ক্ষতি না করা, প্রতারণা না করা, একে অপরের বিপদে সাহায্য করা, অন্যায়ের প্রতিবাদ করা, সম্ভব হলে অন্যায়ের মূলোৎপাটন করা, গুরুজনদের ভক্তি করা, কারো ধর্মীয় বিশ্বাসে আঘাত না করা, রাষ্ট্রের কর পরিশোধ করা এবং সর্বোপরি মানুষের কল্যাণে ব্রতি হওয়া। ধর্ম ও দর্শনের এই বিষয়গুলো ভিন্নভাবে বিচার করার কোন সুযোগ নেই এবং আদৌ যুক্তিযুক্ত নয়। এ সব অনুশাসন এসেছে নৈতিকতা থেকে। যা মূলত বিবেকের প্রতিফলন মাত্র। নৈতিকতা ব্যতিরেকে কোন ধর্ম বা কোন দর্শন-ই সমাজে বাস্তবায়ন হতে পারে না এবং এই সত্যটি ধর্ম ও দর্শনে অনস্বীকার্য। শুধু তাই নয়, ধর্ম ও দর্শনের সামাজিক বাস্তবায়নের মূল চাবিকাঠি এটাই। যার কোন বিকল্প হতে পারে না।
ধর্ম ও দর্শনের উল্লেখিত মৌলিক পার্থক্য না থাকা সত্তে¡ও উভয় পক্ষের কিছু প্রভাবশালী অনুসারী ও প্রবক্তা আছেন। যারা নিজ নিজ পক্ষে অত্যন্ত দৃঢ়, নির্ভুল ও সঠিক মনে করেন এবং অন্যদের ভুল মনে করেন। এরা কারো কোন যুক্তি পরামর্শ মানাতো দূরের কথা শুনতেও প্রস্তুত নয় এমনকি সমন্বয় করতেও রাজি নয়। এরাই মূলত কট্টর, গোড়া ও মৌলবাদী হিসেবে চিহ্নিত। এদের এক পক্ষ ধর্মান্ধ হলে অন্য পক্ষ দর্শনান্ধও বটে। সমাজের যত দ্ব›দ্ব, বিভক্তি ও হানাহানি এদের নিয়েই।
আসলে সুশৃংখল সামাজিক জীবন ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠার জন্য ধর্ম ও দর্শন এক একটি পরিবর্তিত প্রায়োগিক ব্যবস্থা এতে সন্দেহের লেস মাত্র নেই। সামাজিক পরিবর্তনের সাথে সাথে প্রায়োগিক ব্যবস্থার পরিবর্তন যা ক্রমবিবর্তনের মধ্যে দিয়ে এসেছে। তাই কোনটিই চূড়ান্ত নয়। যে কারণে তাওরাত, জব্বুর, ইঞ্জিল, কোরআনসহ আসমানি কিতাবসমূহ এবং সেই সাথে নবী ও পয়গম্বরগণের আগমন ঘটেছে। একইভাবে ভাববাদী বস্তুবাদীসহ বিভিন্ন দর্শনসমূহ ও সেইসাথে সক্রেটিস, হেগেল, প্লেটো, এরিস্টটল, রুশো, ভল্টেয়ার, কার্লমার্কস ও এঙ্গেলস-এর মত দার্শিনিকদের আগমন ঘটেছে। সত্যিকার অর্থে এরা সবাই সমাজের যুগসন্ধিক্ষণে আবিভর্‚ত হয়েছেন ও সুন্দর সুশৃঙ্খল সমাজ গঠনের তত্ত্ব দিয়ে গেছেন এবং বাস্তবে কাজ করে গেছেন। তাই তাদের বলা হয় সমাজ প্রবর্তক বা সমাজ বিজ্ঞানী।
এই আলোচনায় দুটি বিষয় উঠে এসেছে। তা হচ্ছে, বিবেক বা নৈতিকতা এবং আইন। বিবেক একটি অদৃশ্য অনুভবি শক্তি, যা সৃষ্টিকর্তা বা প্রকৃতি প্রদত্ত। এটা মানুষের মনকে সত্য ও ন্যয় পথে পরিচালিত করে এবং অন্যায়ের পথ থেকে বিরত থাকতে সাহায্য করে। বিবেকের কোন ফাঁক ফোকর নেই। তাকে ফাঁকি দেয়া যায় না। তবে অমান্য করা যায়। বিবেকের পথে চলার জন্য মানুষের ইচ্ছেটাই যথেষ্ট। অন্যদিকে আইন হচ্ছে- মনুষ্যসৃষ্ট বিধান। যার ভয়ে ইচ্ছে না থাকলেও অন্যায় ও অসত্য কাজ থেকে বিরত থাকতে হয়। তবে আইনের ফাঁক ফোকর আছে। বিধায় ফাঁকি দেয়া যায়। পূর্বেই বলা হয়েছে- একটি সুশৃঙ্খল সমাজ গঠনের জন্য প্রথমেই দরকার হয়, বিবেকবোধ সম্পন্ন মানুষ। অন্যথায় তেমন সমাজ গঠন হতেই পারে না। অর্থাৎ বিবেকবোধ সম্পন্ন মানুষ আগে। তারপরে আইন তৈরি ও তার প্রয়োগ। দর্শনের যুক্তি ও প্রমাণ বোঝার জন্যও বিবেক আবশ্যক। উল্লেখ করা যেতে পারে এক সময় ধর্মভিত্তিক রাষ্ট্রনায়করা যেমন বিবেকবোধ সম্পন্ন ছিলেন, তেমনি ছিলেন বিবেকবোধ সম্পন্ন প্রজাও। আজকে আধুনিক দর্শন ভিত্তিক রাষ্ট্রে বিবেক বা নৈতিকতার কোন গুরুত্ব নেই বললেই চলে। আধুনিক রাষ্ট্র আইনের প্রয়োগের উপর নির্ভরশীল। ফলে আজকের আধুনিক রাষ্ট্রনায়করা যেমন দুর্নীতি পরায়ণ, ক্ষমতালোভী ও অন্যোর দেশ গ্রাসে লিপ্ত। তেমনি জনসাধারনও হয়েছে অপরাধ প্রবণ, উচ্ছৃঙ্খল ও আইন ভঙ্গকারী। ফলে পৃথিবী আজ উত্তপ্ত হয়ে উঠেছে, অশান্তিতে ভরে গেছে। আগামীতে এই ক্রমবর্ধমান অশান্তি থেকে পরিত্রাণের পথ যেন সুদূর পরাহত হয়ে উঠেছে। এ অবস্থা থেকে পরিত্রাণের একমাত্র পথ বিবেকবোধকে জাগ্রত করা। যার কোন বিকল্প নেই। বর্তমান পৃথিবীতে যেমন ধর্মভিত্তিক রাষ্ট্র আছে, তেমনি দর্শন ভিত্তিক রাষ্ট্রও আছে। কিন্তু কোন রাষ্ট্রেই ধর্ম বা দর্শনের বাস্তবায়ন হচ্ছে বলে প্রমাণ পাওয়া যায় না। সবাই যেন পথভ্রষ্ট। আদর্শিক স্থান থেকে সরে গেছে। আদর্শহীন বিশ্ব বিরাজ করছে। সাম্রাজ্যবাদ আমেরিকা ও তল্পিবাহী রাষ্ট্রগুলো উল্লেখিত পরিস্থিতির সৃষ্টি করেছে। সাম্রাজ্যবাদ জানে- যে কোন আদর্শ বাস্তবায়নের সুযোগ করে দেয়া মানেই তাদের জন্য সমূহ বিপদ। তাই আজও আমেরিকা ছলে, বলে, কৌশলে আদর্শের বীজ ধ্বংস করে বেড়াচ্ছে দেশে দেশে। এক সময় কমিউনিষ্ট দর্শনকে সমস্ত শক্তি দিয়ে বাধা দিয়েছে, বিপথে পরিচালিত করতে ইন্ধন জুগিয়েছে, ভেটো শক্তিগুলোর মধ্যেকার শর্তগুলোকে পুজি করে দেশে দেশে অন্তর্দ্বদ্ব ও বিভক্তির সৃষ্টি করেছে। কমিউনিষ্টরাও আজ বিভক্ত। সংশোধিত পথে চলতে শুরু করেছে। আদর্শিক স্থান থেকে ক্রমশ দূরে সরে যাচ্ছে। অন্য দিকে ধর্ম ভিত্তিক রাষ্ট্রগুলো বহুকাল আগে থেকেই বিভক্ত। আদর্শিক চর্চাও নেই প্রয়োগও নেই। নৈতিকতা হারিয়ে পরস্পরের শত্রু হয়েছে। এক রাষ্ট্র আরেক রাষ্ট্রকে হামলা চালাচ্ছে আমেরিকার ইন্ধনে। তার পরেও ইরানের উত্থান, সাম্রাজ্যবাদ আমেরিকাকে স্তম্ভিত করেছে। যে কারনে ধর্মীয় উত্থান সম্ভাব্য দেশগুলোতে অন্যায়ভাবে আক্রমণ চালিয়ে ধ্বংস করে দিচ্ছে। যেন এমন অবস্থা বিবেচনা করেই কেউ ধর্মীয় উত্থানের চেষ্টা না করে। এ কারণেই বিশ্ব পরিস্থিতি এমনই হয়েছে যে, কোন দেশে ধর্ম বা দর্শনের বাস্তবায়ন খুবই কঠিন হয়ে পড়েছে। তবে অসম্ভব হয়ে গেছে এমনটা মনে করার কোন কারণ নেই। এ জন্য বিবেকবোধ জাগ্রত করতে হবে, নৈতিকতা গড়ে তুলতে হবে। দীর্ঘস্থায়ীভাবে এ কাজ করে যেতে হবে যার কোন বিকল্প নেই। আদর্শবাদীদের জন্য সর্বশেষ ও একমাত্র ভরসার স্থল বিবেক।