বাড়িটাতে আজ ছাত্র-ছাত্রীদের পদচারণা অন্যান্য দিনের চেয়ে বেশি। অবশ্য সরকারি বন্ধের দু’দিন সকাল- বিকাল এমন অবস্থা থাকলেও মঙ্গলবার কোলাহল শুরু হয় সন্ধ্যায়। যা চলে রাত দশটা অবধি। আপন স্যারের বাড়ি বলে কথা! তিনি এলাকার ইংরেজির জনপ্রিয় শিক্ষকদের মধ্যে অন্যতম। তাঁর ছাত্র মানে পাশ একেবারে নিশ্চিত। শুধু পাশ বললে ভুল হবে; সম্মানজনক পাশ। বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজি লেকচারার।
বাড়িটাতে আজ ছাত্র-ছাত্রীদের পদচারণা অন্যান্য দিনের চেয়ে বেশি। অবশ্য সরকারি বন্ধের দু’দিন সকাল- বিকাল এমন অবস্থা থাকলেও মঙ্গলবার কোলাহল শুরু হয় সন্ধ্যায়। যা চলে রাত দশটা অবধি। আপন স্যারের বাড়ি বলে কথা! তিনি এলাকার ইংরেজির জনপ্রিয় শিক্ষকদের মধ্যে অন্যতম। তাঁর ছাত্র মানে পাশ একেবারে নিশ্চিত। শুধু পাশ বললে ভুল হবে; সম্মানজনক পাশ।
বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজি লেকচারার। বয়স চল্লিশের কোটা পেরিয়ে গেছে আরো চার বছর আগে। মাথায় ছোট ছোট মিহি কালো চুল থাকলেও মুখ দাড়িতে ভর্তি। মোটা কালো ফ্রেমের চশমা তাকে দৃষ্টিনন্দন করে তোলে। যুদ্ধাহত মুক্তিযোদ্ধা। যে কারণে চলাফেরায় ওয়াকিং ষ্টিক তার নিত্যসঙ্গী। তার ওপর ব্যাচেলর। দিনের শেষে যেমন করে সন্ধ্যা ঘনিয়ে আসে ঠিক তেমনি বিয়ের বয়সটা তার হারিয়ে যাচ্ছে দূর থেকে আরো দূরে। শহরে নিজস্ব বাড়ি। পুরোনো মডেলের একটি গাড়িও আছে। টাকা পয়সার অভাব নেই। তারপরও প্রাইভেট পড়ান। আপাতদৃষ্টিতে মনে হতে পারে, হয়তো টাকার জন্যে প্রাইভেট পড়ান। যে ভুল অনেকেই করে। তিনি প্রাইভেট পড়ান সত্য, ফিস মাত্র পঞ্চাশ টাকা। এই সময়- এই আধুনিক যুগে একজন ইংরেজি শিক্ষকের কাছে প্রাইভেট পড়তে যেখানে পাঁচ’শ টাকায়ও সম্ভব হয় না সেখানে তিনি নেন মাত্র পঞ্চাশ টাকা! এই টাকা নেবার কারণ তিনি অনেকবার ব্যাখ্যা করেছেন, ‘যদি নূন্যতম মূল্য না নিই লেখাপড়ার প্রতি শিক্ষার্থীদের আগ্রহ জন্মাবে না।’ কোন কোন অভিভাবক জোর করে বেশি টাকা দিলে তিনি সেখান থেকে পঞ্চাশ টাকা রেখে বাকী টাকার মিষ্টি মিঠাই আনিয়ে ছাত্র-ছাত্রীদের মধ্যে বিলিয়ে দেন। তাঁর এই পাগলামি বন্ধ করতে অনেক শিক্ষক অনেকভাবে চেষ্টা করেছে। কেউ আজ পর্যন্ত সফল হয়নি। কে কী বললো, কী করলো তা আপন স্যারের মনে বিন্দুমাত্র প্রভাব ফেলে না। যৌবনে সে পরাধীনতার নাগপাশ থেকে দেশকে মুক্ত করেছে। তারপর পড়াশুনা শেষ করে যুদ্ধ বিধ্বস্ত দেশ গঠনে শিক্ষকতা পেশাকেই বেছে নিয়েছেন শিক্ষার আলো ছড়িয়ে দিয়ে অন্ধকার দূর করার জন্যে। অথচ এই শিক্ষার জন্যে তাঁকে অনেক চড়াই-উৎরায় পেরিয়ে আসতে হয়েছে।
অনেক ছাত্রীদের মনে আপন স্যারের জন্যে ভালবাসা নামক উদ্ভিদ জন্ম নিতেই অঙ্কুরে বিনষ্ট হয়ে যায়। শুধুমাত্র সেঁজুতির বেলায় আলাদা। তাকে নিবরণ করা যায়নি কখনও। সে স্যারকে প্রচন্ড বেশি ভালবাসে। তার সকল ধ্যান জ্ঞান স্যারকে নিয়ে। একথা কলেজ ক্যাম্পাস থেকে শুরু করে পরিচিত মহল কে না জানে! অনেকে অনেক কথা শুনিয়েছে, সেজুঁতি কিংবা আপন স্যার কিছু মনে করে না। অবশ্য সেঁজুতির মা যে বিষয়টা জানে না, তা নয়। সে মেয়েকে আটকায় না। তার বিশ্বাস, মেয়ে তো আর অন্যায় কিছু করছে না। তাছাড়া ভালবাসায় বয়স, জাতপাত, শিক্ষক-ছাত্র, পক্ষ-বিপক্ষ কিছুই চলে না। সেঁজুতি তার মাকে অনেক আগেই আপন স্যারকে ভালবাসার কথা বলেছিল। যে ভালবাসায় কোন খাঁদ নেই। তার মা শুধু একটি কথাই বলেছিল, ‘তবুও একটু ভেবে দেখো।’
‘তোমার কথা আমার মনে থাকবে।’ বলে ঘর থেকে সেদিন বেরিয়ে গিয়েছিল সেঁজুতি।
বাবা নেই। কেন নেই তা জানারও চেষ্টা করে না। কেনইবা করবে? বাবার অভাব কোনদিন বুঝতে দেননি তার মা। অবশ্য দু’একবার যে বাবার কথা জানতে চায়নি তা নয়। তখন তার মা কথার জাদুতে প্রসঙ্গ পাল্টেছেন অত্যন্ত নান্দনিকতায়।
পড়া শেষে ছাত্র-ছাত্রীরা যখন একে একে ঘর থেকে বের হতে ব্যস্ত তখন সেঁজুতি আপন স্যারের সামনে যেয়ে দাঁড়ায়। বলল, ‘আপনাকে একটা অনুরোধ করবো; রাখবেন তো স্যার?’
চোখ থেকে চশমাটা খুলে টেবিলের ওপর রাখা টিস্যু দিয়ে পরিষ্কার করতে করতে বলল, ‘তোমার কথা আমি রাখিনি এমনটা হয়েছে কোনদিন?’
‘আমি আসলে সেভাবে বলতে চাইনি। তবে আমি ধরে নিলাম আপনি আমার কথা রাখছেন।’ বলল সেঁজুতি।
সম্মতিসূচক মাথা নাড়িয়ে বলল, ‘হু’
‘আগামীকাল আপনি আমাদের বাড়িতে যাচ্ছেন।’
‘তোমাদের বাড়ি! হঠাৎ কী বিষয়?’
‘বিষয়তো একটা আছেই। সেটা না হয় সারপ্রাইজ হয়ে থাকলো।’
‘আগামীকাল কেন? পরে গেলে হয় না?’
‘কেন স্যার, আগামীকাল তো কোন ব্যাচ পড়তে আসবে না।’
‘উদ্দেশ্যটা যদি বলতে?’
‘উদ্দেশ্যতো একটা আছেই স্যার। আমার মায়ের সাথে আপনার পরিচয় করিয়ে দেবো এবং সেটা আনুষ্ঠানিকভাবে।’
‘কী বলো! পরিচয়ের আবার আনুষ্ঠানিকতা কী?’
‘আপনি একজন মুক্তিযোদ্ধা। তাছাড়া আমার সরাসরি শিক্ষকও।’
‘এতে আনুষ্ঠানিকতার কী হলো?’ উৎসুক প্রশ্ন আপন স্যারের।
‘ও আপনি বুঝবেন না স্যার। ও হ্যা, পাজামা পাঞ্জাবি পরে যেতে ভুলবেন না।’
‘কেন?’ প্রশ্ন করেন আপন স্যারের।
‘এমনি। আপনাকে পাজামা পাঞ্জাবিতে বেশ ভাল লাগে, তাই। আর একজন ছাত্রী তার টিচারের কাছে এটুকুতো চাইতেই পারে। কী বলেন স্যার?’
‘ঠিক আছে, তুমি যেমনটি চাও।’ আর কোন কথা বাড়ায় না সেঁজুতি। সে বাড়ির দিকে রওনা দেয়।
পড়ন্ত বিকেল। ক্লান্ত সূর্যটা পশ্চিম দিকে হেলে পড়তে উদ্যত। পাখিরাও ইতিমধ্যে ফিরতে শুরু করেছে নিজ গৃহে। শহরে আলোর ঝলকানি শুরু হয়ে গেছে। দূরের মসজিদ থেকে ভেসে আসে মাগরিবের আজানের ধ্বনি। এমনি এক মুহূর্তে আপন স্যার সেজুঁতিদের বাড়ির গেটের সামনে উপস্থিত হয়। গাড়ি থেকে নেমে সেতো হতবাক। লাল নীল বাতি দিয়ে পুরো বাড়িটাকে সাজিয়ে ফেলা হয়েছে। আপন স্যার বুঝতে পারে না, কী হচ্ছে। সেজুঁতি তাকে তেমন কিছুই বলেনি। সৌজন্যতার খাতিরে চাঁন ময়রার হোটেল থেকে কেজি পাঁচেক মিষ্টি নিয়ে এসেছে। অনুষ্ঠানের ধরণ জানতে পারলে সেভাবে গিফট আনা যেত মনে মনে ভাবেন তিনি। ড্রাইভার মিষ্টির প্যাকেট হাতে নিয়ে স্যারকে অনুসরণ করে।
সেজুঁতি অনেক আগে থেকেই দোতলার ব্যালকনিতে দাঁড়িয়ে অপেক্ষায় ছিল। স্যারের আগমন উপলক্ষে একটা ছোটখাট উৎসবের আমেজ ছুঁয়ে যাচ্ছে পুরো বাড়িতে। সেজুঁতির কলেজের বন্ধুরা থেকে শুরু করে এলাকার অনেকে এসেছে। সেজুঁতি তার মাকে বলেছিল, ছোটখাট একটা ঘরোয়া আয়োজন করতে। কিন্তু কাকে রেখে কাকে বলি করতে করতে অনেককে বলা হয়ে গেছে। যা জমকালো অনুষ্ঠানে রূপ নিয়েছে। বাড়ির দক্ষিণ দিকে চলছে রান্নার আয়োজন। যা তরারকি করছে সেজুঁতির দাদু ভূবন কর্মকার।
‘আসুন স্যার।’ বলে সেজুঁতি স্যারের হাত ধরে ড্রয়িংরুমের একপাশে তৈরী বর আসনে নিয়ে বসায়। তিনি চারিপাশে একনজর তাকান। অপেক্ষাকৃত বেশ বড় ড্রয়িং রুমের চারিদিকে আভিজাত্যের প্রভাব। একটি অনুষ্ঠানে যেভাবে সাজানো হয় সেভাবেই সাজানো হয়েছে ঘরের প্রতিটি কোণ। এক পাশে বিয়ের আসনের মতো সাজিয়ে রাখা। কী হচ্ছে এসব! কীসের অনুষ্ঠান? তবে কী সেজুঁতির বিয়ে? নিজের মনের কাছে প্রশ্ন করেন আপন স্যার।
উপস্থিত অতিথিরা জানে আজ সেজুঁতিকে বরপক্ষ দেখতে আসবে। সবকিছু ঠিক থাকলে কোন আনুষ্ঠানিকতা ছাড়াই বিয়ে হবে। তাও আজ-ই। তবে বরের কথা কারো জানতে বাকী নেই। এমন একটা মুহূর্তে সবার সামনে বিয়ের পাত্রীর ঘোরাফেরা মোটেও ভালভাবে নেয় না বয়স্কদের কেউ কেউ। একজনতো বলেই ফেলে, ‘কী কলিকাল এসে পড়েছে? যার বিয়ে সে অতিথিদের মাঝেই ঘুরে বেড়াচ্ছে!’ কথাটা সেজুঁতির কানে গেলেও সেদিকে ভ্রুক্ষেপ করে না।
সেজুঁতি স্যারের কাছে এসে ‘স্যার একটু উঠুন তো।’ বলে তার হাত ধরে বিয়ের আসনে নিয়ে গিয়ে বসায়। বলল, ‘আপনি এখানে বসুন। আমি একটু পরেই আসছি।’ কথাটা শুনে মুহূর্তে ঘামতে শুরু করেছে আপন স্যার। তিনি বিস্মিত হয়ে বললেন, ‘কী পাগলামো করছো তুমি! আমাকে এখানে বসাচ্ছো কেন?’
‘আজ আপনার বিয়ে স্যার।’ কোনরূপ মনের মাঝে জড়তা না রেখে সোজাসুজি কথাটা বলে সেজুঁতি। সে পাশে থাকা বিয়ের টোপর স্যারের মাথায় পরিয়ে দেয়। স্যার বাধা দিতে চেষ্টা করলেও কোন বাঁধাই আটকাতে পারে না সেজুঁতিকে।
যেন আকাশ থেকে পড়েন আপন স্যার। চোখ তাঁর বিস্ময়ে কপালে ওঠে যায়। বহু বসন্ত কেটে গেছে তাঁর জীবন থেকে। এই অবেলায় এসে কী শুরু করেছে মেয়েটা! লোকেই বা বলবে কী? সমাজে মুখ-ই বা দেখাবে কীভাবে? সাত পাঁচ ভাবতে ভাবতে বলল, ‘সেজুঁতি, তুমি পাগলামো করো না। আমার বয়স আর ব্যক্তিত্বটাতো একবার ভাবো।’
‘আমি আপনাকে ভালবাসি, সম্মান করি। অনেক অনেক। আর আমার ভালবাসাকে অবশ্যই সম্মানজনক স্থানে বসাবো, সেটা যে কোন মূল্যেই হোক।’
‘আমি জানি সেজুঁতি। তোমার জন্যেও আমার ভালবাসা মোটেও কম নয়।’
‘তাহলে সমস্যা কোথায়? আমাকে আপনি বিশ্বাস করতে পারছেন না স্যার?’
‘এখানে বিশ্বাস-অবিশ্বাসের প্রশ্ন আসছে কেন? আমি কিন্তু নিজেকে আর সংযত রাখতে পারছি না।’
‘প্লিজ স্যার, বাড়ি ভরা লোকজন। সবাই দেখছে। আপনার ছাত্র-ছাত্রীরাওতো আছে। কেন ভাবছেন এত? আপনি বসুন, আমি রেডি হয়ে আসছি।’ কথাটা এক নিশ্বাসে বলে দ্রুত স্থান ত্যাগ করতে উদ্যত হয়। এমন সময় পুরহিত মশায় এসে বিয়ের আসনে বসে বলল, ‘বর বসে আছে, কণেকে কী সাজানো হয়েছে? লগ্ন এসে পড়লো বলে।’
সেজুঁতি বলল, ‘পুরহিত মশায় আপনি একটু অপেক্ষা করুন আমি আসছি।’ চলে যায় সে।
ভেতরে ভেতরে আপন স্যারের হৃদয়ে তোলপাড় শুরু হয়েছে। কী ঘটতে চলেছে তার সাথে! মেয়েটা কী তবে শেষ পর্যন্ত তাকে….। আর ভাবতে পারে না। একজন মুক্তিযোদ্ধা সে; বিশ্ববিদ্যালয়ের লেকচারারও। তার দ্বারা এই ভরা মজলিসে আর দশ জনের মত কোনকিছু ভাবা বা করা সম্ভব নয়। সে নিশ্চুপ মাথা নিচু করে বসে থাকে। এই মুহূর্তে তার ভাবনায় কিছুই আসছে না।
পাশের ঘরে অতিথিদের আপ্যায়নে ব্যস্ত ছিল মহিমা। সেজুঁতি সেখানে এসে বলল, ‘আম্মু তুমি রেডি হয়ে নাও।’
‘আমার আবার রেডি কী? আমি তো ঠিকই আছি।’ বলল মহিমা।
‘তুমি বিয়ের শাড়ি পরবে আজ।’
‘তোকে দেখতে এসেছে, তোর বিয়ে। আমি পরবো কেন?’ বিস্মিত সে।
‘আমি বলছি তুমি পরো। এটা আমার শখ বলতে পারো।’
‘কী সব আজগুবি শখ তোর! বাদ দেতো এসব।’
‘আম্মু, আমি যেটা বলেছি সেটাই হবেই। আর মেয়ের বিয়ের দিন মা যে বিয়ের শাড়ি পরতে পারবে না এটাই বা তুমি কোন শাস্ত্রে পেয়েছো?’
পাশে দাঁড়িয়ে মা মেয়ের কথা শুনছিল সেজুঁতির দাদু ভূবন কর্মকার। সে কাছে এসে মহিমাকে উদ্দেশ্য করে বলল, ‘সেজুঁতি যখন চাইছে তাহলে পর; অসুবিধা কী।’
নিজের বাবা যখন বলছে তখন সে আর জোরাজুরি করে না। শেষ পর্যন্ত বিয়ের শাড়ি পরতে হয় তাকে।
মা-মেয়ে দু’জনে বিয়ের সাঁজে সেঁজেছে! এক অন্যরকম পরিবেশ। কী করতে চলেছে সেজুঁতি তা বুঝতে পারে না তার সহপাঠীরা, বুঝতে পারে না তার জন্মদাত্রী মা। তাছাড়া বাঙালিদের পুরোনো প্রথা, যার বিয়ে সেই শুধুমাত্র বিয়ের পোশাক পরে; এটাই নিয়ম। কিন্তু দু’জনেই কেন পরলো তা বুঝতে পারেনা কেউ। শিক্ষিত মেয়ে বলে কথা!
বিয়ের আসনের পাশে এসে সেজুঁতি তার মাকে উদ্দেশ্য করে বলল, ‘তুমি এখানে বসো আম্মু।’
‘তুই এখানে বস। আমি কেন?’ আস্তে আস্তে কথাটা মেয়েকে বললেও সেদিকে ভ্রুক্ষেপ করে না সেজুঁতি। সে একপ্রকার জোর করেই তার মাকে সেখানে বসিয়ে নিজে বসে তার পাশে।
পুরহিত তো হতবাক। তার সামনে দুইজন কণে! সে কিছু বলতে যাবে এমন সময় সেজুঁতি বলল, ‘পুরহিত মশায়, বিয়ে পড়ানো শুরু করুন।’
পুরহিত আর নিজেকে স্থির রাখতে পারে না। বলল, ‘মা জননী, দুই জন কণের সাজে! ব্যাপারটা একটু বুঝিয়ে বলবে? আর হ্যা, যার বিয়ে তাকে একটু লাজুক থাকতে হয়। এটাই পরম্পরা। নিজের বিয়ের কথা নিজেই বলতে হয় না।’
‘দু’জন বিয়ের সাজে? এখনই জানতে পারবেন। আর যার বিয়ে সে কথা বলছে, আপনাকে কে বললো? দুনিয়া কী এতই আধুনিক হয়ে গেছে?’ বলল সেজুঁতি।
কথাটা কানে যেতেই উপস্থিত অতিথিরা এ ওর মুখের দিকে তাকাতে থাকে। কী হচ্ছে এসব!
পুরহিত হন্তদন্ত হয়ে বলল, ‘বুঝলাম না মা?’
‘আপনার বুঝে কাজ নেই। আপনি শুরু করুন। বর মুক্তিযোদ্ধা অধ্যাপক আপন বন্দোপাধ্যায় আর কণে মহিমা কর্মকার।’
হঠাৎ আলোর ঝলকানির মতো কথাটা সারা ঘরময় ঘুরতে থাকে। কী বলছে মেয়েটা? স্যারের সাথে তার মায়ের বিয়ে!
‘মহিমা কর্মকার’ নামটা কানে যেতেই চমকে ওঠে আপন স্যার। মুহূর্তে তার হৃদয়পুরের পুরোনো ক্ষতস্থান আবারো জাগ্রত হয়। সে সামনের দিকে তাকায়। মহিমা ঘোমটা দিয়ে থাকায় এতক্ষণ সামনের মানুষটিকে দেখতে না পেলেও সেজুঁতির কথায় সে ঘোমটা সরিয়ে আপন স্যারের চোখে চোখ রাখে। চিনতে মোটেও অসুবিধা হয় না। আপন তুমি! চোখ ছল ছল করে ওঠে মহিমার। তার ঠোঁট দু’টি নিজের অজান্তেই কেঁপে ওঠে।
‘কত খুঁজেছি তোমাকে। এত কাছে থেকেও বহু দূরে ছিলে।’ বলল আপন স্যার। তাঁর চোখের কোণে দেখা যায় জলের রেখা। চশমাটা খুলে চোখ মোছার বৃথা চেষ্টা করে। তারা দু’জনে মুহূর্তে হারিয়ে যায় উনিশ বছর আগে ফেলে আসা ৭১ এর উত্তাল দিনগুলোতে।
মহিমার সাথে আপনের ভালবাসাটা গভীর থেকে গভীরতর হতে থাকা অবস্থায় ঘুরতে থাকে জীবনের মোড়। আপন বরাবরই ইংরেজিতে কাঁচা ছিল। যে কারণে টেনেটুনে এসএসসি পাশ করলেও এইচ এস সি পরীক্ষায় সে দু’বার ফেল করে। আর এই কারণে মহিমার বাবা ভূবন কর্মকার মেয়েকে আপনের থেকে দূরে রাখার সিদ্ধান্ত নেয়। পড়াশুনায় কাঁচা, দরিদ্র ঘরের একটি ছেলের সাথে মেয়ের সম্পর্ক সে মেনে নিতে পারে না। সমূহ বিপদ আঁচ করতে পেরে মেয়েকে খুলনার বিএল কলেজে ভর্তি করিয়ে দেয়। তার খালাবাড়ি কলেজের পাশে ফুলতলা থানায়। ওখান থেকে কলেজে যাওয়া আসা তার জন্যে সহজ।
অস্থিতিশীলতার কারণে দেশের সব শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধ হয়ে গেলে মহিমা আর আপন বাড়িতে ফিরে আসে। ইতিমধ্যে চারিদিকে যুদ্ধের দামামা বেঁজে উঠেছে। ঢাকার রাজপথ উত্তাল। জেলা শহরে ছড়িয়ে পড়েছে উত্তেজনা। গ্রামে যার প্রভাব পড়তে বেশি সময় লাগে না। আবাল বৃদ্ধ বণিতা মুক্তিযুদ্ধে যাবার জন্যে প্রস্তুতি গ্রহণ করছে- কেউ কেউ মুক্তিযুদ্ধে চলেও গিয়েছে। এলাকার হিন্দু পাড়ার অনেকে জীবন বাঁচাতে ভারতে পাড়ি জমিয়েছে। শুধু হিন্দু বললে ভুল হবে, মুসলমানরাও বাদ যায় না তার থেকে। হাজার হাজার মানুষ পিঁপড়ার ঝাঁকের মতো পাড়ি দিচ্ছে প্রতিবেশি দেশ ভারতে।
খান সেনারা যে গ্রামে ঢুকছে সে গ্রাম তছনছ করে তবেই শান্ত হচ্ছে। নারী-শিশুরা বাদ যায়না তাদের হাত থেকে। আপনের বাবা বেঁচে নেই। গত বছর ফাল্গুনের আঠারো তারিখে টাইফয়েড জ্বরে ভুগে মারা গিয়েছিল। বড় দাদা ইতিমধ্যে মুক্তিযুদ্ধে যোগ দিয়েছে। সে মাকে মুক্তিযুদ্ধে যাবার আগ্রহের কথা জানালে তিনি তখনই জয় তিলক কপালে এঁকে দিয়ে বলেছিল, ‘যা বাবা, দেশ মাতাকে রক্ষা কর।’
‘তোমাকে রেখে যেতে মন তো সাঁই দিচ্ছে না মা।’
‘আমার চিন্তা তোকে করতে হবে না। ফিরে এসে যদি দেখিস আমি নেই তাহলে দুঃখ করবি না। ভাববি বিজয়ের পতাকায় আমি আছি।’
‘মা তুমি চিন্তা করো না। বিজয় ছিনিয়ে নিয়ে তবেই তোমার কাছে ফিরে আসবো। এ আমার প্রতিজ্ঞা।’ বলেছিল আপন।
মহিমার কাছে কথাটা জানালে সে বলে, ‘আমার কপালে সিঁদুর দিয়ে তারপর যাও। যাতে আমি তোমার অপেক্ষায় থাকতে পারি।’
আপন বিভিন্ন অজুহাত দিলেও সেদিন কোন অজুহাতে কাজ হয় না। এলাকার একমাত্র পুরহিত দু’দিন আগেই স্বপরিবারে পালিয়ে গিয়েছে ভারতে। মন্দিরগুলো শূন্যস্থানে দাঁড়িয়ে থাকা শূন্যের মতো ভগ্ন হৃদয়ে দাঁড়িয়ে আছে কারো অপেক্ষায়। শেষ পর্যন্ত নিষ্প্রাণ মন্দিরে যেয়ে ঠাকুরের সামনে কপালে সিঁদুর আর ভাটিফুল দিয়ে গাঁথা মালা বদল করে দু’জন দু’জনাকে আপন করে।
আপন মাকে এসব কথা বললে তিনি সাবলীলভাবে নতুন বউকে ঘরে তুলে নেন। পরের দিন ভোর হবার আগেই আপন বেরিয়ে যায় মুক্তির টানে। আপনকে বিদায় দিতে মহিমার মন সাঁই না দিলেও সে আটকাতে পারে না। আপনের ওপর তার যেমন অধিকার, দেশ মাতার অধিকার তার চেয়েও বেশি। শুধু চোখের জল ফেলে ঠোঁট কাঁপাতে কাঁপাতে বলেছিল, ‘তোমার আসার প্রতীক্ষায় থাকবো আজীবন।’ আপনকে বিদায় দিয়ে মহিমা গোপনে তার ঘরে এসে ওঠায় তার বাবা-মা কিছু জানতেই পারে না।
দিন যত যায় দেশের অবস্থা ততই খারাপ থেকে খারাপতর হতে থাকে। মহিমার বাবা প্রথমে গ্রামে থাকতে চাইলেও শেষ পর্যন্ত অনেকের মতো পরিবার নিয়ে রাতের অন্ধকারে অনেক কষ্টে ভারতে যেয়ে শরণার্থী শিবিরে আশ্রয় নেয়। এখানে থাকা অবস্থায় মহিমার শারীরিক অবস্থার পরিবর্তন আসে। যা পরিবার তথা পুরো বংশের মুখে চুনকালি দেবার জন্যে যথেষ্ট। আপন তাকে মন্দিরে বিয়ে করেছে একথা জানালেও কোন কাজ হয় না। ভূবন কর্মকার এ বিয়ে মানে না বলে সাফ সাফ জানিয়ে দিয়েছে। পেটের আগত সন্তান নষ্ট করার জন্যে মহিমার ওপর চাপ সৃষ্টি করলে কিছুতেই সে রাজী হয় না। মহিমা মনে প্রাণে বিশ্বাস করে, আগত সন্তানের পিতৃপরিচয় আছে। তার পিতা একজন মুক্তিযোদ্ধা।
দেশ স্বাধীন হয়। স্বাধীনভাবে পতপত করে ওড়ে লাল সবুজের পতাকা। মহিমার শরীরের অবস্থা ভাল না বলে শরনার্থী শিবির থেকে এক নিকট আত্মীয়ের বাড়িতে আশ্রয় নেয়। সেখানেই সেজুঁতির জন্ম। ভূবন কর্মকার প্রথমে স্বাধীন দেশে ফিরে এসে গ্রামের জায়গা জমি সব বিক্রি করে নারায়নগঞ্জ শহরে একটি বাড়ি কেনে। কিছুদিন পরে মহিমাদের সেখানেই নিয়ে আসে, যাতে কেউ জানতে না পারে সেজুঁতির জন্মবৃত্তান্ত। যদিও এখন সেজুঁতিই ভূবন কর্মকারের প্রাণ ভোমরা।
স্বাধীন দেশে মহিমা আপনকে অনেকভাবে খুঁজেছে; পায়নি। গ্রামে গিয়ে জানতে পারে, যুদ্ধে আপনের পায়ে গুলি লেগেছিল। কিছুদিন হাসপাতালে থেকে গ্রামে ফিরেও এসেছিল। তার দাদা যুদ্ধে শহীদ হয়েছে। বাড়িতে পাক হানাদার বাহিনীরা আপনকে খুঁজে না পেয়ে তার বৃদ্ধ মাকে গুলি করে মেরে ফেলে। দাদা আর মায়ের মৃত্যুশোক সাথে মহিমার খোঁজ না পেয়ে কোথায় যেন চলে যায় আর ফিরে আসেনি। সেই থেকে প্রতি বছর ২৬ শে মার্চে মহিমা একা একা গ্রামে যায় আপনের খোঁজে। যদি তার দেখা পায়।
নীরবতা কাটিয়ে সেজুঁতি বলল, ‘তোমরা স্মৃতিচারণের বহু সুযোগ পাবে। বিয়েটা আগে সারা হোক। এই নাও সিঁদুরের কৌটা।’ দু’জনের মুখ থেকে কোন কথা বের হয় না। আনন্দে তাদের চোখ ছল ছল করে ওঠে। সেজুঁতি আবারো বলল, ‘আমি তোমাদের সব অতীত জানি। আর আমার অধিকার প্রতিষ্ঠার জন্যে বিয়ের আয়োজনটা করতেই হতো। আমি গর্বিত; আমি তোমাদেরই সন্তান।’
‘মা তুই যে…….’ মহিমার কথা শেষ না হতেই সেজুঁতি বলল, ‘হুম ভালবাসি, অবশ্যই ভালবাসি। প্রথমদিন থেকেই আমার বাবার আসনে তাঁকে বসিয়ে রেখেছি। শুধু আজ আমার পূর্ণ অধিকার আদায় করে নিলাম।’
Leave a Comment
Your email address will not be published. Required fields are marked with *