সেই সাতের দশকে আমার মেয়েবেলা। ভাগীরথীর তীরে পূর্ব বর্ধমানের নৈহাটি গ্রামে পাঠশালা, পাশের গ্রাম সীতাহাটিতে উচ্চ বিদ্যালয় থেকে মাধ্যমিক পাশের পর কাটোয়া কলেজে এইচ এস, ইতিহাসে অনার্স ও বি- এড, পড়া। মাসুন্দী গ্রামের রায় পরিবারের ফুলবৌমা। আট ভাইবোনের ছোটো। আদরে সোহাগে কেটেছে মেয়েবেলা। পরবর্তীতে শ্রীরামপুরে। ২০১৬ সালে রবীন্দ্রভারতী বিশ্ববিদ্যালয় থেকে মাস্টার্স ডিগ্রি লাভ।
আমাদের সহজপাঠ প্রথম ভাগ ওয়ান আর দ্বিতীয়ভাগ টু’তে পাঠ্য ছিল। বই দুটি আমার মুখস্থ হয়েছিল। বিজলি বাতি ছিল না গ্রামে।
হেরিকেনের আলোয় নিকানো পরিচ্ছন্ন উঠোনে তালাই বা মাদুর পেতে বসে সন্ধ্যায় বাড়ির গাছগাছালির বাতাসেই পড়া করতাম ভাই বোনেরা সবাই। প্রয়োজনে মা আলো ঘরে নিলেও আমার পাঠ গড়গড়িয়ে চলতো। প্রতি বছর রবীন্দ্র জয়ন্তীতে আবৃত্তি করতাম। ক্লাস টু’তে স্বপ্ন কবিতা আবৃত্তি করতে গিয়ে ভুলে গেছি – “দুই হাত তুলে কাকা” লাইনটি। একজন শ্রোতা দুই হাত তুলে ধরিয়ে দিলেন খেই।
ক্লাস সিক্সে পড়ি যখন রবীন্দ্রজয়ন্তীতে পেটে ও পিঠে নাটকে ভুতুর চরিত্রে অভিনয় প্রথম মঞ্চাভিনয়।
আমাদের বিশাল আমবাগানে গাছের ছায়ায় কখনো গাছের শাখায় চড়ে দুলে দুলে কবিতা আবৃত্তির মহড়া চলতো। ভাগীরথীর জলে সাঁতার আর স্নানের সময় জলে স্টিমার এলে আমরা তীরে উঠে আশ্চর্য হয়ে দেখতাম! সমবেত সুরে শিশুরা চাইতাম– একটা বাঁশি দাও না!
আমাদের গ্রামের সবচেয়ে বড় উৎসব ওই অঞ্চলের জাগ্রত দেবতা কালারুদ্র দেবের চৈত্র গাজন। বোলানগান, শ্মশান নৃত্য, শিবের দোলযাত্রা আর ঢাকের বাদ্যেই ছিল গ্রামে আনন্দ উৎসব। বড়ো মেলা উদ্ধারণপুরের পৌষসংক্রান্তি ও উত্তরান্তির মেলা, নাম সংকীর্তন ও মহোৎসব। পুতুলনাচ, ম্যাজিক, সার্কাস, যাত্রাপালা দেখার আনন্দের স্বাদই আলাদা। কাঁচের চুড়ি আর নাগর দোলায় দোল খাওয়া ছিল মেয়েবেলার অন্যতম আকর্ষণ। শীতকালে আমরা পৌষল্যা অর্থাৎ বনভোজন করতাম। সেই রান্নার হাতেখড়ি। পুতুল বিয়ে দিতাম। ভাদ্রে নলিয়াপুরে ভ্রমরপাড়ে ভাদুমেলা হতো। ভাদুগান, মনসার ঝাঁপান শুনেই মেয়েবেলা কেটেছে। খেজুর রসের গুড় ও রস ইচ্ছেমতো খেতাম মেয়েবেলাতে। রেশনের কেরোসিন তুলতাম আমি। জমিতে আলু তুলেছি, বাগানের লেবু ও আমড়া চারটেতে গন্ডা আর কুড়ি গন্ডাতে এক পণ হিসেবে বিক্রি করতাম। চারটে শলা বা বাড়তি ফাউ দিতাম। দাসপাড়ার মহিলারা আমাকে দিদিঠাকরুণ ডাকতো। ওরাই কাঁচকলা, মোচা, থোড়, লেবু, আম, কাঁঠাল, আমড়া ইত্যাদি আমার কাছে নিয়ে মাথায় ঝোড়া নিয়ে তিন মাইল দূরে কাটোয়া শহরে বিক্রি করে পরের দিনে দাম দিতো। আবার সবজি ফসল নিতো। আমি এ সময় থেকেই সংসারের কাজে ছিলাম। বাবা আমাকে এইসব শিখিয়ে বলেছিলেন– তুই আমার ছোটছেলে। যত খুশি পড়বি। চাকরি করবি। বিয়ে দেবো, তবেই স্বাধীনতা পাবি।
নাহ্! চাকরি পাই নি। তবে স্বাধীনতা উপলব্ধি করি নিজের কাজে ও সংসারে।
শৈশবে আমরা নিয়ম মতো পড়তাম। অতিরিক্ত চাপ কখনোই ছিল না। খেলেছি রকমারি খেলা। ঘরে বসে আবার মাঠে দৌড়ে। দুর্গাপুজো হতো বাড়ির সামনেই। রক্ষাকালি বৈশাখে। দোল দুর্গোৎসব নিয়ে তিনবার কুমারী রূপে পুজিতা হয়ে আমার মেয়ে বেলার আনন্দ অত্যন্ত সুখের শান্তির সর্বোপরি স্বস্তির ছিল।
আমার মেয়েবেলার দুই একটি উজ্জ্বল স্মৃতি-
মেয়েবেলাটি গ্রামে অতিবাহিত। খেলার সাথীতে জাতপাত ছেলে- মেয়ে ভেদ ছিল না। গ্রামের পাঠশালায় খুব আগেভাগেই পৌঁছে যেতাম। দরজা খুলবেন তো মাস্টারমশাই এসে।
জানলার রডে ছিল বেশ ফাঁক। তাই গলে ঘরে ঢুকে ডেস্ক দখল ছিল আমাদের লক্ষ্য। চারজন ছেলে সহপাঠী আমার সঙ্গে খুনসুটি করতো। ওরাও যথারীতি পৌঁছে যেত। ওদের খাতার পৃষ্ঠা ছিঁড়ে ধুলো ভরে ফুঁ দিল একদিন আমাকে লক্ষ্য করে।
আমি একা। ওরা চারজন। আমি কাঁদছি। ওরা বলছে আমরা সিগারেট খাচ্ছি।
বলছি, ’ধুলো লাগছে গায়ে মাথায়।’
সমস্বরে উত্তর- ‘ধোঁয়া তো! এর মধ্যে তুই আছিস।’
–হ্যাঁ তাই।
একজন বানানে বলল, ‘চার-মিনা-র’ আছিস তো?
অসহায়। কাঁদি। বাড়ি এসে দাদাকে ডেকে স্কুলে নিয়ে যাই। তখনো মাস্টারমশাই আসেন নি। ওরা দাদাকে দেখেই পাশে ষষ্ঠীতলার বাঁশবাগানে লুকিয়ে পড়ে।
দাদা ওদের বইয়ের ব্যাগগুলো নিয়ে মাস্টারমশাই এলে জমা দিয়ে নালিশ জানায়।
মাস্টার মশাইয়ের নির্দেশে ওরা নিজের নিজের কান ধরে বলে- ‘আর কক্ষনো এমন করবো না।’
পরেরদিন টিফিনে আমরা চার মেয়ে বিলের ধারে কামরাঙা পেড়ে ফিরছিলাম। ওদের একজন ছুটে এসে আমার পায়ে পা লাগিয়ে যাকে বলে ল্যাঙ মারা ফেলে দিল। পথের ধুলোয় ধপাস! আমি ব্যথা ও লজ্জা পেলাম। ছুটিতে আনমনে বাড়ি ফিরছিলাম। হঠাৎ পিছনে লাথির আঘাতে থতমত। দেখি সহপাঠী ফাস্ট বয় ছুটে পালাচ্ছে। হতভম্ব আমি। ক্ষমতায় ওদের সঙ্গে পারতাম না। মেয়েবেলাটি বড্ড অসহায় অবস্থায় কেটেছে আমার। কখন কি হয়। ভয় আর ভয়।
সাতের দশকের মেয়েবেলা। ভাগীরথীর তীরে। পূর্ব বর্ধমানের নৈহাটি গ্রাম। খেলাধুলা, গাছে ওঠা, গঙ্গাতে সাঁতরে স্নান, কুল, জাম, খেজুর, বেল, আম পেড়ে ইচ্ছে মতো খেয়ে মেয়েবেলা কাটিয়ে আজ কলম হাতে। গ্রামের পাঠশালায় ছেলেমেয়ে একসঙ্গে পড়ালেখা খেলা আর খুনসুটি– সোনাঝরা সেই হারানো মেয়েবেলার স্মৃতি মেদুরতায়! দিদির ছেলেপুতুলের সঙ্গে আমার মেয়ে পুতুলের বিয়েতে আমাদের তিন বাঁড়ুজ্যে বাড়ির সবাই লুচি আলুরদম ও মিষ্টি খেয়েছে! মেয়েবেলায় দুর্গা ও অন্নপূর্ণা পুজোয় এই মেয়েই তিন তিনবার কুমারী পুজো পেয়ে কত আনন্দে!