728 x 90

ট্রেন্স থেকে ফিরে এসে: রউফ আরিফ

পূর্ব প্রকাশের পর- ৫. ‘অবাক পৃথিবী, অবাক করলে তুমি, জন্মেই দেখি, ক্ষুব্ধ স্বদেশ ভুমি।’ আজকে বারবার আরমানের কেন জানিনা এই লাইন দুটো বেশি করে মনে পড়ছে। সন্ধ্যাবেলা আরমান একা একা পায়চারি করছিল। উঠোনটা বেশ বড়। মামারা ধানিপানি গৃহস্থ পরিবার। সবাই লেখাপড়া জানে। ভালো ভালো চাকরিও করে। চাষবাসও আছে। বনেদিয়ানার সাথে পুরোনো ঐতিহ্য যত্নসহকারে ধরে রেখেছে।


পূর্ব প্রকাশের পর-

৫.

‘অবাক পৃথিবী, অবাক করলে তুমি,

জন্মেই দেখি, ক্ষুব্ধ স্বদেশ ভুমি।’

আজকে বারবার আরমানের কেন জানিনা এই লাইন দুটো বেশি করে মনে পড়ছে। সন্ধ্যাবেলা আরমান একা একা পায়চারি করছিল। উঠোনটা বেশ বড়। মামারা ধানিপানি গৃহস্থ পরিবার। সবাই লেখাপড়া জানে। ভালো ভালো চাকরিও করে। চাষবাসও আছে। বনেদিয়ানার সাথে পুরোনো ঐতিহ্য যত্নসহকারে ধরে রেখেছে।

উঠোনের কোনায় বিশাল একটা বিচালির পালা। একপাশে লম্বা গোয়ালঘর। যেখানে দশ বারোটা গরু অনায়াসে রাখা যায়। মামাদের এখানে এসে এতদিন আরমান অস্থির জীবন কাটাচ্ছে। সে নিজে এখানে থাকলেও মনটা পড়ে রয়েছে ঢাকায়। আরমানের পাশে এসে দাঁড়ালো তার নানাজান। তিনি ক্ষীণ কণ্ঠে ডাকলেন, দাদু ভাই।

-জি নানা ভাই।

-কি করছ এখানে অন্ধকারে?

-কিছু না। হেটে বেড়াচ্ছি।

-মন খারাপ লাগছে? মন খারাপ করে কি করবে বলো? ভবিতব্যের লিখন তো পাল্টানো যাবে না। পরম করুণাময়ের ইচ্ছাকে স্বাভাবিকভাবে মেনে নেওয়াই বুদ্ধিমানের কাজ। এই আমাকে দেখছিস না। তোর মাকে তো আমি কোলে করে মানুষ করেছি। সারা উঠোন পা পা করে হেঁটে বেড়াতো। কতবার পড়তো-কতবার উঠতো।

শিশু থেকে কিশোরী হলো। কিশোরী থেকে যুবতি। তখন তাকে নিয়ে আমার কত উৎকণ্ঠা। একটু দুরন্ত ছিল বলে তোর নানিজান সবসময় তাকে চোখে চোখে রাখতো। ভয়ে কাটা হয়ে থাকতো। কখন কোন বিপদ ঘটায়। তোর বাবার সাথে বিয়ে দিয়ে দিলাম। সে যুগে এমবিবিএস পাশ করা ডাক্তার চাইলেই পাওয়া যেত না।

বিয়ের পরে তোর বাবা তাকে নিয়ে ঢাকায় চলে গেলো। ঢাকায় তারা ভালো থাকবে বলে। এখানকার পরিবেশ পরিস্থিতি তখন খুবই খারাপ। হিন্দুস্থান পাকিস্থান ভাগ হওয়ার পরে সবাই পাকিস্তানে যাওয়ার জন্য পাগল হয়ে গেলো। তোর বাবাও চলে গেলো। অথচ দেখ নিয়তির কি নির্মম পরিহাস। আমি এখনো এই পৃথিবীর মাটিতে হেঁটে বেড়াচ্ছি। কিন্তু তোর মা বাবা কেউ আজ নেই। এ যে কি কষ্ট তা তোকে কি করে বোঝাবো।

-সবই বুঝি নানাজান। কিন্তু মন মানাতে পারছি কই।

-চেষ্টা কর ভাই। মনকে শক্ত কর। ধীরে ধীরে সব ঠিক হয়ে যবে।

ওদের কথার মাঝে এসে দাঁড়ালো পারভিন। আরমানের মামাতো বোন। সে বৃদ্ধকে উদ্দেশ্য করে বলল, দাদা ছোট চাচা তোমাকে ডাকছে।

-কেন, ডাকছে কেন?

-ওপাড়ার কালু ঘোষ এসেছে। তিনি তোমার খোঁজ করছে।

-ও আচ্ছা। নানাজান আর দাঁড়ালো না। ভেতর বাড়ির দিকে চলে গেলো। পারভিন দাঁড়িয়ে ছিল। আরমান জিজ্ঞাসা করল, কিছু বলবে মেজো আপা?

-চল। ওই পুকুর ঘাটে গিয়ে বসি।

-চলো।

আলো আধারির স্বল্প আলোয় ওরা দুজনে ছোট ছোট পা ফেলে সান বাঁধানো পুকুর ঘাটে গিয়ে মুখোমুখি বসল। পারভিন বিবাহিত। দুই সন্তানের জননী। তবে বয়সের চেয়ে সে অনেক বেশি সুন্দরী। হঠাৎ করে কেউ তার প্রকৃত বয়স আন্দাজ করে নিতে পারে না। পারভিন পেশায় শিক্ষক। একটা কলেজে পড়ায়। সে কোনো ভূমিকা না করে বলল, আজ একটা চিঠি আমার হাতে এসে পৌচেছে। একটা মেয়ের চিঠি। মেয়েটার নাম রোজি। চিনিস নাকি মেয়েটাকে?

-হাঁ আপা। রোজি খুব ভালো মেয়ে। চিঠিটা কই?

-আমার কাছে আছে। মেয়েটাকে কি তুই বিয়ে করেছিস?

-হাঁ।

-তাহলে তাকে নিয়ে তোর চিন্তা ভাবনা করা উচিত।

-ওকে নিয়েই ভাবছি। খুব শীঘ্র আমি বাংলাদেশে চলে যাবো।

-ওকে নিয়ে কি আবার এখানে চলে আসবি? না কি ওখানেই সেটেল্ড করবি?

-না। এখানে ফিরে কি করবো। চাচারা আমার জমাজমি ঠিক মতো দিতে চাইছে না। তাছাড়া আমি এখানে কোনো সরকারী চাকরি পাবো না। আমার রেজাল্ট ভালো। মুক্তিযোদ্ধা ছিলাম। আল্লাহ সহায় হলে ওখানে ভালো চাকরি পাবো।

-বাংলাদেশে যে অরাজগতার কথা শুনছি তাতে করে যা করবি খুব ভেবে চিন্তে করবি।

-আচ্ছা।

৬.

আরমান কোলকাতা থেকে ঢাকায় ফিরে এলো। ঢাকায় এসে জানতে পারল রোজি ঢাকায় নেই। সে এখন কুমিল্লায়। ঢাকায় এক বন্ধুর বাসায় দুদিন কাটিয়ে রোজির খোঁজে কুমিল্লায় গেলো।

আরমান যখন কুমিল্লায় গিয়ে পৌছালো তখন বিকেল। শুধু বিকেল বললে ভুল হবে, তখন পড়ন্ত বিকেল। জায়গাটা অচেনা না হলেও বাড়িটা অচেনা। তবুও খুঁজে বের করতে বিশেষ বেগ পেতে হলো না।

জায়গাটা শহর থেকে মাইল পাঁচেক দূরে। বড়সড় একটা গ্রাম্য বাজার, বাজারের পাশেই বাড়ি। বাড়ির উঠোনে বিশাল একটা ঝাপড়ানো পেয়ারা গাছ। একপাশে পূঁইশাকের মাচা। পলের গাদা। গোয়াল ঘর। অন্যদিকে পরপর দু’খানা টিনের ঘর। টিনের বেড়া দেওয়া।

পেয়ারা গাছের নিচে দাঁড়ানো সতেরো আঠারো বছর বয়সের এক তরুণী। পরনে শাড়ি ব্লাউজ। কোমরে আঁচল জড়ানো। মাথার দুপাশে দুটো বেণী দুলছে। হাতে একটা লগা। পেয়ারা গাছ থেকে পেয়ারা পাড়তে পাড়তে উঠোনে বেগানা পুরুষ দেখে থমকে দাঁড়িয়েছে। চোখে মুখে ছড়িয়ে আছে কিছুটা লজ্জা আর একরাশ বিস্ময়।

আরমান দূরে দাঁড়িয়েই জিজ্ঞাসা করে, এটা কি জব্বার সাহেবের বাড়ি?

-জ্বি। আপনি কাকে চান? মিয়াভাই বাড়ি নেই।

আরমান বুঝে নেয় মেয়েটা জব্বার সাহেবের বোন। তাই আবারও জিজ্ঞাসা করে, ওনার স্ত্রী বাড়ি নেই?

-হাঁ আছে।

-তাকে গিয়ে বলেন যে, ঢাকা থেকে মেহমান এসেছে।

-আচ্ছা। মেয়েটা ভেতর বাড়ির দিকে যেতে যেতে ফিরে দাঁড়ালো। আপনি দাঁড়িয়ে থাকলেন কেন? বারান্দায় উঠে বসেন। ভাবীকে গিয়ে কি বলবো। আপনি তার কি হন?

-আমি তার ভগ্নিপতি।

মেয়েটার মুখে এবার হাসি ফোটে। আরে, তাহলে তো আপনি কাছের মানুষ, বেয়াই সাহেব। কোন জন?

-ছোট। তোমাদের এখানে রোজি আছে না? ওনার।

-ওম্মা। আপনি আরমান ভাই! স্লামালেকুম। আসেন আসেন। পরিচয়ডা আগে দেবেন তো।

মেয়েটার মুখেচোখে খুসি উপচে পড়ে। সে প্রাণপনে নিজের আঞ্চলিক ভাষাটা পরিহার করে কথা বলার চেষ্টা করছিল। যদিও সেটা রপ্ত না থাকায় পারছিল না। মাঝে মাঝে দু একটা শব্দ বেরিয়ে আসছিল। এরপরে সে আরমানের মুখোমুখি দাঁড়ালো। আরমানের হাত থেকে ব্যাগটা নিয়ে ঘুরে দাঁড়িয়ে চিৎকার দিলো, বড় ভাবী, রোজি আপা দেখে যান, নতুন অতিথি এসেছে। বড় ভাবী রোজি আপা-

আরমান মেয়েটাকে কিছু জিজ্ঞাসা করতে যাচ্ছিল। কিন্তু সে প্রশ্ন করার আগেই বাড়ির ভেতর থেকে বেরিয়ে এলো রোজি। আরমানকে দেখে থমকে দাঁড়ালো। ওর চোখে মুখে আনন্দ বেদনার মিশ্রিত অভিব্যাক্তি। ঠোঁটে চাপা হাসি ঝিকমিক করছে। চোখে নেমেছে অশ্রুর ধারা।

আরমান ভাবছে অন্য কথা। রোজির কোলে একটা ছোট্ট শিশু। কার শিশু? রোজির? ছেলে না মেয়ে। তাহলে সে কি বাবা হয়ে গেছে?

রোজি লিখেছিল সে মা হতে যাচ্ছে। কতদিন আগে হিসাব মিলাতে পারছে না। পায়ে পায়ে রোজির কাছে গিয়ে দাঁড়ালো। পরী বলল, কি দেখছেন মিয়া! ছেলের বাপ হয়ে গেছেন। দেখেছেন কেমন সুন্দর। মা বাপ দুজনকেই ছাড়িয়ে গেছে।

আরমানের ভেতরে থম মেরে থাকা আনন্দের পাখিরা হঠাৎ করে যেন কিচির মিচির করে ডেকে উঠল।

 -সত্যি!

পরীর চোখ অপূর্ব ভঙ্গিমায় ঘোরে। সত্যি নয়তো কি মিথ্যা নাকি। আপনি তো মিয়া বিদেশে গিয়ে কেমন চুপটি মেরে ছিলেন। যত ঝামেলা তো রোজি আপা একাই সামলালো।

আরমান বাচ্চাটাকে কোলে নেবার জন্য হাত বাড়ালো। রোজি তেমনি নিরবে বাচ্চাটকে আরমানের কোলে তুলে দিলো। আরমান ছেলেকে বুকে জড়িয়ে ধরে আকাশের দিকে চেয়ে চোখ বুজল। বাপ ছেলের এই মিলন মুহূর্ত দু’চোখ ভরে দেখে আনন্দে কেঁদে ফেলল রোজি। আজ কতদিন সে এই মিলন মুহূর্তটির জন্য অপেক্ষা করে আছে। কত কষ্ট, কত প্রতিকুলতা, ঝড় ঝঞ্ঝা দু’পায়ে মাড়িয়ে এসেছে।

পরী আবারও আলি আরমানের উদ্দেশ্যে কথা ছুড়ে দিল, কি মিয়া, ছেলেরে পেয়ে ছেলের মারে ভুলে গেলেন নাকি?

আলি আরমান বাঁকা চোখে তাকালো, মানে!

চলবে-

Read More

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked with *

সর্বশেষ পোস্ট

Advertising