প্রফেসর ড. মুহাম্মদ ইউসুফ আলী: শিরক আরবি শব্দ যার অর্থ হলো, অংশিদার সাব্যস্ত করা। মহান আল্লাহ তায়ালাকে বাদ দিয়ে অন্য কোন কিছুর ইবাদাত করা অথবা আল্লাহ তায়ালার যে কোন হক্বে কাউকে অংশীদার সাব্যস্ত করাকেই শিরক বলা হয়। শিরক এরুপ মারাত্মক গোনাহ যা মহান আল্লাহ তায়ালা কখনই ক্ষমা করবেন না বলে পবিত্র কুরআনে ঘোষণা করছেন। হজরত
প্রফেসর ড. মুহাম্মদ ইউসুফ আলী: শিরক আরবি শব্দ যার অর্থ হলো, অংশিদার সাব্যস্ত করা। মহান আল্লাহ তায়ালাকে বাদ দিয়ে অন্য কোন কিছুর ইবাদাত করা অথবা আল্লাহ তায়ালার যে কোন হক্বে কাউকে অংশীদার সাব্যস্ত করাকেই শিরক বলা হয়। শিরক এরুপ মারাত্মক গোনাহ যা মহান আল্লাহ তায়ালা কখনই ক্ষমা করবেন না বলে পবিত্র কুরআনে ঘোষণা করছেন। হজরত আদম আলাইহিস সালামের জীবদ্দশায় তার বংশধরদের ধর্মবিশ্বাসে কোনো প্রকার শিরকের সংমিশ্রণ ছিলো না। তারা সবাই ছিল তাওহীদ বা একত্ববাদে বিশ্বাসী। ইতিহাস ও তাফসীরের কিতাব থেকে জানা যায়, আদম আলাইহিস সালামের শরিয়তের অধিকাংশ আদেশ নিষেধ ছিলো বৈষয়িক বা দুনিয়ার বিষয়ে। কারণ পৃথিবীকে নতুন করে আবাদ করতে এবং এটিকে বাসযোগ্য করতে এই সমস্ত বিষয়ের প্রয়োজনই ছিলো সবচেয়ে বেশি। এ কারণে আদম আলাইহিস সালামের বংশধরদের মাঝে ধর্ম নিয়ে তেমন কোনো বিভেদের সৃষ্টি হয় নি। কিন্তু আদম আলাইহিস সালামের মৃত্যুর পর কালের বিবর্তনে মানুষের মধ্য শিরকের অনুপ্রবেশ ঘটে। তার ওফাতের কয়েক হাজার বছর পর হজরত নুহ আলাইহিস সালামের সম্প্রদায় ওয়াদ, সুওয়া, ইয়াগুছ, ইয়াউক ও নাসর নামের কয়েকজন মৃত নেককার লোকের পূজা শুরু করে। এ প্রসঙ্গে আল্লাহ জাল্লাশানুহু বলেন, “তারা বলছে (নূহ আলাইহিস সালামের কওম), তোমরা তোমাদের উপাস্যদেরকে ত্যাগ করো না এবং ত্যাগ করো না ওয়াদ, সুওয়া, ইয়াগুছ, ইয়াঊক ও নাসরকে” (সূরা নূহ::২৩)। তাদের পূজায় লিপ্ত হওয়ার পর্যায়ক্রমিক ধাপগুলো ছিল এমন: ওয়াদ ছিলেন নুহ পূর্বকালীন সময়ের সবচেয়ে নেককার ও বুজুর্গ ব্যক্তি। লোকেরা তাকে খুবই ভালোবাসতো ও সম্মান করতো। সে মারা যাওয়ায় লোকেরা খুব কষ্ট পেলো এবং তার কবরের পাশে জড়ো হয়ে আহাজারি করতে লাগলো। ইবলিস শয়তান তাদের এ অবস্থা দেখে এক ফন্দি আঁটলো। সে মানুষের আকৃতি ধরে এসে বললো, এ লোকের জন্য তোমাদের কী বেদনা তা আমি লক্ষ্য করেছি। আমি কি তোমাদেরকে তার এমন একটি প্রতিকৃতি বানিয়ে দিবো যা তোমরা তোমাদের সমাবেশস্থল ও মিলনকেন্দ্রগুলোতে রেখে দিবে এবং এর মাধ্যমে তোমরা তার কথা স্মরণ করবে? এইসব নেককার মানুষের মূর্তি সামনে থাকলে তাদের দেখে আল্লাহর প্রতি ইবাদতে অধিক আগ্রহ সৃষ্টি হবে। লোকেরা তার কথায় খুশি হয়ে তাকে তার প্রতিকৃতি বানিয়ে দিতে বললো, যাতে তারা তাকে চোখের সামনে দেখে তার জন্য শোক করতে পারে, তাকে স্মরণ করতে পারে। এভাবে শয়তান তাদের জন্য ওয়াদ, সুওয়া, ইয়াগুছ, ইয়াউক ও নাসর নামের বুজুর্গ ব্যক্তিদের প্রতিকৃতি বানিয়ে দেয় এবং লোকজন তাদের প্রতিকৃতি সামনে রেখে তাকে স্মরণ করতে থাকে। ধীরে ধীরে অনেকে তাদেরকে ওছিলা বানিয়ে আখেরাতে মুক্তি পাবার আশায় তাদের পূজা শুরু করে। তাফসিরবিদগণ বলছেন, এই পূজা তাদের কবরেও হতে পারে, কিংবা তাদের মূর্তি বানিয়েও হতে পারে। কালক্রমে তাদের সন্তানেরা তাদের এ সমস্ত কাজ দেখতে লাগলো। ধীরে ধীরে বংশবৃদ্ধি হতে লাগলো। নতুন প্রজন্ম আস্তে আস্তে ওই মূর্তি তৈরির আসল উদ্দেশ্যটিই ভুলে গেলো। তারা মৃত পুণ্যবান লোকটিকে নয়, এই মূর্তিকেই শ্রদ্ধা করতে লাগলো এবং মূর্তিকে বিভিন্ন ক্ষমতার অধিকারী মনে করে এটার পূজা করতে লাগলো। আর এভাবেই মানব ইতিহাসে সর্বপ্রথম মূর্তি পূজার সূচনা হলো। এই পাঁচটি মূর্তির মাহাত্ম্য ও তাদের প্রতি ভক্তি মানুষের অন্তরে অত্যন্ত মজবুতভাবে গ্রোথিত হয়েছিলো। এমনকি তারা বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে এবং পারস্পরিক চুক্তি সম্পাদনকালে তাদের নাম উল্লেখ করতো। তাফসির ইবনে কাসির, হাদিসের বর্ণনা ও আরবের ইতিহাস থেকে জানা যায়, এই মূর্তিগুলোর পূজা পরবর্তীকালে আরবদের মধ্যেও চালু হয়ে যায়। ‘ওয়াদ’ ছিলো বনু কালবের জন্য দুমাতুল জান্দালে, সুওয়া ছিলো বনু হোজায়েলের জন্য, ইয়াগুছ ছিলো বনু গুত্বায়েফের জন্য জুরুফ নামক স্থানে, ইয়াঊক ছিলো বনু হামদানের জন্য এবং নাসরা ছিলো হিমইয়ার গোত্রের বনু জি-কালা’র জন্য। পৃথিবীর আদি ও সবচেয়ে প্রাচীন শিরক হলো নেককার মানুষের কবর অথবা তাদের মূর্তিপূজা। যা আজও প্রায় সকল ধর্মীয় সমাজে চালু আছে। উদাহরণ স্বরুপ, যীশুর বা ঈসা আলাইহিস সালামের মূর্তি। আজকের খৃস্টান সম্প্রদায় গির্জায় স্থাপিত যীশুর মূর্তির সামনে গিয়েই নতজানু হয়, তার কাছেই কায়মনোবাক্যে প্রার্থনা করে, কোনো কিছু কামনা করে। যীশুর মূর্তিকেই নবীর একটি সিম্বল বানিয়ে, ঈশ্বরের পুত্রের একটি উপমা বানিয়ে তার পূজা করছে। আরও কিছু ধর্ম আছে যেখানে হাজারো মানুষ ও পশুপাখির মূর্তি বানিয়ে তার পূজা করা হয়। মূর্তিপূজা হলো নির্ভেজাল শিরক যার গোনাহ আল্লাহ সুবহানাহু তায়ালা কখনই মাফ করবেন না। আমাদের বর্তমান মুসলিম সমাজেও মূর্তি পূজার এই বীজ স্থানপূজা, কবরপূজা, কবরে মানত করা, ছবি-প্রতিকৃতি বানিয়ে সম্মান করা ইত্যাদি রুপে অত্যন্ত সন্তর্পণে প্রবেশ করছে। মহাবিশ্বের একমাত্র মালিক ও উপাস্য মহান আল্লাহ পাক আমাদের সবাইকে সহিহ বুঝ দান করুন এবং শিরক থেকে বেঁচে থাকার তৌফিক দান করুন।
(লেখক: মৎস্য-বিজ্ঞানী ও অধ্যাপক, খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়, পোস্ট-ডক্টরাল ভিজিটিং ফেলো, সিডনী)
Leave a Comment
Your email address will not be published. Required fields are marked with *