728 x 90

কাবা শরীফে মূর্তিপূজার উৎপত্তি কিভাবে হলো?

  প্রফেসর ড. মুহাম্মদ ইউসুফ আলী:  শিরকের গোনাহ সবচেয়ে মারাত্মক ও ধ্বংসাত্মক। শিরকের গোনাহ অমার্জনীয়, এই মর্মে মহান আল্লাহ তায়ালা পবিত্র কুরআনে ঘোষণা করেন, “নিশ্চয় আল্লাহ তায়ালা তার সাথে শিরক করার অপরাধ ক্ষমা করবেন না। এ ছাড়া অন্যান্য অপরাধ যাকে ইচ্ছা ক্ষমা করে দেন। আর যে কেউ আল্লাহর সাথে শরিক করে, সে মহাপাপ করে (সূরা

 

প্রফেসর ড. মুহাম্মদ ইউসুফ আলী:  শিরকের গোনাহ সবচেয়ে মারাত্মক ও ধ্বংসাত্মক। শিরকের গোনাহ অমার্জনীয়, এই মর্মে মহান আল্লাহ তায়ালা পবিত্র কুরআনে ঘোষণা করেন, “নিশ্চয় আল্লাহ তায়ালা তার সাথে শিরক করার অপরাধ ক্ষমা করবেন না। এ ছাড়া অন্যান্য অপরাধ যাকে ইচ্ছা ক্ষমা করে দেন। আর যে কেউ আল্লাহর সাথে শরিক করে, সে মহাপাপ করে (সূরা নিসা:৪৮)”। অর্থাৎ, তওবা না করে শিরক করা অবস্থায় কেউ মারা গেলে তার আর নিস্তার নাই। অন্যত্র আল্লাহ পাক এরশাদ করেন, “নিশ্চয় শিরক সবচেয়ে বড় অন্যায় (সূরা লুকমান:১৩)”। মূর্তিপূজা হলো শিরকের একটি নির্ভেজাল রুপ। গত সংখ্যায় আমরা জেনেছিলাম পৃথিবীতে কিভাবে প্রথম মূর্তিপূজা ও শিরক চালু হয়েছিল। আজ আমরা জানবো ইসলামের প্রাণকেন্দ্র পবিত্র মক্কা ও কাবা শরীফে কিভাবে মূর্তিপূজা ও শিরকের প্রচলন হয়েছিল।

মক্কা বাসিরা মূলত. হযরত ইসমাঈল আলাইহিস সালামের বংশধর ছিল এবং তারা জন্মগতভাবেই তাওহীদ, রিসালাত ও আখেরাতে বিশ্বাসী ছিল। তারা পবিত্র কাবা গৃহকে আল্লাহর ঘর বা বায়তুল্লাহ বলে বিশ্বাস করত। এই কারণে তারা এই ঘরকে সম্মান করতো; রক্ষণাবেক্ষণ ও তত্ত্বাবধান করত। তারা এখানে নিয়মিতভাবে হজ্জ, ওমরাহ, ত্বওয়াফ ও সাঈ করত। এমনকি তারা বহিরাগত হাজীদের নিরাপত্তা ও পানি সরবরাহের দায়িত্ব পালন করত। কিন্তু দীর্ঘদিন যাবৎ তাদের মাঝে কোন নবী না আসায় শয়তান তার জাল বিস্তারের সুযোগ পায়। শয়তানী প্ররোচনায় তাদের গোত্র ও সমাজনেতা এবং ধনিক শ্রেণির অনেকেই পথভ্রষ্ট হয়ে যায়। পরিশেষে এক সময় তাদের মাধ্যমেই মূর্তিপূজার শিরক চালু হয়, যেভাবে ইতিপূর্বে নূহ আলাইহিস সালামের কওমের মধ্যে হয়েছিল। তাফসীর, হাদিস ও নির্ভরযোগ্য ইতহাস থেকে জানা যায়, কুরায়েশ বংশের বনু খোযা‘আহ গোত্রের সরদার আমর বিন লুহাই সর্বপ্রথম পবিত্র মক্কা ও কাবা শরিফে মূর্তিপূজার প্রচলন করেন। মহানবী সল্লাল্লাহু আলাইহিস সালাম বলেন, ‘আমার সম্মুখে (স্বপ্নে) জাহান্নামকে পেশ করা হল, … অতঃপর আমাকে দেখানো হল আমর বিন লুহাইকে। জাহান্নামে সে তার নাড়ি-ভুঁড়ি টেনে বেড়াচ্ছে। এ ব্যক্তিই প্রথম তাদের উপাস্যদের নামে উট ছেড়ে দেওয়ার রেওয়াজ চালু করেছিল (যা লোকেরা রোগ আরোগ্যের পর কিংবা সফর থেকে আসার পর তাদের মূর্তির নামে ছেড়ে দিত)। ঐসব উট সর্বত্র চরে বেড়াত। কারও ফসল নষ্ট করলেও কিছু বলা যেত না বা তাদের মারা যেত না (বুখারী ও মুসলিম)।

এই আমর বিন লুহাই ছিল বেশ ধার্মিক, দানশীল ও দরবেশ স্বভাবের লোক। মক্কার লোকেরা তাকে অত্যন্ত শ্রদ্ধা করত এবং তার প্রতি অন্ধভক্তি পোষণ করত। তাকে আরবের অন্যতম শ্রেষ্ঠ আলেম ও অলি-আউলিয়াদের মধ্যে গণ্য করা হতো। শয়তান তাকেই বেছে নিল তার কার্যসিদ্ধির জন্য। একবার তিনি শামের বালক্বা অঞ্চলের ‘মাআব’ নগরীতে গিয়ে দেখেন যে, সেখানকার লোকেরা জমকালো আয়োজনের মাধ্যমে ‘হুবাল’ মূর্তির পূজা করে। তিনি তাদেরকে এর কারণ জিজ্ঞেস করলে তারা বলে যে, আমরা এই মূর্তির ওছিলায় বৃষ্টি প্রার্থনা করলে বৃষ্টি হয় এবং সাহায্য চাইলে করলে সাহায্য পাই। এরা ছিল আমালেক্বা গোত্রের লোক এবং ইমলীক্ব বিন লাবেয বিন সাম বিন নূহ-এর বংশধর। আমর ভাবলেন অসংখ্য নবী-রসূলের জন্মভূমি ও কীর্তিভূমি এই শামের ধার্মিক লোকেরাই যখন ‘হোবল’ মূর্তির ওছিলায় বৃষ্টি প্রার্থনা করে, তখন আমরা করলে দোষ কি। আমরাও এটা করে উপকৃত হতে পারব। ফলে বহু মূল্যের বিনিময়ে আমর একটা হোবল মূর্তি খরীদ করে নিয়ে গেলেন এবং মক্কার নেতাদের রাজী করিয়ে পবিত্র কা‘বাগৃহে স্থাপন করলেন। কথিত আছে যে, একটা জিন আমরের অনুগত ছিল। সেই-ই তাকে খবর দেয় যে, নূহ আলাইহিস সালামের সময়কার প্রসিদ্ধ ওয়াদ, সুওয়া, ইয়াগুছ, ইয়াঊক ও নাসর (সূরা নূহে এগুলোর নাম আছে) প্রতিমাগুলি জেদ্দার অমুক স্থানে মাটির নীচে প্রোথিত আছে। আমর সেখানে গিয়ে সেগুলো উঠিয়ে আনেন এবং হজ্জের মওসুমে সেগুলিকে বিভিন্ন গোত্রের হাতে সমর্পণ করেন।

এভাবে আমর ছিলেন প্রথম ব্যক্তি, যিনি ইসমাঈল আলাইহিস সালামের দ্বীনে পরিবর্তন আনেন এবং তাওহীদের বদলে শিরকের প্রবর্তন করেন। অতঃপর ধীরে ধীরে বনু ইসমাঈলের মধ্যে মূর্তিপূজার ব্যাপক প্রসার ঘটতে থাকে। নূহ আলাইহিস সালামের কওমের রেখে যাওয়া ওয়াদ, সুওয়া, ইয়াগুছ, ইয়াঊক ও নাসর প্রভৃতি মূর্তিগুলি কালক্রমে ইব্রাহিম আলাইহিস সালামের বংশধরগণের দ্বারা পূজিত হতে থাকে।

উদাহরণস্বরুপ:-বনু হুযায়েল কর্তৃক সুওয়া, ইয়ামনের বনু জুরাশ কর্তৃক ইয়াগূছ, বনু খায়ওয়ান কর্তৃক ইয়াঊক্ব, যুল-কুলা কর্তৃক নাসর, কুরায়েশ ও বনু কেনানাহ কর্তৃক হুবাল ও উযযা, ত্বায়েফের বনু ছাক্বীফ কর্তৃক লাত, মদীনার আউস ও খাযরাজ কর্তৃক মানাত, বনু ত্বাঈ কর্তৃক ফিল্স, ইয়ামনের হিমইয়ার গোত্র কর্তৃক রিয়াম, দাউস ও খাছ‘আম গোত্র কর্তৃক যুল-কাফফায়েন ও যুল-খালাছাহ প্রভৃতি মূর্তি সমূহ পূজিত হ’তে থাকে (সীরাতে ইবনে হিশাম )। এভাবেই ইসলামের প্রাণকেন্দ্র মক্কা নগরী, তার আশপাশ এবং তাওহীদের ঘর পবিত্র কা’বা শরীফে শেষমেষ ৩৬০ টি মূর্তির পূজা হতে থাকে। বর্তমানে অনেক পীর-আওলিয়াদের কবরগুলো শিরকি কাজকর্মের আস্তানায় পরিণত হয়েছে। অথচ এই সমস্ত বুজুর্গগণ তাদের জীবদ্দশায় ঘূর্ণাক্ষরেও তাদের কবর উঁচু করে পূজার বেদী বানাতে বলেন নি। মুসলিম সমাজে আজ মূর্তিপূজা ও শিরকের বীজ স্থানপূজা, কবরপূজা, কবরে মানত করা, সম্মানিত ব্যাক্তিদের ছবি-প্রতিকৃতি বানিয়ে সম্মান করা ইত্যাদি রুপে অত্যন্ত সন্তর্পণে প্রবেশ করছে। আমাদের একমাত্র মালিক ও ইলাহ মহান আল্লাহ পাক আমাদের সবাইকে সহিহ বুঝ দান করুন এবং শিরক থেকে বেঁচে থাকার তৌফিক দান করুন।

 

(লেখক: মৎস্য-বিজ্ঞানী ও অধ্যাপক, খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়, পোস্ট-ডক্টরাল ভিজিটিং ফেলো, সিডনী)

 

 

Read More

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked with *

সর্বশেষ পোস্ট

Advertising