728 x 90

মসজিদুল আকসা ও বাইতুল মুকাদ্দাস

কায়সার আহমেদ: বাইতুল মুকাদ্দাস মক্কা ও মদীনার পরে মুসলিমদের কাছে তৃতীয় তীর্থ স্থান। তিন তিনটি ধর্মের মিলনস্থল জেরুজালেমের মসজিদুল আকসা। ইহুদী, খ্রিস্টান ও মুসলিমদের কাছে পবিত্র এই ভূমি মিলনস্থল হিসেবে কাজ করে আসছে শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে।মসজিদুল আকসাতে একসাথে প্রায় ৫০০০ মানুষ নামাজ আদায় করতে পারেন। মসজিদুল আকসার গম্বুজ কিন্তু সোনালি নয়, বরং কালচে ধূসর।

কায়সার আহমেদ: বাইতুল মুকাদ্দাস মক্কা ও মদীনার পরে মুসলিমদের কাছে তৃতীয় তীর্থ স্থান। তিন তিনটি ধর্মের মিলনস্থল জেরুজালেমের মসজিদুল আকসা। ইহুদী, খ্রিস্টান ও মুসলিমদের কাছে পবিত্র এই ভূমি মিলনস্থল হিসেবে কাজ করে আসছে শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে।মসজিদুল আকসাতে একসাথে প্রায় ৫০০০ মানুষ নামাজ আদায় করতে পারেন। মসজিদুল আকসার গম্বুজ কিন্তু সোনালি নয়, বরং কালচে ধূসর। এর ভেতরে চতুর্দশ শতকের ইসলামি পেইন্টিং ছিলো যা ১৯৬৯ সালের আগুনে ধ্বংস হয়েছিলো। কিন্তু পরে trateggio পদ্ধতি অবলম্বন করে সম্পূর্ণ পেইন্টিং আবার ফিরিয়ে আনা হয়। মসজিদের ওজু করবার ঝর্ণাটি ‘আল-কাস’  (পেয়ালা) নামে পরিচিত।

সোনালী গম্বুজের চমৎকার মসজিদটি চোখে পড়লেই আমরা অনেকেই ভাবি এটাই মসজিদুল আকসা। আবার অনেকে বাইতুল মসজিদুল আকসাকেই মনে করে থাকেন মুকাদ্দাস। সোনালী গম্বুজের মসজিদ আর মসজিদুল আকসা এক নয়, ইহুদী, খ্রিস্টান ও মুসলমান সকলের কাছেই বাইতুল মুকাদ্দাস সমানভাবে পবিত্র।

ইসরাইলের রাজধানী তেলআবিব থেকে সরিয়ে ইতিহাস বিজড়িত জেরুজালেম নগরীকে রাজধানী করার ঘোষনা দেয়া হয়েছে। আব্রাহামিক তিন ধর্মেরই সহস্ররাধিক বছরের ধর্মীয় ইতিহাস এ নগরীকে ঘিরে রেখেছে। জেরুজালেমকে হিব্রু ভাষায় বলা হয় ‘ইয়ারুশালেইম’ বা ‘শান্তির শহর’। মধ্যপ্রাচ্যের জুদিয়া পাহাড়ি এলাকার মালভূমিতে ভূমধ্যসাগর আর মৃত সাগরের মাঝে এ শহরের অবস্থিত। ইসরায়েল ও ফিলিস্তিন উভয়েই জেরুজালেমকে তাদের রাজধানী হিসেবে দাবী করে থাকে।

জেরুজালেম শহরের দীর্ঘ ইতিহাস ঘাটলে দেখা যায়, এ শহরটি অন্তত দুবার ধ্বংস হয়, ২৩ বার অধিকৃত হয়, ৫২ বার আক্রমনের শিকার হয় আর উদ্ধার করা হয় ৪৪ বার। কেনান দেশীরা জেরুজালেম নামটি ভিন্ন অর্থে ব্যবহার করেছিলো। কুনিফর্ম হরফে লেখা লিপিতে দেখা যায়, তারা এ নগরীকে ‘উরুসালিমা’ বা শালিম এর শহর হিসেবে উল্লেখিত, কারণ শালিম তাদের এক দেবতার নাম।এটা খ্রীস্টপূর্ব ২৪০০ সালের কথা। অন্যদিকে হিব্রু ভাষায় একই নামের অর্থ শান্তির শহর। তবে খ্রীস্টপূর্ব নবম শতকের দিকে ইসরায়েলীরা এখানে শহর গড়ে তুলতে কাজ শুরু করে। আরবি ভাষায় এ শহরকে কুদস বলা হয়। দ্বিতীয় শতকে রোমানরা এ শহরের নাম দিয়েছিলো ‘ইলিয়া কাপিতোলিনা’। কখনো ‘ইলিয়া’ নামেও পরিচিতি ছিলো। সেই থেকে আরবিতেও নামটি হয়ে যায় ‘ইলিয়া’।

খ্রিস্টপূর্ব অষ্টম শতকে জুদাহ রাজ্যের প্রশাসনিক কেন্দ্র ছিলো জেরুজালেম। তবে তখনকার জেরুজালেম বর্তমান অবস্থা থেকে ছোট ছিলো, পুরোনো জেরুজালেমকে ‘ওল্ড সিটি’ বলা হয়। ১৫৩৮ সালে সুলতান সুলেমান পুরোনো শহরের চারপাশে দেয়াল তুলে দেন। সেই দেয়াল দেখেই আজ আমরা পার্থক্য দেখতে পারি। ওল্ড সিটি ঐতিহ্যগতভাবে চার অংশে বিভক্ত – আর্মেনীয়, ইহুদী, খ্রিস্টান ও মুসলিম অংশ। ১৯৮১ সালে ওল্ড সিটিকে ওয়ার্লড হেরিটেজ সাইট হিসেবে ঘোষনা দেয়া হয়। ২০১৫ সালের হিসেবে জেরুজালেম শহরে বসবাস ৮ লক্ষ ৫০ হাজার লোকের। ২০১১ সালের হিসেব অনুযায়ী, শহরটির মোট জনসংখ্যার ৬২% ইহুদী, ৩৫% মুসলিম এবং ২% খ্রিস্টান।

বাইবেল অনুযায়ী, খ্রিস্টপূর্ব প্রথম সহস্ররাব্দে কিং ডেভিড বা হযরত দাউদ (আ:) জেবুসাইটদের কাছ থেকে জয় করে নেন জেরুজালেম নগরী, এবং এরপর শহরটিকে ইসরায়েল এর রাজধানী করেন। তার পুত্র কিং সলোমন বা হযরত সুলাইমান (আ:) সেখানের টেম্পল মাউন্ট এলাকায় ফার্স্ট টেম্পল বা প্রথম উপসানালয়ের নির্মাণকাজ শেষ করেন।

 

টেম্পল মাউন্ট সম্পর্কে আমরা কতটুকু জানি। টেম্পল মাউন্ট কি? হিব্রæতে একে বলা হয় ‘হার হা-বাইত’। ‘হার’ মানে পাহাড় বা মাউন্ট। ‘বাইত’ অর্থ গৃহ বা ঘর। অর্থ দাড়াচ্ছে ‘ঈশ্বরের ঘরের পাহাড়’। জেরুজালেমের ওল্ড সিটির এ টিলার ‘টেম্পল মাউন্ট’ কমপ্লেক্সটি মুসলমানদের কাছে আল হারাম আশশারিফ বা হারাম শরিফ হিসেবে পরিচিত। মক্কার মসজিদুল হারামকেও একই নামে বলা হয়। আবার আল হারাম আল কুদস আল শরিফ নামেও পরিচিত এ জায়গা। উমাইয়া শাসনের যুগ থেকেই এখানে রয়েছে তিনটি ঐতিহাসিক স্থাপনা – মসজিদুল আকসা, চার মিনার, ডোম অফ দ্য রক এবং ডোম অফ দ্য চেইন। ১১টি গেট দিয়ে এখানে ঢোকা যায়, তার মাঝে ১০টি মুসলামনদের জন্যে অন্যটি অমুসলিমদের । প্রত্যেক দ্বারের কাছে রয়েছে ইসরায়েলী পুলিশের গার্ড পোস্ট। তবে, স্থায়ীভাবে বন্ধ করা আরও ৬টি গেট বিবেচনা করলে মোট গেট ১৭টি।

খ্রিস্টপূর্ব ৯৫৭ সালে কিং সলোমন বা সুলাইমান (আ:) নির্মাণ করেন ফার্স্ট টেম্পল বা প্রথম উপসানালয়, যা বাইতুল মুকাদ্দাস নামে চিরচেনা। এটি ইহুদীদের প্রার্থনার কিবলা এবং মুসলিমদেরও প্রথম কিবলা ছিল বহু বছর। এদিকে ফিরেই মুসলিমরা আগে নামাজ আদায় করত মদিনায় হিজরতের ১৭তম মাস পর্যন্ত। পবিত্র কুরআনের আয়াত অনুযায়ী, এই প্রথম উপসানালয় নির্মাণের আগেই দাঁড়ানের অবস্থায় মৃত্যুবরণ করেন হযরত সুলাইমান (আ:)। ইহুদী কিতাবগুলোতে এ উপসানালয়ের বিস্তারিত বিবরণ রয়েছে। কিন্তু দুর্ভাগ্যজনকভাবে, খ্রিস্টপূর্ব ৫৮৬ সালে ফার্স্ট টেম্পলটি ব্যবিলনীয়রা ধ্বংস করে দেয়।

খ্রিস্টপূর্ব ৫১৬ সালে পূর্বতন জায়গাতেই, এহুদিয়া প্রদেশের পারস্য অঞ্চলের গভর্নর জেরুবাবেলের পৃষ্টপোষকতায় সেকেন্ড টেম্পল বা দ্বিতীয় উপসানালয় নির্মিত হয়। দু:খজনক যে আদি সেই উপসানালয়ের কোন চিহ্ন এখন আর অবশিষ্ট না থাকায় কোনো নির্দিষ্ট কাঠামোকে বাইতুল মুকাদ্দাস সম্বোধন করা হয় না। বাইতুল মুকাদ্দাস কথাটা কোথা থেকে এসেছিলো? আরবিতে এর প্রচলনের অনেক আগেই হিব্রুতে সেই পবিত্র উপসানালয় বা হোলি টেম্পলকে ‘বেইত হা-মিকদাস’ বলা হতো। ‘মিকদাস’ মানে পবিত্র, মুকাদ্দাস বা আল-মাক্বাদিস বলতে আরবিতে যা বোঝায়, আর বেইত হলো ‘ঘর’, আরবিতে যা বাইত।

এই ধ্বংসপ্রাপ্ত ‘বাইতুল মুকাদ্দাস’ বা ‘পবিত্র ঘর’ এখন না থাকলেও অনুমান করা যায় যে এটা এই টেম্পল মাউন্ট বা হারাম শরীফ এলাকাতেই ছিলো। ঘরটি না থাকলেও ঘরের পরিবত্রতা এখনো আছে এবং ছিলো। তাই এ জায়গাটিকেই বাইতুল মুকাদ্দাস বলা হয়, এবং কোন নির্দিষ্ট কাঠামোকে নয়। এই মৌলিক ধারণাটিই অনেকে বুঝতে ভুল করে থাকে এবং মসজিদুল আকসাকে এককভাবে বাইতুল মুকাদ্দাস ভেবে প্রচার করে অনেক ওয়েভসাইট ও বইতেও। ইহুদীরা এ জায়গার দিকে ফিরেই প্রার্থনা করে তিন বেলা, ঠিক যেখানে আগের দুবার বাইতুল মুকাদ্দাস নির্মাণ করা হয়েছিলো এবং তারা দুঢ়ভাবে বিশ্বাস করে এখানে তৃতীয় বারের মতো আবার বায়তুল মুকাদ্দাস নির্মিত হবে।

আমাদের মনে স্বভাবতভাবেই প্রশ্ন জাগতেই পারে যে এ জায়গাতো ইহুদীদের জন্যে অনেক পবিত্র, তবে তাদের জন্যে টেম্পল মাউন্টে ঢুকার গেট কম কেনো? সত্যি বলতে কি ইহুদীরা একে এতোই পবিত্র মনে করে যে, অনেক ইহুদী টেম্পল মাউন্ট বা হারাম শরিফ এলাকাতে পা ফেলে না পবিত্র রক্ষার্থে। কারণ এখানেই ইহুদীদের কাছে পবিত্রতম জায়গা Holy of Holies আছে, যেখানে আর্ক অফ দ্য কভেন্যান্ট বা তাবুতে সাকিনা (শরীয়ত সিন্দুক) ছিলো। একইসাথে ছিলো হযরত মূসা (আ:) এর উপর বেহেশত থেকে নাজিল করা তাওরাতের দশ আদেশের ফলকগুলো। ধারণা করা হয়, ডোম অফ দ্য রকের ঠিক নিচেই এ জায়গা। যদি টেম্পল মাউন্টে হাঁটতে গিয়ে এ পবিত্র জায়গার ওপর দিয়ে পা মাড়িয়ে যায়, সেই আশংকায় বহু ইহুদী এদিকে আসে না।

 

এতক্ষন বাইতুল মুকাদ্দাস নিয়ে লিখলাম, এবার বলছি মসজিদুল আকসার সম্পর্কে। এই নামটি এসেছে আমাদের পবিত্র ক্বোরআনের সুরা বনী ইসরাইলের প্রথম আয়াত (১৭:১) থেকে, “পরম পবিত্র ও মহিমাময় সত্ত্বা তিনি, যিনি স্বীয় বান্দাকে কুদরতের কিছু নিদর্শন দেখাতে রাত্রিবেলায় ভ্রমণ করিয়েছিলেন মসজিদুল হারাম (মক্কা) থেকে মসজিদুল আকসা পর্যন্ত, যার চারিপাশে আমি পর্যাপ্ত বরকত দান করেছি।”

মসজিদুল আকসার অর্থ ‘দুরের মসজিদ’। ৬০০ সালের পরের যে রাতের কথা এখানে বলা হলো, ইকিহাস থেকে আমরা জানতে পারি, সে সময় বাইতুল মুকাদ্দান বা সেই উপাসনালয় ধ্বংসপ্রাপ্তই ছিলো। তবে তার মানে এই নয় যে, সেই এলাকা একদম শুন্য ছিলো। বরং, প্রাচীর দিয়ে ঘেরাও করা ছিলো সেই পবিত্র এলাকা। এবং সেখানে অনেকগুলো দ্বারও ছিলো, ছিলো পূর্ববর্তী নবীদের ব্যবহার করা জায়গার স্মৃতিচিহ্ন। উক্ত আয়াতেই উল্লেখ আছে ‘যার চারিপাশে আমি পর্যাপ্ত বরকত দান করেছি’ অর্থাৎ একটি ‘এলাকা’র কথাই বলা হয়েছে। আর আশীর্বাদপুষ্ট পবিত্র এলাকা বলতে টেম্পল মাউন্ট এলাকাই আছে সেখানে। আল বিদায়া ওয়ান নিহায়া গ্রন্থে দাউদ (আ:) এর মিহরাবের কথা বলা আছে। ক্বোরআন ও হাদিস সূত্রে একে মসজিদ বলা হয়েছে, কারণ সেটি সিজদার স্থান ছিলো। মসজিদ বলতে কোনো ছাদওয়ালা ইমারতকে বোঝানো হয় না সবসময়। যেমন হাদিস অনুযায়ী, “তোমার জন্যে সমগ্র পৃথিবীই মসজিদ।” (সুনান ইবনে মাজাহ)। তাছাড়া তখন মক্কার মসজিদুল হারাম এর ওপরেও কোন ছাদ ছিলো না।

ইসলামের নবী (সা:) এর মক্কা থেকে জেরুজালেমের রাত্রিভ্রমণকে ‘ইসরা’ বলা হয়: বাইতুল মুকাদ্দাস এলাকায় তিনি নামাজ আদায় করেন। পরবর্তীতে উমর (রা:) নিজে খলিফা থাকাকালে জেরুজালেম যান, যার বর্ণনা আমরা প্রসিদ্ধ আল-বিদায়া ওয়ান নিহায়া গ্রন্থে পেয়েছি তা নিন্মে তুলে ধরা হলো, “.. মুসলিম জাহানের খলিফা উমর (রা:) সম্মুখে অগ্রসর হয়ে বায়তুন মুকাদ্দাসের খ্রিস্টানদের সাথে সন্ধিচুক্তি সম্পাদন করলেন এবং শর্ত করলেন যে, তিন দিনের মধ্যে সকল রোমান নাগরিক বায়তুল মুকাদ্দাস ছেড়ে চলে যাবে। এরপর তিনি দরজা দিয়ে বায়তুল মুকাদ্দাসে প্রবেশ করলেন। এই সেই দরজা যে দরজা দিয়ে মি’রাজের রাতে রাসুল (স:) প্রবেশ করেছিলেন। কেউ কেউ আবার বলে থাকেন যে, বায়তুল মুকাদ্দাসে প্রবেশের সময়ে তিনি তালবিয়া পাঠ করেছিলেন, ভিতরে গিয়ে দাউদ (আ:) এর মিহরাবের পার্শ্বে তাহিয়্যাতুল মসজিদ নামাজ আদায় করলেন। পরের দিন ফজরের নামাজ মুসলমানদেরকে সাথে জামাতের সাথে নামাজ আদায় করলেন। এরপর তিনি ‘সাখরা’ বা বিশেষ পাথরের নিকট এলেন। কা’ব আল আহবার (রা:) থেকে তিনি ঐ স্থান সম্পর্কে পূর্বেই জেনে নিয়েছিলেন। কা’ব (রা:) এই ঈঙ্গিতও দিয়েছিলেন যেন তিনি মসজিদটি ওই পাথরের পিছনে তৈরী করেন। হযরত উমর (রা:) বললেন, ইহুদী ধর্ম তো শেষ হয়ে গিয়েছে। তারপর তিনি বায়তুল মুকাদ্দাসের সম্মুখে মসজিদ নির্মাণ করলেন। এখন সেই মসজিদটি উমারী মসজিদ নামে পরিচিত..।”

এখানে কতগুলো বিষয় লক্ষণীয় যে, রোমান নাগরিকরা বাইতুল মুকাদ্দাস কম্পাউন্ডে থাকতো। টেম্পল মাউন্টের পবিত্র এলাকাটাই আসলে বাইতুল মুকাদ্দাস হিসেবে উল্লেখিত হচ্ছে, যাকিনা প্রাচীরাবৃত। সাখরা নামের এক পাথরের কথা বলা হয়েছে। আর বলা হয়েছে দাউদ (আ:) এর মিহরাবের কথা। এ সবগুলো জিনিষ ১৪০০ বছর পর এখনো বিদ্যমান।

নামাজের সময় হলে সোফ্রেনিয়াস তাকে চার্চে নামাজ পড়ার আহবান জানালে হযরত উমর চার্চে নামাজ পড়তে অস্বীকার করে বললেন তিনি যদি এখন এই চার্চে নামাজ আদায় করেন, তাহলে পরবর্তীতে মুসলমানরা এই চার্চ ভেঙ্গে মসজিদ বানিয়ে ফেলবে। এতে খ্রিস্টানরা তাদের পবিত্র স্থান হারাবে। হযরত উমর (রা:) এখানে কোনো জবরদস্তি করানো থেকে বিরত করলেন যে কারণে সেটা হলো সেই জায়গা যেখানে খ্রিস্টানরা মনে-প্রাণে বিশ্বাস করে যে যীশুখ্রিস্ট ক্রশবিদ্ধ হয়েছিলেন, আর এখানের গুহাতেই তাঁর দেহ রাখা হয়েছিলো। উল্লেখ্য সেই চার্চ এখনো আছে, তার নাম হলো Church of the Holy Sepulchre|

হযরত উমর (রা:) চার্চের বাহিরে বেরিয়ে নামাজ আদায় করলেন। পরে সেখানে আরেকটি মসজিদ বানানো হয়, নাম দেয়া হয় ‘মসজিদে উমর’। তবে উল্লেখ্য, কয়েক শতক পর (১০০৯ সালে) ফাতিমীয় খলিফা আল হাকিম উমর (রা:) এর কথা সম্পূর্ণ অমান্য করে এই চার্চ ধ্বংস করে দেন। পরবর্তীতে তার পুত্র খলিফা আজ জাহির চার্চটি আবার নির্মাণ করার অনুমতি দেন। ১০৪৮ সালে চার্চটি বানানো শেষ হয়।

ইহুদীদের জন্যেও জেরুজালেম খুবই পবিত্র জায়গা। খ্রিস্টান অধিকার থেকে মুক্ত করে উমর (রা:) এ স্থানে ইহুদীদের পুনর্বাসনের জায়গা করে দেন। তখন ৭০টি ইহুদী পরিবার বসবাসের জন্যে জেরুজালেম চলে আসে। টেম্পল মাউন্ট কমপ্লেক্সের ভেতরে, প্রাচীরের ভেতর পবিত্র বাইতুল মুকাদ্দাস নামের এলাকাতেই উমর (রা:) ছোট্ট এক নামাজ ঘর নির্মাণ করেন। উমাইয়া খলিফা আব্দুল মালিক ইবনে মারওয়ান (৬৪৬-৭০৫) এ মসজিদটি পুননির্মান ও প্রসারিত করা শুরু করেন। এটিই মসজিদুল আকসা, মিরাজের রাত্রে পবিত্র বাইতুল মুকাদ্দাসের ভেতরে যেখানে নবী (সা:) নামাজ আদায় করেন বলে বর্ণিত আছে। মসজিদে উমর কিন্তু ভিন্ন আরেকটি মসজিদ।

৭৪৬ সালে ভূমিকম্পে মসজিদুল আকসা পুরোপুরি ধ্বংস হয়ে যায়। পরে ৭৫৪ সালে আব্বাসীয় খলিফা আল মনসুর (৭১৪-৭৭৫) সেটি আবার নির্মাণ করেন। ৭৮০ সালে এটি আবার সংস্কার করা হয়। কিন্তু দুর্ভাগ্যজনকভাবে, ১০৩৩ সালে মসজিদটি আরেক ভূমিকম্পে আবার ধ্বংস হয়ে যায়। দু’বছর পর ফাতিমি সপ্তম খলিমা আলী আজ জাহির (১০০৫-১০৩৬) আবারও সেই জায়গায় মসজিদটি নির্মাণ করেন। তিনি যে সীমান অনুযায়ী মসজিদটি বানিয়েছিলেন, আজকের মসজিদুল আকসা ঠিক ততটুকু জায়গার উপরেই দাঁড়িয়ে। এমনকি, আজকের সেই মসজিদের কিবলা দেয়ালের মোজাইকও তার সময়কার।

বিভিন্ন খলিফা বিভিন্ন সময়ে এ মসজিদে অনেক কিছুই সংযোজন করেন, যেমন- মিম্বর, মিনার ইত্যাদি। তবে ১০৯৯ সালে ক্রসেডাররা জেরুজালেম জয় করে নেবার পর এ মসজিদকে প্রাসাদ হিসেবে ব্যবহার করে। আর বাইতুল মুকাদ্দাসের অপর যে মসজিদটি রয়েছে অর্থাৎ যেটিকে আমরা সোনালি গম্বুজের জন্য চিনে থাকি, সেটিকে চার্চ হিসেবে ব্যবহার করে তারা। তারা সেটার নাম দিয়েছিলো Templum Domini বা Temple of God বা ঈশ্বরের উপাসনালয়। মসজিদুল আকসাকে তারা বলতো ঞবসঢ়ষব ড়ভ ঝড়ষড়সড়হ নামে, যদিও এর সাথে সুলাইমান (আ:) এর কোনোই সম্পর্ক ছিলো না। সেখানে তারা ঘোড়ার আস্তাবল স্থাপন করে। জেরুজালেমের ওল্ড সিটি ইসরায়েলের অধিকারে থাকলেও এ জায়গার মসজিদ জর্দানি-ফিলিস্তিনি ইসলামি সংঘ ‘ওয়াকফ’ এর অধীনে।

১১১৯ সালে মসজিদুল আকসা নাইট টেমপ্লারদের হেডকোয়ার্টার হিসেবে যাত্রা শুরু করে। তারা ইমারতের সাথে পূর্ব ও পশ্চিম দিকে দুটো অংশ যোগ করে। বর্তমানে পশ্চিম দিকের অংশ নারীদের নামাজ আদায়ের জায়গা এবং পূর্ব দিকের অংশটি ইসলামি জাদুঘর হিসেবে চালু আছে। ১১৮৭ সালে সুলতান সালাহউদ্দীন জেরুজালেম জয় করবার পর এ মসজিদের চেহারা পুরোই চেহারা বদলে ফেলেন। তিনি মসজিদের সংস্কার করেন এবং সুলতান নুর আল দীনের মিম্বর সেখানে যোগ করেন।

অটোম্যান সাম্ররাজ্যের সময় টেম্পল মাউন্ট এলাকায় বিভিন্ন নতুন জিনিষ যোগ করা হলেও মসজিদুল আকসাকে অপরিবর্তিত রাখা হয়। নতুন যোগ করা জিনিষের মধ্যে ছিলো কাশিম পাশার ঝর্ণা (১৫২৭) এবং নবীজীর গম্বু জবা জিব্রাইলের গম্বুজ (১৫৩৮)। মসজিদুল আকসা শীর্ণ অবস্থায় চলে গেলে জেরুজালেমের গভর্ণর সুলাইমান পাশা আল আদিল একে সংস্কার করেন ১৮১৬ সালে। কিং সলোমন বা সুলাইমান (আ:) বাইতুল মুকাদ্দাস নির্মাণ করলেও এর ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করেছিলেন হযরত ইয়াকুব (আ:) বাইবেলের জ্যাকব। ইয়াকুব (আ:) বীরশেবা থেকে বেরিয়ে হারান মরুর দিকে যাচ্ছিলেন। এখানে তিনি সন্ধ্যার পর ঘুমালে স্বপ্ন দেখেন যে, পৃথিবী থেকে একটি সিঁড়ি উপরে উঠে গেছে। সেখানে আল্লাহর ফেরেশতারা ওঠা-নামা করছে। স্বপ্নে আল্লাহ তাঁকে জানালেন, যেখানে হযরত ইয়াকুব (আ:) শুয়ে আছেন, সেই ভূমি তিনি তাঁকে দেবেন, এবং তার বংশধরকে। তাঁর বংশধরেরা পৃথিবীতে ছড়িয়ে পড়বে। স্বপ্ন দেখে তিনি জেগে উঠলেন। এই সিঁড়ির স্বপ্ন ‘জ্যাকবস ল্যাডার ড্রিম’ নামে পরিচিত। এ স্বপ্নের মাধ্যমে তিনি পবিত্র ভূমির প্রতিশ্রুতি পান। ‘লুজ’ নামের সেই জায়গার নাম তিনি ‘বেথেল’ (বাইতুল্লাহ) রাখলেন।

সুত্র: ইবনে কাসির এর আল বিদায়া ওয়ান নিহায়া গ্রন্থ ও আব্দুল্লাহ ইবনে মাহমুদ এর ইহুদী জাতির ইতিহাস। ২৪শে জুলাই ২০২৩

 

Read More

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked with *

সর্বশেষ পোস্ট

Advertising