728 x 90

অষ্ট্রেলিয়ার স্বাস্থ্য ব্যবস্থা ও বাংলাদেশের চিত্র

  সামসুল ইসলাম টুকু , সিডনী থেকে : অষ্ট্রেলিয়া একটি কল্যান রাষ্ট্র তা বলার অপেক্ষা রাখেনা । নেই কোন রাজনৈতিক অস্থিরতা বা সহিংসতা , রয়েছে গতিশীল অর্থিনীতি , সকল ধর্ম ও জাতির মেলবন্ধনে আছে একটি সুন্দর সুশৃঙ্খল ,সামাজিক ব্যাবস্থা ।বাংলাদেশে বসে থেকে তা বোঝা সম্ভব নয় । প্রায় ২ কোটি ৫৪ লক্ষ জন-  অধ্যুসিত অষ্ট্রেলিয়া

 

সামসুল ইসলাম টুকু , সিডনী থেকে : অষ্ট্রেলিয়া একটি কল্যান রাষ্ট্র তা বলার অপেক্ষা রাখেনা । নেই কোন রাজনৈতিক অস্থিরতা বা সহিংসতা , রয়েছে গতিশীল অর্থিনীতি , সকল ধর্ম ও জাতির মেলবন্ধনে আছে একটি সুন্দর সুশৃঙ্খল ,সামাজিক ব্যাবস্থা ।বাংলাদেশে বসে থেকে তা বোঝা সম্ভব নয় । প্রায় ২ কোটি ৫৪ লক্ষ জন-  অধ্যুসিত অষ্ট্রেলিয়া ৬ টি রাজ্যে বিভক্ত । নিউ সাউথ ওয়েলস , ভিক্টোরিয়া , ওয়েষ্টার্ন অষ্ট্রেলিয়া , সাউথ অষ্ট্রেলিয়া , কুইন্সল্যান্ড ও তাসমানিয়া । গত ৭ আগাষ্ট সন্ধ্যায় সিঙ্গাপুর এয়ারলাইনসের বিমানে নিউ সাউথ ওয়েলসের রাজধানী সিডনী শহরে এসে পৌচেছি । আমার ছেলে এখানেই একটি সরকারী অফিসে পানি ব্যাবস্থাপনা প্রকৌশলী হিসেবে কর্মরত। সেই সুবাদে আমরা স্বামী স্ত্রী এক বছরের ভিসা পেলেও মাত্র ৭৫ দিনের জন্য বেড়াতে এসেছি । এখানে এসেই আমাকে স্বাস্থ্য বিভাগের শরনাপন্ন হতে হয়েছে । এখানকার স্বাস্থ্য বিভাগ কত যে উন্নত ও সুশৃঙ্খল তা সরাসরি না দেখলে বিশ্বাস করতে পারতামনা । তারই সামান্য উদাহারন তুলে ধরতে চাই আমাদের দেশের স্বাস্থ্য বিভাগের উদ্দেশ্যে ।

এখানে আসার পুর্বে প্রায় ১৫/১৬ দিন যাবৎ পেটের পীড়ায় ভুগছিলাম । পাতলা পায়খানা হচ্ছিল দিনে ৩ থেকে৫ বার পর্যন্ত । নিয়ম অনুযায়ী স্যালাইন পানি পান করছিলাম । কিন্তু কোন ভাবেই নিয়ন্ত্রন হচ্ছিলনা । অবশেষে ডাক্তারের পরামর্শে ১২ ঘন্টার বিরতিতে ২ টি ফিলমেট ট্যাবলেট সেবন করলাম ৬ আগাষ্ট বিমানে ওঠার আগে । বিমানে ৩ বার খাবার পেলাম কিন্তু রুচি না থাকায়  ২/১ টা আইটেম খেয়ে ছেড়ে দিলাম । বিমানেও ৩/৪ বার পিচকারী   হয়ে গেল । সন্ধ্যা সাড়ে সাতটায় সিডনীর মিন্টোতে ছেলের বাসায় পৌছানোর সাথে সাথে প্রচন্ড গতিতে পায়খানা হয়ে গেল । পর মুহুর্তে শরীর কাঁপতে থাকলো । স্থির হয়ে দাঁড়াতে পারছিলামনা । মনে হলো বাংলাদেশে হয়তো ফিরে যেতে পারবোনা । রাতটা কোনভাবে  কাটলো । সকালে ছেলে ডাক্তারের কাছে নিয়ে যেতে চাইলো । কিন্তু তখনো ধাতস্থ হতে পারিনি । বললাম সিপ্রসিন গ্রুপের কোন ক্যাপসুল পাওয়া গেলে ফার্মেসী থেকে নিয়ে এসো। এরপর ছেলের কথায় বুঝতে পারলাম অষ্ট্রেলিয়ার স্বাস্থ্য ব্যাবস্থার একটা সুশৃঙ্খল চিত্র । ছেলে বললো ডাক্তারের প্রেস্ক্রিপসান ছাড়া কোন ওষুধ কিনে পাওয়া যায়না । যা খুব সহজেই বাংলাদেশে পাওয়া যায় । যদিও এ ব্যবস্থাটি বাংলাদেশে চালু আছে কিন্তু পুরোপুরি বাস্তবায়ন হয়নি । ছেলের কথায় হতাশ হয়ে বললাম বিকেলে কোন হাঁসপাতালে নিয়ে চল । ছেলে ফোনে কার সাথে কথা বলে  বিকেলে নিয়ে গেল ইংলেবার্ন এলাকার একটি মেডিক্যাল সেন্টারে । সেখানে সুন্দরভাবে সাজানো গোছানো রিসেপসান কক্ষে একটা কাউন্টারে বসে থাকা এক সুন্দর মহিলা রিসেপসনিষ্ট এর সাথে কথা বলে নিশ্চিত হলো ডাক্তারের সাথে আমাদের সাক্ষাতের সময় রাত ৮ টার পরে । ছেলেকে বললাম এটাতো কোন হাঁসপাতাল নয় এবং ইমারজেন্সি বিভাগ ও দেখছিনা । ছেলে বললো অষ্ট্রেলিয়ার নিয়ম হচ্ছে কোন অসুখ বিসুখ হলে প্রথমে যেতে হয় জিপির কাছে । অর্থাৎ জেনারেল প্রাকটিসিনারের কাছে যারা মুলত এমবিবিএস । এ ধরনের মেডিক্যাল সেন্টারগুলো রাজ্য সরকার কর্তৃক অনুমোদিত প্রাইভেট চিকিৎসা কেন্দ্র ও ফার্মেসী । এখানে প্রাথমিক চিকিৎসা দেওয়া হয় নির্দিষ্ট অর্থের  বিনিময়ে  এবং একইসাথে ওষুধ বিক্রি করা হয় । এই জিপির চিকিৎসা শেষ না হওয়া পর্যন্ত কোন কন্সাল্ট্যান্ট  বা বিশেষজ্ঞ চিকিতসকেরা চিকিৎসা দেননা । এদিকে ইতোমধ্যে জিপির চিকিৎসা সহ রোগীর ইতিহাস অনলাইনে বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকের কাছে পৌঁছে যায় । ফলে চিকিৎসা সহজতর হয় । এই শৃখলা বাঙ্গলাদেশের চিকিৎসা ব্যাবস্থায় অনুপস্থিত । বাংলাদেশে টাকা থাকলেই বিশেষজ্ঞ ডাক্তারের সাক্ষাত পাওয়া যায় । সেখানে দেখা যায় শত শত রোগীর ভীড় । লক্ষ লক্ষ টাকা গুনে নেন বিশেষজ্ঞ ডাক্তারেরা । চিকিৎসা হয় হ য ব র ল ।একজন রোগীকে যে সময়  দেওয়া ও আন্তরিক আচরন করা দরকার তা দিতে পারেননা ।এতে রোগীরা ক্ষুব্ধ হয় ও চিকিৎসার জন্য ভারত সহ বিভিন্ন উন্নত দেশে পাড়ি জমায় । অষ্ট্রেলিয়ায় এসব সমস্যা পোহাতে হয়না রোগীদের । সরকারিভাবেও সে সূযোগ নেই ।তারা শত শত রোগীর চিকিৎসা দেননা একদিনে । খুবই সীমিত সংখ্যক রোগী দেখেন । একান্ত প্রয়োজন ছাড়া অনর্থক কোন প্যাথলজিক্যাল পরীক্ষার বাড়াবাড়িও নেই । শুধু তাইনয় যারা এদেশের নাগরিকত্ব পেয়েছেন তারা স্বাস্থ্য কার্ড পান এবং বিনে পয়সায় চিকিৎসা পেয়ে থাকেন । তবে কেউ ব্যক্তিগত ভাবে প্রাইভেট ক্লিনিক বা ডাক্তারের কাছে চিকিৎসা নিতে চাইলে সে পথ খোলা আছে । তবে তা অর্থের বিনিময়ে । এখানে যারা এখনো নাগরিক হতে পারেননি তারা স্বাস্থ্য ইন্সিউরেন্স করে থাকলে কিছুটা ছাড় পেয়ে থাকেন । ছেলে বললো এখানে সবচেয়ে বড় সুবিধা হচ্ছে জররী রুগী  হলে ০০০ নম্বরে কল দিলেই মাত্র তিন মিনিটের মধ্যে এম্বুল্যান্স হাজির হয়ে যাবে ।দ্রুত হাঁসপাতালে পৌঁছে দেবে এবং তাৎক্ষনিক চিকিৎসার ব্যাবস্থা করবে ।এজন্য রুগীর অভিভাবকদের ব্যস্ত হতে হবেনা ।  এ সুবিধার কারন হচ্ছে প্রতিটি কাউন্সিলে ২/৩ টি করে আম্বুল্যান্স প্রস্তুত থাকে। এ সুবিধা আজও বাংলাদেশ দিতে পারেনি ।

 

যাইহোক আমি রাত ৮টার পর ডাক্তার দেখানোর সুযোগ পেলাম ডাক্তার অং কিউ নামে একজন বার্মিজ ডাক্তারের কাছে । তিনি আমার রোগ সংক্রান্ত নানা প্রশ্ন করলেন , জ্বর ও প্রেসার মাপলেন , পেটটা টিপে টুপে দেখলেন , অন্য কোন অসুখ আছে কিনা জিজ্ঞাসা করলেন । তারপরে প্রেস্ক্রিপসানে ১ টি ওষুধ লিখে দিলেন’ লফেনক্সল’  ডায়াফেনক্সিলেট হাইড্রক্লোরাইড গ্রুপের । প্রতিদিন  ২টি করে  ট্যাবলেট ৩ বার সেবন করতে।  যদি প্রয়োজন হয় । সেইসাথে পরদিন পায়খানার নমুনা দিয়ে যেতে বললেন। এই মেডিক্যাল সেন্টারের ভেতরেই ফার্মেসী সেখান থেকে ওষূধ কিনলাম । ওষুধের প্যাকেটে আমার নাম সহ ওষুধ খাওয়ার পদ্ধতি সুন্দরভাবে প্রিন্ট করা আছে । অর্থাৎ ডাক্তার প্রেস্ক্রিপসান লেখার সাথে সাথে মেসেজটি ফার্মেসীতে পৌঁছে গেছে । এই যে সিস্টেম তা কি বাংলাদেশে বাস্তবায়ন হবে ? বাংলাদেশের ডাক্তারেরা রোগীকে ৫ মিনিট সময় দিতে পারেননা । আর রোগীর অসুখের বর্ননা দেওয়া শেষ না হতেই ডাক্তার ৫ থেকে ১০ টি ওষুধ লিখে শেষ করেন ।তারপুর্বে ৫/৭ টি অনর্থক প্যাথলজিক্যাল টেষ্ট এবং সেখান থেকে কমিশন বানিজ্যের কথা নাই বা বললাম । ডাক্তারের লেখা প্রেস্ক্রিপসান অনেক সময় পড়াই যায়না । তার উপরে ডাক্তারের চেম্বার থেকে বের হলেই দেখা যাবে বিভিন্ন ওষুধ কোম্পানির ১০/১৫ জন বিক্রয় প্রতিনিধি দরজা ঘিরে দাঁড়িয়ে আছে আপনার প্রেস্ক্রিপসানের ছবি নেওয়ার জন্য । যা একেবারে অনভিপ্রেত ,অনাকাঙ্খিত ও অনধিকার চর্চা । অষ্ট্রেলিয়ায় যা কল্পনাই করা যায়না ।

পরদিন অর্থাৎ ৯ আগাষ্ট মেডিক্যাল সেন্টারে পায়খানার নমুনা দিয়ে আসা হলো । সেদিনই তা ল্যাবে পরীক্ষা করে তারা” সিগুলা ব্যাকটেরিয়া”সন্ধান পেলেন । তারা সাথে সাথেই বিষয়টি নিউ সাউথ ওয়েলসের জনসাস্থ্য বিভাগকে অবহিত করেছেন । ১০ আগাষ্ট জনস্বাস্থ্য বিভাগ থেকে আমাদের কাছে ফোন এলো ।  প্রায় ৩০ মিনিট ধরে তারা প্রশ্ন করলো । কোন ফ্লাইটে এসেছি , আসন নম্বর কত , কি কি খেয়েছি , বিমানের টয়লেট ব্যাবহার করেছি কিনা , এমন বেশ কিছু প্রশ্ন শেষে পরামর্শ দেওয়া হলো বাইরের অন্য কোন টয়লেট যেন ব্যাবহার না করি । এ ঘটনা থেকেও প্রমান হয় যে অষ্ট্রেলিয়া স্বাস্থ্য নিরাপত্তা বিষয়ে কত সচেতন ও যত্নবান । বাংলাদেশে ৫/১০ জন  মারা না গেলে তা উদ্বেগজনক হয়না ।লফেনক্সল এর ৬টি ট্যাবলেট সেবন করার পরেও পায়খানা নিয়ন্ত্রন না হওয়ায় পুনরায় ১১ আগাষ্ট ওই মেডিক্যাল সেন্টারের ডাক্তার সুভাস মাঝি কে দেখালাম । তিনি আগের রিপোর্ট পায়খানার রিপোর্ট প্রভৃতি দেখে ৫টি এন্টিবায়টিক ‘এজিথ্রোমাইসিন’ সেবন করার পরামর্শ দিলেন । এক্ষেত্রেও একই পরিমাণ ডাক্তারী ফি ও ওষুধের দাম দিতে হলো ।

এবার ডাক্তারের ফি ওষূধের দাম নিয়ে আলোচনা করা যায় ।প্রত্যেকবারই ডাক্তারকে ফি দিতে হয়েছে ৭৫ অষ্ট্রেলিয়ান ডলার  । যা বাংলাদেশী প্রায় ৫ হাজার ২৫০ টাকা । যেখানে বাংলাদেশে একজন বিশেষজ্ঞ ডাক্তার নেন এক হাজার টাকা । অর্থাৎ বাংলাদেশের ৫ গুন ।এদিকে ওষুধ লফেনক্সল ২০ ট্যাবলেটের  এক পাতার দাম ১৬ ডলার বা বাংলাদেশী ১১২০ টাকা । বাংলাদেশে এই ট্যাবলেটের দাম সর্বোচ্চ ১৫০ টাকা । অর্থাৎ প্রায় ৮ গুন ।তেমনভাবে ৫ টি এজিথ্রোমাইসি ট্যাবলেটের দাম ৩০ ডলার বা বাংলাদেশী ২১০০ টাকা বা প্রতিটি ট্যবলেট ৪২৫ টাকা । যা বাংলাদেশে মাত্র ৫০ টাকা । অর্থাৎ প্রায় ৮ গুন ।এ ক্ষেত্রে একটি বিষয় উল্লেখ করা যেতে পারে । তাহলো , বাংলাদেশে ওষুধের মুল্য অনেক কম এবং মানসম্মত বলেও সুনাম আছে ও বিভিন্ন দেশে রপ্তানী হয় । তাই অষ্ট্রেলিয়া সরকার বাংলাদেশ থেকে ওষুধ আমদানী করে কমদামে রোগীদের জন্য সরবরাহ করতে পারে ।  অষ্ট্রেলিয়ায় ওষুধের এই উচ্চ মুল্যে আমি উষ্মা প্রাকাশ করলে আমার ছেলে বললো এ দেশ যেমন নেয় তেমনই দেয় । নাগরিক সুবিধার কোন ঘাটতি রাখেনা । নাগরিক অধিকারের জন্য এখানে চিৎকার করতে হয়না । কোন সমস্যার বিষয়ে কাউন্সিলকে অবহিত করলে কাউন্সিল অতি দ্রুত সমস্যার সমাধান দেয় ।ডাক্তারের ফি এবং ওষুধের মুল্যের যে তুলনামুলক চিত্র তুলে ধরলাম তা এ কারনেই যে অষ্ট্রেলিয়া কল্যান রাষ্ট্র হিসেবে যারা এ দেশের নাগরিক বা অভিবাসী তারা বিনে পয়সায় সাধারন চিকিৎসা পেয়ে থাকেন। তবে জটিল চিকিৎসার জন্য রোগী বা রোগীর অভিভাবককে চিকিৎসা ব্যয় বহন করতে হয় ।সেক্ষেত্রেও কিছু সুবিধা পেয়ে থাকেন । কিন্তু যারা প্রথমে ছাত্র হিসেবে অথবা অভিবাসীর পিতা মাতা বা আত্মীয় স্বজন হঠাৎ  করে বেড়াতে আসেন তাদের সাধারন চিকিৎসার জন্য উপরেল্লিখিত উচ্চ মুল্য পরিশোধ করতে হয় । এটা তাদের জন্য কঠিন ব্যয়সাধ্য হয়ে যায়। তাদের জন্য কি বিনে পয়সায় চিকিৎসা দেওয়া সম্ভব নয় ? অষ্ট্রেলিয়ার বিভিন্ন রাজ্য সরকার সহ অস্ট্রেলিয়া ফেডারেল সরকারের কাছে আমার বিনীত নিবেদন , বিষয়টি গভীরভাবে বিবেচনা করার জন্য । অস্ট্রেলিয়া সরকার ও রাষ্ট্র আরও মানবিক হোক এই প্রত্যাশা ।

 

Read More

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked with *

1 Comment

  • Tapan Dey
    November 25, 2023, 4:09 am

    Excellent comparison. ❤️🙏

    REPLY

সর্বশেষ পোস্ট

Advertising