সুপ্রভাত সিডনি : আমাদের মহান রব কর্তৃক মনোনীত ধর্ম ইসলাম। ইসলাম একটি পূর্নাঙ্গ জীবন ব্যবস্থা। এর কিছু মৌলিক নীতি রয়েছে। সেই ইসলামী মৌলিক নীতি বা শিক্ষার প্রতি গভীরভাবে দৃষ্টিপাত করলে একথা দিবালোকের ন্যায় স্পষ্ট হয়ে যায় যে, ইসলাম বৈরাগ্যবাদ ও একাকিত্বের জীবন পছন্দ করেনা। যেমন হাদীস শরীফে নবীজি ইরশাদ করেন- “অর্থাৎ আল্লাহ তায়ালা আমাদেরকে বৈরাগ্যবাদের বদলে সহজ সরল সঠিক ধর্ম দান করেছেন।”
স্বচ্ছ-সুন্দর ও পঙ্কিলতাহীন জীবন-যাপনে বিয়ের গুরুত্ব অপরিসীম। বিয়ে সুস্থ সমাজ নির্মাণের অন্যতম ভিত্তি। জীবনের গুরুত্বপূর্ণ এই বিধান পালনে নবীজির সুন্নত অনুসরণ করা জরুরি। এতে বরকত ও জীবন সুখের হয়। সুন্নত আদায়ের সওয়াব হয়। অন্যথায় বর-কনে এবং সংশ্লিষ্ট সবাইকে রবকত শূন্য থেকে যেতে হয়।
বিয়ে আল্লাহ পাকের অশেষ নেয়ামত এবং রাসুল (সা.)-এর গুরুত্বপূর্ণ সুন্নত। চারিত্রিক অবক্ষয় রোধের শ্রেষ্ঠ হাতিয়ার। আদর্শ পরিবার গঠনে, মানুষের জৈবিক চাহিদা পূরণে কিংবা মানবিক শান্তি লাভের প্রধান উপকরণ। বিয়ে ইসলামী শরিয়তের অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ একটি নিয়ম।
আধুনিকতার নামে অসাম্প্রদায়ীকরা আচার–অনুষ্ঠানে এমন জগা–খিচুরি বানিয়েছেন যে বিয়ে কেবল একটি অসুস্থ সামাজিক বিষয় হয়ে দাড়িঁয়েছে। ৮০০ সালের দিকে হিন্দু রাজা বল্লা্ল সেন প্রথম বিয়েতে গায়ে হলুদের প্রচলন করে। কিন্তু বর্তমানে মুসলমানেরা গায়ে হলুদ ছাড়া বিয়ে করেনা ধর্মীয় বিধি–বিধান তোয়াক্কা না করে।
আলেমদের মতে, ইসলামী বিবাহ মসজিদে ও জুমার দিন হওয়া উত্তম। এতে ঘোষণা ও জনসমাগম বেশি হয়।
দেশীয় অপসংস্কৃতি কিংবা বিধর্মীদের কালচার বিয়েকে অভিশপ্ত করে। সুন্নত তরিকার বিয়ে খুবই সহজ। কোনো হাক্কানী আলেমের কাছ থেকে জেনে নিন। একখানা হাদিস মনে রাখবেন, নবী করিম (সা.) বলেছেন, সবচেয়ে বেশি বরকত সেই বিয়ে হয়, যাতে খরচের চাপ সবচেয়ে কম থাকে।
বিবাহ পড়ানোর সুন্নাহসম্মত পদ্ধতি হলো, প্রথমে কনের কাছ থেকে ইজন বা অনুমতি নিতে হবে। এসময় কমপক্ষে দুজন সাক্ষী উপস্থিত থাকতে হবে। তখন বর উচ্চ স্বরে ‘কবুল’ অথবা ‘আমি গ্রহণ করলাম’ বা সম্মতিসূচক ‘আলহামদু লিল্লাহ’ বলবে। এরূপ তিনবার বলা উত্তম। (বুখারি, হাদিস : ৯৫)
বিবাহের ক্ষেত্রে পাত্র-পাত্রী বা বর-কনেই মুখ্য, যারা সারা জীবন একসঙ্গে ঘর-সংসার করবে। তাই বিবাহের আগে তাদের সম্মতি থাকতে হবে। কোনো অবস্থায়ই কোনো ছেলে-মেয়ের অসম্মতিতে তাদের বিবাহ করতে বাধ্য করা উচিত নয়। আল্লাহ বলেন, ‘হে ঈমানদাররা! তোমাদের জন্য বৈধ নয় যে তোমরা বলপূর্বক নারীদের উত্তরাধিকারী হবে। ’ (সুরা নিসা, আয়াত : ১৯)
এরপর অভিভাবক (যদি বিবাহ পড়াতে সক্ষম হন) বা যিনি বিবাহ পড়াবেন তিনি বিবাহের খুতবা পাঠ করবেন। এরপর মেয়ের অভিভাবক বরের সামনে মেয়ের পরিচয় ও মোহরের পরিমাণ উল্লেখ করবেন। তারপর তিনি বিবাহের প্রস্তাব পেশ করবেন। অথবা অভিভাবকের অনুমতি নিয়ে যিনি বিবাহ পড়াবেন তিনি হবু বরের কাছে বিবাহের প্রস্তাব তুলে ধরবেন। এটাকে ইসলামের ভাষায় ‘ইজাব’ বলা হয়।
বিবাহের ক্ষেত্রে অভিভাবকের অনুমতি নিতে হবে। বিশেষ করে মেয়ের ক্ষেত্রে অভিভাবকের অনুমতি একান্তভাবে আবশ্যক। কারণ অভিভাবকের অনুমতি ছাড়া বিবাহ হয় না। নবী করিম (সা.) বলেন, ‘অভিভাবক ছাড়া কোনো বিবাহ নেই। ’ (তিরমিজি, হাদিস : ১১০১)
শুধু বরকেই কবুল বলাতে হবে। কনের কাছ থেকে কনের অভিভাবক শুধু অনুমতি নেবেন। বর বোবা হলে সাক্ষীদ্বয়ের উপস্থিতিতে ইশারা বা লেখার মাধ্যমেও বিবাহ সম্পন্ন হতে পারে।
এভাবে বিবাহ সম্পন্ন হয়ে যাবে। এরপর উপস্থিত সবাই পৃথকভাবে সুন্নতি দোয়া পাঠ করবে : ‘বা-রাকাল্লাহু লাকা, ওয়া বা-রাকা আলাইকা, ওয়া জামাআ বায়নাকুমা ফী খায়ের। ’
অর্থ : ‘আল্লাহ তোমার জন্য বরকত দিন, তোমার ওপর বরকত দিন ও তোমাদের দুজনকে কল্যাণের সঙ্গে মিলিত করুন। ’ (তিরমিজি, হাদিস : ১০৯১)
বিয়ের আকদ (চুক্তি) করানোর দায়িত্ব মেয়ের অভিভাবকদের পালন করতে হবে। যেহেতু আল্লাহ তাআলা বিয়ে দেয়ার জন্য অভিভাবকদের প্রতি নির্দেশ করেছেন। আল্লাহ তাআলা বলেন, ‘আর তোমরা তোমাদের মধ্যে অবিবাহিত নারী–পুরুষদের বিবাহ দাও। ’ (সূরা নূর, ২৪:৩২)
রাসুল (সা.) বলেন, ‘যে নারী তার অভিভাবকের অনুমতি ব্যতীত বিয়ে করবে তার বিবাহ বাতিল, তার বিবাহ বাতিল, তার বিবাহ বাতিল। ’ (তিরমিজি, হাদিস নং : ১০২১)
অভিভাবককে মুসলিম হতে হবে। সুতরাং কোন অমুসলিম ব্যক্তি মুসলিম নর–নারীর অভিভাবক হতে পারবে না। অনুরূপভাবে কোন মুসলিম ব্যক্তি অমুসলিম নর–নারীর অভিভাবক হতে পারবে না।
মহানবী (সাঃ) বলেছেন– “এক মহিলা আরেক মহিলাকে বিয়ে দিতে পারবে না। অথবা মহিলা নিজে নিজেকে বিয়ে দিতে পারবে না। ব্যভিচারিনী নিজে নিজেকে বিয়ে দেয়।”[ইবনে মাজাহ (১৭৮২) ও সহীহ জামে (৭২৯৮)।
৪/ বিবাহের সুন্নাত সমূহ
১. সহীহ বিবাহ অনাড়ম্বর হবে, যা অপচয়, অপব্যয়, বেপর্দা ও বিজাতীয় সংস্কৃতি, গান–বাদ্য, ভিডিও–অডিও মুক্ত হবে এবং তাতে কোন যৌতুকের শর্ত বা সামর্থ্যের অধিক মহরানার শর্ত থাকবে না। (হাদীস নং– ৩৬১২, তাবরানী আউসাত)
২. সৎ ও খোদাভীরু পাত্র–পাত্রীর খোঁজ করে বিবাহের পয়গাম পাঠান । কোন বাহানা বা সুযোগে পাত্রী দেখা সম্ভব হলে, দেখে নেয়া মুস্তাহাব। কিন্তু আনুষ্ঠানিকভাবে পাত্রী দেখানোর যে প্রথা আমাদের সমাজে প্রচলিত, তা সুন্নাতের পরিপন্থী ও বর্জনীয়। (ইমদাদুল ফাতাওয়া, ৪ : ২০০/ বুখারী হাদীস নং– ৫০৯০)
৩. শাওয়াল মাসে এবং জুমু‘আর দিনে মসজিদে বিবাহ সম্পাদন করা সুন্নত। তবে যে কোন মাসের যে কোন দিন বিবাহ করা জায়েয আছে। (মুসলিম, হাদীস নং– ১৪২৩/ বাইহাকী, হাদীস নং– ১৪৬৯৯)
৪. বিবাহের কথা ব্যাপকভাবে প্রচার করে বিবাহ করা এবং বিয়ের পরে আকদ অনুষ্ঠানে উপস্থিত সবার মাঝে খেজুর বণ্টন করা। (বুখারী শরীফ, হাদীস নং– ৫১৪৭)
৫. সামর্থ্যের মধ্যে মহর ধার্য করা।(আবু দাউদ: হাদীস নং– ২১০৬)
৬. বাসর রাতে স্ত্রীর কপালের উপরের কিছু চুল হাতে নিয়ে এই দু‘আ পড়াঃ
اَللّهُمَّ إنِّيْ أسْألُكَ مِنْ خَيْرِهَا وَخَيْرِ مَا جَبَلْتَ عَلَيْهِ . وأعُوْذُ بِكَ مِنْ شَرِّهَا وَشَرِّ مَا جَبَلْتَ عَلَيْهِ.
আল্লাহুম্মা ইন্নি আসয়ালুকা খায়রাহা ওয়া খায়রা মা জাবালতাহা আলাইহি। ওয়া আউজু বিকা মিন শাররিহা ওয়া শাররি মা জাবালবাহা আলাইহে (আবু দাউদ, হাদীস নং– ২১৬০)
৭. স্ত্রীর সঙ্গে প্রথমেই অন্তরঙ্গতা সৃষ্টি করবে, তারপর যখনই সহবাস–এর ইচ্ছা হয়, তখন প্রথমে নিচের দু‘আ পড়ে নেওয়া
بِسْمِ اللّهِ اَللَّهُمَّ جَنِّبْنَا الشَّيْطَانَ وَجَنِّبِ الشَّيْطانَ مَا رَزَقْتَنَا.
“বিসমিল্লাহ, আলহুম্মা জান্নিবনাশ শায়তান ও জান্নিবিশ শায়তানা মা রাযাকতানা।” (মুসলিম/১৪৩৪)
মনে রাখবেন, উপরের দু‘আ না পড়লে শয়তানের তাছীরে বাচ্চার উপর কু–প্রভাব পড়ে। যার ফলে সন্তান বড় হলে, তার মধ্যে ধীরে ধীরে তা প্রকাশ পেতে থাকে এবং সন্তান নাফরমান ও অবাধ্য হয়। সুতরাং পিতা–মাতাকে খুবই সতর্ক থাকতে হবে।
৮.”বাসর রাতের পর দু’হাতে আত্মীয়–স্বজন, বন্ধু–বান্ধব, শুভাকাঙ্ক্ষী এবং গরীব–মিসকিনদের তাওফীক অনুযায়ী ওলীমা খাওয়ানোর আয়োজন করা। (মুসলিম, হাদীস নং– ১৪২৭)”
দুঃখের ব্যাপার হলো, বর্তমানে আমাদের সমাজে যে নিয়ম পদ্ধতিতে বিয়ের আয়োজন করা হয় তা সম্পূর্ন শরীয়ত বিরোধী ও সুন্নতের খেলাফ এবং বিধর্মীদের রীতি। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য কয়েকটি হলো,
বিনা পর্দায় প্রথম সাক্ষাত, গায়ে হলুদ, গেট ধরা, মেয়েরা বরের হাত ধোয়ানো, বিয়েতে বিপুল খরচ, অধিক মোহর নির্ধারণ ইত্যাদি।
তিরমিযী শরীফে বর্ণিত আছে। নবীজী এরশাদ করেছেন-
যখন তোমাদের নিকট এমন কেউ প্রস্তাব দেয় যার দ্বীন ও চরিত্রকে তোমরা পছন্দ করো তাহলে তোমরা তার সাথে বিয়ে দিয়ে দাও। যদি তোমরা এরূপ না করো তাহলে জমিনের মধ্যে ফিতনা এবং মহা ফাসাদ সৃষ্টি হবে।
বিভিন্ন হাদীস দ্বারা পাত্রী দেখার বৈধতা সাব্যস্ত হয়। তবে তাদেরকে দেখার একটি নির্দিষ্ট গন্ডি রয়েছে।
আর তা হলো চেহারা, উভয় হাতের তালু ও উভয় পায়ের পাতা। এছাড়া আর কোন অঙ্গ দেখতে পারবে না । কিন্তু বর্তমানে দেখা যায় যখন ছেলেরা মেয়ে দেখতে আসে তখন ছেলের সাথে তার বিভিন্ন আত্মীয়-স্বজন বা বন্ধু বান্ধবরা এসে থাকে । এটা সম্পূর্ণ অবৈধ । মেয়েকে শুধু ছেলেই দেখতে পারবে। তাও আবার নির্দিষ্ট কয়েকটি অঙ্গ । তবে যদি ছেলের পক্ষ থেকে কোন মহিলা দেখতে আসে তাহলে সে দেখতে পারবে।
১. প্রথম সাক্ষাৎ:
ইসলামী শরীয়ত বেগানা (গায়রে মাহরাম) মহিলার প্রতি দৃষ্টিপাত করা হারাম করেছে। তবে বিশেষ কিছু স্থানে ইসলামী শরীয়ত মহিলাদেরকে দেখার অনুমতি দিয়েছে। তার মধ্যে একটি হলো বিয়ের জন্য পাত্রী দেখা।
২. ফোনালাপ ও দেখা সাক্ষাৎ:
একটা ছেলে যখন একটা মেয়েকে দেখার পর তাদের মাঝে বিয়ে ঠিক হয়ে যায় তখন দেখা যায় তার একে অপরের সাথে ফোনে কথাবার্তা বা অন্য কোন ভাবে দেখা সাক্ষাত করে থাকে । অথচ বিয়ের আগে কথাবার্তা ও দেখা সাক্ষাৎ কোন ভাবেই জায়েয নেই।
৩. গায়ে হলুদ:
গায়ে হলুদ সাধারণত বিয়ের একদিন আগে অনুষ্ঠিত হয় । এটা হিন্দুয়ানী সংস্কৃতি, বিজাতীয় অনুকরণ ও অনৈসলামিক প্রথা। হলুদ বা কোন রং ব্যবহার করা পুরুষের জন্য সম্পূর্ন হারাম। মহিলাদের জন্য যদিও রং জায়েজ, কিন্তু বর্তমানে যেরূপ বেপর্দা ও বেহায়াপনার সাথে গান বাজনা বাজিয়ে গায়ে হলুদ অনুষ্ঠিত হয় তা সম্পূর্ণ নিষেধ ও শরীয়ত পরিপন্থী।
৪. আরো কয়েকটি নিষিদ্ধ কর্মকান্ড:
বিয়ের দিন আমরা এমন কিছু কর্মকান্ড করে থাকি যা অবৈধ হওয়ার সাথে সাথে শালীন রুচির খেলাফ। যেমন-
১. যখন বর যাত্রী আসে তখন গেইটে ফিতা ধরা এবং বরের কাছে থেকে কিছু টাকা আদায় করা।
২. বরের যখন খানা খাওয়া শেষ হয় তখন যুবক-যুবতীরা মিলে বরের হাত ধোয়ানো।
৩. ছবি তোলা, ভিডিও করা, গান বাজানো ইত্যাদি।
৪. বরের জুতা লুকানো
এ সমস্ত কাজ সবই শরীয়ত বিরোধী কাজ। অথচ এখন এগুলো হয়ে উঠেছে আমাদের কাছে অত্যন্ত আনন্দদায়ক । এ সমস্ত আয়োজন ছাড়া যেন বিয়েই হয়না। অথচ এর থেকে বেঁচে থাকা একজন মুসলমানের ঈমানী দায়িত্ব। এগুলো সব হলো বিধর্মীদের রীতি । অথচ আমরা তারই অনুসরন করি । অপরদিকে বিধর্মীরা আমাদের কতটুকু অনুসরণ করে । আমাদের উচিত বিয়ের সুন্নাত পদ্ধতি জেনে সেই অনুযায়ী বিবাহ চুক্তি সম্পাদন করা । যাতে করে আমাদের বিয়ে বরকতময় হয়।
বাসর রাত :
ইসলাম একটি পূর্ণাঙ্গ জীবন ব্যবস্থা, ইসলাম তার পূর্ণাঙ্গ জীবন ব্যবস্থা এ রাত সম্পর্কে দিক নির্দেশনা দিয়েছে। তা নিম্নরূপ:
*প্রথমে স্বামী নববধূর মাথায় হাত রেখে আল্লাহর নাম স্মরণ করবে, এবং আল্লাহর নিকট নববধূর জন্য বরকতের দোয়া করবে।
* বর কনে দুই রাকাত নামাজ পড়ে আল্লাহর দরবারে প্রার্থনা করবে।
* স্বামী নববধূর সাথে অত্যন্ত প্রীতি মধুর কথা বলবে ।
* কিছু হাদিয়া পেশ করবে। এতে পরস্পরে মহব্বত সৃষ্টি হবে। কমপক্ষে কিছু খাদ্যবস্তু হলেও পেশ করবে।