ডঃ মোঃ নুরুল আমিন এক : ১৯৭৪ এ দুর্ভিক্ষের কবলে শেখ মুজিবের বাংলাদেশ আকাশচুম্বী শেখ মুজিবকে দেখে রাজপথে মানুষ আর হাত তোলে না- ১৯৭৪ সালের ২৭ সেপ্টেম্বর লন্ডন থেকে প্রকাশিত স্টেটম্যান পত্রিকায় এভাবেই ব্যাখ্যা করা হয় বংগবন্ধুর অবস্থা। এধরণের অনেকগুলো বিদেশি সংবাদ মাধ্যমের প্রতিবেদন নিয়ে প্রকাশিত হয়েছে একটি বই “বিদেশী সাংবাদিকের দৃষ্টিতে শেখ মুজিবের বাংলাদেশ
ডঃ মোঃ নুরুল আমিন
এক : ১৯৭৪ এ দুর্ভিক্ষের কবলে শেখ মুজিবের বাংলাদেশ
আকাশচুম্বী শেখ মুজিবকে দেখে রাজপথে মানুষ আর হাত তোলে না- ১৯৭৪ সালের ২৭ সেপ্টেম্বর লন্ডন থেকে প্রকাশিত স্টেটম্যান পত্রিকায় এভাবেই ব্যাখ্যা করা হয় বংগবন্ধুর অবস্থা। এধরণের অনেকগুলো বিদেশি সংবাদ মাধ্যমের প্রতিবেদন নিয়ে প্রকাশিত হয়েছে একটি বই “বিদেশী সাংবাদিকের দৃষ্টিতে শেখ মুজিবের বাংলাদেশ “। এই বইটিতে সে সময়ের যে চিত্র তুলে ধরা হয়েছে তার সারাংশ তুলে ধরা হলো। ১৯৭৪ সালের ৩০ মার্চ লুই সিমনস লন্ডনের গার্ডিয়ান পত্রিকায় আলিমুদ্দিন সহ অনেকেরই পরিচয় করে দেন। তিনি শিরোনাম করেন যে এ একজনের কাহিনী নয়। তিনি তার রিপোর্টে আওয়ামী লীগের সীমাহীন দুর্নীতির কথা উল্লেখ করেছেন। তার রিপোর্টের আগ মুহুর্ত পর্যন্ত প্রায় ৫০ লক্ষ টনের বেশি খাদ্যশস্য এসেছিলো সাহায্য হিসেবে। কিন্তু এই খাদ্যের বেশিরভাগ পাচার হয়ে ভারতে গিয়েছে। তিনি আরও লিখেন যে রাজনৈতিক চাইরা রিলিফের গম, চাল চুরি করে কালোবাজারে বিক্রি করেছেন। রেশনের দোকানে গিয়ে কিছুই পাওয়া যায়নি। বিদেশ থেকে খাদ্য সামগ্রী সাহায্য আসে চট্টগ্রাম বন্দর হয়ে জাতিসংঘের বাংলাদেশস্থ রিলিফ অফিসে। এরপর তদারকি শুরু করতেন বাংলাদেশ সরকার। রিপোর্টার আরও বলেন শেখ মুজিব অভ্যন্তরীণ বিলি বন্টনে বিদেশিদের তদারকি বরদাশত করতনা। সংবাদের তথ্য মতে যে পরিমাণ সাহায্য আসতো তা দিয়েই অভাব দূর হবার কথা। কিন্তু শুধুমাত্র কাগজে কলমে বিলি দেখিয়ে বেশিরভাগই চলে যেত সীমান্ত পাড়ি দিয়ে ভারতে। ওয়ার্নার এডাম ১৯৭৪ এর ২০ আগষ্টে বাংলাদেশের দুর্ভিক্ষের চিত্র তুলে ধরেন পশ্চিম জার্মানির ফ্রাংকফুটার এলজেমাইন পত্রিকায়। তার অভিযোগ ছিলো যে ভারতের প্রতি নতজানু পররাষ্ট্রনীতির কারনে আওয়ামী শাসকগোষ্ঠী সর্বদাই সেবাদাস হিসেবে কাজ করেছিলো। তাই ভারত ফারাক্কা বাধ দিয়ে গংগার পানি প্রত্যাহার করে বাংলাদেশকে বন্যায় ভাসিয়ে দিতে ভারতের চক্রান্ত নিয়ে কোন কথাই বলেনি! রিপোর্ট লেখার আগ পর্যন্ত প্রায় দুই বছরে প্রায় ৩৫০০ মিলিয়ন মার্ক সাহায্য পাবার পরেও বাংলাদেশের কোন উন্নতি হয়নি বিধায় বাংলাদেশকে বহির্বিশ্বে একটি “তলাবিহীন পিপে” হিসেবে আখ্যায়িত করা হয়েছে।
আওয়ামী চাটুকাররা রিলিফ মারছে কিন্তু মরছে বিপন্ন মানুষ! রিলিফ মারবেই বা না কেন? আওয়ামীলীগের ক্ষমতার ভিত্তিই ছিলো সীমাহীন দুর্নীতি। এভাবেই ৭৪ এর দুর্ভিক্ষের চিত্র তুলে ধরেন কার্লোস উইগম জুরিখ থেকে প্রকাশিত টজেস আর্জগার পত্রিকায় ১৯৭৪ সালের ২৯ আগষ্ট। তার রিপোর্টের তথ্য মোতাবেক আওয়ামী সরকার বাংলাদেশের বন্যা পরিস্থিতির অতিরঞ্জিত তথ্য দেখিয়ে বিদেশ থেকে সাহায্য এনেছিলো এবং সেই অর্থের বেশিরভাগ সরকারি কর্তাদের পকেটে গিয়েছিলো। তার দেয়া অনেক তথ্যের মধ্যে একটি হলো এই যে, বন্যাপীড়িতদের সাহায্যের জন্য যে গুরু দুধ আসতো সেগুলো বিমানবন্দর থেকে খালাস হয়েই পরদিন বাজারে বিক্রি হতো। এভাবেই চলতো রিলিফ কর্মসূচি। তিনি বাংগালীর রিলিফ চুরি নিয়ে প্রবাদ উল্লেখ করেছেন, তা হচ্ছে “বাংগালীর মাথা আকাশে, পা ধুলায় ও হাত অন্যের পকেটে।” শেখ মুজিবের শাসন আমলের চিত্র নিয়ে ১৯৭৪ সালের ২২ সেপ্টেম্বর দি সানডে টাইমস পত্রিকায় জন সোয়ালন লিখেছেন যে বাংলাদেশ দেওলিয়ার পথে। তার রিপোর্টে উল্লেখ করেছেন যে স্বাধীনতা পরিবর্তি প্রায় ২০০০ মিলিয়ন ডলার সাহায্য পেয়েছে বাংলাদেশ। যা প্রায় জনপ্রতি ১০ পাউন্ডের বেশি। সেই সময় বাংলাদেশের মানুষের জনপ্রতি বছরে গড় আয় ছিলো ৩০ পাউন্ড। অথচ এই বিশাল অংকের সাহায্য পেয়েও বাংলাদেশ সেই সাহায্যের উপযুক্ত ব্যবহার করেনি। কল কারাখানা বন্ধ হয়ে গেছে, তা চালুর উদ্যোগ নেয়নি সরকার। ২ কোটি ৬০ লাখ শ্রমিকদের ১/৩ বেকা, চালের দাম বৃদ্ধি পেয়েছে, অভাবের কারণেই বেপরোয়া খুন রাহাজানি, একদিন একসাথে ৪ টি চালের গুদাম লুন্ঠিত হয়েছে।
অভাবের করুন কষাঘাতে কেউ এখন রাজপথে শেখ মুজিবকে দেখে হাত তোলে না। জনাথন ডিম্বলবী নিউ স্টেটম্যান পত্রিকায় ১৯৭৪ এর ২৭ সেপ্টেম্বর এভাবেই তুলে ধরেছেন মুজিবের জনপ্রিয়তা ও তার শাসনের চিত্র। হায়রে মুজিব যাকে দেখে বাংগালী আবেগে জড়িয়ে ধরত সে এখন গাড়িতে জানালা বন্ধ করে চলে। ক্ষুধার্ত মানুষের সংখ্যা দিন দিন এতো বেড়ে গিয়েছিলো যে সরকারি কর্তা ভয়ে ছিলেন যে ক্ষুধার্ত জনগণ একবার ক্ষেপে গেলে রক্ষা নেই। অন্যদিকে সরকারি কর্তা বা আওয়ামী লীগের নেতারা ঢাকার ইন্টার কন্টিনেন্টাল হোটেলে মদের পেয়ালা নিয়ে ঠিকই আমত ফুর্তিতে ব্যস্ত ছিলো। এই ছিলো ক্ষুধার্ত জনগণের প্রতি আওয়ামী ভালোবাসার চিত্র। এরাই ছিলো বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের বীরবাহিনী যারা গেরিলা যুদ্ধে পাকিস্তানকে হারিয়েছে। এরাই আজ রাজনৈতিক দালালী করে ধনাঢ্য জীবন যাপন করছে। অহরহ সরকারি কর্মচারীদের ভয় দেখাচ্ছে। এরাই ছিলো আওয়ামী লীগের বাছাই করা পোষ্য। এই রিপোর্টে হারুন কিসিঞ্জার এর একটি কথা উল্লেখ করেছেন “বাংলাদেশ একটা আন্তর্জাতিক ভিক্ষার ঝুলি”।
জেকুইস লেসলী লন্ডন গার্ডিয়ান পত্রিকায় ১৯৭৪ সালের ২ অক্টোবর লিখেছেন যে সবচেয়ে প্রান্তিক জনগোষ্ঠী বেশী অনাহারক্লিষ্ট। তাদের চেহারা হাড্ডিসার, ক্ষুধায় শিশুদের পেট গর্তে ঢোকানো। এদিকে বাংলাদেশের আমলারা দুর্ভিক্ষের জন্য বন্যাকে দায়ী করেন কিন্তু বিদেশি পর্যবেক্ষকদের মতে বন্যা নয় দুর্ভিক্ষের জন্য সরকার দায়ী। সরকারের ব্যর্থতা দায়ী। দুর্ভিক্ষের কারন বন্যা ততোটা নয়, যতটা মজুদদারী ও চোরাচালানের ফল। চালের অভাব মেটাতে আমদানি করা হতো কিন্তু সেই চালের সবই রেশন প্রথা চালু রাখতেই ফুরিয়ে যায়। রেশনের খাদ্যসামগ্রীর মাত্র ১% রিলিফের জন্য দেয়া হতো। এরকম একটা ভয়াবহ অবস্থায় গ্রামের জনগণ শহরে এসে ভিক্ষাবৃত্তির সঙ্গে জড়িত হয়েছিল। কিন্তু সরকার রাজপথ ভিক্ষুকমুক্ত রাখতে বদ্ধ পরিকর। বন্দুকের ভয় দেখিয়ে ক্ষুধার্ত ভিক্ষুকগুলোকে নিয়ে যাওয়া হতো ক্যাম্পে। সেখানে সারাদিন ২/১ টুকরো রুটি খেতে দেয়া হতো। ক্যাম্পে একবার ঢুকলে আর বের হতে পারতো না কেউ। যে দেশে ক্ষুধার্ত মানুষকে ক্যাম্পে নিয়ে খাঁচাবন্দি করে রাখা হয় সে আবার কেমন স্বাধীন দেশ। এভাবেই শেখ মুজিবের শাসন আমলের চিত্র তুলে ধরেন ড্যানিয়েল সাদারল্যান্ড ক্রিশ্চিয়ান সায়েন্স মনিটর পত্রিকায় ১৯৭৪ সালের ১৮ অক্টোবর।
স্বাধীন বাংলাদেশের গ্রামগুলো খাঁ খাঁ করছে, কাজ নেই, খাবার নেই। বাজারে চালের দাম অনেক চড়া! ১৯৭৪ সালের সেপ্টেম্বর মাসের তৃতীয় সপ্তাহে চালের মন ছিলো ৪০০ টাকা যা স্বাধীনতার আগের দামের ১০ গুন। দুর্দশার এই চিত্র তুলে ধরেন লরেন্স লিফসুলজ ১৯৭৪ সালের ২৫ অক্টোবর হংকং থেকে প্রকাশিত ফার ইস্টার্ন ইকনমিক রিভিউ এ। ১৯৭৪ সালের ২৩ সেপ্টেম্বর যুক্তরাষ্ট্রে যাবার প্রাক্কালে শেখ মুজিব প্রতিটি ইউনিয়নে একটি করে ৪৩০০ লংগরখানা চালুর ঘোষণা দেন। এজন্য প্রতিটি ইউনিয়নের জন্য রোজ বরাদ্দ ছিলো মাত্র দুই মন আটা, যা দিয়ে এক হাজার লোকের দৈনিক একটি রুটির জন্যও যথেষ্ট ছিলো না। এছাড়া চুরি তো ছিলোই। লংগরখানার বিররন দিয়েছেন কস্তুরি রংগন ১৯৭৪ সালের ১৩ নভেম্বর নিউইয়র্ক টাইমস এ। তার বর্ননা অনুযায়ী লংগরখানায় প্রতিটি কেন্দ্রে প্রতিদিন যে ১০০০ বা তার চেয়ে আরো বেশি লোকজন আসতো তাদেরকে দেয়া হতো মাত্র একটি করে রুটি অথবা চাল-ডাল মিশ্রিত ৪ আউন্স (১ আউন্স = ২৮ গ্রাম) খিচুড়ি। কোনো কোনো লংগরখানায় শুধুমাত্র মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের দেয়া বিস্কুট দেয়া হতো। এই ছিলো লংগরখানার চিত্র। লঙ্গরখানার এরকম চিত্র আমি নিজেও তৎকালীন বয়স্কদের মুখে শুনেছি। তাদের বর্ণনা মোতে, “ লংগরখানায় দেয়া হতো খিচুড়ি। সেই খিচুড়ি দেয়া হতো বালিতি ভরে। খিচুড়ির পরিমাণ বেশি ছিলো না। বালতিতে খিচুড়ি নেয়ার কারন ছিলো খিচুড়ির পানির পরিমানের কারনে। সামান্য কিছু চাল, ডাল, কয়েকটি সীম আর ডেসকি ভর্তি পানি! তেল মসলা পিয়াজ নেই বললেই চলে। অন্যদিকে, লংগরখানার ভলান্টিয়ার আওয়ামী সমর্থকেরা বেনসন সিগারেট ফুকতেন আর ক্ষুধার্ত মানুষকে লাইনে দাড় করাতেন। লংগরখানায় পিয়াজ, তেল, মসলা ব্যবহার না করে সেগুলো চুরি করে নিজের বাড়িতে নিয়ে যেতেন এসব আওয়ামী বেনসন ফুকাররা! এইরকম ঘটনা যে সত্য ছিলো তার প্রমান মিলে স্বয়ং শেখ মুজিবের বক্তব্যেই। যেমন আমি বিদেশ থেকে ভিক্ষা কইরা আনি আর এই চাটার দলেরা সব চাইটা খায়! পাকিস্তান সব কিছুই নিয়া গেছে, শুধু চোর গুলোকে থুইয়া গেছে! এছাড়াও কম্বল নিয়ে শেখ মুজিবের বক্তব্য, চোরের খনি ইত্যাদি সব বক্তব্যই সবাই জানেন।” মুজিব দু:শাসনের সৃষ্ট এই দুর্ভিক্ষের মৃত্যু পদযাত্রী বনি আদমরাই জানে লংগরখানার আসল কথা। লংগরখানা নিয়ে এমন মন্তব্য করেছেন পিটার গ্রেসটন, লন্ডন গার্ডিয়ান পত্রিকায় ১৯৭৪ এর ৩০ অক্টোবর। তার রিপোর্ট মোতাবেক বাংলাদেশের ঝুলিতে মারাত্মক ফুটো আছে, যত সাহায্য দেয়া হোক না কেন, দুর্নীতি, আলসেমী ও সরকারি আমলাদের আত্নঅহমিকায় অপচয় হবে। বেশি দেয়া মানেই লোকসান।
এদিকে মহা মনন্তরে কবলিত এই বাংলাদেশকে বাচাতে এগিয়ে এসেছিলো বিশ্ববাসী। কিন্তু সাহায্য যা আসতো তা মুজিবের “চাটার দল” শেষ করে দিতো। স্টান কার্টার “ডেইলি নিউজ” পত্রিকায় এভাবেই মুজিবের শাসন আমলের বর্ননা দিয়েছেন ১৯৭৪ সালের ১ নভেম্বর। তার রিপোর্টে সে উল্লেখ করেছেন যে শেখ মুজিব হয়তো ঘুষ গ্রহণ করতেন না কিন্তু বেগম মুজিব ঘুষ গ্রহণ করতেন বলে গুজব আছে। সরকারি কর্মকর্তারা ঘুষ খেতেন তা নিশ্চিত। আর ঘুষের বিনিময়ে চোরাচালান হয়ে চাল পাচার হয়ে যেতো ভারতে। কিন্তু শেখ মুজিব বরাবরই দোষ অন্যের উপর চাপাতে চেষ্টা করলেও তিনি এবং তার সাংগরাই দুর্ভিক্ষের জন্য দায়ী। এইভাবেই বলেছেন এইচ ডি এস গ্রীনওয়ে ওয়াশিংটন পোস্ট এ ১৯৭৪ সালের ৮ নভেম্বর। অন্যদিকে মুজিবের দু:শাসনের রক্তচক্ষু উপেক্ষা করে অনেকেই বলেছিলেন যে দুর্ভিক্ষের জন্য একমাত্র শেখ মুজিবের রাজনীতি। এ ভাবেই রিপোর্ট উল্লেখ করেছেন মার্টিন ডেভিডসন ফার ইস্টার্ন ইকনমিক রিভিউ তে ১৯৭৪ এর ৮ নভেম্বর। যদিও সরকার পুরো সমস্যার জন্য অকাল বন্যাকে দায়ী করে চলেছিলেন আসলে দুর্ভিক্ষের কারন ছিলো মনুষ্যসৃষ্ট, মানুষের অসাধুতা, খাদ্য পাচার, আওয়ামী সাংগদের দুর্নীতি। শেখ মুজিব বাংগালীকে যে স্বাধীনতার স্বপ্ন দেখিছিলেন তা তিন বছরের মধ্যেই নিরর্থক হয়েছিলো। এই বিষয়টি বিশ্লেষণ করেছিলেন নিউইয়র্ক টাইমস পত্রিকায় বার্নার্ড ওয়েনরাব ১৯৭৪ সালের ১৩ ডিসেম্বর। তার বিশ্লেষণ অনুযায়ী স্বাধীনতার তিন বছরের মধ্যেই দেশের অর্থনীতি দেওলিয়া হয়েছিলো। দুর্নীতিতে দেশ ভরপুর হয়েছিলো। সাহায্যের ৭ টি বেবি ফুডের ১ টি এবং ১৩ টি কম্বলের ১ টি গরীবদের কাছে যেতো। এসবের জন্য বাংলাদেশের রেডক্রস চেয়ারম্যান ও আওয়ামী লীগের ঢাকা নগরীর চেয়ারম্যান গাজী গোলাম মোস্তফা, শেখ মুজিবের পরিবারের বিরুদ্ধে অভিযোগ শোনা যেত বেশী। শেখ মুজিবের ভাগিনা শেখ মনি একটি ঔষধ কোম্পানি দখল করে রেখেছিলো। কোম্পানির মালিক ভারত থেকে ফিরে এসে সেই কোম্পানি চালু করতে চাইলে শেখ মনি ৩০ হাজার ডলার দাবী করেছিলো। এভাবেই দুর্নীতির খেসারত দিতে গিয়ে দেশে দেখা যায় দুর্ভিক্ষ। এই দুর্নীতির মুল হোতা শেখ মুজিবকেই দায়ী করে ১৯৭৫ সালের ৬ জানুয়ারী লন্ডনের ডেইলী টেলিগ্রাফে লিখেছিলেন পিটার গীল। তার মতে সেই মুহুর্তে শেখ মুজিব বাংলাদেশের জন্য একটি বড় বোঝা হিসেবে পরিচয় পেয়েছিলো। তবে শেখ মুজিব সরাসরি দুর্নীতি করেছেন বা অর্থ আত্নসাত করেছেন কিনা আমার জানা নেই। কিন্তু এন্থনি মাসকারেনহাস এর রচিত “লিগ্যাসি অব ব্লাড” বইয়ের বাংলা ভার্শন “বাংলাদেশ: রক্তের ঋণ” এ বইয়ে পড়েছি তা হলো যে শেখ মুজিবের ছেলে শেখ জামালকে স্যান্ডহার্স্টের মিলিটারি একাডেমীতে পড়াতে সরকারি অর্থ খরচ করে বিশেষ ব্যবস্থায় অর্থ মন্ত্রনালয়ের অজ্ঞাতে গোপন আর্মি চ্যানেলে ৬০০০ পাউন্ড পাঠানো হয়েছিলো। যাহোক তিনি দুর্নীতি করুক কিংবা না করুক, তিনি দুর্নীতি থামাতে পারেনি। উপরুন্ত তিনি জরুরী অবস্থা জারি করেন। ঢাকাকে পরিছন্ন রাখতে প্রায় ঢাকার ৫০ হাজার বস্তিবাসীকে পুলিশ আটক করে ক্যাম্পে নিয়ে আসেন। এই রকম বন্দী শিবিরের কথাই উল্লেখ করেছেন জেকুইস লেসলি, লন্ডন গার্ডিয়ান পত্রিকায় ১৯৭৫ সালের ১৮ ফেব্রুয়ারিতে। ক্ষুধার মুর্ত প্রতিক ছিলো এই বন্দী শিবির গুলো। ১৯৭৫ সালের ২৯ জানুয়ারী প্রকাশিত কানসাস টাইমসে জুলিও শেরার বর্ননা মতে এসব ক্যাম্পে ক্ষুধার্ত মানুষকে আটকে পাহারায় ছিলো সশস্ত্র সৈন্য। এসব ক্যাম্পের বর্ননা থেকেই দুর্ভিক্ষের ভয়াবহ চিত্র ফুটে ওঠে বিশ্ববাসীর কাছে। দুর্ভিক্ষে অগনিত লোক মারা যায়। সরকারি হিসেব অনুযায়ী ২৭ হাজার কিন্তু বেসরকারি হিসেব অনুযায়ী ৩ লাখের মতো। এই পরিসংখ্যান দিয়েছিলেন জু গেন্ডলম্যান শিকাগো ডেইলী নিউজ পত্রিকায় ১৯৭৫ এর ২৬ মার্চ সংখায়।
এরকম অসংখ্য খবরের উদ্ধৃত করে প্রকাশ করা হয়েছে বইটিতে, যা এই স্বল্প লেখায় অসম্ভব। তবে সারবস্তু হলো ১৯৭৪ এর দুর্ভিক্ষের মুল কারণ সমুহ হচ্ছে: ১) আওয়ামী সরকারের সীমাহীন দুর্নীতি। ২) প্রশাসনের অব্যবস্থাপনা, ৩) আওয়ামী লীগের চাটুকারদের প্রতি শেখ মুজিবের অন্ধ ভালোবাসা, ৪) ভারতের প্রতি নতজানু পররাষ্ট্র নীতি, ৫) অর্থলোভী আওয়ামীলীগারদের দ্বারা ভারতে খাদ্য পাচার, ৬) আওয়ামী চাটার দলের রিলিফ চুরি ইত্যাদি। বিপর্যয়ের এই মুহুর্তে শেখ ব্যর্থ গালাগালি করেই ক্ষ্যান্ত ছিলেন। সংকট কাটাতে যথাযথ চেষ্টা না করে ক্ষমতার মছনদ টিকে রাখতে তৈরী করেছিলেন একদলীয় শাসনের, তার নাম বাকশাল। ৭৪ এ শুধু যে আওয়ামী চাটার দলের সীমাহীন দুর্নীতির কবলে জাতি নিস্পেসিত ছিলো তাই নয়। উপরন্তু ভারত নির্ভর নতজানু পররাষ্ট্র নীতি ছিলো অনেকটা দায়ী। স্বাধীনতা যুদ্ধে ভারত কেন সহায়তা করেছে সে বিষয়ে আজ লিখছিনা। শুধু এতটুকু বলছি ভারত কিন্তু শুধুমাত্র বন্ধু হিসেবে সাহায্য করেনি! তাদেরও অনেক স্বার্থ জড়িত ছিলো। তবুও বলা যায়, ভারতের সহায়তা ছিলো অনেক গুরুত্বপূর্ণ। তাই বলে নতুন এক দেশ থেকে রাশি রাশি খাবার পাচার করা হয়েছে ভারতে এটা মেনে নেয়া কি যায়। রিলিফের খাদ্য সামগ্রী পাচার করা হয়েছে ভারতে। তদুপরি অর্মত্য সেন তার বই “ফেমিন পভার্টি” তেও উল্লেখ করেছেন যে দুর্ভিক্ষ কবলিত এই বাংলাদেশ থেকে তখনও প্রচুর খাদ্য দ্রব্য ভারতে চলে গিয়েছে। এ যেন নিজ দেশের জনগণকে অভুক্ত রেখে ভারতকে সন্তুষ্ট রাখতে চেয়ছিলো ততকালীন আওয়ামী সরকার!
দুই
২০২৪ এর সম্ভাব্য মনন্তরে শেখ হাসিনার বাংলাদেশ
২০২৪ এর ৭ জানুয়ারি নির্বাচনের আগে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছেন যে বিএনপি ও আমেরিকা মিলে মার্চ নাগাদ দেশে দুর্ভিক্ষ ঘটাবে। আসলে একটি দেশে দুর্ভিক্ষ মাত্র ১/২ মাসে হয়না। বছর বা যুগ ধরে চলা অর্থনৈতিক অব্যবস্থাপনায় হয় দুর্ভিক্ষ। সম্প্রতি একটি টিভি চ্যানেলের রিপোর্ট দেখলাম যে বাংলাদেশে নিম্ন বা মধ্যবিত্তরা বাজারের গিয়ে মাছের কাটা, ফাটা ডিম, মুরগীর পা কিনছে প্রোটিনের চাহিদা মেটাতে। অথবা বলা যায় মাছের কাটা কিনে সেটা দিয়ে তারা সবজি ভাজি করে কোন রকমে মাছের গন্ধ দিয়ে সবজি খেয়ে “দুধের স্বাদ ঘোলে মেটানোর” চেষ্টা মাত্র। আর সেই সবজিও সস্তা তা কিন্তু নয়! এখন বর্তমান বাজারে গিয়ে কি দেখা যায়? দ্রব্য মুল্যের দাম সাধারণ মানুষের হাতের নাগালের বাইরে। বাদ দিলাম মাছ মাংসের কথা। সাধারণ খেটে খাওয়া দরিদ্র শ্রেনীর লোকেদের শেষ আশ্রয় হচ্ছে গোল আলু, ডিম, কাচা মরিচ, একটু লবণ। আলু হচ্ছে গরীবের সবজি, আর ডিম হচ্ছে গরীবের প্রোটিন। কিছু না পেলেও ২ টা আলু সিদ্ধ করে, একটু লবন কাচা মরিচ, লবণ কচলিয়ে ভর্তা করে পেট ভরে একটু ভাত খেয়ে কাজে নেমে যান সাধারণ খেটে খাওয়া শ্রমজীবী হত দরিদ্র মানুষ। কিন্তু সেটাও এখন আয়ত্ত্বের বাইরে! উদাহরণ স্বরূপ কয়েকদিন আগে মিরপুরে গার্মেন্টস শ্রমিকরা আন্দোলন করেছেন তাদের মুজুরী বৃদ্ধির জন্য। তাদের বর্তমান মুজুরী প্রায় মাসে ৮ হাজার টাকা। দিনে ৩০০ টাকার চেয়ে কম। এই টাকায় ৪/৫ জনের একটি পরিবারের দৈনিক ২/৩ কেজি চাল, ৫/৬ টা গোলআলু, ৫০ গ্রাম কাচা মরিচ, ১০০ গ্রাম লবন, ইত্যাদি কেনাই সম্ভব নয়। তার উপর ঢাকায় বাসা ভাড়া, সন্তানদের অন্যান্য খরচ, চিকিৎসা, শিক্ষা ইত্যাদি হবে কি করে? অথচ আমরা দেখলাম মালিক পক্ষ দিতে চায় মাসে ১০ হাজার টাকা বেতন। এই পর্যায়ে বিক্ষোভ দমনে পুলিশ সদস্যের গুলিতে মারা গেছেন গার্মেন্টস শ্রমিক! এখানে উল্লেখ্য যে এই গার্মেন্টস রপ্তানির মাধ্যমেই বাংলাদেশ সরকার সবচেয়ে বেশি বৈদেশিক মুদ্রা আয় করে। অথচ যারা এই শিল্পের জন্য পরিশ্রম করে যাচ্ছে তাদের নেই নুন্যতম একটি জীবন। ওরা চাইলেন একটু ভর্তা, ভাত খেয়ে বাচতে আর পুলিশ করল গুলি! এছাড়া সরকারি দলের সমর্থক বন্ধুক হাতে গার্মেন্টস পাহারায়। এসব শ্রমিকরা যেন সরকারি দলের সমর্থকদের কাছে আবর্জনা! ক্ষোভে ব্যথায় গার্মেন্টস শ্রমিকরা বলেছেন বেতন বাড়িয়ে দিতে হবেনা জিনিসপত্রের দাম কমিয়ে দেন। আর কিছুদিন পরে হয়তো এরাই বলবে হয় মুজুরী বাড়ান না হয় গুলি করেন!
বয়স্কদের মুখে শুনেছি ৭৪ এ মানুষ যা পেত তাই খেয়ে জীবন বাচানোর চেস্টা করেছিলো। কিন্তু কিছু খেতে তেল, পিয়াজ, মরিচ না থাক লবন ছাড়া বোধহয় বিশ্বের কেউ খাবার খেতে পারেনা। সেই লবণও নাকি মিলেনি ৭৪ এ। মানুষ লবণের খালি বস্তা পানিতে ভিজিয়ে সেই পানি দিয়ে খাবার মেখে খেয়েছিলেন। ঠিক বর্তমান এই বাস্তবতায় দেখি মানুষ যখন পিয়াজ, মরিচ, তেল ইত্যাদি কিনতে হিমশিম খায় তখন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা মাঝে মধ্যে তেল ছাড়া রান্না, পিয়াজ ছাড়া রান্না, বেগুন ছাড়া বেগুনি, মরিচ সংরক্ষণের পদ্ধতি ইত্যাদি হাস্যকর রেসিপি দিয়েই চলেছেন। সম্প্রতি সপ্তাহ খানেকের মধ্যে তিনি মুরগী ডিম দেয়ার একটি গবেষণা পত্র প্রকাশ করেছেন। কারণ ডিমের বাজার মুল্য সাধারণ মানুষের ক্রয় ক্ষমতার বাইরে। তাই বাজারে ডিমের যোগান, চাহিদা ও মুল্য বুঝাতে গিয়ে উনি বলেছেন যে মুরগী বর্ষাকালে ডিম পাড়ে কম। অর্থাৎ বর্ষা শেষ হলেই ডিমে আবার ভড়ে যাবে দেশ! বিশ্বে এত নামী দামি পোল্ট্রি বিজ্ঞানীরা গবেষণা করে এমন একটি বিষয় প্রমান করতে পেরেছে কিনা জানিনা। তবে শেখ হাসিনা পেরেছেন। এটা কি উনার যোগ্যতা নাকি মশকারা এটা আমার ধারনার বাইরে!
জনগনকে নিয়ে মশকরা করার একটি ঊদাহরন দেই। এভাবেই একের পর এক, মেগাপ্রকল্পের মেগা দুর্নীতির মধ্য দিয়েও দেশকে কসমেটিক উন্নয়ন দিয়ে সাজিয়ে তোলে শেখ হাসিনা। আর সেই কসমেটিক উন্নয়নের সুবাসে জনগণের কথা একেবারেই ভুলে যায়। উদাহরণস্বরূপ, দেশের ১/৪ ভাগ বন্যায় ভাসছিলো বন্যায়, পর্যাপ্ত সাহায্য না দিয়েই পদ্মা সেতু উদ্বোধন অনুষ্ঠান উপলক্ষে শতশত কোটি টাকা খরচ করে, ভারতের নাচলেওয়ালিকে ভাড়া করে শত কোটি পদ্মার পানিতে টুস করে ফেলে দেয়। খুবই জমকালো উদ্বোধনী অনুষ্ঠান করতে চার জেলার ডিসিদের নামে প্রায় ৫ কোটি টাকা বরাদ্দ দিয়েছে সরকার, বরাদ্দকৃত জেলা গুলো হচ্ছে, ঢাকা জেলার জন্য ১ কোটি ৫০ লাখ টাকা, মুন্সিগঞ্জ জেলার জন্য ১ কোটি ৩৯ লাখ টাকা, মাদারীপুর জেলার জন্য ১ কোটি ৩৯ লাখ টাকা এবং শরীয়তপুর জেলার জন্য ৫০ লাখ টাকা বরাদ্দ দেয়া হয়েছে (সূত্রঃ পদ্মা সেতুর উদ্বোধন কাল চার জেলার উদযাপন ব্যয় ৫ কোটি টাকা, ইনকিলাব, ২৪ জুন ২০২২)। এছাড়া ৬০ জেলায় উদযাপন ব্যয় কত বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে সেই হিসেব সেতু বিভাগ থেকে সেটি বলা হয়নি (ইনকিলাব, ২৪ জুন ২০২২)। অন্যদিকে, সিলেট ও সুনামগঞ্জের বন্যাকবলিত ৪৪ লাখ মানুষের জন্য বরাদ্দ হয়েছে ২ কোটি ৯৫ লাখ টাকা, ১ হাজার ৯৫২ টন চাল ও প্রায় ৩০ হাজার প্যাকেট শুকনো খাবার, যা পর্যালোচনা করলে দেখা যায়, জনপ্রতি বরাদ্দ দেয়া হয়েছে মাত্র ৬ টাকা ৫৫ পয়সা ও ৪৪০ গ্রাম চাল (সূত্রঃ জনপ্রতি সরকারি বরাদ্দ ৬ টাকা ৫৫ পয়সা, চাল আধা কেজিরও কম, দি ডেইলি স্টার ২২ জুন, ২০২২)।
এখন বর্তমান আরেকটি উদাহরণে আসি। হাজারো সংকটে জনগনকে রেখে প্রতিনিয়ত সরকারি অর্থ ব্যয় করা হচ্ছে বিভিন্ন বন্দনায়, যার কোন দায় দায়িত্ব নেই। মুজিব বর্ষ (১৭ মার্চ ২০২০- ২৬ মার্চ ২০২১) পালনে বরাদ্দ ছিলো ৫১২ কোটি টাকা, এবং ২০১৯- ২০ অর্থ বছরে ছিলো ১০০ কোটি টাকা (সূত্রঃ মুজিববর্ষ পালনে সরকারি বরাদ্দ ১০০ কোটি টাকা, ডয়েচে ভেলে, ১৭ জানুয়ারি ২০২০)। শত শত কোটি টাকা খরচ করে সারাদেশের আনাচেকানাচে শেখ মুজিবের ভাস্কর্য নির্মাণ শুরু করে (সূত্রঃ মুজিব ভাস্কর্য: বিতর্কের মুখে কাজ বন্ধ থাকা ধোলাইপাড়ের এই প্রকল্পটির খবর কী? বিবিসি বাংলা, ২৫ মার্চ ২০২২)। এসব অনেক ভাস্কর্যে শুধুমাত্র নিম্নমানের কাজ করেই খরচ করা হয়েছে দেশের অর্থ। পদ্মা সেতু পার হয়ে ঢাকায় আসার অভিমুখে শেখ মুজিবের ভাস্কর্য নির্মানের খরচ ৯ কোটি টাকা (বঙ্গবন্ধুর স্মৃতি ধরে দেশে ভাস্কর্য শিল্পে ‘জাগরণ’ বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম, ১৫ আগষ্ট ২০২৩)। স্বাধীনতার ৫০ বছর পুর্তি পালনের নিমিত্তে ভারতের মোদিকে নিয়ে আসে অনাড়ম্বর অনুষ্ঠান করে কোটি কোটি টাকা খরচ করে (সূত্রঃ ৫০ কর্মসূচিতে স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তী উদযাপন, ব্যয় ২৬০ কোটি, ঢাকা পোষ্ট,২৭ ফেব্রুয়ারি ২০২১) । কোভিড মহামারীতে সারা বিশ্ব অস্থির। জীবন যাপন বিপন্ন। সারাবিশ্বেই একটি দুর্যোগ। বাংলাদেশেও একের পর এক লক ডাউন। পাশাপাশি লক ডাউন দিয়ে বিরোধী দলের আন্দোলন দমনের চেষ্টা। জনগণ যখন টিকার জন্য হাহাকার তখন ভারত থেকে টিকা আনার নিমিত্তে ৬০০ কোটি টাকা গচ্চা দেয়। এরপর চার্টার্ড প্লেনে বিশাল সফল সংগী নিয়ে ফিনল্যান্ড ব্যক্তিগত সফর হয়ে জাতিসংঘ অধিবেশনে যোগ দেয় (সূত্রঃ যুক্তরাষ্ট্রের পথে প্রধানমন্ত্রী ফিনল্যান্ডে, জনকন্ঠ, ১৮ সেপ্টেম্বর ২০২১; মহামারী শুরুর পর প্রথম দেশের বাইরে যাচ্ছেন প্রধানমন্ত্রী, জনকণ্ঠ, ১৬ সেপ্টেম্বর ২০২১; জাতিসংঘ অধিবেশনে যোগ দিতে নিউইয়র্ক পৌঁছেছেন প্রধানমন্ত্রী, দি ডেইলি স্টার, ২০ সেপ্টেম্বর, ২০২১ )। ফিনল্যান্ডে গিয়ে বিমানকে শুধুমাত্র ব্যক্তিগত প্রয়োজনে ২ দিন এয়ারপোর্ট পার্কিং ফি দিয়ে বসিইয়ে রাখে। পুরু জাতিকে করোনার সংকটে রেখে বৈদেশিক মুদ্রা খরচ করে এমন একটি বিশাল বহরের ভ্রমনসঙ্গী নিয়ে এরকম একটি যাত্রা তখন অনেক সমালোচনা সৃষ্টি হয়। নিউইয়র্ক থেকে শেখ হাসিনা সংবাদ সম্মেলনে বলেছিলেন দীর্ঘদিন করোনার কারনে ট্রাভেলস বন্ধ থাকায় পাইলটরা বসে ছিলো, তাই নিউইয়র্ক – এর এই বিমান যাত্রায় পাইলটদের প্রাক্টিস হলো। জাতির এত রিজার্ভের ডলার খরচ করে করোনা সংক্টকালীন মুহুর্তে এ ধরনের কথা সত্যিই জাতির সাথে মশকরা। উল্লেখ্য অপ্রমানিত সুত্রের খবরে তখন সোস্যাল মিডিয়ায় চাউর হয়যে শেখ হাসিনা ফিনল্যান্ডে প্রায় ২৭ টি লাগেজ ভর্তি করে কিছু নিয়ে গেছেন এবং সেখানে তার বোনপো ববির কাছে রেখে এসেছেন। ঠিক শেখ হাসিনার ভ্রমনের ঐ মুহুর্তে ইউনিয়ন ব্যাংকের ভল্ট থেকে বিপুল অর্থ চুরি হয়ে যায় (সূত্রঃ ইউনিয়ন ব্যাংকের ভল্টে টাকার হিসাব মিলছে না, প্রথম আলো, ২৩ সেপ্টেম্বর ২০২১)। বিদেশে থাকা অনেকেই প্রধানমন্ত্রীর সফরের লাগেজ এবং টাকা চুরির একটি মিল খুঁজে সমালোচনা করেন। তবে শেখ হাসিনার সমালোচনা বা তার বিরুদ্ধে অভিযোগ দেয়ার মতো সাহস বাংলাদেশে কোন গনমাধ্যমের বা ব্যক্তির নেই। উল্লেখ্য ১৯৭১ সালের পর শেখ হাসিনার বাবা শেখ মুজিব সদ্য স্বাধীনতা প্রাপ্ত ভঙ্গুর অর্থনীতির মধ্যেও চাটার্ড প্লেন নিয়ে জাতিসঙ্গের অধিবেশনে গিয়েছিলেন এবং প্রায় ৭ দিন বিমানকে পার্কিং এ রেখে ফি দিয়েছেন।
এছাড়াও করোনার এসময় রিলিফ চুরির আওয়ামী নেতাদের মহোৎসব। রিলিফ বা টিসিবির সয়াবিন তেলের বোতল পাওয়া যায় আওয়ামী নেতাদের বাসার বক্স খাটের নীচে। স্তরে স্তরে সাজানো। আওয়ামী চাটারদের গোডাউনে রিলিফের চালের বস্তার স্তুপ। লোকজন সামাজিক মাধ্যমে ট্রল করে এরা কাফনের কাপড় পর্যন্তও চুরি করবে। অবশ্য এটাই স্বাভাবিক। অন্যদিকে, করোনার সময় ৬৫ দিন লকডাউন দেয়ার পর এক সরকারী বিজ্ঞপ্তিতে বলেছিলো যে, ১.৫ কোটি পরিবার বা ৭.৫ কোটি লোকের মধ্যে বিতরণ করেছে ১ লাখ ৭১ হাজার ৭৮১ মেট্রিক টন চাল (সুত্রঃ প্রায় দেড় কোটি পরিবারকে ত্রাণ দিয়েছে সরকার, ইত্তেফাক, ১২ জুন ২০২০)। যদিও আওয়ামী চাটারদের রিলিফ চুরির উল্লাস জাতি দেখেছে (সূত্রঃকরোনাভাইরাস: মহামারি হয়তো একদিন যাবে, কিন্তু বাংলাদেশে দুর্নীতির ভাইরাস কোন ওষুধে দূর হবে? বিবিসি, ২৩ এপ্রিল ২০২০;করোনার ত্রাণ চুরি সমাচার, যুগান্তর, ১৮ এপ্রিল ২০২০, ডয়েসে ভেলে,করোনার চাল চুরি, ১৩ এপ্রিল ২০২০ )। যদি মনেকরি কোন দুর্নীতি হয়নি, তবে ৬৫ দিনে জনপ্রতি বরাদ্দকৃত চালের পরিমাণ হয় মাত্র ২ কেজি ৩০০ গ্রাম। অর্থাৎ প্রতিদিন একজন মানুষের জন্য বরাদ্দ দেয়া হয়েছে প্রায় ৩৫ গ্রাম। একজন ব্যক্তি শুধুমাত্র ৩৫ গ্রাম চাল তিন বেলা খেলে প্রতিবেলায় চালের পরিমাণ দাঁড়ায় প্রায় ১২ গ্রাম। অথচ করোনার এই সংকট পরিস্থিতিতে ৫ তলা ভবনের মালিক আওয়ামীলীগ নেতাও পেয়েছেন ও এম এস এর চাল (সূত্রঃ ত্রাণের খাদ্য সহায়তা কর্মসূচিতে নানা অনিয়ম, গরিবের চাল খাচ্ছে প্রভাবশালীরা, যুগান্তর, ১৪ মে ২০২০) । পুর্বের ঐ একই প্রেস বিজ্ঞপ্তি অনুসারে, সাড়ে ১৪ লক্ষ মানুষের মধ্যে ৬৫ দিন ব্যাপী বিতরণ করা হয়েছে ২৭ কোটি ১৪ লক্ষ টাকা। অর্থাৎ, দুর্নীতি না হলে জনপ্রতি ৬৫ দিনে মাত্র ১৯৩ টাকা। আর সহজে বললে দাঁড়ায় ২ টাকা ৯৬ পয়সা। এই টাকা দিয়ে তেল, লবণ, কাঁচামরিচ, তরকারী ইত্যাদি কিনতে পারবে কেউ? অন্যদিকে, করোনায় বিপর্যস্ত অর্থনীতি ও সংকটের সময় গ্রামীণ সড়ক আর কালভার্ট নির্মাণের নামে এমপিদের দেয়া হয়েছে মাথাপিছু ২০ কোটি টাকা ( সূত্রঃ ইত্তেফাক,মহামারির মধ্যেও ২০ কোটি টাকা পাচ্ছেন সংসদ সদস্যরা, ২১ জুন ২০২০ ) । উল্লেখ্যযে, করোনার সাহায্যের জন্য আওয়ামীলীগের ত্রান কমিটি করা হয়েছিলো যাদের ভুমিকা ছিলো প্রশ্নকর (সূত্রঃ আওয়ামী লীগের ত্রাণ কমিটি যেন প্রশাসনের উপর খবরদারি না করে: টিআইবি, বিডিনিউজ২৪ডটকম, ১৮ এপ্রিল ২০২০) ।
সেই ভয়াল ১৯৭৪ এ রিলিফের কম্বল দিয়ে অনেক নেতারাই মুজিব কোট বানিয়েছেন। তাই সাধারন জনগণ বলত ” কম্বল কেটে মুজিব কোট, আর দিবনা নৌকায় ভোট। ” এখন অবশ্য এটা বলার সুযোগ নেই। কারন বর্তমানে কে ভোট দিলো আর না দিলো তাতে কি আসে যায়! ভোট তো আগেই ব্যালটে কেটে নেয় আওয়ামীরা। ৭৪ এ জনগনের ক্ষুধা এত চরমে গিয়েছলো যে কবি রফিক আজাদ কবিতায় লিখেছিলেন “ভাত দে হারামজাদা নইলে মানচিত্র খাব।” যাহোক আজ সেই ৫০ পরে কি অবস্থা! এখনো কি কবিতা লেখা হয়না? নাকি এখন জনগনের অভাব নেই! আসলে সেটা লেখার সাহস অনেকেরই নেই। কয়েকমাস আগে প্রথম আলো পত্রিকায় একটি ছবি দিয়ে একটি কিশোরের বক্তব্য কোট করা হয়েছিল “আমাদের চাল, ডালের স্বাধীনতা লাগবে। ” সামান্য এই একটি কথা সহ্য করতে পারেনি ক্ষমতাশীন দল। তারা সেই সাংবাদিক এবং পত্রিকার সম্পাদক এর উপর কি জুলুম করেছে সেটা সবাই দেখেছেন। এমন পরিস্থিতিতে অভাব, দ্রব্য মুল্য নিয়ে কবিতা কিংবা চিত্র আকে কার এমন সাহস!
জনগনের অবস্থা যখন এরকম তখন একের পর একটি মেঘা প্রকল্প করে বিদেশী লোনের বোঝা বাড়াচ্ছে সরকার। মেঘা প্রকল্প করে মেঘা দুর্নীতি চলছে। বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ কমে যাচ্ছে। আমদানি ব্যহত। তদুপরি আমদানি ও রপ্তানির অন্তরালে বিদেশে অর্থ পাচার করছে সরকারি দলের সমর্থক অলিগাররা। তবুও একের পর এক গোয়েবলীয় উন্নয়নের গল্প জনপ্রিয়তা অর্জনের নোংরা খেলায় মেতেছে আওয়ামী লীগ! একই সাথে শেখ মুজিবকে আবার হিরো বানানোর চেস্টা করছে আওয়ামী লীগ। একের পর একের বই বাজারে আসছে শেখ মুজিবকে নিয়ে। মুজিবকে দেখানো হচ্ছে মহানায়ক হিসেবে। কিন্তু অন্যান্যদের ভুমিকা নিয়ে কোন আলোচনা তো নেই বরং কাউকে কাউকে রাজাকার বা স্বাধীনতা বিরোধী পাকি দালাল বানানোর গোয়েবলস চলছেই। এই দীর্ঘ ৫০ বছর পরে শেখ মুজিবকে সিনেমা বানিয়ে জনগণের কাছে করুনা আদায় করার চেষ্টা করছে আওয়ামী লীগ। কারন জনগণকে দিয়েছে শুধু উন্নয়নের মিথ্যা বয়ান। তাই নির্বাচনকে সামনে রেখে করুনা ভিক্ষা ছাড়া আর কি বা চাইতে পারে এই দল। শেখ মুজিব একটি জাতির রুপকার এই ছবি দেখে দর্শকদের কান্নাজড়িত ভিডিও যতই শেয়ায় হচ্ছে ততই সামাজিক মাধ্যমে এই পোস্টগুলোতে হা হা রিয়াকশন ও ট্রল কমেন্টস বাড়ছে। আওয়ামী লীগের জনপ্রিয়তা যে সেই ৭৪ এর অবস্থায় চলে গেছে তাতে কোন সন্দেহ নেই। এর কারন কি? জনগণের উপর নেমে এসেছে নীরব দুর্ভিক্ষ! দ্রব্যমুল্যের ভাড়ে অতিষ্ঠ জনগন।
বর্তমান এসময়ে আমরা দেখি ভারতের বন্দনা গাইতে ব্যস্ত আওয়ামী সমর্থক বুদ্ধিজীবীরা। পরবর্তীতে আবারও ক্ষমতায় আসার জন্য উনারা ভারত নির্ভরশীল। পররাষ্ট্র মন্ত্রী মোমেন সাহেবের একটি বক্তব্য রীতিমতো ভাইরাল হয়েছিল। তার মতে তিনি ভারতকে শেখ হাসিনার ক্ষমতা টিকিয়ে রাখতে বলেছেন। আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক কোন এক বক্তব্যে বলেছেন আমেরিকার জন্য দিল্লি প্রয়োজন, দিল্লি আছে আমরা আছি। এমনকি স্বয়ং প্রধানমন্ত্রীও বলেছেন যে ভারতকে উনি যা দিয়েছেন ভারত তা চিরদিন মনে রাখবে। এই সব কথা বার্তায় এটাই স্পষ্ট হয়য়ে ভারতের প্রতি নতজানুতা বর্তমান সরকারি দলের আরও বেশি। এই নতজানুতা এতো প্রবল যে দেশের মানুষ ইলিশ কিনতে না পারলেও সেই ইলিশ কম দামে কলকাতার বাজারে বিক্রি হচ্ছে পুজার সময়। অথচ সেই ভারতের কাছ গংগা তথা পদ্মার এক ঘটি পানিও নিতে পারেনা বাংলাদেশ। আর সেই পদ্মার ইলিশ খাবার শখ হয় সেই ভারতীয়দের। বাংলাদেশ সরকার বা আওয়ামী সরকার দিন দিন বন্ধুত্বের দোহাই দিয়ে ভারতকে তুষ্ট করেই চলেছে।
এরই মধ্যে বাংলাদেশের অর্থনৈতিক অবস্থা এত খারাপের দিকে গেছে যে বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর বলেছেন যে তিনি তার চাকুরী জীবনের ৩৬ বছরে এমন ভয়াবহ অবস্থা দেখেননি (সূত্রঃ অর্থ সূচক:
৩৬ বছরের চাকরী জীবনে এমন অর্থনৈতিক সঙ্কট দেখিনিঃ গভর্নর, ০৭ নভেম্বর ২০২৩; বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর কেন বলছেন, অর্থনীতি তলানিতে, গোলাম মওলা, বাংলা ট্রিবিউন, ০৯ নভেম্বর ২০২৩)! প্রচন্ড নিয়ন্ত্রণ থাকা স্বত্ত্বেও বাংলাদেশের সংবাদপত্রে মাঝে মাঝে কিছু খবর আসে যা খুবই ভয়াবহ দুর্ভিক্ষের বার্তা দেয়। দীর্ঘদিন ধরে সংবাদ মাধ্যমে আসা খবর বিশ্লেষণ করে দেখা যায় বাংলাদেশের দুর্নীতি বেড়েই চলছে (সূত্রঃ দুর্নীতি আরও বেড়েছে, সমকাল, ৩১ জানুয়ারি ২০২৩), ব্যাংক গুলো চরম অর্থ সংকট নিয়ে চলছে (সূত্রঃ ব্যাংকে টাকায় টান পড়েছে, বেড়ে গেছে সুদহার, সানাউল্লাহ সাকিব, প্রথম আলো, ১৯ নভেম্বর ২০২৩) । সেই সাথে রয়েছে ঋন খেলাপি, ঋন কেলেংকারী,নামে বেনামে কোম্পানির নামে ঋন ইত্যাদি (সূত্রঃ সমকাল,ঋণের নামে ব্যাংক লুণ্ঠনের ‘মেগা সিরিয়াল’ ০৩ ডিসেম্বর ২০২২; প্রথম আলো, আলোচিত যত ব্যাংকঋণ কেলেঙ্কারি, নিজস্ব প্রতিবেদক, ২৪ নভেম্বর ২০২২; প্রথম আলো, ইসলামী ব্যাংকে ‘ভয়ংকর নভেম্বর’ সানাউল্লাহ সাকিব, ২৪ নভেম্বর ২০২২)। এছাড়াও আমদানি ও রপ্তানির অন্তরালে সীমাহীন অর্থ পাচার করা হয়েছে বিগত কয়েক বছর গুলোয় (সূত্রঃ বণিক বার্তা, ব্যবসার আড়ালে অর্থ পাচার প্রেক্ষাপট বাংলাদেশ, নিজাম আশ শামস, জানুয়ারি ১৬, ২০২৩; প্রথম আলো, কেন এই লাগামহীন অর্থপাচার, মামুন রশীদ, ১৭ অক্টোবর ২০২৩)। এমনকি মহামারীর সময়েই থেমে থাকেনি এই অর্থ পাচার। সব কিছু মিলিয়ে বৈদেশিক মুদ্রায় রিজার্ভ তলানিতে। যদিও সরকার থেকে বলা হচ্ছে রিজার্ভ পর্যাপ্ত। কিন্তু বাস্তবতা ভিন্ন (সূত্রঃ প্রবাসী আয় বাড়লেও কমছে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ, নিজস্ব প্রতিবেদক, প্রথম আলো, ১৭ নভেম্বর ২০২৩) । রিজার্ভ সংকটের কারনে আমদানি ব্যহত (সূত্রঃ খরচ সামলাতে নিত্যপণ্য কেনায় কাটছাঁট, কমেছে আমদানি, মাসুদ মিলাদ, প্রথম আলো,২৫ নভেম্বর ২০২৩), এল সি খুলতে পারছেনা অনেক ব্যবসায়ীরা (সূত্রঃ ইত্তেফাক, আহমেদ তোফায়েল, ১৮ অক্টোবর ২০২৩,এলসি খুলতে জটিলতা কাটছে না, বাড়ছে ব্যবসার খরচ)। বর্তমানে ব্যবহার যোগ্য রিজার্ভের পরিমাণ ১৫.৯ বিলিয়ন ডলার (সূত্র: প্রথম আলো,ব্যবহারযোগ্য রিজার্ভ কমে ১৬ বিলিয়ন ডলারের নিচে, ২৮ নভেম্বর ২০২৩), এর মধ্যে আছে ১০০ বিলিয়ন ডলারের বিদেশি ঋন (সূত্রঃ বনিক বার্তা, ১০০ বিলিয়ন ডলারে পৌঁছল বাংলাদেশের বিদেশী ঋণ, ২২ নভেম্বর ২০২৩)।
একের পর এক মেঘা প্রকল্প যেমন মেট্রোরেল, কর্নফুলী টানেল, পদ্মা সেতু, রুপপুর পারমানবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র ইত্যাদি হাতে বিদেশ থেকে নেয়া ঋণের বোঝা বাড়িয়েছে বর্তমান সরকার । বাংলাদেশের ২০টি মেগা প্রকল্পের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো- রূপপুর পারমানবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র, ঢাকা ম্যাস র্যাপিড ট্রানজিট ডেভেলপমেন্ট প্রজেক্ট লাইন-১, মাতারবাড়ি ১২০০ মেগাওয়াট কয়লা বিদ্যুৎ প্রজেক্ট, ঢাকা ম্যাস র্যাপিড ট্রানজিট ডেভেলপমেন্ট প্রজেক্ট লাইন-৫, লাইন-৬, পদ্মা ব্রিজ রেল সংযোগ, ফোর্থ প্রাইমারি অ্যাডুকেশন ডেভেলপমেন্ট প্রোগ্রাম, এক্সপানশন হযরত শাহজালাল ইন্টারন্যাশনাল এয়ারপোর্ট প্রকল্প, ঢাকা-আশুলিয়া অ্যালিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে, ডিপিডিসির পাওয়ার সিস্টেম শক্তিশালীকরণ প্রকল্প, যমুনা নদীতে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব রেলওয়ে ব্রিজ প্রকল্প, কর্ণফুলী টানেল প্রকল্প, সেফ ওয়াটার সাপ্লাই প্রকল্প ও কভিড ইমারজেন্সি রেসপন্স ও প্যান্ডামিক প্রিপারেডেন্স প্রকল্প ইত্যাদি। গত এক দশকে সরকারি বিভিন্ন মেগা প্রকল্পের পাশাপাশি বিদ্যুৎ খাতেও বিপুল পরিমাণ বিদেশী ঋণ এসেছে। রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র নির্মাণ প্রকল্পে সর্বোচ্চ ঋন এসেছে । এসব প্রকল্পের মোট ব্যয় প্রায় ৭১ বিলিয়ন ডলারের ৬১% ভাগ বিদেশী ঋণের (বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম, ২১ জুলাই ২০২২ঃ ২০ মেগা প্রকল্পের ঋণ শোধের বড় ধাক্কা আসছে: দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য )। বনিক বার্তায় ২০২২ সালের ১৮ অক্টোবর তারিখে “২০২৩ সালে বিদেশী ঋণ দাঁড়াবে ১১৫ বিলিয়ন ডলারে” শিরোনামে প্রকাশিত প্রতিবেদন অনুসারে ২০২৪ সালর শেষে বিদেশী ঋণের পরিমাণ হবে ১৩০ বিলিয়ন ডলার। একইসাথে ২০২৪ সাল থেকে ঋণের কিস্তি পরিশোধ শুরু হবে অনেক মেগা প্রকল্পের। ফলে বিদেশী ঋণ পরিশোধের পরিমাণ বাড়বে এবং আরো বেশি পরিমাণে ডলারের প্রয়োজন হবে। এভাবে বিদেশী ঋণ বাড়ার সাথে সাথে এর সুদ ও আসলের কিস্তি পরিশোধের পরিমাণও বাড়ছে। সে অনুযায়ী ২০২৩-২০২৪ অর্থবছরে ৪ বিলিয়ন ডলার, আর ২০২৪-২৫ অর্থবছরে ৫ বিলিয়ন ডলার ছাড়িয়ে যেতে পারে বলে বিশেষজ্ঞদের মতামত (যায়যায়দিন, ২৩ অক্টোবর ২০২২ঃ ভারী হচ্ছে বিদেশি ঋণের বোঝা)। এমনিতেই ডলারের তীব্র সংকট চলছে দেশে । এছাড়াও রেমিট্যান্স, রফতানি আয়সহ দেশে ডলার সংস্থানের উৎসগুলো সংকুচিত হয়ে এসেছে। অন্যদিকে দেশের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভের ক্ষয়ও ক্রমাগত বাড়ছে। এমতাবস্থায় যখন বেশিরভাগ এর কিস্তি পরিশোধ শুরু হবে ২০২৪ সালে তখন এক ভয়াবহ বিপদে পরবে বাংলাদেশ। কারন ইতিমধ্যে ব্যালেন্স অব পেমেন্ট এর বিশাল ঘাটতি নিয়ে আগাচ্ছে বাংলাদেশ। এ অর্থবছর (২০২২-২০২৩) শুরু হয়েছে ১৮.৭ বিলিয়ন ডলার পেমেন্ট অব ব্যালেন্সের বিশাল ঘাটতি নিয়ে (নয়া দিগন্ত, ১৩ নভেম্বর ২০২২ঃ বাংলাদেশের ২৬ বিলিয়ন ডলারের রিজার্ভ অর্থনীতির জন্য কী বার্তা দিচ্ছে? ) ।অর্থনীতিবিদদের মতে এ অর্থ বছর ২০২২-২৩ শেষে ব্যালেন্স অফ পেমেন্ট এর ঘাটতি দাঁড়াবে প্রায় ২০ বিলিয়ন ডলার (নিউজ বাংলা২৪.কম, ৪ জুলাই ২০২২ঃ লেনদেন ভারসাম্যে রেকর্ড ঘাটতির মুখে দেশ )। অর্থাৎ ২০২২-২৩ অর্থবছর শেষে প্রায় ২০ বিলিয়ন ডলারের ঘাটতি নিয়েই নতুন অর্থবছর ২০২৩-২৪ এ প্রায় ৪ বিলিয়ন ডলারের বিদেশী ঋণের কিস্তি পরিশোধ করতে হবে। যদি আর কোন লোন না নেয় তবুও এই বিদেশি লোন পরিশোধ করতে সময় লাগবে ২০৬২ সাল পর্যন্ত (সূত্রঃবর্তমান ঋণ শোধ করতেই বাংলাদেশের সময় লাগবে ২০৬২ সাল পর্যন্ত,নয়া দিগন্ত অনলাইন ০৬ আগস্ট ২০২৩)। এতকিছুর পরেও সরকারি দল সমর্থিতরা বলে অর্থনীতি চাঙ্গা হয়ে উঠছে (বাংলা ট্রিবিউন, ০৩ জানুয়ারি ২০২৩ঃ চাঙ্গা হয়ে উঠছে দেশের অর্থনীতি)। যদিও ধার-কর্জ করেই চাঙ্গা রাখা হচ্ছে অর্থনীতি (ডেইলি স্টার ১৪, ২০২১ঃ ঋণ নিয়ে চাঙ্গা রাখা হচ্ছে অর্থনীতি)। যদিও অর্থনীতিবিদদের মতে এত এত ঋণের বোঝা বড় করলে বাংলাদেশ সংকটে পড়বে ।
এমন উদ্ভূত পরিস্থিতিতে, চাহিদা থাকা স্বত্ত্বেও আমদানি কমিয়ে দেয়া হয়েছে। তাই দেশে বাজারের চাহিদা অনুযায়ী যোগান না থাকায় ভেজিটেবল অয়েল থেকে শুরু করে ডিম, আলু পিয়াজ সবকিছুর দাম উর্ধগতির। যদিও সরকার থেকে বলা হয় এগুলো সিন্ডিকেটের কারসাজি, কিন্তু আজ পর্যন্ত কোন সিন্ডিকেট ভাংগার পদক্ষেপ নিতে দেখা যায় নি। এর মধ্যে ভারত থেকে ডিম আমদানি করে ডিমের মুল্য নিয়ন্ত্রণের চেস্টা চলে। ভারতীয় ডিম আসার একদিনের মধ্যেই ডিমের দাম সামান্য একটু কমে গেলে সরকারি দলের মুখ পাত্র হয়ে কাজ করা মিডিয়া গুলো এটাকে সিন্ডিকেট ভাংগার একটি সফলতা হিসেবে দেখাতে চেয়েছে (সূত্রঃ আমদানির সিদ্ধান্তে কমেছে ডিমের দাম: বাণিজ্যমন্ত্রী
ইত্তেফাক অনলাইন ডেস্ক, ২৫ নভেম্বর ২০২৩)। অর্থাৎ ডিমের যোগান বাড়িয়ে সিন্ডিকেটদের দৌড়াত্ব নিয়ন্ত্রণ করা গেছে বলে প্রচার চালাচ্ছে মিডিয়া গুলো। কিন্তু ব্যাখ্যা অন্যও হতে পারে। ভারত থেকে ডিম আমদানি করতে বাধ্য করতে সিন্ডিকেট কৃত্রিম সংকট তৈরী করতে পারে। এ ধারণা করা অমূলক নয়। ১৯৭৪ সালে খাদ্যের অভাব যেটুকু ছিলো তার চেয়ে বেশি ছিলো কৃত্রিম সংকট। অবৈধ মজুদদাররা খাদ্য সামগ্রী মজুদ করে বাজারে কৃত্রিম সংকট তৈরী করেছিলো। অধিক দাম দিয়ে খাদ্য ঠিকই কেনা যেত তখন। এখনো কি এরকম অবস্থা বিরাজমান? অসম্ভব কিছু না। বাংলাদেশে যে আলু খুব সস্তায় বিক্রি হতো, বিক্রি না করতে না পেরে যে আলু পচে যেত সেই আলুও এখন আমদানি করতে হয় ভারত থেকে (সুত্রঃ ইত্তেফাক, ভারত থেকে প্রথমবারের মতো আলু আমদানি শুরু, ০২ নভেম্বর ২০২৩)। যে বাংলাদেশের রয়েছে বিশাল এক সমুদ্র সেই বাংলাদেশ শেষ পর্যন্ত লবণটাও আমদানি করবে ভারত থেকে (সূত্রঃ এবার লবণ আমদানির অনুমতি, ইত্তেফাক অনলাইন ডেস্ক, ০৭ নভেম্বর ২০২৩) ! এটাও কি সিন্ডিকেটের কারসাজি নাকি আসলেই অভাব। রিজার্ভের এই পতনের মাঝে যদি লবন আমদানি করতে হয় তবে অর্থনীতি টিকে থাকবে কিসের উপর ভিত্তি করে! যে সরকার বিরোধী মত দমনে এত কঠোর পদক্ষেপ নিচ্ছে সেই সরকার সিন্ডিকেট ভাংগতে অপারগ! এটা অবিশ্বাস্য। আসলে ঐসব ব্যবসায়ী সিন্ডিকেট আর কেউ নয়, সরকারি দলের সমর্থক বা ছত্র ছায়ার থাকা কিছু অলিগার। দেশের এমন পরিস্থিতিতে তাই প্রশ্ন বাংলাদেশ কি আরেকটি দুর্ভিক্ষের সন্নিকটে? বাংগালী কি দুর্ভিক্ষের ৫০ বছর পুর্তি করতে যাচ্ছে!
বিশেষ দ্রস্টব্যঃ
সন্মানিত পাঠক এই লেখায় আমার নিজস্ব কোন মতামত নেই। লেখার সম্পুর্ন অংশ বিভিন্ন প্রকাশিত বইয়ের থেকে নেয়া এবং বাংলাদেশের সংবাদপত্রের থেকে নেয়া। পাঠকগন ইচ্ছে করলে সংবাদের শিরোনাম কপি করে গুগল থেকে দেখে নিতে পারেন। বিশেষকরে এন্থনি মাস্কারেনহাস এর “বাংলাদেশ: রক্তের ঋণ” এবং হাসনাত করিম এর লেখা “বিদেশী সাংবাদিকের দৃষ্টিতে শেখ মুজিবের বাংলাদেশ” বই দুটি পড়তে পারেন।
বই দুটির ফ্রি পিডিএফ লিঙ্ক দেয়া হলোঃ
বিদেশী সাংবাদিকের দৃষ্টিতে শেখ মুজিবের বাংলাদেশ <https://www.pathagar.org/index.php?/book/detail/2792>
বাংলাদেশ: রক্তের ঋণ < https://xeroxtree.com/pdf/bangladesh_rokter_rin.pdf >
Leave a Comment
Your email address will not be published. Required fields are marked with *