728 x 90

কাকতাড়ুয়া প্যালারাম: রাণা চ্যাটার্জী

  “পারবো না আর বাজার আনতে, যা জুটবে সেটাই ভাইকে রান্না করে খাওয়াবে” রেগে বলল প্যালারাম। যদিও আদুরী, স্বামীকে প্যাংলা ডাকতেই অভ্যস্ত, নয় নয় করে নয় বছরের প্রেম শেষে বিয়ে বলে কথা, তাই কি এতদিনের অভ্যাস ছেড়ে ওগো হ্যাঁ গো ডাকা যায়! তাছাড়া এমন আদরের ডাক ছাড়া নয়তো বলবে কি! ওই তো ছিরি, দু খানা

 

“পারবো না আর বাজার আনতে, যা জুটবে সেটাই ভাইকে রান্না করে খাওয়াবে” রেগে বলল প্যালারাম। যদিও আদুরী, স্বামীকে প্যাংলা ডাকতেই অভ্যস্ত, নয় নয় করে নয় বছরের প্রেম শেষে বিয়ে বলে কথা, তাই কি এতদিনের অভ্যাস ছেড়ে ওগো হ্যাঁ গো ডাকা যায়! তাছাড়া এমন আদরের ডাক ছাড়া নয়তো বলবে কি! ওই তো ছিরি, দু খানা হাড় সর্বস্ব প্যাংলা শরীর, এক তাল মাংস পর্যন্ত কোথাও নেই!

বিয়ের পাকা কথা বলার সময় হবু জামাইয়ের চেহারা নিয়ে ঘোর আপত্তি ছিল বাবার। মেয়ের ডাগর শরীরের পাশে জামাইকে যদি পাট কঞ্চির মতো লাগে তবে তো চোখ কপালে ওঠা স্বাভাবিক। কি করে লোকজনকে জামাইয়ের পরিচয় দেবে! মা খান্তা দেবী অবশ্য ছেড়ে দেবার নন, মেয়ের মুখ চেয়ে একহাত নিয়েছিলেন স্বামীকে! “বলি হ্যাঁ গা, আদুরীর বাপ, বিয়ের সময় পাহাড় প্রমাণ হুমদো তুমি তো তখন পুঁচকে আমিটাকে পটাতে দুবেলা ঘুর ঘুর করতে তার বেলা, আর এখন কিনা ব্যাঘাত দিচ্ছ? বলি আমার হবু জামাইয়ের মুখশ্রী কোন অংশে কম শুনি!

যাই হোক বেশ ধুমধাম করেই চার হাতের মিলন হয়ে গেলো প্যলা ওরফে সুদর্শন ও আদুরীর। প্যালারামের শরীরের জুত না থাকলে কি হবে নামের মধ্যে বেশ জৌলুশ ছিল। সত্যিই সুদর্শন  নাম ব্যঙ্গ করতো প্যালার শরীর! তাই অকালেই  সুন্দর নাম হারিয়ে “প্যালা” তেই  আটকে যায়, এ যেন চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত। অবশ্য শুধু প্যালা নয়,  আদুরীরও আসল নাম ঊর্মিলা, যা প্যালার আদরে সে হয়ে ওঠেছে আদুরী।

আদুরী যেমন ফুলে ফেঁপে ক্রমশ ফুটবল হয়েছে প্যালার কোনো শারীরিক পরিবর্তন নেই। হাড়ের ওপর চামড়া লাগিয়ে যেন ভগবান প্যালাকে ছেড়ে দিয়েছে। এ যেন ম্যানুফ্যাকচারিং ডিফেক্ট! সৃষ্টিকর্তা বড্ড তাড়াহুড়োয়  শৈল্পিক হাতে ফিনিশিং টাচ দিতে  ভুলে গেছে শ্রীমান প্যালার! আদুরীর ভাই অবশ্য বলে ছিল ওরে  দিদি, এ যে জাম্বু তো এক্কেবারে কাক তাড়ুয়া! আড়ালে বললেও শ্যালক ও এক পাল শ্যালিকারা যে তাকে নিয়ে বেশ মজা পায় তা অল্প হলেও বোঝে জামাই বাবাজীবন প্যালা।

“বাজার আনতে পারবে না মানে, এমন কথা কেন  শুনি? দশ টাকা সাইজের রসগোল্লার মতো চোখ পাকিয়ে ঝাঁজ নিয়ে বলল আদুরী। দিদির বাড়ি আসছে কিনা সাধের ভাই। আহারে আমার সোনামানিক ভাই, ছটা বোনের পর হয়েছে। দশ টা নয় পাঁচটা নয় সাধের একটা মাত্র ভাই আমার, বাড়িতে  কত আদর ওর জানো”?

“হম, হম আদরে বাঁদর করে ছেড়েছো ভাইকে আর এখন আমার পেছনে বাঁশ দিতে ঘটা করে কিনা অতিথি আপ্যায়ন..” ভেংচি কেটে থামলো প্যালা! কি বললে অতিথি!! আমার ভাই এবাড়ির ঘরের ছেলে বলে কথা, তাকে এমন বেইজ্জত! কোমরে আঁচল গুঁজে দশাসই গিন্নি এগিয়ে আসতেই না জানি বিপদ বাড়বে ভেবে কাছ থেকে সরে দাঁড়ালো। মোক্ষম চড় বা ঘুঁষি যদি হাত ফস্কে নিয়ন্ত্রণ ভেঙে একটা ধেয়ে আসে বিছানায় সাতদিন গোঙাতে হবে তাকে, এ দৃশ্য মনে ভাসতেই মুখ বেঁকিয়ে কটা চটা থলে ঝুলিয়ে বাজার চললো প্যালা থুড়ি সাধের জাম্বো। বারান্দা থেকে  ঝুঁকে আদুরী আবদারে “অ্যাই শোনো, ওপরে তাকাও একবার”, এরপর গালে পান ঠেসে হাসি মুখে বলল, “কই গো বলছি কি, গলদা চিংড়ি, ইলিশ আর ওই স্পেশাল দই এক কেজি এনো কেমন ফেরার পথে”।

মাঝে মাঝে বর টাকে আদুরীর  বর্বর মনে হয়,আর লাগবে নাই বা কেন যেটা সে বলবে উনি ঠিক তাল কেটে  উল্টো পথে হাঁটবে! কত্তা বাজার যেতেই মনটা ফুরফুরে হলো আদুরীর।ঘরের চাদর পাল্ট কুইন্টাল খানেক ময়লা বসা পর্দা গুলো টেনে নামালো।ভাবলো যাক আজ বর যা বলবো শুনবে মনে হচ্ছে ,চরম ঝাড় খেয়েছে! মেয়ে ইন্নিকে বাজখাঁই গলায় হাঁক পেরে বললো বাপের মতো অমন হলে ঘাড় ধরে বের করবো।মামা আসবে ঘর গুলো একটু গুছাবে তা নয় ধিঙ্গি মেয়ে দিন রাত কানে গুঁজে ইউটু প্রাঙ্ক দেখছে! “আমি আবার কি করলাম তোমার,খামোকা বকছো “কাঁচুমাচু ইন্নি চৌকাঠে দাঁড়ালো।

বউয়ের সামনে কিছু বলতে না পারলেও ভেতরে ফুঁসছে প্যালা। এই তো সেদিন ভাইফোঁটায় এলো শ্যালক,বছর বছর একই পুনরাবৃত্তি! গন্ডে পিন্ডে গিলে জামাইবাবুর পকেট খালি করে দিন চার পাঁচ কাটিয়ে যখন গেলো যেন সমুদ্রে তৈরি গভীর নিম্নচাপ কাটলো! অথচ এখন কি রাজকার্যে ভাই আসছে এ প্রশ্ন গিন্নিকে যে করবে সে বুকের পাটা নেই প্যালার, সেটাও সে বিলক্ষণ জানে! যা হয় হোক বাড়িতে কুরুক্ষেত্র  বা তালিবান যুদ্ধ , কিছুই আনবো না বলে আড়াইশো চারা পোনা, কচু, লাউ শাক এইসব হাবিজাবি কিনে ব্যাগ ভরে ফিরলো!

বাথরুমে প্যালা হাত- পা ধুতে যেতেই বাজার দেখে তো আদুরীর চক্ষু ছানাবড়া। মাথায় ধিক ধিক করে আগুন জ্বলছে , কিন্তু না ওর মতো বেয়াদপ লোককে চিৎকারে মোটেও শায়েস্তা করা যাবে না। দিতে হবে মোক্ষম দাওয়াই ভেবে কোনো কথা না বলে চুপচাপ বেডরুমে খিল তুলে দিলো। আদুরী আজ কত সখ করে বসে ছিল ভাইয়ের জন্য দুপুরেই দুটো পদ বানিয়ে রাখবে! সন্ধ্যায় ইউটিউব দেখে শেখা স্পেশাল টিফিন এর আয়োজন চলছিলো সব দিলো পণ্ড করে মর্কটটা,কিন্তু রাগ তো প্রকাশ করা তার ওপরই সাজে যে গুরুত্ব দেয়! দুঃখ হলেও মনে মনে পরিকল্পনা সাজিয়ে নিলো আদুরী,আজ দাঁড়াও হচ্ছে তোমার প্যালা।ব্যাটাকে না খেতে দিয়ে মারবো।

“কই গো রাঁধবে না,বেলা যে প্রায় যায় গো, ও আমার আদুরী” সুর নরম করে হেঁকে চলেছে কত্তা। ভেতরে ভেতরে বেশ বুঝছে প্যালা, এই রে বেশ তো হলো  দুপুরে কি খাওয়া জুটবে না,তবে তো কপালে বেশ দুঃখ আছে! ওদিকে বিকাল হলেই নাকি শালা বাবু হাজির হবেন আর ওর সামনে হাসিখুশি সুখী দম্পত্তির অভিনয়  করতে হবে ভেবেই মুখটা বাংলা পাঁচের মতো বেঁকে গেলো প্যালার। গিন্নির মুখ ঝামটা,অপমান যা কিছু সব হজম করতে পারলেও কিছুতেই খিদেটা সহ্য হয় না প্যালার কিন্তু উপায়ই আর কি তার!!

সব বুঝেও কিছুতেই সাড়া দিলো না আদুরী, দরজা তেমনই বন্ধ।আজ একটা এসপার ওসপার শিক্ষা দিতেই হবে । যেমন হাড় জিরজিরে সোয়ামি তেমন হাড়কেপ্পন লোক, নে এবার ঠ্যালা সামলা বলে  বন্ধ ঘরে আগে থেকে মজুত রাখা চিড়ে,কলা, গুঁড়ো দুধ মেখে পেট পূজা সারলো আদুরী। মনে মনে ভাবলো যেমন উল্টোপাল্টা জিনিস নিয়ে  ফিরেছো আমায় জব্দ করতে এবার বোঝো  কত ধানে কত চাল। বেকার চিৎকার ঝগড়া না করে এভাবেই শায়েস্তা করার রাস্তা বুদ্ধিমতীর মতো বেছেছে আদুরী।

খিদেতে পেট চুঁই চুঁই  করছে প্যালার। মশার কামড়ে  অতিষ্ঠ দুপুর জুড়ে! কেবল জল খেয়ে খালি পেটে কি ঘুম সম্ভব! একবার ভাবছে রান্না ঘরে যে কিছু বানিয়ে নেবে কিন্তু সামান্য গ্যাস পর্যন্ত জ্বালতে জানে না! পরক্ষনেই মায়া হচ্ছে আহারে আদুরীটা না খেয়ে পড়ে আছে অথচ  এখন প্যালা কি করবে ভেবে না পেয়ে মেঝেতে ধপাস করে বসলো। নিজেকে এবার বড্ড অসহায় লাগছে! আদুরী আগেভাগেই ছক কষে ইন্নিকে পাশের পাড়ায় সইয়ের বাড়ি পাঠিয়ে দিয়েছে। পরের দুজন বিন্নি, তিন্নি তো আগেই মামারবাড়িতে। ছোট বেলার সই আদুরীর,কত বার যেতে বলেছিল,সেই  মোক্ষম সুযোগ আজ নিলো। নইলে মেয়েকে পটিয়ে গ্যাস জ্বেলে আতপ চালের ভাত, আলু সেদ্ধ, ঘি পেটে চালান দেবে প্যালা, ওটি হতে দেবে না আদুরী। প্যালা বেশ সমস্যায় পড়লো, গিন্নি ওভাবে দরজা বন্ধ করে, মেয়েটারও দেখা নেই। মোবাইল রিং করেও সুইচ অফ দেখে বড্ড আপসেট। উফ বাবারে বাবা যেন ঘর নয় এটা, কেউ ক্যাকটাসের বিছানা পেতে দিয়েছে প্যালারামের জন্য!  মুখ গোমড়া করে খানিক জল আর বাতাসা খেলো। ব্রেন খিদেতে কাজ করছে না! “ও বউ খোলো দরজা, প্রমিস করছি, বাজার আনবো বিকালেই। এইবার মাফ করো আমায়। কই গো, সাড়ে তিনটা যে বাজলো, সেই টিফিনে সামান্য শসা মুড়ি! তোমারও যে শরীর খারাপ হবে”!

তৃপ্তি করে খেয়ে ঘুমটা এসেছিল আদুরীর ,স্বপ্ন দেখছিল প্যালা এক খানা প্রিন্টেড লুঙ্গি কেটে ফতুয়া বানিয়ে নিজেকে ঘন ঘন আয়নায় দেখছে। ইস আদিখ্যেতা! একখানা হিরো লুক দিয়ে ঠোঁটের কোণে সে যে কি মুচকি হাসি! তবে প্যালা ওটা কি পড়েছে নিচে! খুব যেন চেনা লাগছে আদুরীর। কাছে গিয়ে যেই দেখছে তার হারিয়ে যাওয়া নতুন সায়াটাকে মহান প্যালারাম মাঝ বরাবর সেলাই করে পাজামা বানিয়েছে,দেখে তো আদুরীর মাথায় আগুন জ্বলে উঠলো! হতচ্ছাড়া, পাজি, ছুঁচো, দাঁড়াও দেখাচ্ছি মজা বলে ঘুমের ঘোরেই ধরফর করে উঠে দরজা খুলে কলতলায় রাখা এক বালতি জল প্যালার মাথায় ঢেলে দিলো! এই রে এ কি করলো সে, তার তো দরজা না খুলে তেজ দেখানোর পর্ব চলছিল! প্যালা তো সায়া নয়  রীতিমতো বারমুডা পড়ে ঝিমাচ্ছিল! তবে কি ওটা স্বপ্ন ছিল! ভেবে অপ্রস্তুত ও লজ্জায় পড়লো আদুরী।

খিদেতে কাতর, ক্লান্ত আমআঁটির মতো শুকনো মুখে ঘুম এসে যাওয়া প্যালারাম রীতিমতো জলের ধাক্কায়,” ঘাবড়ে বাবাগো মেরে ফেললো আমায়” বলে পাঁচিল টপকে দৌড়! বাইরে বেরিয়ে হকচকিয়ে ভাবছে বউ বুঝি আজ তাকে বালতি দিয়ে মাথা ফাটিয়েই দিতো! বড্ড অসহায় মুখে  ফ্যাঁচ ফ্যাঁচ করে কেঁদে ফেললো। পাশের বাড়ির রাঙাপিসি ইয়ার্কি ছলে প্রশ্ন ছুঁড়লো,” আহারে নাত বৌমা ভালোবাসায় বুঝি ভিজিয়ে দিলো প্যালা রামকে..”! ? বলেই ফিক করে  জর্দা পানে হাসি! রাগে মাথা জ্বলছে প্যালার! বউ না হয় মারুক কাটুক ক্ষতি নেই তাবলে কিনা পাড়ার লোকজন মজা কুড়াবে!

 

দূর ছাই জীবনটা আলু ভাতের মতো চটকে দিলো সব্বাই! কেন্নর মতো গুটি সুটি মেরে, বাড়ির উঠানে ঢুকলো প্যালা। না খেয়ে রীতিমতো ধুঁকছে সে। দেখেও আদুরী পাত্তা না দিয়ে পেছন করে বসে রইল। প্যালা হাত জোড় করে দরজা থেকে  বললো, “মারিস নি রে বউ, দয়া করে মারিস নে, আমি আজই বিকালে বাজার করে আনবো”। আদুরীর ঘুম তো একদম চলে গেছে, সে হাসবে না কাঁদবে কিছুই বুঝতে পারছে না। অথচ এমন সময় রাগ পুষে রাখতেই হবে  আদুরীকে, কারণ প্যালা অবাধ্য হয়ে গিন্নিকে শুধু না তার আদরের ভাইকেও তাচ্ছিল্য করেছে।এক আধবার যে প্যালার ওপর মায়া যে হচ্ছে না আদুরীর তা নয়, কিন্তু এখনই বেশি নরম হওয়া বুমেরাং হয়ে না যায় তাই গম্ভীর ভাব বজায় রেখে প্যালাকে এড়িয়ে গেলো।

রাগ পুষে আদুরী ঘুমিয়ে যেতে যেভাবে স্বপ্ন তার মস্তিকে  হানা দিয়েছিল মনে পড়তেই ফিক করে হেসে ফেললো আপন মনে। এমন এক

উদ্ভট ড্রেসে তাবলে প্যালাকে যে কোনোদিন দেখবে ভাবেনি! এরপর রান্না ঘরে ঢুকে স্বামীর জন্য একটু গরম সুজি বানালো, বিকেল তখন গড়িয়ে প্রায় সন্ধ্যা নামার মুখে। প্যালা কোনো কথা না বাড়িয়ে সুরুৎ করে খাচ্ছে, যেন তার কত্ত তাড়া বাজার যাওয়ার! খেয়ে বাজারের ব্যাগ নিতে যাচ্ছিল দেখে চড়া গলায় আদুরী আদেশের সুরে বলে উঠলো, “ব্যাগ রাখো অনেক উপকার করেছো তুমি, আর দরকার নেই”। বাহ্যিক শুকনো মুখ বজায় রেখে ভেতরে খুশির হাওয়া বয়ে

যাচ্ছিল প্যালার, এটা ভেবে যে গিন্নির বোধোদয় হয়েছে হয়তো! এরপরের শব্দ গুলো শুনে চুপসে গেলো রীতিমতো।

“ভাইকে তার পছন্দের যা যা খাবার খেতে চায় সেই মতো সব কিনে ঘর ঢুকতে বলেছি, যা বিল হবে তোমার  একাউন্ট থেকে অনলাইন ব্যাঙ্কিং করে আমি ওকে মিটিয়ে দেবো”

শুনে তো আত্মারাম খাচাঁছাড়া হওয়ার উপক্রম প্যালার! মনে মনে ভাবলো উফ কি জন্য যে অনলাইন ব্যাঙ্কিং নিজে না শিখে আদুরীকে শিখে নিতে বলেছিলাম! এমনিতেই  শাড়ির লাইভ দেখে অর্ডার দেওয়ার ধুম বেড়েছে মা- মেয়ের, আর আজ কিনা আরও এক কদম এগিয়ে বলছে ভাইকে পেমেন্ট করবে! তখুনি চেনা গলায় ভূমিকম্পের মতো গম গম  পুরুষ কণ্ঠের হাঁক, ” দিদি, ও জাম্বো দরজা খোলো.”.!

নির্ঘাৎ শ্যালক হাজির প্যালার অপ্রস্তুত সময়ে! … অগত্যা হাসি মুখে জাম্বো এক ছুটে শ্বশুরের সন্তানকে অভ্যর্থনা করতে দরজা খুলে চমকে উঠলো! একি শ্যালক তো একা নয়! তার পেছনে  মেয়েদের মতো এক মাথা ঘন লম্বা চুলে কানের দুলে সজ্জিত এক বন্ধুও দিদির বাড়ি হাওয়া বদল করাতে সটান হাজির।” আয় ভাই আয় বোস, আহারে মুখটা ক্লান্তিতে তো শুকিয়ে গেছে জার্নি করে, পলাশ কে সঙ্গে এনে খুব ভালো করেছিস রে ভাই, তুফান কেও আনতে হতো তবেই না তিন বন্ধু আমার ঘর আলো করে তুলতো”- বলে আদুরী ভীষন রকম গদ গদ। কিছুক্ষনের মধ্যে আদুরী আর প্যালারামের আদরের বড়ো কন্যা হাজির। মামাকে পেয়ে ঘরে একটা উচ্ছ্বাস শুরু হয়েছে। অন্যদিকে মনে মনে বউয়ের কথাগুলো ভ্যাঙাচ্ছিল প্যালারাম। আদুরী ঠিক বুঝতে পেরে “উহু চোরের মতো মুখ করে ঘুরবে না একদম সামনে” চাপা গলায় শাসন করে ভাইয়ের কিনে আনা খাবারের বিলটা প্যালার হাতে গুঁজে দিলো। সারাদিন শসা মুড়ি আর বিকালে পাতলা সুজি খাওয়া প্যালার হৃৎপিন্ডটা বত্রিশ শো টাকার খাওয়ার বিল দেখে আরও যেন চুপসে গেল!

“এই খবরদার বলছি,অন্যায় করে আবার অমন বাংলা পাঁচের মতো মুখ করে বিড়বিড় করবে না। দেখলে  আমার গা পিত্তি যেন জ্বলে যায়! ” প্যালারামের উদ্দেশ্যে কথাটা বলে আদুরী কড়াইয়ে চচ্চড়িটা নাড়তে লাগলো।

“সে তো জ্বালা ধরবেই, আমি যে ঘরে আছি! সারাদিন টুকুস করে রান্না, ঘরের কাজ  সেরে শুধু কানে ফোন গোঁজা! বলি এত ইয়েটা কিসের তোমার?” –

কথাটা বলেই ডোজ বেশি হয়ে গেছে বুঝে খানিক চুপ হতেই তেড়ে এলো গিন্নি।

“টুকুস করে রান্না! বলো কি গো?চোখে পোকা পড়বে পোকা। ঘেমে অস্থির হই পায়রার মতো ঘুপচি রান্নাঘরে তারওপর লকডাউনে কাজের মেয়েদের ছুটি। বোলচাল বন্ধ করে তাও যদি সংসারের  কাজে লাগতে একটু বুঝতাম বলা সাজে”!

আবার কত্তা প্যালারাম কামড় দেবার ছলেই বলল,

“সময় পেলেই মা,মা করে চোদ্দ বার ফোন! বাপের বাড়িতে আড়ি পাতা মোটেও ভালো নয় কতবার বলবো তোমায় আদুরী”!

“কি বললে, আড়ি পাতি আমি, আর তুমি আছো বলে কিনা জ্বলছি, তবে হ্যাঁ শুনে রাখো সত্যিই জ্বলছে  একদম গা-হাত, মন সব কিছু চিড়বিড় চিড়বিড় করে লঙ্কা বাটার মতো জ্বলন হচ্ছে আর শুনবে কিছু? ছি: ছি: ছি: ওগো তোমরা কি গো, সকাল থেকে টিফিন বানালাম, দুবার চা তারপরও কিনা নোংরা কথা, আড়ি পাতি! খসে পড়বে দেখো ও জিভ খসে পড়বে”।

“উফ আমি কি সে আড়ি পাতার কথা বলেছি তুমিও না গিন্নি খুব উল্টো বোঝো”।

“আড়ি’র আবার আলাদা কি মানে হয় শুনি তোমার ডিকশেনারিতে! ওগো আমি কি ফ্রক পড়া বাচ্চা মেয়ে ? তুমি হলে হাড় বজ্জাত লোক”।

প্যালা ততক্ষনে কল্পনায় অমন দশাসই চেহারার গিন্নিকে ফ্রকে ভেবেই ফিক করে হেসে গম্ভীর হলো। মুখে বললো,” উফ এতো ঘামছো, এসি চালাই,বসবে এসো”।আজ থাইরয়েডের ওষুধ খেয়েছো”?

“যত্তসব আদিখ্যেতা। খাটিয়ে দম বের দিলো আর বসে বসে এখন গুলতানি!

খানিক চুপ থেকে অতীতের সুখ স্মৃতিতে ডুব দিলো প্যালারাম।

” আদুরীর ভালো নাম হলো ঊর্মিলা যা প্যালার  ভালো নাম সুদর্শন এর মতোই অন্তরালে চলে গেছে। কলেজে পড়াকালীন হৃদয়ে ঝড় তোলা ঊর্মিলা মাতন্ডকরের সাথে আদুরীর নামের মিল পেয়ে প্রেমটা আরও মাখো মাখো ও দীর্ঘতর হয়েছিল ওদের।সেই প্রেমিকা ঊর্মিলা যে আজ অমন দশাসই পাহাড় হবে কে ভেবেছিল! তখন হিন্দি সিনেমার হট বেবি উর্মিলার  নাম শুনলেই প্যালার শরীরজুড়ে শিহরণ খেলতো! তাই কলেজে ভর্তি হয়েই সুন্দরী ছিপছিপে আজকের এই ভীমাকার সহধার্মিনীকে মন দিয়ে ফেলেছিল। এ হৃদয়দান যেন অনেকটা ভুল করে  কাশ্মীর দেবার মতো জিইয়ে রাখা সমস্যা। তবু এটাই টক ঝাল মিষ্টি জীবনের আল্পনায় মরুদ্যান। যে ঝগড়ার মাত্রা বৃদ্ধির সাথে রাগ-অভিমানের পারদ চড়ে ঘন্টা খানেক কথা বন্ধ হয় বটে কিন্তু তাতে কখনো ভালোবাসার লভ্যাংশ পায় দুজনেই।

মাঝে মধ্যেই চরম আকারে উভয়ের ঝগড়া, দিনের শেষে সুমিস্ট গন্ধ ছড়ায় সংসার জুড়ে-বুড়ো হাড়ে, এটা বুঝে আবার চর্বিত চর্বন। গৃহবন্দি আবহে এই যে দীর্ঘ দিন ঠায় ঘরে বসে থাকা কত্তা-গিন্নি যাদের  কোয়ালিটি টাইম শেয়ার করার ইচ্ছা থাকলেও উপায় হয় না এমন বহু বাড়ির অভ্যন্তরে হাতা খুন্তির এমন ফ্লাইং ডিস খেলা চলছে।

এমনিতেই এই কুড়ি বছরে ভালো রকম পেছন ফেটেছে কর্তার-বিয়ের পর পরই দু বছর ছাড়া ছাড়া তিন কন্যা ইন্নি, বিন্নি, তিন্নির জন্মলাভ  তারসঙ্গে এই দাপটে গিন্নি, আমফান ঝড়ের মতোই শক্তিসেল ফাটায় কথার বর্ষণে। ভাগ্যিস দীর্ঘ স্কুল বন্ধে, কন্যারা ছুটিতে মামার বাড়ি গেছে, নাহলে মাকে সমর্থন করে বানর সেনার মতো চারজনের যে ভাবে প্যালার বিরুদ্ধে বিদ্রোহ ঘোষণা, একমাত্র পুরুষ সদস্য প্যালা জলদি কাহিল হয়ে যায়!

ওই আবার রান্না ঘরে ঝাঁজ বর্ষণের ইঙ্গিতবাহী ঝন ঝন বাসন পড়ার শব্দ! এ যেন সিম্বলিক ইন্টারেকসন, চিৎকার চেঁচামেচিতে উত্তাপ বাড়লে হাত পায়ের বশ থাকে না ইদানিং তার সহধর্মিনীর। নরম গলায় হাঁক পারলো প্যালারাম।

-“কই গো প্রেসারটা চড়লো নাকি আবার, তবে চলো সন্ধ্যায় মাপিয়ে আনি”বলতেই অন্য প্রান্ত থেকে বোমা ফাটল।

“ন্যাকামো করো না একটু উঠে হাত পা ছাড়াও বরং, সন্ধ্যার টিফিন কিছু একটা বানিয়ে নিও। জ্বর আসায় ভীষণ ক্লান্ত লাগছে গো আমার প্যালা”।

অসুস্থ গলাতেও প্যালা আদুরীর আন্তরিক ডাকে অভিভূত। “এই রে দেখো আবার বড়সড়ো অঘটন ঘটিও না লক্ষীটি, এমনিতেই মারণ বীজানুর দাপটে ওষ্ঠাগত প্রাণ, কিছু হলে চিকিৎসা পর্যন্ত করানো চাপ”।

“…কিছু হলে বেঁচে যাও তাই না, ঢং করে মরা কান্না কেঁদে তো ঘাটের মড়া আবার লকলকে জিভে নতুন বউ ঘরে তুলবে”।

“ইস, বলি হচ্ছেটা কি, ভীমরতি হয়েছে নাকি, যা মুখে আসছে বলে যাচ্ছ”!! গলা চড়ালো স্বামী।

উহুঁ তোমাদের পুরুষ গুলোর সব এক রা, যত নিয়ম আমাদের মেয়েদের ওপর। আমি বাবা আলমারির যত যা নতুন কাপড় আছে সব ব্যবহার করে নেব দাঁড়াও, যাতে শখের শাড়ি গয়না কেউ গায়ে তুলবে সহ্য হবে না”!

প্যালার আর কিচ্ছু ভালো লাগছে না! এই কিনা তার সুখী দাম্পত্য জীবনের নমুনা! ওদিকে গিন্নি আবার সবজি বাজারের ব্যাগ ঘেঁটে দায়সারা গোছের ফালতু বাজারে তিন রকম শাক, কচুর লতি পেয়ে রীতিমতো খাপ্লা! চিৎকার করে বলছে, “এক এক সময় মনে হয় যেন গরম খুন্তির এক ঘা বসিয়ে দেই”!

কত্তা ঘাড় তুলে, “বলে ফেলো  বাকি আর কি কি রাগ আছে, থামলে কেন শ্বশুরের বেটি? কি কুক্ষনে যে বিয়ে করেছিলাম! এই কিনা আমাদের দীর্ঘ প্রেম পর্বের নমুনা না ছাই! জীবনটা আমের চাটনি আর এ সংসারকে পাগলা গারদ বানিয়ে ছাড়লো”, বলে ছাদে কেটে পড়লো প্যালারাম।

Read More

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked with *

সর্বশেষ পোস্ট

Advertising