728 x 90

ট্রেন্স থেকে ফিরে এসে: রউফ আরিফ

  পূর্ব প্রকাশের পর- রোজির আরেক দফা থমকাবার পালা। অঞ্জনা বৌদিকে এখনি কোনো প্রশ্ন করে বিরক্ত করতে মন চাইল না। আচ্ছা বলে, দীর্ঘশ্বাস চাপতে চাপতে উপরে উঠে এলো। বৌদির ইঙ্গিত সত্বেও রোজি বুঝতে পারেনি আরমান তাকে ছেড়ে, এই শহর ছেড়ে দূরে কোথাও চলে যাচ্ছে। সে আর ঘরে ফিরবে না। দ্রুত হাতে গৃহস্থালীর কাজ গোছায়। সন্ধ্যার

 

পূর্ব প্রকাশের পর-

রোজির আরেক দফা থমকাবার পালা। অঞ্জনা বৌদিকে এখনি কোনো প্রশ্ন করে বিরক্ত করতে মন চাইল না। আচ্ছা বলে, দীর্ঘশ্বাস চাপতে চাপতে উপরে উঠে এলো। বৌদির ইঙ্গিত সত্বেও রোজি বুঝতে পারেনি আরমান তাকে ছেড়ে, এই শহর ছেড়ে দূরে কোথাও চলে যাচ্ছে। সে আর ঘরে ফিরবে না।

দ্রুত হাতে গৃহস্থালীর কাজ গোছায়। সন্ধ্যার আগে রান্না করে। আরমানের পছন্দের দুই তিনপদ রান্না করে। কেননা খাওয়া দাওয়ার ব্যাপারে আরমান ছেলেবেলা থেকেই বেশ খুতখুতে। পাশাপাশি বাসায় বসবাস করায় সবই রোজির নখদর্পনে।

রান্নাবান্না শেষ করে সন্ধ্যাবেলা আবার গোসল করে। সুন্দর করে চুল বাধে। আরমানের কিনে আনা শাড়িটা পরে ওর জন্য অপেক্ষা করে। তাকে দেখলে এই মুহূর্তে যে কেউ মনে করবে রোজি কোনো পার্টিতে যাওয়ার জন্য সেজেগুজে বসে আছে।

রোজির অপেক্ষার সময় দীর্ঘ হতে থাকে। দেখতে দেখতে রাত এগারোটা বেজে যায়। ঘুমে তার চোখের পাতা বুজে আসতে থাকে। রোজি ভেবে পায় না আরমান এমন করছে কেন? আসলে সে কি চাইছে?

জয়কে বুকে জড়িয়ে শুয়ে শুয়ে ভাবতে থাকে, বৌদি তখন বলছিল আরমান বৌদিকে বলেছে তার খুব বিপদ। কি বিপদ? বিপদ আপদ যাই হোক রোজিকে না জানিয়ে সে কোথায় গেলো?

রোজির চিন্তায় ছেদ পড়ে। ডোরবেল বাজছে। রোজি সজাগ হয়। ওই বোধহয় ফিরে এলো! সে দরোজা খোলার আগে একবার আয়নার সামনে দাঁড়ায়। দ্রুত চুলে চিরুনী চালায়। স্থানচ্যুত কাপড় ঠিক করে নেয়। রোজি চায় ঘরে ঢুকেই আরমান রোজিকে দেখে মুগ্ধ হোক।

হাসি হাসি মুখে দরোজা খুলে একপাশে সরে দাঁড়ায়। কিন্তু আরমান কই? দরোজায় উকি দেয় সুন্দর চেহারার এক পুলিশ অফিসার। পেছনে কয়েকজন সেপাই। রোজি কাঁপা কাঁপা স্বরে জিজ্ঞাসা করে, আপনারা?

পুলিশ অফিসার বোধহয় ভাবতে পারেনি, আসামী ধরতে এসে এমন একজন সুন্দরী তরুণীর মুখোমুখি হতে হবে। মুহূর্তে নিজেকে সামলে নিয়ে জিজ্ঞাসা করে, এটা কি আলি আরমান সাহেবের বাসা?

-জি।

-আরমান সাহেব বাসায় আছে?

-জি না।

-আপনি তার কি হন?

-স্ত্রী।

-বাসায় আর কে আছে?

-আর কেউ নেই।

-কেন। আপনার শ্বশুর শ্বাশুড়ি?

-ওনারা বেঁচে নেই।

-আমরা আপনার বাসাটা সার্চ করে দেখতে চাই।

-দেখুন। রোজি দরোজা ছেড়ে সরে দাঁড়ায়। পুলিশ অফিসার ঘরে প্রবেশ করে। ভয়ে রোজির বুক কাঁপে। সে বুঝে পায় না, কি দিয়ে কি হচ্ছে। নিচে গিয়ে বৌদিকে ডেকে আনবে, তাও পারছে না।

পুলিশ অফিসারটা ঘরময় ওলট পালট করে খোজে। কি খোজে তা সেই জানে। রোজির মাথায় কিছুই আসে না। সবকিছু ওলট পালট করে দেখে যখন তাদের কাংঙ্খিত বস্তু না পায় তখন রোজির সামনে এসে দাঁড়ায়।

ঘরময় জিনিসপত্র ছড়ানো। রোজি ঘরের মাঝখানে জবুথবু দাঁড়িয়ে ঠকঠক করে কাঁপছে। পুলিশ অফিসার জিজ্ঞাসা করে, আপনার স্বামী কখন ফিরে আসবে?

-জানি না। আমার সাথে আজ তার দেখা হয়নি।

-কেন? উনি বাড়িতে ছিলেন না?

-না।

-কোথায় ছিলেন?

-আমি ঠিক জানি না।

-উনি কি প্রায়ই রাতে এরকম বাড়ির বাইরে থাকেন?

-না। উনি কখনোই এরকম বাড়ির বাইরে থাকেন না। গত চারদিন আগে তার সাথে আমার ঝগড়া হয়েছিল। কি নিয়ে ঝগড়া হয়েছিল আশাকরি সে বিষয়ে প্রশ্ন করে বিব্রত করবেন না। সেই ঝগড়াকে কেন্দ্র করে গত কয়দিন তিনি বাসায় ফেরেননি। আজ বিকালে তিনি বাসায় ফিরেছিলেন, তখন আমি বাসায় ছিলাম না। আমার সাথে তার দেখা হয়নি।

-আপনি কোথায় গিয়েছিলেন?

-আমি একজন স্কুল টিচার। স্কুলে ছিলাম।

-তিনি নিশ্চয়ই রাত্রে বাসায় ফিরবেন?

-আমি তো সেরকমই আশা করছি।

-উনি বাসায় ফিরলে থানায় গিয়ে দেখা করতে বলবেন।

-আপনারা তাকে খুঁজছেন কেন? সে কি কোনো-

-আপনার স্বামীর নামে অভিযোগ আছে।

-বিষয়টা কি আমি জানতে পারি?

-স্যরি। আপনাকে কিছুই জানানো যাচ্ছে না। আমরা তার সাথেই কথা বলতে চাই। তবে তিনি যদি পুলিশের সাথে কোয়াপারেট না করেন তাহলে তার কপালে খারাবি আছে।

পুলিশ চলে গেলো। রোজি সোফায় বসে ঘামতে লাগলো। এ কী শুনলো সে! তার স্বামী পুলিশের খাতায় ব্লাক লিস্টেড! তার মানে সে এমন জঘন্ন কাজ করেছে, যা তার সামাজিক মান মর্যাদাই শুধু ক্ষুণ্ন করেনি, তাকে আদর্শচ্যুত করেছে।

রোজি সারারাত ঘুমুতে পারেনা। যন্ত্রনায় ছটফট করে। এ কী করল আরমান? তারা না হয়, না খেয়ে থাকতো। না, তাই বা কেন? ছোট হলেও সে তো একটা চাকরি করছে। মাস গেলে বেতন পাচ্ছে। সেটা অংকে তেমন স্ফীত না হলেও দুটো লোকের ডালভাত অনায়াসে হয়ে যায়।

বিনিদ্র রাত কাটে রোজির। দুঃসহ একটা রাত। সদা ভয়, আবার কখন পুলিশ আসে। আবার জিজ্ঞাসাবাদ শুরু করে। তার ওপরে অত্যাচার না করে!

রোজি ভেবে পায় না, এখন সে কি করবে। বিষয়টা কিভাবে অঞ্জনা বৌদিকে জানাবে? না না, তাই বা কি করে সম্ভব! ঘরের কুৎসা! দাদা বৌদি তাকে কত ভালো জানে। এমন একটা খারাপ সংবাদ জানলে আরমান সম্পর্কে তাদের একটা খারাপ ধারনা জন্মাবে। আগের মতো আর বিশ্বাস থাকবে না। ভালোবাসা থাকবে না।

রোজির নিজের চুল নিজেকেই টেনে ছিঁড়তে ইচ্ছা করে। আরমান এমন একটা অপরাধের সাথে জড়িত হতে পারে রোজি এখনো তা বিশ্বাস করতে পারছে না। সে কোনো ঘটনার শিকার হয়ে যায়নি তো? আসলে প্রকৃত সত্য যে কি তা সে ঘরে ফিরলেই বোঝা যেতো। আরমান যাই করুক তার কাছে সত্য গোপন করতো না। প্রকৃত ঘটনা খুলে বলতো।

এখন যা অবস্থা, তাতে আরমানের ঘরে ফেরাও নিরাপদ নয়। বিষয়টা কি সে আগে থেকেই আচ করতে পেরেছে! সেকথাই কি বৌদিকে বলেছে? যা বৌদি বোঝেনি? অথবা বোঝার মতো করে বলেনি। এবং সবকিছু জেনে বুঝেই ঘরে ফেরেনি। কোথাও গা ঢাকা দিয়ে আছে। কোথায় আছে? কেমন আছে, তা জানার জন্য রোজির মন ব্যাকুল হয়ে ওঠে।

রাত বাড়ে। ক্লান্ত শরীর ঘুমে টলতে থাকে। রোজি ছেলেকে বুকে জড়িয়ে এক সময় ঘুমিয়েও পড়ে। তবে মাঝে মাঝেই তার ঘুম ভেঙ্গে যায়। ঘুম থেকে জেগে অন্ধকারে কান খাড়া করে অপেক্ষা করে। একবার মনে হয়, আরমান বোধহয় ফিরে এসেছে। সে বাইরে অপেক্ষা করছে।

রোজি লাইট জ্বালে। দেওয়াল ঘড়ির দিকে তাকিয়ে দেখে রাত তিনটা। তখনই মনে হয়, না না, এত রাতে আরমান আসবে কি করে। রাত এগারোটার সময় তো মেইন গেটে তালা লাগিয়ে দেওয়া হয়েছে। আরমান জানে যে এর পরে ফিরলে সে ভেতরে ঢুকতে পারবে না। ফলে, এমন ভুল সে কখনোই করবে না।

রোজি উঠে জগ থেকে পানি ঢেলে খায়। গলাটা শুকিয়ে কাঠ হয়ে গিয়েছিল। পানি খাওয়ার পর ভালো লাগে। রোজি শুয়ে শুয়ে ভাবে, জীবনটা এমন হয়ে যাচ্ছে কেন? ‘খোদা, স্বজ্ঞানে এমন কোনো অন্যায় কাজ কখনো করেনি, যার কারণে আমাদের জীবন এমন জটিল করে দিচ্ছ। রহম কর খোদা। সমস্ত বালা মসিবত থেকে নাজাত কর।’

 

১৪.

ট্রেন ভোরবেলা চিটাগাং স্টেশনে ইন করে। এখনো পুবের আকাশ ভালো করে ফর্সা হয়নি। চারিদিকে আবছা অন্ধকার। হালকা কুয়াশা পড়েছে। যার কারণে আজকের দিনের সূচনা হয়তো একটু দেরিতেই হবে। আরমান ট্রেন থেকে নেমে কোনদিকে যাবে ভেবে স্থির করতে একটু সময় নিলো।

চারিদিকে একবার সতর্ক দৃষ্টি বুলিয়ে নিয়ে আস্তে আস্তে স্টেশনের বাইরে এলো। যদিও সে নির্লিপ্তভাবে হাটছিল, তথাপি তার সতর্ক নজর ছিল সবদিকে। খেয়াল রেখেছিল কেউ তাকে ফলো করছে কি না।

গোলাম মাওলা অবশ্য তার একটা বড় উপকার করেছে। একটা পরচুলো আর দাড়ি লাগিয়ে এমন মেকাপ দিয়ে দিয়েছে যে, আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে আরমান নিজেই নিজেকে চিনতে পারেনি। বিধায় পুলিশ বা গোয়েন্দা বিভাগের লোকেরা সহসা তাকে সনাক্ত করতে পারবে না।

আরমান স্টেশনের বাইরে এসে একটা ট্যাক্সি নিলো। নির্দিষ্ট ঠিকানায় পৌছাতে এখান থেকে বাসে যাওয়া যায়। তবে আরমান এখন মোটেও ঝুকি নিতে চায় না। তাই সে ট্যাক্সি নিয়ে চলে এলো কক্সবাজারে তার নির্দিষ্ট ঠিকানায়।

বাড়ির সামনে নেমে একটু থমকে গেলো। বিশাল বাড়ি। সমুদ্র পাড়ে এমন সুন্দর একটা বাড়িতে সে অতিথি হয়ে এসেছে, এজন্য তার বুক আনন্দে ফুলে উঠতো, যদি মাথার ওপরে পুলিশের খড়গ ঝুলে না থাকতো। ট্যাক্সি ভাড়া মিটিয়ে দিয়ে সে গেটের সামনে এলো। দরোয়ান ভেতরে ঢোকার আগে সামনে এসে দাঁড়ালো। পরিচয় জানতে চাইলো।

-আমি তালুকদার সাহেবের সাথে দেখা করতে চাই। তিনি কি বাসায় আছেন?

তালুকদার সাহেবের নাম শুনে দারোয়ান নরম হয়। পথ ছেড়ে সরে দাঁড়িয়ে বলে, আসুন। সাহেব বাসায় আছেন।

চলবে…

Read More

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked with *

সর্বশেষ পোস্ট

Advertising