পূর্ব প্রকাশের পর- মহিলা আবারও একঝলক মুক্তঝরা হাসি হাসল। ফাইন। আপনার যুক্তি মেনে নেওয়া ছাড়া কোনো উপায় নেই। যাক, যে জন্য এসেছি। আপনাকে আমার সাথে একটু বাইরে যেতে হবে। আমি কিছু কেনাকাটা করতে চাই। আপনি দ্রুত রেডি হয়ে নিচে আসুন। আরমান তার মতামত জানাবার আগেই তিনি যেমন এসেছিলেন তেমনি অদৃশ্য হয়ে গেলেন। আরমান কি
পূর্ব প্রকাশের পর-
মহিলা আবারও একঝলক মুক্তঝরা হাসি হাসল। ফাইন। আপনার যুক্তি মেনে নেওয়া ছাড়া কোনো উপায় নেই। যাক, যে জন্য এসেছি। আপনাকে আমার সাথে একটু বাইরে যেতে হবে। আমি কিছু কেনাকাটা করতে চাই। আপনি দ্রুত রেডি হয়ে নিচে আসুন।
আরমান তার মতামত জানাবার আগেই তিনি যেমন এসেছিলেন তেমনি অদৃশ্য হয়ে গেলেন। আরমান কি করবে বুঝতে পারছিল না। আসলে ঘটনাটা সত্য না বিভ্রম সেটাই বুঝে উঠতে পরছিল না। তিন মাস পার হয়ে গেছে সে এই বাড়িতে এসেছে। যে মহিলা সারাক্ষণ চোখের সামনে ঘুরঘুর করেও, যে কোনোদিন সৌজন্যের খাতিরেও একটা কথাও বলেনি, সে আজ সরাসরি মার্কেটে যাওয়ার প্রস্তাব দিচ্ছে, ব্যপারটা আরমানের কাছে কেমন কাকতালীয় লাগছে।
বারবার তার মনে হচ্ছে, সে কিছুই শোনেনি। এটা তার অবচেতন মনের ভুল। হ্যালোচুনেশন।
পরক্ষণই মনে হলো, হ্যালোচুনেশন হবে কেন? কেন সে তার অবচেতন মনে হানা দেবে? তার অবচেতন মনে এলে আসবে রোজি। কই রোজির মুখটা তো তার স্মৃতিপটে এমনভাবে ভেসে ওঠে না। বরং রোজির কথা মনে এলেই আরামনের বুকের ভেতরে একটা পিনপিনে ব্যথা চাগাল দেয়। মনটা হতাশায় ডুবে যায়। কেমন একটা খা খা শূণ্যতা।
কেন এমন হয়?
আরমান ভাবে। মানুষ এভাবেই পাল্টে যায়। যে মেয়ে তাকে ছাড়া পৃথিবীর কোনোকিছুই ভাবতে পারতো না। যে মেয়ে তাকে ভালোবেসে বিয়ে করেছে। বাবা মার সাথে, পুরো পরিবারের সাথে একা লড়াই করে নিজের ভালোবাসার মর্যাদা দিতে কসুর করেনি। সেই মেয়েই আবার কেমন অবলীলায় তার কাজিনের প্রেমে আসক্ত হলো। স্বামী বর্তমান থাকতে কাজিনের সাথে ঢলাঢলি করে বেড়াতে তার কোনো দ্বিধা সংকোচ নেই। ছি! ভাবতেও আরমনের গা ঘিনঘিন করে।
আরমানের চিন্তায় ছন্দপতন ঘটে। দরোজায় এসে দাঁড়িয়েছে টোটোন। স্যুটেড বুটেড। ওর কচি মুখে হাসি উপচে পড়ছে। আরমানকে ওভাবে বসে থাকতে দেখে বলল, স্যার আপনি এখনো বসে আছেন। কাপড় চেঞ্জ করেননি। নিচে গাড়ির কাছে মা আপনার জন্য দাঁড়িয়ে আছে।
আরমান তটস্থ হয়। ও আচ্ছা, তুমি যাও আমি আসছি।
টোটন কথা না বাড়িয়ে নেমে যায়। আরমান তড়িঘড়ি কাপড় চেঞ্জ করে নিচে নেমে আসে। দেখে টোটোনের আম্মা সত্যিই দাঁড়িয়ে আছে। তাকে দেখে মনে হচ্ছে একটা শ্বেত বলাকা। মাথার চুল আর গায়ের ত্বকের রং যদি একটু রক্তাভ না হোতো তাহলে তাকে শ্বেত-মর্মরই বলা যেত। বলা যেত প্রেমের দেবী আফ্রিদিতি।
ঘরে যখন থাকে তখন মহিলার চোখে চশমা থাকে না। এখন আছে। আর এই চশমা তাকে আরও শোভন, আরও মোহনীয় করে তুলেছে। আরমানকে দেখে মহিলা মৃদু হাসল। মৃদুস্বরে বলল, ছেলেদের তৈরি হতে এত দেরি হয় আমার জানা ছিল না।
আরমান কোনো জবাব দিলো না। হাসিমুখে একটু কাঁধ ঝাকালো। ভাবখানা এই রকম, আগে দেখেননি এবার দেখলেন তো!
টোটোন আর তার মা গাড়ির পেছনে উঠে বসলো। আলি আরমান সামনে, ড্রাইভারের পাশের সিটে বসলো। গাড়ি ছুটে চলল তার গন্তব্যের দিকে। কোথায় যাচ্ছে তার কোনো নিশানা জানা নেই আলি আরমানের। ব্যাপারটা তার কাছে কেমন স্বপ্নীল স্বপ্নীল, আবার রহস্যময়।
মিষ্টেরিয়াস এই কারণে, যে মহিলা নিজের চারপাশে সবসময় ব্যক্তিত্বের দেয়াল তুলে ঘুরে বেড়ায়। কাউকে তেমন একটা পাত্তা দিতে চায় না। চারপাশের কোনো কিছুকেই তোয়াক্কা করে না। সে আজ হুটকরে তাকে নিয়ে মার্কেটে চলেছে।
আরমান বসে বসে নিজের মতো করে ভাবে। আরে বাবা মার্কেটে যাবা তুমি নিজে যাও। আমি তো তোমাদের গলগ্রহ। আমাকে ছাড়াই তোমাদের দুনিয়া সচল। তাহলে আবার আমার মতো দুর্ভাগাকে নিয়ে এই টানাটানি কেন?
গাড়ি ছুটে চলেছে আপন গতিতে। ছুটে চলেছে আরমানের চিন্তা-স্রোতও। এই মুহূর্তে কেন জানি না আরমানের মানসপটে বারবার ভেসে উঠছে তার শিশুপুত্রের কচি মুখখানা। পাশাপাশি রোজির কথাও কেন যে এতকরে মনে পড়ছে কে জানে। আজ এই মুহূর্তে তারা কেমন আছে কে জানে। রোজিকে যে অবস্থায় ফেলে এসেছে সেই অবস্থায় একা মেয়েমানুষ একটা দুধের বাচ্চাকে নিয়ে কেমন আছে তা একমাত্র খোদাতালাই বলতে পারে।
মনে মনে নিজেই নিজেকে প্রবোধ দেয়। ভালো আছে নিশ্চয়ই। কারণ, ঢাকায় তার বাবা মা আছে, ভাই বোন আছে। রোজির কোনোরকম অসুবিধা হলে তারা ছুটে আসবে তাতে কোনো সন্দেহ নেই। তারপর সাব্বির নামের ওই যুবক তো আছেই।
সাব্বিরের কথা মনে হতেই আরও একটা কথা মনে আসে। আরমানের বুকে একটা জ্বলুনি শুরু হয়। এখন তো বাসা খালি। আজ রোজির পাশে আরমান না থাকলেও রোজির আফসোস থাকার কথা নয়। বরং তার অনুপস্থিতি তাদের জন্য বড় সুযোগ।
গাড়ি এসে থামলো একটা বার্মিজ মার্কেটের সামনে। ড্রাইভার নেমে গিয়ে পেছনের দরোজা খুলে ধরলে আরোহীরা নামলো। আরমান বুঝলো তারও নামার সময় হয়েছে। আরমান এদিকে আগে কখনো আসেনি। তাই কক্সবাজারের সবকিছুই আরমানের কাছে অপরিচিত।
টোটোনের আম্মা ছেলের হাত ধরে মার্কেটের ভিতরে যাওয়ার জন্য এগিয়ে গেলো। আরমান তাদের অনুসরণ করলো। তাদের হাটার ভঙ্গিমা বলে দিচ্ছে এই মার্কেট তাদের কাছে অপরিচিত নয়। এখানে তারা বহুবার এসেছে। মার্কেটের ভেতরে ঢুকে আরমানের সেই ধারনা আরও স্পষ্ট হলো।
ওরা এ-দোকান সে-দোকান ঘুরে ঘুরে নানা জিনিস কিনলো। কেনাকাটা যা করার মহিলা নিজেই করলেন। আরমান ছায়ার মতো তাদের অনুসরণ করলো শুধুমাত্র। তাদের মাঝে আর তেমন কোনো কথাবার্তাও হলো না।
এভাবে নীরবে ছায়ার মতো ঘুরতে আরমানের ভালো লাগছিল না। বরং প্রেস্টিজে লাগছিল। কিন্তু এই মুহূর্তে তার কিছুই করার ছিল না। যেহেতু সে তাদের আশ্রিতা। একটা দোকানের সামনে দাঁড়িয়ে টোটোনের আম্মা বলল, মাস্টার সাহেব, দেখুন তো এই সোয়েটারটা আপনার গায়ে ফিট করে কি না।
আরমান একটু থতমত খেয়ে বলল, না না ম্যাডাম। আমার জন্য কিছু কিনতে হবে না।
মহিলা হাসল। আমি ম্যাডাম নই। আমার নাম অনন্যা। আমাকে অনন্যা বলেই ডাকতে পারেন।
-স্যরি, আপনার নামটা আমার জানা ছিল না।
-আমার আর কি কি জানা আছে আপনার?
-কিছুই না। শুধু জানি আপনি ফালু মামার মেয়ে। টোটোনের আম্মা। আর কিছু না।
-জানবার চেষ্টা করেছেন কখনো?
-না।
-কেন?
-অনধিকার চর্চা করতে পছন্দ করি না তাই।
-অনধিকার চর্চা বলছেন কেন, কৌতুহল বলুন। আমরা এক বাড়িতে থাকি, পরস্পরকে জানার একটা কৌতুহল থাকবে না সে কেমন কথা?
সত্যি কথাটা বলতে গিয়েও বলতে পারলো না। মৃদু হেসে বলল, অনন্যা দেবী; যদি কিছু মনে না করেন তাহলে একটা কথা বলবো।
-বলুন।
-অযাচিত কৌতুহল কারো বিরক্তির কারণও তো হতে পারে।
অনন্যা মিটিমিটি হাসছিল। হাসি থামিয়ে বলল, আপনার কাছ থেকে এরকমই একটা উত্তর আমি আশা করছিলাম।
আরমান অনন্যার মুখের পানে বোকা বোকা চোখে চেয়ে ছিল। প্রতিদিনকার দেখা অনন্যার সাথে বর্তমানের অনন্যার মিল খুজে ফিরছিল। না, মিলের চেয়ে অমিলই বেশি।
-কি দেখছেন অমন করে?
আরমান দ্রুত চোখ নামিয়ে নিয়ে বলল, আপনাকে।
-নতুন কিছু কি দেখছেন?
-হাঁ।
-কি রকম?
-যা আগে দেখিনি।
-কি দেখেননি আগে?
-রাগ করবেন না তো?
-আপনার মুখটাকে আগে কোনোদিন এতভালো করে, খেয়াল করে দেখিনি।
-কেন দেখেননি?
-আলাপ পরিচয় না থাকলে কারোদিকে হ্যাংলার মতো তাকানো কি ঠিক? শালিনতা বিরোধি হয়ে যায় না?
-আলাপ করেননি কেন?
-গায়ে পড়ে আলাপ করা আমার পোষায় না।
-আপনি খুব অহংকারী।
– না। অহংকারী নই। আত্মমর্যদা জ্ঞান সম্পন্ন।
-শুনেছি আপনি বিবাহিত?
-ঠিকই শুনেছেন। শুধু বিবাহিত নই। আমাদের একটা ছেলেও আছে।
অনন্যা প্রথমদিন থেকেই আরমানের ওপরে কড়া নজরদারি করছে। তবে লোকটার কোনো দুর্বল দিক খুজে বের করতে পারেনি, যেদিক থেকে আরমানকে আঘাত করে নিজেকে জাহির করতে পারে। প্রথম দিকে অনন্যা মুডি আচরণ করেছে। চোখের উপরে ঘুরঘুর করেছে অথচ কথা বলেনি। ভেবেছে আরমান তার সাথে যেচে আলাপ করবে। তেমন হলে ভাব জমাতেও চেষ্টা করবে।
কিন্তু অনন্যার চিন্তাধারাকে আরমান ব্যর্থ করে দিয়েছে। অনন্যা যতটা অহং দেখিয়েছে, আরমান তার চেয়েও বেশি নিস্পৃহ আচরণ করেছে। টোটোনের সাথে সারাক্ষণ গল্পগুজোব করলেও অনন্যাকে যেন চোখেই দেখেনি।
অনন্যা আরমানের কাধে সোয়েটার ধরে মাপ নিতে নিতে নিচুস্বরে বলল, আমার জীবনে দেখা আপনিই অন্যরকম মানুষ। আপনাকে আমার ভালো লেগেছে।
-আপনার ভালো লাগার জন্য ধন্যবাদ।
-এখন থেকে আমরা বন্ধু হতে পারি না?
-তা পারি।
-তারপারে—- আর কিছু?
-আপনি যেমন বিবাহিতা, আমিও তেমনি। বিধায়, পরের ব্যাপার গুলোতো সহজ নয়। শিক্ষা রুচি বিবেক- সবকিছু মিলিয়ে খুবই কঠিন।
-ফাইন।
-মানে!
-সত্যভাষণের জন্য ধন্যবাদ। সত্যিকথা সবাই নিষ্ঠুরভাবে বলতে পারে না। স্ত্রীকে নিশ্চয়ই খুব ভালোবাসেন?
-দ্বিতীয় কোনো মেয়ের কথা কখনো ভাবিনি।
-মহিলা কি আমার চেয়েও বেশি সুন্দরী?
-কেন? আপনি কি জেলাস ফিল করছেন?
-জেলাস ফিল করছি না। তবে ভাবছি, যে মেয়ের স্বামী এমন সেই মেয়েটা কত ভাগ্যবতী। তাছাড়া পুরুষ মানুষ সম্পর্কে যে ধারনা ছেলেবেলা থেকে ধীরে ধীরে গড়ে উঠেছিল, আপনি সেটায় চিড় ধরিয়ে দিয়েছেন।
চলবে….
Leave a Comment
Your email address will not be published. Required fields are marked with *