মিজানুর রহমান সুমন (অস্ট্রেলিয়া প্রবাসী সাংবাদিক ও কলামিস্ট ): অবশেষে বাংলাদেশ সরকার ভারতকে দেশের মধ্যে যাতায়াতের জন্য করিডোর দিয়েই দিলো। যুগ যুগ ধরে ভারত এই সুযোগের অপেক্ষায় ছিলো। বিরোধী দলগুলো বলে আসছে , এই করিডোর দেয়ার ফলে ভারতের দাসত্বের প্রাতিষ্ঠানির রূপ পেলো। প্রতিবেশি দেশের জন্য করিডোর তো দেয়া যেতেই পারে। তবে বাংলাদেশের জন্য এটা ভারতের দাসত্ব
মিজানুর রহমান সুমন (অস্ট্রেলিয়া প্রবাসী সাংবাদিক ও কলামিস্ট ): অবশেষে বাংলাদেশ সরকার ভারতকে দেশের মধ্যে যাতায়াতের জন্য করিডোর দিয়েই দিলো। যুগ যুগ ধরে ভারত এই সুযোগের অপেক্ষায় ছিলো। বিরোধী দলগুলো বলে আসছে , এই করিডোর দেয়ার ফলে ভারতের দাসত্বের প্রাতিষ্ঠানির রূপ পেলো। প্রতিবেশি দেশের জন্য করিডোর তো দেয়া যেতেই পারে। তবে বাংলাদেশের জন্য এটা ভারতের দাসত্ব কেনো বলা হচ্ছে সেটি নিয়ে বিশ্লেষন করলে অনেক কিছু সামনে নিয়ে আসতে হচ্ছে। বিশেষ করে প্রতিবেশী দেশগুলোর সাথে ভারতের সম্পর্ক ও অন্যান্য দেশের অভ্যন্তরে ভারতের হস্তক্ষেপের যেসব নজির রয়েছে, তাতে ভারতকে করিডোর দেয়ার অর্থ হচ্ছে বাংলাদেশের সার্বভৌমত্ব কম্প্রোমাইজ করা।
বাংলাদেশ থেকে একটি রেল করিডোর নেয়ার বিষয়ে ভারত সরকারের আগ্রহ বহুদিনের। কিন্তু বাংলাদেশের বিগত সরকারগুলো সেই সুযোগ দেয়নি। এর পেছনের কারন হচ্ছে একটি দেশের মধ্যে আরেকটি দেশের শর্তহীন এই ট্রানজিটের উপরে হোস্ট দেশটির কতৃত্ব না থাকলে কার্যত সার্বভৌমত্বের উপরে হস্তক্ষেপ হয়ে যায়। কিন্তু শেষ পর্যন্ত ভারত সফল হলো শেখ হাসিনার হাত ধরে। শেখ হাসিনার সরকার এর আগেও একের পর এক গোপন চুক্তি করেছে ভারতের সাথে। সেসব চুক্তিতে তারা ঠিক কি পেয়েছে বা কি দিয়ে এসেছে কিছুই জানেনা বাংলাদেশের জনগণ। বরাবরই সংসদকে পাশ কাটিয়ে ভারতে গিয়ে দেশের মর্যাদার জন্য হানিকর চুক্তি করে আসেন বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী। তিনি যেহেতু বাংলাদেশের একটি নির্বাচনহীন স্বৈরতন্ত্র কায়েম করতে পেরেছেন, ফলে তার সাধারন মানুষের প্রতি দায়বদ্ধতা ও জবাবদিহিতা নেই বললেই চলে। যারাও প্রশ্ন করতে পারতো , তাদের অধিকাংশই ভারতের কতৃত্ব মেনে নিয়ে শেখ হাসিনার হাতের পুতুল হয়ে রেয়েছে।
শেখ হাসিনার সরকার যদিও বিষয়টিকে ট্রানজিট বলছে। কিন্তু বাংলাদেশের মধ্য দিয়ে কলকাতা থেকে আগরতলায় যদি ট্রেন যাতায়াত করে, সেই ট্রেন হবে ভারতের পতাকাবাহী। সেই ট্রেনে যারা যাতায়াত করবেন সেখানে থাকবেনা বাংলাদেশের বিন্দুমাত্র নিয়ন্ত্রন। ভারতের সেনাবাহিনীও যদি এভাবে বাংলাদেশে চলে আসে, কার্যত বাংলাদেশ সরকারের কিছুই করনীয় থাকবে না। এভাবে একটি দেশের মধ্যে কোনো ধরনের নিয়ন্ত্রন ছাড়া আরেকটি দেশের ট্রেন চলতে দেয়া নজিরবিহীন। অত্যন্ত গোপনে করা এসব চুক্তির ফলে দেশের মানুষের ধারনা হয়েছে,ভারতের মুদ্রানীতি চালুর মাধ্যমে বাংলাদেশকে শোষণ করার গভীর ষড়যন্ত্র চলছে। ভারত তাদের নিজেদের সুবিধার জন্য বাংলাদেশের সড়কপথ এবং রেলপথ ব্যবহার করবে। বাংলাদেশের সমুদ্রসীমা গবেষণার নামে বাংলাদেশের সমুদ্র সম্পদ লুট করার জন্য সমুদ্র চুক্তি করা হয়েছে। ১৯৪৭ সালে ভারত বিভক্তির পর থেকেই ভারত তদানীন্তন পূর্ব পাকিস্তানের কাছ থেকে ট্রানজিটের নামে করিডোর চেয়ে আসছিল। পাকিস্তানের ২৪ বছরের ইতিহাসে তাদের সেই করিডোর দেওয়া হয়নি। বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পরও ভারত একই আবদার জানিয়ে আসছিল। ২০০৯ সালের পূর্ব পর্যন্ত অর্থাৎ বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার ৩৮ বছর পর্যন্ত ভারতকে ঐ করিডোর দেওয়া হয়নি। কিন্তু ২০০৯ সালের জানুয়ারি মাসে ক্ষমতা গ্রহণের পর থেকে আওয়ামী লীগ সরকার বিগত ১৫ বছরে ভারতকে স্থল ও নৌপথে করিডোর দিয়েছে। কিন্তু রেলপথে করিডোর দেয়নি। বিষয়টি একটু পরিষ্কার করা দরকার। আওয়ামী লীগ সরকার আসার পর বাংলাদেশের এক স্থান থেকে রেলপথে ভারতে যাওয়া যায়। কিন্তু আওয়ামী লীগের ১৬ বছরের শাসনেও ভারতের এক স্থান থেকে যথা কলকাতা থেকে বাংলাদেশের ওপর দিয়ে ট্রেনে ভারতের অপরাংশে যথা আগরতলা, মেঘালয় ইত্যাদি কোনো স্থানে যাওয়ার করিডোর দেওয়া হয়নি।
কিন্তু এবার অর্থাৎ ২০২৪ সালের ৭ জানুয়ারির নির্বাচনের পর অবশেষে চলতি মাসে ভারতকে সেই রেল করিডোর দেওয়া হচ্ছে। ভারত থেকে বাংলাদেশের ওপর দিয়ে ভারতের অপরাংশে যে ট্রেন যাতায়াত করবে। সেই ট্রেনে মালামাল পরিবহন ছাড়াও অস্ত্রশস্ত্রও পরিবহন করা হবে বলে ভারত ও বাংলাদেশের একশ্রেণির পত্রপত্রিকায় উল্লেখ করা হয়েছে।
পশ্চিমবঙ্গে ২৫০ কি.মি. নতুন রেললাইন বসানো হবে। এটি হবে পশ্চিমবঙ্গ থেকে মেঘালয় ভায়া বাংলাদেশ। রুটটি হবে বালুরঘাট-হিলি-গাইবান্ধা-মহেন্দ্রগঞ্জ-তুরা-মেন্দিপাথর। পশ্চিমবঙ্গেও লাইন হবে দুটি। একটি হবে ৮০ কি.মি.। আরেকটি হবে ৬০ কি.মি.।
অপর রুটটি হবে পশ্চিমবঙ্গ থেকে আসাম ভায়া বামনহাট। রুটটি হবে বালুরঘাট-হিলি-পার্বতিপূর-কাউনিয়া-লালমনিরহাট-মোগলহাট-গিতালদহ। যেসব রেললাইন ব্রডগেজে কনভার্ট করা হবে, সেগুলো হলো পশ্চিমবঙ্গ থেকে ত্রিপুরা ভায়া বাংলাদেশ। রুটটি হলো গেদে-দর্শনা-আখাউড়া-আগরতলা-পেট্রাপোল-বেনাপোল-নাভারন-যশোর-রূপদিয়া-পদ্মাবিলা-লোহাগড়া-কাশিয়ানি-শিবচর-মাওয়া-নিমতলা-গেণ্ডারিয়া-ঢাকা-টঙ্গী-ভৈরব বাজার-আখাউড়া-আগরতলা। এই বিশাল রুটে যথাক্রমে ১০০ কি.মি. ও ১২০ কি.মি. লাইন ব্রডগেজে কনভার্ট করা হবে। নেপালের দিকে স্থাপন করা হবে ১৯০ কি.মি. রেললাইন। রুটটি হবে বিরাটনগর-নিউ মল। আরেকটি হবে ১২ দশমিক ৫ কি.মি.। রুটটি হবে গলগলিয়া-ভদ্রপুর-কাজালি বাজার।
ভারতীয় রেলওয়ে সূত্র উল্লেখ করে, হিন্দুস্তান টাইমস এবং টাইমস নাউ পত্রিকাসমূহে বলা হয়েছে, এর ফলে একদিকে যেমন ভ্রমণের সময় অনেক কমে যাবে; অন্যদিকে তেমনি কৌশলগতভাবেও ভারত লাভবান হবে। কারণ চিকেন নেকটি মাত্র ২২ কি.মি. লম্বা। এর এক প্রান্ত রয়েছে নেপালে, আরেক প্রান্ত রয়েছে বাংলাদেশে। ভুটানের দোকলাম নামক কৌশলগতভাবে গুরুত্বপূর্ণ ভূখণ্ডটি নিয়ে ভারত এবং চীনের মধ্যে যখন যুদ্ধাবস্থা সৃষ্টি হয় তখন এ চিকেন নেক নিয়ে ভারত অত্যন্ত চিন্তিত হয়ে পড়ে। তখন থেকেই ভারত চিন্তা করতে থাকে যে সামরিকভাবে অত্যন্ত স্পর্শকাতর এ চিকেন নেক যদি শত্রুর হুমকির মুখে পড়ে, তাহলে ভারতের পশ্চিমাঞ্চল পূর্বাঞ্চল থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়বে। পর্যবেক্ষক মহল বলেন, এমন একটি অবস্থায় ভারত দুটি বিচ্ছিন্ন অঞ্চলে পরিণত হবে। বিশেষজ্ঞদের মতে, কলকাতা থেকে শিলিগুড়ি করিডোর হয়ে উত্তর-পূর্ব ভারতের মনিপুর বা নাগাল্যান্ডে যেতে সময় লাগে ৩২ ঘণ্টা। হিন্দুস্তান টাইমস দাবি করেছে যে, যদি কলকাতা থেকে বাংলাদেশ হয়ে মেঘালয়, মনিপুর বা নাগাল্যান্ডে যেতে হয়, তাহলে বিরতিহীন দ্রুত গতির মালগাড়ির সময় লাগবে মাত্র ৪ ঘণ্টা। অর্থাৎ ভারতের সময় বাঁচবে ২৮ ঘণ্টা। বিবিসি এবং আল-জাজিরায় বলা হয়েছে যে, এসব রুটে যে মালগাড়ি চলবে, সেগুলোয় শুধুমাত্র নিত্যব্যবহার্য পণ্যই পরিবহন করা হবে না, সমরাস্ত্রও পরিবহন করা হবে। ভারতীয় ইংরেজি পত্রপত্রিকায়ও সমরাস্ত্র শব্দটি সরাসরি না বলে বলা হয়েছে Goods having strategic importance.
এ সামরিক গুরুত্বের কারণেই ভারতীয় পত্রপত্রিকাগুলোয় বলা হয়েছে যে, বাংলাদেশ হয়ে যে নতুন রেল ট্রানজিট স্থাপন করা হবে, সেই রুটগুলো শিলিগুড়ি করিডোর বা চিকেন নেকে নির্মিত রেললাইনকে পাশ কাটিয়ে চলবে। এর ফলে চিকেন নেকের ওপর তেমন কোনো চাপ আর থাকবে না। ভারতের রেলওয়ে বোর্ড যেসব রুটকে চূড়ান্ত অনুমোদন দিয়েছে, দি হিন্দু পত্রিকার বিজনেস লাইনে তার দৈর্ঘ্য ধরা হয়েছে ১২৭৫ দশমিক ৫০ কি.মি.। নিচের লাইনটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। সেখানে ইংরেজিতে বলা হয়েছে, FLS for 14 new railway connectivity routes connecting Bangladesh, Nepal, and alternate routes towards the North-East have been sanctioned, an official in the Railway Ministry stated. অর্থাৎ ভারতীয় রেল মন্ত্রণালয় আনুষ্ঠানিকভাবে এসব নতুন রেল পথের প্রস্তাব অনুমোদন করেছে।
আরেকটি রুট হবে বিলোনিয়া-ফেনী-চট্টগ্রাম। এই রুটের দৈর্ঘ্য হবে ৩৮ কি.মি.। বিহারের পূর্ণিয়া থেকে বাংলাদেশের লক্ষ্মীপুর পর্যন্ত ১৭০ কি.মি. নতুন লাইন স্থাপন করা হবে। ২০১৭ সালে ভারত ও চীনের মধ্যে বিদ্যমান দোকলাম অচলাবস্থার কারণে সামরিক বাহিনী এবং বেসামরিক পরিবহনের জন্য গুরুত্বপূর্ণ রেললাইনটি উদ্বেগের কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। কারণ সংকীর্ণ করিডোরটি বিবাদ অঞ্চলের কাছে পড়ছে। আন্তর্জাতিক রেল সংযোগ স্থাপনের ক্ষেত্রে ১৪টি রুট সমীক্ষা রিপোর্টে চূড়ান্ত সিলমোহর দিয়েছে ভারতীয় রেল বোর্ড। ইতোমধ্যে সেবক থেকে রংপো পর্যন্ত ট্রেন নিয়ে যাওয়ার কাজ চলছে। নাথুলা পর্যন্ত ট্রেন চালানোর পরিকল্পনা রয়েছে। ১,২৭৫.৫ কিলোমিটার রেললাইনের যে অনুমোদন দিয়েছে রেল বোর্ড, তার মধ্যে বাংলাদেশের ৮৬১ এবং নেপালের ২৯২.৫ কিলোমিটার রয়েছে। বাকিটা উত্তর-পূর্বাঞ্চলের।
এই খবরের পর যা ঘটবার তাই ঘটেছে। যখন বেগম খালেদা জিয়া ক্ষমতায় ছিলেন এবং ১৯৯৬ সালে যখন তিনি বিরোধীদলের আসনে বসেন, তখন এ উভয় সময়ে তিনি বলেছিলেন, বুকের রক্ত দিয়ে হলেও তিনি ভারতের এ করিডোর রুখবেন। বেগম জিয়া অনেক দিন হলো ক্ষমতায় নাই। এই সুযোগে বিগত ১৫ বছরে আওয়ামী লীগ ভারতের যত চাহিদা ছিল সব পূরণ করেছে। সর্বশেষ এ সর্বনাশা রেল করিডোর দিতে যাচ্ছে। তাই প্রত্যাশিতভাবেই বিএনপি এর তীব্র বিরোধিতা করেছে। গত ১৯ জুন বুধবার এক সংবাদ সম্মেলনে বিএনপির সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবির রিজভী বলেছেন, রেল ট্রনজিটের যে উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে, সেগুলো ভারতের সমরাস্ত্র এবং বেসামরিক পণ্য পরিবহনের জন্যই করা হয়েছে। আর এগুলো অবশ্যই করা হয়েছে প্রধানমন্ত্রীর অনুমোদনক্রমে।
এর আগে এইসব সুযোগ সুবিধার আশায় ভারত সরকার বাংলাদেশে শেখ হাসিনাকে ক্ষমতায় রাখার জন্য দেশের জনগণের ভোটের অধিকার কেড়ে নিয়েছে। বিগত ১৫ বছর বাংলাদেশে কোনো ধরনের অবাধ ও নিরপেক্ষ নির্বাচন হচ্ছেনা। সংসদ নির্বাচন তো নয়ই , উপজেলা , ইউনিয়ন পরিষদ, কোথাও অবাধ ও নিরোপেক্ষ নির্বাচন হচ্ছেনা। দেশ গভীর স্বেরতন্ত্রে নিমজ্জিত। এই অবস্থায় বাংলাদেশের জনগণের কাছে ভারত খুবই অজনপ্রীয় একটি দেশের নাম। এমনকি খেলাধুলায়ই বাংলাদেশের সাধারন জনতা ভারতের উপর থেকে তাদের সমর্থন প্রত্যাহার করে নিয়েছে। বিগত কয়েকটি নির্বাচনে বাংলাদেশের আওয়ামী লীগ সরকার ভারতকে কিছু না কিছু দিয়েই ক্ষমতায় থাকছে। সর্বশেষ এই বহুমুখী করিডের দেয়ার ফলে সম্ভবত আগামী নির্বাচনেই আওয়ামী লীগের হাতে ভারতকে দেয়ার জন্য আর কিছুই থাকবে না। একজন ব্যক্তিকে ক্ষমতায় রাখার জন্য দেশের মানুষ এই সার্বভৌমত্ব বিকিয়ে দেয়াকে কিভাবে নেয় বা সামনে বাংলাদেশের সাধারন মানুষের কাছ থেকে কি ধরনের প্রতিক্রিয়া আসে সেটাই দেখার বিষয়।
Leave a Comment
Your email address will not be published. Required fields are marked with *