পূর্ব প্রকাশের পর- -কেন, ছেলেবেলা থেকে পুরুষ মানুষের প্রতি খারাপ ধারনা জন্মানোর কারণ কি? নিশ্চয়ই তারা আপনার সাথে খারাপ ব্যবহার করেছে? -তা বলতে পারেন। একটু কথা বলার জন্য, একটু মেলামেশার জন্য কত জনেই তো কত রকমের ছল চাতুরি করেছে। শুধু আপনাকেই দেখলাম ব্যতিক্রম। আলাপচারিতার মাঝে আরমানের সংকোচ কিছুটা কমে আসে। সে বুঝতে পারে এই মহিলা
পূর্ব প্রকাশের পর-
-কেন, ছেলেবেলা থেকে পুরুষ মানুষের প্রতি খারাপ ধারনা জন্মানোর কারণ কি? নিশ্চয়ই তারা আপনার সাথে খারাপ ব্যবহার করেছে?
-তা বলতে পারেন। একটু কথা বলার জন্য, একটু মেলামেশার জন্য কত জনেই তো কত রকমের ছল চাতুরি করেছে। শুধু আপনাকেই দেখলাম ব্যতিক্রম।
আলাপচারিতার মাঝে আরমানের সংকোচ কিছুটা কমে আসে। সে বুঝতে পারে এই মহিলা বাইরে যতটা শক্ত বর্মে নিজেকে আবৃত করে রাখে, ভেতরের মানুষটা ততটাই কোমলমতি। আরমান কথা ঘোরায়। আপনি তো কলেজে পড়ান। চেনা জানা অনেক লোক আছে। আমার একটা চাকরির ব্যবস্থা করে দিতে পারেন?
-কেন, চিটাগাং-এ থেকে যেতে চান?
-হাঁ।
-কথাটা তো আপনি আব্বুকে বলতে পারেন। তিনি ইচ্ছা করলে- কথা শেষ করে না অনন্যা। আরমানের মুখের দিকে চেয়ে থাকে।
-মামাকে বলতে সাহস হয় না। উনি ব্যস্ত মানুষ। তাছাড়া আমি যে ঝামেলায় আছি।
-শুনেছি আপনার ঝামেলাটা খুব তাড়াতাড়ি মিটে যাবে। পুলিশ আপনার বিরুদ্ধে কোনো তথ্য প্রমান পায়নি।
-আপনি দেখছি আমার সম্পর্কে বেশ খোজ খবর রাখেন।
অনন্যা কথা ঘোরাবার জন্য বলে, সোয়েটারের রঙটা আপনার পছন্দ তো?
আরমান হাঁ না কিছুই বলে না। শুধু হাসে। অনন্যা চোখ কুচকে জিজ্ঞাসা করে, অমন হাসছেন কেন?
-আপনার পাগলামি দেখে।
-পাগলামির কি দেখলেন?
-এই যে সোয়েটার কেনার জন্য-
-এটাতো প্রয়োজনে কিনছি। আপনার একটাই মাত্র সোয়েটার। এই কড়া শীতে আরেকটা দরকার।
আরমান এরপরে আর কথা বলতে পারে না। হঠাৎ করে তার মনটা বিষণ্ন হয়ে যায়। কেনাকাটা শেষ করে ওরা ফিরে আসে। পথে আর তেমন কথা হয় না। গাড়িতে বসে আরমানের শুধু রোজির কথা মনে পড়ে। রোজিও তাকে দেবতার মতো পূজা করে। অথচ সেই রোজির চোখে সে ছোট হয়ে গেলো। হিরো থেকে ডাকু বনে গেলো। জীবনের ওপরে, চরিত্রের ওপরে সাদা কাগজে দোয়াত উল্টে পড়ার মতো এক থ্যাবড়া কালি লেপে গেলো। যে চিহ্ন সারা জীবনেও মুছবে না।
১৭.
সুনাম বাতাসে ছড়ায় ধীরে কিন্তু দুর্নাম দুর্গন্ধের মতোই বাতাস দ্রুত বহন করে নিয়ে যায় দূর থেকে দূরান্তে। যেমন রোজি আরমানের খবরটা তার স্বজনদের না জানালেও তারা ঠিকই সেটা পেয়ে যায়। বড় বোন লিলুফা খবরটা না জেনে ঠিকই ছুটে আসে। বোনের দুঃসময়ের কথা ভেবে ঘরে বসে থাকতে পারে না।
তবে রোজি চায়নি তার স্বামীর এই অপকর্মের খবর তার আত্মীয় স্বজনরা জানুক। এবং তারা গায়ে পড়ে উপদেশ বিলোতে আসুক। তবে লিলুফা যখন এসে পৌছালো তখন রোজি খুশিই হয়েছিল।
ছেলেমেয়েকে খাইয়ে ঘুম পাড়িয়ে অনেক রাতে দুই বোন মুখোমুখি বসেছিল। ছেলেমেয়েদের সামনে বড়আপা আরমানকে নিয়ে কোনো কথাই জিজ্ঞাসা করেনি। রোজিও বলেনি। এখন বড় আপা জিজ্ঞাসা করল, এতদিন হয়ে গেলো আরমান একবারও তোর খোঁজ নেয়নি?
-না।
-ওর আত্মীয় স্বজনদের কাছে খোঁজ নিয়েছিস?
-হাঁ। সে ইন্ডিয়ায় যায়নি।
-তাহলে কোথায় গেছে?
-জানি না। রোজির বুকে দীর্ঘশ্বাস আটকে যায়।
-তুই এখন কি করতে চাস?
-কি আর করবো। কিছুই তো ভেবে পাচ্ছি না।
-আরমান ফিরে না আসা পর্যন্ত তুই একা একা এখানে থাকবি কি করে? তর চেয়ে আমার কাছে চল।
রোজি জবাব দেয় না। অন্ধকারের দিকে চেয়ে বসে থাকে। সময় গড়িয়ে যায়। বড় আপা আবার নিরবতা ভাঙ্গে। মা বাবাও তোর খোঁজ করেনি?
-মাঝে মাঝে মেজোভাই আসে। খোঁজ খবর নিয়ে যায়।
-আর কেউ আসে না?
-না।
-তুই কোনোদিন যাসনি?
-না।
-যেতে ইচ্ছা করে না?
-ওসব কথা থাক বড় আপা। ওসব কথা শুনতে আমার ভালো লাগে না। তুমি আরমানের কথা বলো। ওর কেসটা কিভাবে মিটিয়ে ফেলা যায়, সেই চেষ্টা কর। পারলে ওর একটা খোঁজ এনে দাও।
-আমি মেজো ভাইয়াকে সেই কথাই বলেছিলাম। দেখলাম মেজো ভাইয়া আরমানের ব্যাপারে খুবই বিরক্ত।
-কি বলল মেজো ভাইয়া?
-তার ধারনা আরমান আগের সেই আরমান নেই। সে এখন অনেক বদলে গেছে। সে এখন অন্য জগতের মানুষ।
রোজি দীর্ঘশ্বাস ছাড়ে। তার মানে, তার এই বিপদের দিনে তারা সাহায্যের হাত বাড়াবে না। ঠিক আছে। তদের যা ইচ্ছা তাই করুক। কারো বিরুদ্ধে আমার কোনো অভিযোগ নেই।
-মা বাবা চাইছেন তুই আরমানকে ছেড়ে তাদের কাছে ফিরে যা। তারাই তোর সব দায়িত্ব নেবে।
-বড় আপা তুই ভালো করেই জানিস আমি কখনো আমার সিদ্ধান্ত পালটাই না। আরমানকে যদি ছেড়ে যেতে হয় তাহলে এই ভাবে যাবো কেন, সে ফিরে আসুক। যদি বুঝি তার সাথে থাকা সম্ভব নয় তাহলে সামনা সামনি তাকে গুডবাই জানাবো।
-কবে সে ফিরবে, তার তো কোনো নিশ্চয়তা নেই ।
-সময়টা যত দীর্ঘই হোক সেই পর্যন্ত আমাকে কষ্ট করতে হবে।
-সবঠিক আছে। তাই বলে একা একা-
-একা পথ চলতে আমার ভয় নেই। মা বাবা তো আমাকে ত্যাগ করেছে, তোমরাও যদি তাই কর, সেটা তোমাদের ইচ্ছা। আমি কারো বিরুদ্ধে কোনো অভিযোগ করবো না। আমার নিজের পথে আমি একাই চলবো।
-এত গোয়ার্তুমি করে না বোন। সব মা বাবাই তার সন্তানদের ভালো চায়।
-আমি তা অস্বীকার করছি না। তবে আমার ক্ষেত্রে আমার মা বাবা যা করেছে, তারা আমার প্রতি সুবিচার করেছে বলে আমি মনে করি না। তারা যদি আরমানকে মেনে নিতো তাহলে তো আজ এমনটা হবার কথা ছিল না। আরমান চুরি করুক, ডাকাতি করুক, যা কিছু করেছে আমার জন্য করেছে। আমার ভরণ পোষণের জন্য, আমার সুখের জন্য করেছে।
বড় আপা বুঝে গেলো রোজিকে টলানো যাবে না। সে যেখানে আছে সেখানে থেকে লড়াই করে যাবে। তারপরও সময় সুযোগ মতো তার স্বভাব সুলভ কথাবার্তায় রোজিকে বোঝাতে চেষ্টা করলো। বড় আপা বলল, এখনও সময় আছে, যদি তুই মনে করিস জীবনের গতিধারা পাল্টে ফেলবি, তাও করতে পারিস। সেক্ষেত্রে, মা বাবা ভাই বোন সবাই তার পাশে এসে দাঁড়াবে।
রোজি হাসলো। একটু ভেবে বলল, চিন্তা করিস না। তেমন যদি করতে হয়, আমিই তোদের বলবো।
বড় আপা রোজির উত্তরে সন্তুষ্ট হতে না পারলেও, রোজিকে আর ঘাটালো না। রোজির মনোভাব বুঝতে পেরে অবশেষে রণে ভঙ্গ দিয়ে নিজ ঘরে ফিরে গেলো। বড় আপা চলে যাওয়ায় রোজিও যেন হাফ ছেড়ে বাঁচল। সারাক্ষণ কানের কাছে ঘ্যানর ঘ্যানর রোজির মোটেও ভালো লাগছিল না।
সেদিন সকালবেলা আকাশ ভেঙ্গে বৃষ্টি নামলো। যাকে বলে মুষলধারে বৃষ্টি। রোজি সকালের যাবতীয় কাজ গোছালো। রান্না করলো। জয়কে গোসল করালো। খাওয়ালো। তারপর জয়কে নিয়ে নিচে নেমে এলো। অঞ্জনা বৌদির ঘরের দরোজায় কড়া নাড়লো।
বৌদি দরোজা খুলে বাইরে মুখ বাড়ালো। রোজিকে দরোজায় দাঁড়ানো দেখে বলল, এই বৃষ্টি মাথায় কোথায় বের হচ্ছিস?
-স্কুলে যেতে হবে না?
-এই বৃষ্টি মাথায় কি ছেলেমেয়েরা স্কুলে আসতে পারবে?
-ছেলে মেয়েরা আসতে পারুক না পারুক শিক্ষক শিক্ষয়িত্রিদের যেতে হবে।
-তাহলে একটু দেরি কর। বর্ষাটা একটু কমে এলে তারপর বের হোবি।
অঞ্জনা বৌদির কথাই ঠিক। বৃষ্টি আবার ঝেপে এলো। এই অবস্থায় বাড়ির বাইরে বের হলে নির্ঘাত ভিজতে হবে। অঞ্জনা বৌদির উনুনে তরকারী ফুটছিল। সে কথা বলতে বলতে সোজা কিচেনে গেলো। রোজি বৌদিকে অনুসরণ করলো। বৌদি বলল, কাল রাতে আরমান ফোন করেছিল।
কথাটা শোনার পরেই রোজির বুকের মধ্যে ছ্যাৎ করে উঠলো। কোনো প্রশ্ন না করে রোজি তার ডাগর ডাগর চোখের তারা ঘুরিয়ে অঞ্জনা বৌদির মুখের পানে ফ্যাল ফ্যাল করে চেয়ে রইলো। বৌদির পরের কথাগুলো শোনার জন্য কান সজাগ রাখলো।
অঞ্জনা বৌদি তরকারী নাড়তে নাড়তে রোজির মুখের পানে চেয়ে তার ব্যাকুল চাহনি দেখে থমকে গেলো। নিজেকে সামলে নিয়ে বলল, সে বাংলাদেশেই আছে। ভালো আছে। কেসের জন্যই তাকে আত্মগোপন করে থাকতে হয়েছে। কেসের একটা সুরাহা হয়ে গেলেই ঘরে ফিরে আসবে। ততদিন তুই যেন একটু কষ্ট করে- কথা শেষ করে না বৌদি। তরকারী নামাতে ব্যস্ত হয়ে পড়ে।
রোজি জিজ্ঞাসা করে, আর কিছু বলেনি?
-হড়বড় করে কত কথাই তো বলল। সব কি আমার মনে আছে ছাই।
-আমাকে ডেকে দিতে বলেনি?
-না। আমিই তো বললাম তুমি অপেক্ষা কর। আমি রোজিকে ডেকে দিচ্ছি। ও বলল, না বৌদি। ওকে ডেকো না। এই অবস্থায় আমি ওর সাথে কথা বলতে পারবো না। ও আমার সাথে ঝগড়া করবে, কান্নাকাটি করবে। আমার খারাপ লাগবে। তার চেয়ে তুমি ওকে একটু বুঝিয়ে বোলো।
তাই আমি আর তোকে ডাকিনি।
-ভালো করেছ।
রোজি জয়কে বৌদির জিম্মায় রেখে বেরিয়ে পড়লো। এখন বৃষ্টি থেমেছে। তবে আকাশে নতুন করে মেঘ জমছে। বাতাস থেমে গেছে। অচিরেই যে আবার ঝমঝম করে বৃষ্টি নামবে, এটা যেন তারই পূর্বাভাস। রোজি রিকসায় উঠে বসলো। রিকসায় বসে ভাবতে লাগল, লোকটা দূরে গিয়েও ভালো নেই। নিজের কৃতকর্মের জন্য আত্মশ্লাঘায় জরজরিত হচ্ছে। আমার মুখোমুখি দাঁড়াতেও সাহস পাচ্ছে না।
মানুষটার সব ভালো। তবে অত্যন্ত সন্দেহ প্রবন। তার পাশে অন্য কাউকে সহ্য করতে পারে না। স্ত্রীর প্রতি তার বিশ্বাস কেন যে এত পলকা ভেবে পায় না রোজি।
আরমানের কথা ভাবতে ভাবতে রোজির বুকের ভেতরে পিনপিন করে ব্যাথা ওঠে। কষ্ট। বড্ড কষ্ট। রিকসার তুলে দেওয়া হুটের গায়ে মাথা এলিয়ে দিয়ে উপচে আসা কান্নাকে রোধ করার চেষ্টা করে।
চলবে….
Leave a Comment
Your email address will not be published. Required fields are marked with *