এম,এ ইউসুফ শামীম: মার্শাল আর্ট চ্যাম্পিয়ন ও গোল্ড মেডেলিস্ট দ্বীনের দাঈ তাজুল ইসলাম ১৪ই অক্টোবর ২০২৪, সোমবার, সকাল ৯:৩০ মিনিটে সিডনির কনকর্ড হাসপাতালে শেষ নিশ্বাস ত্যাগ করেন। ইন্না লিল্লাহি ওয়া ইন্না ইলাইহি রাজিউন। মৃত্যুকালে তার বয়স হয়েছিল ৫৯ বছর ৬ মাস ১২ দিন। তিনি চার ছেলে ও এক মেয়ে, পাশাপাশি অসংখ্য বন্ধু-বান্ধব এবং শুভাকাঙ্ক্ষী রেখে
এম,এ ইউসুফ শামীম: মার্শাল আর্ট চ্যাম্পিয়ন ও গোল্ড মেডেলিস্ট দ্বীনের দাঈ তাজুল ইসলাম ১৪ই অক্টোবর ২০২৪, সোমবার, সকাল ৯:৩০ মিনিটে সিডনির কনকর্ড হাসপাতালে শেষ নিশ্বাস ত্যাগ করেন। ইন্না লিল্লাহি ওয়া ইন্না ইলাইহি রাজিউন। মৃত্যুকালে তার বয়স হয়েছিল ৫৯ বছর ৬ মাস ১২ দিন। তিনি চার ছেলে ও এক মেয়ে, পাশাপাশি অসংখ্য বন্ধু-বান্ধব এবং শুভাকাঙ্ক্ষী রেখে গেছেন।
সদা হাস্যোজ্জ্বল এই দ্বীনের দাঈ সিডনির সারিহিলস মসজিদের সামনেই বসবাস করতেন প্রথম জীবনে। পরিচিত বা অপরিচিত, যেকোনো মানুষ তার প্রতিদিনের মেহমান ছিলেন। বিশেষ করে জুম্মার দিনে, নামাজের শেষে তিনি মুসুল্লিদের ধরে ধরে বাসায় নিয়ে দস্তরখানে বসিয়ে দিতেন। এক গ্রুপ খাবার শেষ হলে, তিনি অন্য গ্রুপের সন্ধানে মসজিদে চলে যেতেন। এভাবে সারাদিনব্যাপী চলত তার খেদমত। এ যেন নবী ইব্রাহিম (আ.) এর সত্যিকার অনুসারী। তিনি কখনো মেহমান ছাড়া খাবার খেতেন না; প্রথমে মেহমান জোগাড় করতেন, তারপর দস্তরখানে বসতেন।
বিবাহিত জীবনে তিনি অস্ট্রেলিয়ার অন্যতম মুসলমান অধ্যুষিত এলাকা সিডনির ল্যাকেম্বায় চলে আসেন। এই এলাকায় মসজিদের সংখ্যা এত বেশি যে, তা অস্ট্রেলিয়ার অন্য কোথাও নেই। তাছাড়া, আরব বিশ্বের বিভিন্ন দেশ থেকে আগত হাজারো ধর্মপ্রাণ ভাই-বোন এখানে শান্তিপূর্ণভাবে বসবাস করেন। ল্যাকেম্বায় আমাদের বাংলাদেশী কমিউনিটির সংখ্যাও চোখে পড়ার মতো বেড়ে গেছে।
ল্যাকেম্বায় রয়েছে হালাল রেস্তোরাঁসহ রকমারি খাবারের দোকান, হালাল গোশতের দোকান এবং বিভিন্ন ধরনের হালাল ফাস্ট ফুডের দোকান। এর ফলে অনেকেই দূরদূরান্ত থেকে শপিং বা একবেলা হালাল খাবারের উদ্দেশ্যে ল্যাকেম্বায় আসেন। মুসলমান দেশের বাহারি ফ্যাশনের কাপড়ের দোকানও এখানে অন্য এক মাত্রা যোগ করেছে।
কুরআনিক সোসাইটি বা ল্যাকেম্বা মসজিদে তিনি বেশিরভাগ ওয়াক্তের নামাজ আদায় করতেন। দেশি বা ভিনদেশি, সকলের সঙ্গে তার ছিল অত্যন্ত সুসম্পর্ক। তাজুল ইসলাম ছিলেন একজন সদালাপী, মিষ্টভাষী ও অমায়িক মানুষ, যার জন্য সবাই তাকে পছন্দ করতেন।
প্রায় ৩ বছর আগে হঠাৎ তার স্ত্রীর ইন্তেকাল হলে মরহুম তাজুল ইসলাম অত্যন্ত ভেঙে পড়েন। তিনি ৪ ছেলে ও ১ মেয়ের মধ্যে ২ ছেলের বিয়ে দিয়েছেন, কিন্তু বাকি ২ ছেলে ও ১ মেয়ের এখনও অবিবাহিত। নিকট আত্মীয়-স্বজনের অভাব থাকলেও কিছু বন্ধু রয়েছে, কিন্তু সবাই ব্যস্ত এ যান্ত্রিক জীবনে। তার রেখে যাওয়া অনাথ ছেলে-মেয়েদের দায়িত্ব কে নেবে? কারোরই সময় নেই; সবাই দৌড়ের উপর।
তাজুল ইসলাম একজন সঠিক দায়ী ছিলেন। যতই ক্লান্ত থাকুক, দ্বিনের দাওয়াত দিতে বললে সঙ্গে সঙ্গে “আমি তৈয়ার আছি” বলে হাত উঁচিয়ে ঘোষণা করতেন। তিনি মানুষের জন্য প্রচুর খেদমত করেছেন। তার হাতের খাবার খায়নি, এমন কথা হয়তো তাজুল ইসলামের শত্রুও বলতে পারবে না। প্রতি শুক্রবার, নিজের খরচে বিশাল পাতিলে বিরিয়ানি রান্না করে ল্যাকেম্বার বড় মসজিদে নিয়ে যেতেন। বয়ান শেষ হলে, সবাইকে দস্তরখানে বসিয়ে নিজ হাতে খাবার পরিবেশন করতেন।
অতঃপর, ল্যাকেম্বা মুসল্লায় খেদমত শুরু করেন। অসুস্থ হওয়ার পরেও খেদমত ছাড়েননি। বুধবারের মাশোয়ারার দিন, তিনি বড় ফ্লাস্কে চা বানিয়ে ল্যাকেম্বা নিয়ে যেতেন এবং আগত মেহমানদেরকে চা ও বিস্কুট দিয়ে আপ্যায়ন করতেন। খেদমতের জন্য তার নাম স্বর্ণাক্ষরে লেখা থাকবে। কখনো তার কষ্ট ছিল না, টায়ার্ড ছিলেন না; বিরতিহীনভাবে দীর্ঘদিন ধরে তিনি এ খেদমত করে গেছেন।
দেশ-বিদেশের বিভিন্ন জায়গায় ঘুরে ঘুরে দাওয়াতের কাজ করেছেন তিনি। সমগ্র বিশ্বে দাওয়াত ও তাবলীগের কাজে দ্বারে দ্বারে বারে বারে গিয়েছেন। আল্লাহর দ্বীনের ফেরি করে বেড়িয়েছেন এবং আল্লাহর হুকুম ও আমাদের শেষ নবী হজরত মুহাম্মদ (সা.) এর জীবনাদর্শ অনুসরণ করে দুনিয়া ও আখিরাতে একমাত্র শান্তি ও চিরস্থায়ী কামিয়াবী লাভের সত্যটি তিনি পুরোপুরি উপলব্ধি করেছিলেন।
এ কারণে, তার ব্যক্তিগত জীবনেও এটি স্পষ্ট প্রতিফলিত হয়েছে। শুধু নিজে নয়, তার পরিবারকে দ্বীনের উপর বহাল রাখার জন্য সর্বদা চেষ্টা করেছেন। প্রতিটি ছেলেকে নিয়ে দ্বীনের রাস্তায় বহুবার সফর করেছেন। তাজুল ইসলামের প্রচেষ্টা বিফলে যায়নি; তিনি একমাত্র মেয়েকে ফুল টাইম মাদ্রাসায় পবিত্র কোরআন শরীফ হেফ্জ করার জন্য দিয়েছেন। মেয়ে মায়ের মতো পর্দানশীল এবং নিকাব পরিধান করেন। প্রত্যেক ছেলের মুখে দাঁড়ি রয়েছে, যা অস্ট্রেলিয়ার মতো দেশে বিরল, এবং এটি সম্ভব হয়েছে তাজুল ইসলামের চেষ্টা ও মেহনতের ফলে।
তাজুল ইসলামের সুখের সংসার ভালোই চলছিল, কিন্তু হঠাৎ করে আল্লাহর পরীক্ষা চলে এল। তার স্ত্রী অসুস্থ হয়ে সিডনির কনকর্ড হাসপাতালে ভর্তি হলেন। একদিন আল্লাহর ডাকে সাড়া দিয়ে চলে গেলেন। এরপর থেকে শুরু হলো পরিবারের একের পর এক পরীক্ষা। স্ত্রীর ইন্তেকালের কারণে তাজুল ইসলামের মন সব সময় খারাপ থাকতো। প্রায় প্রতিদিন রকউড কবরস্থানে স্ত্রীর কবরের পাশে বসে দীর্ঘক্ষণ পবিত্র কোরআন থেকে তিলাওয়াত করতেন।
দিবসের অনেক সময় কাটাতেন মরহুম স্ত্রীর শিয়রের কাছে। সেখানে ছোট একটি ভাঁজ করা চেয়ার নিয়ে গিয়ে লম্বা সময় পবিত্র কোরআন, জিকির-আজগার এবং দোয়া করে খুশি মনে মসজিদে ফিরতেন। কোনো কারণে কবরস্থানে না গেলে মন খারাপ করতেন এবং আফসোস করতেন। এভাবে অনেক সময় কেটে যায়।
হঠাৎ এক সকালে তার ছোট ছেলের ফোন আসে। ছেলে আমাকে বলে, “আংকেল, বাবা কথা বলছেন না।” আমি জিজ্ঞেস করলাম, “মানে কি?” ছেলে বলে, “অনেক সময় ধরে আমাদের দিকে চেয়ে আছে, চোখ দিয়ে পানি ঝরছে, কিন্তু কথা বলছেন না।” আমি জানতে চাইলাম, “জ্ঞান আছে? নিঃশ্বাস নিচ্ছে?” ছেলে জানায়, “জি, নিশ্বাস নিচ্ছে।” আমি বললাম, “শীঘ্রই হাসপাতালে ফোন করো।” কে জানতো, এটাই ছিল তার জীবনের ইতি টানার প্রথম সোপান।
অনেকদিন, অনেক মাস ধরে তার চিকিৎসা চলে। ডাক্তাররা তেমন কোনো রোগ খুঁজে পায়নি। সকল ধরনের চেক-আপ করে ডাক্তাররা আশ্চর্য হয়ে যায়। কোনো রোগ নেই, তবে তিনি অসুস্থ। দীর্ঘদিন হাসপাতালে থাকার পর তাজুল ইসলাম বাসায় ফিরে যাওয়ার জন্য পাগলপ্রায় হয়ে ওঠেন। জনে জনে ফোন করে নালিশ করতে থাকেন—”আমাকে আটকিয়ে রাখা হয়েছে হাসপাতালে, আমাকে নিয়ে যান”—এমন ধরনের কথা বলেন। তার অনেক বন্ধুরা আমাকে ফোন করে বিভিন্নভাবে সত্য উদ্ঘাটনের চেষ্টা করেন।
ডাক্তাররা চান, তাজুল ইসলাম সম্পূর্ণ সুস্থ হলে তাকে হাসপাতাল থেকে ছাড়তে। আমরা জানি -অস্ট্রেলিয়ার নাগরিকদের জন্য চিকিৎসা সম্পূর্ণ ফ্রি। কোনো অস্ট্রেলিয়ান নাগরিক অসুস্থ হলে, তার পূর্ণাঙ্গ চিকিৎসা হয়ে গেলে এক মুহূর্তও হাসপাতালে রাখা হয় না। আমাদের দেশে এর উল্টো, যেখানে অতিরিক্ত একদিন হাসপাতালে রাখা হলে এক্সট্রা বিল আদায় করা হয়, তাই অনেকের অভিযোগ—অসৎ ডাক্তাররা ইচ্ছেকরেই রোগীকে দেরি করে ছাড়েন।
একসময় দেখা গেল, ডাক্তারদের কিছু না বলে ক্যান্টারবুরি হাসপাতাল থেকে ইউনিফর্ম পরে চলে গেলেন। কর্তৃপক্ষ পুলিশকে জানালে তাৎক্ষণিক পুলিশের টহল টিম বের হয় তাকে খোঁজার জন্য। অবশেষে রাস্তায় তার দেখা পেয়ে যায়, ল্যাকেম্বার হেলডন স্ট্রিটের বাসার দিকে হেঁটে যাচ্ছিলেন। পুলিশ তাকে সম্মানের সঙ্গে আবার হাসপাতালে পৌছিয়ে দেন। এরপর থেকে ২৪ ঘণ্টা একজন নার্স নিযুক্ত করে তার দেখভালের জন্য।
আমরা তাকে বাসায় নিয়ে যাওয়ার জন্য ব্যাকুল হয়ে উঠেছিলাম। তিনি আমাদের সঙ্গে বাসায় যেতে চাইতেন, কিন্তু অনেক বুঝিয়েও যখন কাজ হয়নি, তখন আমরা কৌশলে সটকে পড়তাম। নিজেদের কাছে খুব খারাপ লাগতো, কিন্তু করণীয় ছিল না। তার সুচিকিৎসাই ছিল আমাদের প্রাথমিক লক্ষ্য।
ডাক্তার যখন ৩/৪ মাসের জন্য বেইলমেইনের বিশেষ হাসপাতালে পাঠানোর চিন্তা করেন, তাজুল ইসলাম তাতে ভেটো দেন। তার ছেলে-মেয়ে বিশেষ মুচলেকা দিয়ে তাকে ক্যান্টারবুরি হাসপাতাল থেকে রিলিজ করে বাসায় নিয়ে যান।
কিছুদিন কেটে যায়, অসুস্থতার লক্ষণ আবারও দেখা দিতে শুরু করে। মাঝে মাঝে তিনি চিৎকার করে উঠতেন। হাসি-খুশির সময় হঠাৎ করে বিকট চিৎকার করতে থাকতেন। এর মধ্যেই তিনি বাংলাদেশে বেড়াতে যান; কে বা কারা তাকে বিভিন্ন প্রলোভন দেখিয়ে টিকিট করে দেয়, বলে ছেলে-মেয়েরা অভিযোগ করে। দেশ থেকে ফিরে এসে তিনি বেশ ফুরফুরে মেজাজে ছিলেন।
মেয়ের বিয়ের জন্য একজন ভালো পাত্র খুঁজতে থাকেন। তার অনুরোধে আমিও চেষ্টা করতে থাকি অস্ট্রেলিয়ার বিভিন্ন প্রদেশে। স্থায়ীভাবে বসবাসরত হাফেজ, আলেম বা মাওলানা ছিল তার প্রথম পছন্দ।
তাজুল ইসলাম পুনরায় অসুস্থ হয়ে কনকর্ড হাসপাতালে ভর্তি হন এবং আইসিইউতে চলে যান। দিন দিন তার অবস্থার অবনতি হতে থাকে। একসময় তার জবান বন্ধ হয়ে যায় এবং খুব ঘনিষ্ঠদেরকেও চিনতে পারেন না। কেউ গেলে শুধু কান্না করতেন এবং বাইরে যেতে চাইতেন। ডাক্তাররা অনেক চিকিৎসা করেও কোন ফল পাননি; অবশেষে এমআরআই করেন, কিন্তু তাতেও কিছু মেলে না। ডাক্তার আমাকে জিজ্ঞেস করেন, “কোনো জটিল রোগ ছিল কিনা অথবা কোনো প্রাণীর সংস্পর্শে গিয়েছেন কিনা ?” সদ্য বাংলাদেশ ফেরত তাজুল ইসলাম প্রাণীর সংস্পর্শে ছিলেন কিনা, সে বিষয়ে আমি নিশ্চিত ছিলাম না।
ডাক্তাররা বোর্ড মিটিং করে কোনো সিদ্ধান্তে পৌঁছাতে পারলেন না। একদিন পারিবারিক মিটিংয়ে আমিও হাজির হলাম। যেহেতু তাজুল ইসলামের সিডনিতে কোনো আত্মীয়-স্বজন ছিল না, তাই মুরুব্বি হিসেবে মিটিংয়ে যোগ দিতে অনুরোধ করা হলো। ডাক্তাররা কোনভাবেই চিকিৎসা চালাতে রাজি নয় এবং জানালো যে তাজুল ইসলামের অবস্থার ক্রমাগত অবনতি হচ্ছে, যা মৃত্যুর দিকে ঠেলে নিয়ে যাচ্ছে। ছেলেরা বহু চেষ্টা করেও ডাক্তারদের কাছে বিনীতভাবে অনুরোধ করেও ব্যর্থ হয়; অবশেষে শুক্রবার সন্ধ্যা আনুমানিক ৬ টায় লাইফ সাপোর্ট খুলে দেওয়া হয়। তখনও তিনি নিশ্বাস নিচ্ছিলেন, কিন্তু কষ্ট হচ্ছিল।
ছেলে-মেয়ে পালা করে বাবার শিয়রে কালিমার তালকিন করতে থাকলেন। সোমবার আনুমানিক সকাল ৯:৩০ মিনিটে আল্লাহর ডাকে সাড়া দিয়ে তিনি ইন্তেকাল করেন। মুহূর্তেই এ দ্বীনের দাঈর ইন্তেকালের সংবাদ সমগ্র অস্ট্রেলিয়ায় ছড়িয়ে পড়ে। বাংলাদেশী ছাড়াও বিভিন্ন ভাষাভাষীর মুসলমানেরা জানাজায় শরিক হন।
Leave a Comment
Your email address will not be published. Required fields are marked with *