সামসুল ইসলাম টুকু : ইতিহাস ছাড়া কোনো জাতি হয়না । সেটাও সুনির্দিষ্ট একটি ইতিহাস হতে হয়, বাংলাদেশ ভূমির পূর্বের ইতিহাসগুলো মোটামুটি সর্বজন গ্রাহ্য হিসেবে স্বীকৃতি পেয়েছে। কিন্তু ৫০ বছরের অধিক সময় পার হয়ে গেলেও বাংলাদেশ এর স্বাধীনতার সঠিক ও সুনির্দিষ্ট ইতিহাস আজও রচিত হয়নি । সেজন্য আজও আমরা একটি ইতিহাসের অনুসারী নই। আমরা বিভক্ত ।
সামসুল ইসলাম টুকু : ইতিহাস ছাড়া কোনো জাতি হয়না । সেটাও সুনির্দিষ্ট একটি ইতিহাস হতে হয়, বাংলাদেশ ভূমির পূর্বের ইতিহাসগুলো মোটামুটি সর্বজন গ্রাহ্য হিসেবে স্বীকৃতি পেয়েছে। কিন্তু ৫০ বছরের অধিক সময় পার হয়ে গেলেও বাংলাদেশ এর স্বাধীনতার সঠিক ও সুনির্দিষ্ট ইতিহাস আজও রচিত হয়নি । সেজন্য আজও আমরা একটি ইতিহাসের অনুসারী নই। আমরা বিভক্ত । এই বিভক্তি যতটা না রাজনৈতিক তার চেয়ে বেশি ঐতিহাসিক। শেখ হাসিনার আমলের দীর্ঘ ১৫ বছরে যে ইতিহাস রচিত হয়েছে তা অসত্য ও দলীয় বয়ানে ভরপুর । আর সেই ইতিহাস পড়েছে ১৫ বছর থেকে ২৫ বছর বয়সী নতুন প্রজন্ম ।খুব স্বাভাবিক কারণে উল্লিখিত ইতিহাসের সংস্কৃতি বহন করে চলেছে এই প্রজন্ম । যা তাদের মন থেকে সহজে মুছে দেয়া সম্ভব নয় । শেখ হাসিনা অত্যন্ত বুদ্ধিমত্তার সাথেই সেই প্রজন্মের জন্য দলীয় বয়ানসহ অসত্য ইতিহাস পাঠ্য বই রচনা করে পড়তে বাধ্য করেছেন । শুধু তাই নয়, তৎকালীন প্রিন্ট ও ইলেন্ট্রনিক মিডিয়ায় জোরেসোরে প্রচার করিয়েছেন, পাশাপাশি সাংস্কৃতিক অঙ্গনেও একই ইতিহাস ছড়িয়েছেন । এখানেই থেমে থাকেননি, প্রশাসনকেও সভা সমাবেশে বলতে ও গুণকীর্তন করতে বাধ্য করেছেন । তার বাবাকে জাতির পিতা হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করার জন্য আইন ও সংসদকে ব্যবহার করেছেন । জনগণের কোটি কোটি টাকা অপচয় করে জেলায় উপজেলায় তার পিতার হাজারো মূর্তি প্রতিষ্ঠিত করে জনগণের মনে প্রভাব ফেলার চেষ্টা করেছেন ।
শেখ হাসিনার পিতা শেখ মুজিবুর রহমান একজন জনপ্রিয় নেতা ছিলেন তাতে সন্দেহের অবকাশ নেই। তিনি তার জ্বালাময়ী ভাষণ দিয়ে গণজাগরণ সৃষ্টি করেছিলেন । ছয়দফা তথা স্বায়ত্ব শাসনের দাবিতে মানুষকে উদ্বুদ্ধ করেছিলেন, পশ্চিম পাকিস্তানের শোষণ ও শাসনের বিরুদ্ধে সোচ্চার করেছিলেন । এই গণজাগরণের অংশ হিসেবে ১৯৬৯ সালে গণভ্যুথান হয় এবং ১৯৭০ সালের নির্বাচনে আওয়ামী লীগ জনগণের রায় পেয়ে নির্বাচিত হয় । কিন্তু পাকিস্তান এর সেনা সরকার বিজীত আওয়ামী লীগকে ক্ষমতা হস্তান্তর না করায় আন্দোলন শুরু হয় । আর ক্ষমতা হস্তান্তরের নামে পাকিস্তান সরকার প্রতারণা চালাতে থাকে । শেখ মুজিবুর রহমান ৭ মার্চের ভাষণ দিয়ে পাকিস্তান সরকারকে হুমকি প্রদান করলেন । কিন্তু কাজ হলোনা । তারপরেও শেখ মুজিবুর রহমান আলোচনা অব্যাহত রাখলেন ।
এদিকে জনতার মনে স্বাধীনতার আকাঙ্ক্ষা তীব্র থেকে তীব্রতর হতে থাকলো । প্রেক্ষিতে তাজউদ্দিন দলের নেতাকর্মীসহ ২৫ মার্চ হাজির হলেন শেখ মুজিবের কাছে । সই চাইলেন স্বাধীনতার ঘোষণাপত্রে । কিন্তু শেখ মুজিবুর রহমান তখনও অবিভক্ত পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী হওয়ার স্বপ্ন দেখছিলেন । তাই স্বাধীনতার ঘোষণাপত্রেসই দিলেননা । বললেন এই ঘোষণাপত্রে সই দিলে তাকে রাষ্ট্রদ্রোহী হিসেবে চিহ্নিত করবে পাকিস্তান সরকার আর তাজউদ্দিন গংকে বললেন নাকে তেল দিয়ে ঘুমাওগে , আগামী ২৭ মার্চ হরতাল পালিত হবে । কিন্তু ২৬ মার্চ শেখ মুজিবুর রহমান জেনে বুঝে নিরস্ত্র জনগণকে অরক্ষিত রেখে পাক সেনাদের হাতে ধরা দিলেন এবং পাকিস্তানের কারাগারে বন্দি হলেন
এদিকে জনতার স্বাধীনতার আকাঙ্ক্ষার পাশাপাশি মেজর জিয়াউর রহমান মৃত্যু নিশ্চিত জেনেও তার বেঙ্গল রেজিমেন্টসহ বিদ্রোহ ঘোষণা করলেন এবং একইসাথে স্বাধীনতার ঘোষণা দিলেন। পর্যায়ক্রমে অন্যান্য বেঙ্গল রেজিমেন্ট গুলোও বিদ্রোহ ঘোষণা করলো । ফলে জনগণের স্বাধীনতার আকাঙ্ক্ষা নতুন মাত্রা যোগ হলো । এরপর তাজউদ্দিনের নেতৃত্বে দীর্ঘ ৯ মাসের মুক্তি যুদ্ধ এবং বহু কাঙ্ক্ষিত স্বাধীনতা এলো । এই স্বাধীনতা যুদ্ধের সাথে শেখ মুজিবুর রহমানের কোনো সম্পর্ক ছিলনা। যেমন তিনি স্বাধীনতার ঘোষক নন তেমনি নেতৃত্বও দেনিনি । স্বাধীনতার পরে ১০ এপ্রিল তিনি পাকিস্তান কারাগার থেকে মুক্ত হয়ে লন্ডন হয়ে দেশে ফিরলেন । প্রথমেই তিনি প্রেসিডেন্ট থেকে প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্ব নিলেন তাজউদ্দিনের কাছ থেকে । দেশপ্রেমিক তাজউদ্দিন সেদিন ক্ষমতা ত্যাগ না করে ষড়যন্ত্র করতে পারতেন যেমনটা খন্দকার মোস্তাক করেছিলেন । শেখ মুজিব এতে ক্ষান্ত হলেননা তাজউদ্দিন যে দীর্ঘ ৯ মাস স্বাধীনতা যুদ্ধের নেতৃত্ব দিলেন তার নামটি পর্যন্ত মুছে দিলেন । সেনাবাহিনীকে নিরাপদ না মনে করে সমান্তরাল সেনাবাহিনী হিসেবে রক্ষীবাহিনী গঠন করলেন । রক্ষীবাহিনী দিয়ে হত্যা খুন ধর্ষণ চালিয়ে গোটা দেশে ত্রাস সৃষ্টি করলেন । ১৯৭৩ সালের নির্বাচনে হেলিক্যাপ্টরে করে নির্বাচনে কারচুপি করলেন ,১৯৭৪ সালে দুর্ভিক্ষ ডেকে আনলেন । এরপর রক্ষীবাহিনী কর্তৃক যত গুম ,খুন ধর্ষণ সহ সব অপকর্মকে চাপা দেওয়ার জন্য ১৯৭৪ সালে ইন্ডেমনিটি বিল বা দায়মুক্তি আইন পাশ করলেন। সেটাই ছিল বাংলাদেশে প্রথম দায়মক্তি আইন এবং এই অগণতান্ত্রিক চর্চা শুরু করে আওয়ামী লীগ । ক্ষমতাকে নিরঙ্কুশ করার জন্য প্রধানমন্ত্রী থেকে প্রেসিডেন্ট হলেন । এতেও তার স্বাদ মিটলনা , তিনি গণতন্ত্রের কবর দিয়ে একদলীয় ব্যবস্থা বাকশাল প্রতিষ্ঠিত করলেন । এমন একজন বিতর্কিত মানুষকে আদৌ জাতির পিতা হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়া যায় কি ? অথবা আদৌ তার যোগ্য কি?
বর্ণিত ইতিহাস্টুকু যে লেখা হয়নি তা নয় । যেমন মইদুল হাসানের মূলধারা ,একে খন্দকারের মুক্তিযুদ্ধের পুর্বাপর কথোপকথন ,মতিউর রহমান রেন্টুর আমার ফাঁসি চাই ,মেজর জলিল ,মেজর ডালিম , তাজউদ্দিন কন্যা শারমিন আহামেদ এর লেখায় এই সত্যগুলো বেরিয়ে এসেছে । বের হয়ে এসেছে বাম ঘরানার লেখকদের বইয়ে । কিন্তু সেগুলো গুটি কয়েক বুদ্ধিজীবী পড়েছেন মাত্র । তা মূলত কালো কালির শৃঙ্খলে বন্দি থেকে গেছে । নতুন প্রজন্মের জানা , পড়া ও শেখার মত করে কোনো ইতিহাস প্রকাশিত হয়নি । স্কুল কলেজের পাঠ্য বইয়ে সংক্ষিপ্ত আকারে এই সত্য ইতিহাস লেখা হয়নি । বিভিন্ন ভয় ভীতি ও প্রতিবন্ধকতার কারণে হয়তো লেখা সম্ভব হয়নি । কিন্তু এই ঐতিহাসিক দায়িত্ব তো কাউকে নিতে হবে । বর্তমান সরকার তো এই দায়িত্ব নিতে পারে । জানিনা তারা এ দায়িত্ব নেবে কিনা ? হাসিনার তৈরি করা অসত্য ইতিহাস সংস্কৃতি মুছে দিতে হবে দ্রুত । সদ্য প্রকাশিত দৈনিক আমার দেশও এ ব্যাপারে ভূমিকা নিতে পারে । আগামীতে ক্ষমতায় আসার জন্য সম্ভাব্য একটি রাজনৈতিক দল বিএনপি । ক্ষমতায় এলে তারাও ইতিহাসের এই গুরুত্বপূর্ণ কাজটি করতে পারে । বিএনপি একটি বৃহৎ দল হিসেবে কয়েকদফা ক্ষমতায় থাকার পরেও এই সত্য ইতিহাস লেখার প্রয়োজনীয়তা অনুভব করেনি । এখানেই বিএনপির সবচেয়ে বড় ব্যর্থতা । অবশ্য ঐ দলে আওয়ামী পন্থি বিএনপি থাকা এর একটি কারণ । শুধু তাইনয় কয়েকদফা ক্ষমতায় থাকার পরেও তারা নিজস্ব প্রিন্ট ও ইলেকট্রনিক মিডিয়া গড়ে তুলতে পারেনি। যার মাধ্যমে এই সত্য ইতিহাসকে নতুন প্রজন্মসহ আম জনতার কাছে পৌঁছে দিতে পারে । সময় এসেছে আওয়ামী লীগের দেওয়া অসত্য ও দলীয় বয়ান ভরা ইতিহাসের স্ংস্কৃতিকে ১৫ থেকে ২৫ বছর বয়সী নতুন প্রজন্মের মন থেকে মুছে ফেলার । এর কোনো বিকল্প নেই । ইতিহাসে যার যতটুকু প্রাপ্য সম্মান বা অবদান তা দিতে হবে । দলীয় বয়ান একেবারে নিষ্প্রয়োজন । তাহলেই সত্যের সংস্কৃতি ফিরে আসবে । এই নৈতিক দায়িত্ব পালন করতে পারলে বিএনপির ইতিহাস স্বর্ণাক্ষরে লেখা থাকবে । ইতিহাস বিভ্রান্তি থেকে মুক্ত হবে গোটা জাতি ।
Leave a Comment
Your email address will not be published. Required fields are marked with *