মিথ্যা, মিথ্যাবাদী, শাস্তির বিধান ও বাস্তবতা

সামসুল ইসলাম টুকু : “মিথ্যা” একটি বিশেষণ। এর আভিধানিক অর্ধ হচ্ছে অসত্য, অযথার্থ, অমূলক, কল্পিত, নিষ্ফল, অনর্থক, অকারণ, কপট ইত্যাদি। যা করা হয়নি, বলা হয়নি, ঘটেনি তা বলাই মিথ্যা বলা। ধর্মীয় বিধান অনুযায়ী মিথ্যা বলা প্রতিশ্রুতি ভঙ্গ  করা এবং আমানতের খেয়াতন করা মুনাফিকের কাজ। আবার বলা হয়েছে মিথ্যা বলা কবিরা গুনাহ্। অভিধান ও ধর্মীয় বিধান মিথ্যাকে পরিপূর্ণ নেতিবাচকভাবে ব্যাখ্যা করলেও কেউ কেউ বলেন, মিথ্যা বলা একটি আর্ট বা কলা।

মিথ্যার রকমফের

জার্মানীর রাজনীতিবিদ এবং ১২ বছরের পাবলিক এনলাইটমেন্ট এন্ড প্রপাগান্ডা মন্ত্রী জোসেফ গোয়েবলস  বলতেন একটা মিথ্যাকে বার বার বললে তা সত্যের রূপ লাভ করে। বর্তমানে এরই প্রতিযোগিতা চলছে জোরে সোরে। এখন আমরা অকারণে মিথ্যা বলতে পারদর্শী হয়ে উঠেছি। কোন প্রলোভন ছাড়া বিনে পয়সায় মিথ্যা বলি। রম্য লেখক সৈয়দ মুজতবা আলীর লেখা ‘দেশে বিদেশে’ উপন্যাসের একটি মিথ্যা গল্পের উদাহরণ উপস্থাপন করলে পাঠকবৃন্দ বুঝতে পারবেন, আমরা কেমন মিথ্যা বলি। পল ও পিটার দুই বন্ধু রাস্তায় হাঁটতে হাঁটতে এক ডলারের একটি নোট পেল। পল বললো ঐ ডলারটা আমার, যেহেতু আমি এটি প্রথম দেখেছি। পিটার বললো ওটা আমার, যেহেতু আমি কুড়িয়েছি। এ নিয়ে তাদের মধ্যে বিরোধ চরমে উঠলো। শেষ পর্যন্ত দু-জনের মধ্যে সিদ্ধান্ত হলো, যে সব চেয়ে বেশি মিথ্যা বলতে পারবে সে এই ডলারের মালিক হবে। সিদ্ধান্ত অনুযায়ী প্রথমে পল তার মিথ্যা গল্প শুরু করলো। নিউইয়র্কের পথে হাঁটতে হাঁটতে এক নীল নয়না অপরূপ সুন্দরীর সাথে পলের দেখা হলো। পল বললো ওকে প্রেম নিবেদন করলাম, সে রাজি হলো ও হাঁসি মুখে গ্রহণ করলো। তাকে নিয়ে বারে ঢুকলাম, সবচেয়ে দামি মদ পান করলাম। দীর্ঘ সময় ধরে ড্যান্স করলাম। তার পরে চলে গেলাম আমেরিকার সেই সু-উচ্চ ১০৫ তলা ভবনের উপরে। স্নিগ্ধ চাঁদের আলোয় ফুরফুরে মিষ্টি হাওয়ায় আমরা দু-জন উপভোগ করলাম। পরস্পরকে আলিঙ্গন করে স্বর্গ সুখ অনুভব করলাম। সকালে ঘুম ভেঙ্গে দেখলাম আমরা তেমনিভাবেই উভয়ে গলা জড়িয়ে শুয়ে আছি। এ আমার জীবনের পরম পাওয়া। এই বলে পল তার মিথ্যা গল্প শেষ করলো। এবারে পিটারের মিথ্যা গল্প বলার পালা। পিটার বললো, তুমি যে গল্প বললে আর আমি শুনলাম সেটাতো মিথ্যা গল্প-ই না। কারণ ঐ সময় তোমাদের দু’জনের সাথেই আমি ছিলাম এবং তোমাদের সব দেখেছি। হঠাৎ করে পথের পাশে বেঞ্চে বসে থাকা পাদ্রী (ধর্ম যাজক) বলে উঠলেন, ছিঃ-ছিঃ বাবারা এতো মিথ্যা কথা বলতে হয়না। ঈশ্বরের কাছে এটা মহা পাপ। এ কথা শুনে পল ও পিটার দু’জনে সমস্বরে বলে উঠলো, এ ডলারটা আমাদের প্রাপ্য নয়, এটা পাদ্রীর-ই প্রাপ্য, তাকে দিয়ে দাও। এ গল্প থেকে বোঝা যায় মিথ্যার বিস্তৃতি কত দূর। বর্তমান জামানায় এর বিস্তৃতি সব সীমাকেই অতিক্রম করেছে। আদালত পাড়ায় কি দেখি? একজন আরেক জনকে ঘায়েল করার জন্য মিথ্যার পর মিথ্যা বলে চলেছে। আইনজীবীরা তার মক্কেলকে মামলায় জেতানোর জন্য মিথ্যা বলার রিহার্সেল করাচ্ছেন। আর মোয়াক্কেলরা কোরআন, গীতা ও বাইবেলের মতো পবিত্র গ্রন্থে হাত রেখে শপথ করে বলছে, যাহা বলিব সত্য বলিব, সত্য ছাড়া মিথ্যা বলিব না। কিন্তু প্রকৃতপক্ষে তারা অন্তরে অন্তরে বলছে, যাহা বলিব মিথ্যা বলিব, মিথ্যা ছাড়া সত্য বলিব না।

 

সেই মধ্যযুগে কি হয়েছে সেটা বিচার করে দেখি। আরব্য উপন্যাসে সহস্র রজনীর কাহিনীর সবই মিথ্যা। মন্ত্রী কন্যা শাহারজাদী তার ছোট বোন দুনিয়ারজাদিকে গল্প শুনিয়ে বর্বর জালিম বাদশা যিনি প্রতিদিন একটি করে বিয়ে করে পরদিন প্রভাতে তাকে হত্যা করতেন। সেই বর্বরের হাত থেকে নিজেকে রক্ষা করেন। এক হাজার রাতের সেই মিথ্যা কাহিনী এক শ্রেষ্ঠ উপন্যাস হিসেবে আজও বিশ্বে সমাদৃত। মিথ্যার রকমফের হতে পারে, তবে সে যুগেও মিথ্যা ছিল আজও আছে এবং ভবিষ্যতেও থাকবে। সত্য যেমন সত্যই। তেমনি মিথ্যা যুগে যুগে সত্য। আমরা রাগারাগি করলে গালাগালি দেই অশ্রাব্য ভাষায়। যে ভাষায় গালাগালি করিনা কেন, সেটা মূলত মিথ্যা কথা। কিন্তু গালাগালি দিলে প্রতিপক্ষ ভীষণ উত্তেজিত হয় কেন? গালাগালির জন্য? না গালাগালিটা মিথ্যা কথা এ জন্য? এ কারণেই কথাটা বললাম যে, একটা মানুষ হলাহল মিথ্যা বলে চলেছে অথচ কোন মতামত ব্যক্ত করছি না। কিন্তু গালাগালি করলে উত্তেজিত হচ্ছি, পাল্টা গালাগালি করছি এমনকি  খুনাখুনিও করছি।

সত্য ও মিথ্যার পরিণাম

সমাজে মিথ্যা আছে বলেই সত্যকে উপলব্ধি করা যায়। আর সত্য আছে বলেই মিথ্যাকে চেনা যায়। সত্য ও  মিথ্যা এরা দুই যমজ ভাই। পাশাপাশি বাস করে। একই সাথে এদের জন্ম ও বেড়ে উঠা। সত্য ও মিথ্যা দু’টি শব্দ দুই অক্ষরের। দু’টি শব্দের মধ্যে দিন ও রাতের ব্যবধান। আলো আর আঁধারের মত। সত্য জান্নাতের পথ, মিথ্যা জাহান্নামের পথ। সত্য পুণ্য দেখায়, মিথ্যা পাপের পথে নিয়ে যায়। সত্যকে সবাই ভালোবাসে, মিথ্যাকে ঘৃণা করে। সত্যবাদিকে সবাই ভালোবাসে, মিথ্যাবাদিকে কেউ দেখতে পারেনা। এমনকি মিথ্যাবাদী যদি বাস্তবে সত্য বলে তবুও বিশ্বাস করে না। কারণ আগের মিথ্যার কারণে সে বিশ্বাস হারিয়েছে। মিথ্যার মাধ্যমে মানুষ নিজেকে বাঁচানোর মিছে চেষ্টা করে, কিন্তু আরো ফাঁদে পড়ে। একটা মিথ্যা থেকে বাঁচার জন্য পর্যায়ক্রমে মিথ্যা বলতে থাকে। তবুও বাঁচতে পারে না। বরং মিথ্যার ফাঁদে আরো জড়িয়ে যায়। এক পর্যায়ে নিজের সৃষ্টি করা মিথ্যার উপর নিজেরই আক্ষেপ হয়। কেন মিথ্যা বলতে গেলাম, সত্য বললে এতো বিপদ হতো না। মিথ্যা হলো কাপুরুষতা আর সত্য হলো সৎ সাহস। যে সৎ সাহস দেখিয়ে সত্য বলে দেয়, সে কারণে তাকে হয়তো সাময়িক শাস্তি পেতে হয় বা ঘৃণার সম্মুখীন হতে হয়। কিন্তু পরবর্তীতে সত্য বলার সৎ সাহসের কারণে সে প্রশংসিত হয়। বিশ্বাসের যে সম্পদ লাভ করে, তার কাছে হাজারো শাস্তি বা ঘৃণা তুচ্ছ। আর যে মিথ্যাবাদী হিসেবে পরিচিতি পায়, সে দশবার কশম করে একটি সত্য কথা বললেও মানুষ ভাবে সে মিথ্যা বলছে। এমনকি তার স্ত্রী, সন্তানরাও। এতে সে এক পর্যায়ে সত্য বলার আগ্রহ হারিয়ে ফেলে। সত্য সমাজের মঙ্গল করে। আর মিথ্যা বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি করে। ব্যাপক মানুষ আজো সত্যকেই লালন করে বলেই সমাজের ভারসাম্য রক্ষা হচ্ছে। তবে মিথ্যা ক্রমশ বিস্তার লাভ করছে। কিন্তু এখনও সত্যকে গ্রাস করতে পারেনি। অন্যদিকে সত্যের পাল্লা ভারী হলেও মিথ্যাকে উৎপাটিত করা সম্ভব হয়নি। কিছু মানুষ সব সময় মিথ্যা বলে, যদিও তারা জানে মিথ্যা বলাটা অপরাধমূলক কাজ। মিথ্যা বলার পরিণাম খুবই ধ্বংসাত্মক। এর জন্য দুনিয়াতে রয়েছে ধ্বংস আর আখেরাতে রয়েছে অপমান ও লাঞ্ছনা।

মিথ্যা বলার ধরণ

মানুষ মনের অজান্তেই অনেক মিথ্যা বলে। পরে কথাগুলো মনে হলেই তা বুঝতে পারে। সে জন্য নিজেকে ততটা অপরাধী ভাবে না। কিছু মানুষ আছে যারা অকারণে মিথ্যা বলে। এটা অনেক সময় বুঝতেই পারে না যে সে মিথ্যা বলছে। বেশিরভাগ ক্ষেত্রে দুই তিন বছরের শিশু থেকে মিথ্যা বলা শুরু করে। তখন তাদের মিথ্যা বলার কারণ ভয় বা শাস্তি থেকে বাঁচা। অবশ্য ঐ বয়সে মিথ্যার পরিসর থাকে ছোট, তবে বয়স বাড়ার সাথে সাথে মিথ্যার পরিধিও বাড়ে, যদি পারিবারিক শিক্ষা না থাকে। মানুষ যে সব কারণে মিথ্যা বলে, সেগুলো হচ্ছে- নিজের দুর্বলতা বা অক্ষমতাকে লুকিয়ে রাখার জন্য, প্রতারণা করার জন্য, কৌতুক করার জন্য, ব্যক্তিগত কোন বিষয়কে আড়াল করার জন্য, লোক হাসানোর জন্য, বেচা-কেনা করার জন্য, কারও বিশ্বাস বজায় রাখার জন্য, অন্যের কাছ থেকে সম্মান পাবার জন্য, কারো সাথে বিশেষ সম্পর্ক গড়ার জন্য, সময়মত আসতে চেয়ে না আসা, প্রয়োজনীয় জিনিস কারো কাছ থেকে নিয়ে তা না দেয়া, অন্যকে বা নিজেকে বিপদ থেকে বাঁচানোর জন্য এমন অসংখ্য কারণ থাকতে পারে মিথ্যা বলার জন্য। যা হোক মিথ্যা বলাটা মানুষের চরিত্রেরই একটি অংশ। সবাই মিথ্যা বলে। তবে কেউ কম কেউ বেশি। কেউ ভালো উদ্দেশ্যে, কেউ খারাপ উদ্দেশ্যে। পারিপার্শ্বিক অবস্থা, সামাজিক ও পারিবারিক পরিবেশের কারণেও মিথ্যার বিস্তৃতি হয়। কোন শিশু যদি এমন পরিবেশে মিথ্যার ছড়াছড়ি দেখে, তখন স্বাভাবিক ভাবেই তার মিথ্যা বলার প্রবণতা বৃদ্ধি পায়। মিথ্যা কথা বললে, মুখমন্ডলে শ্বাস প্রশ্বাসে তার ছাপ পড়ে। অর্থাৎ চেহারায় বাহ্যিক পরিবর্তন দেখা যায়। তবে অভিজ্ঞ চোখ ছাড়া এ পরিবর্তন ধরা যায় না। আর ঠান্ডা মাথায় কথা বললে পেশাদার অপরাধীদের মোটেই ধরা যায় না, তাদের চেহারায় কোন পরিবর্তন দেখা যায় না। এমন ধর্ম বা জাতি অতিবাহিত হয়নি, যাদের মধ্যে মিথ্যা হারাম বলে বিবেচিত ছিলনা। এমনকি জাহেলিয়াত যুগেও মিথ্যা বলা খারাপ মনে করা হতো। অনেকের ধারণা, হাসি রশিকতা করে মিথ্যা বলা বৈধ। কিন্তু ইসলাম ধর্মে এর কোন ভিত্তি নেই। যে ব্যক্তি শোনা কথা (সত্য বা মিথ্যা) সব প্রচার করে তার দ্বারা মিথ্যা প্রচারিত হওয়ায় স্বাভাবিক। যার সাথে বাস্তবতার কোন সম্পর্ক থাকে না। মিথ্যা একটি চারিত্রিক ব্যাধি। যার মধ্যে মনুষ্য রুচিবোধ কিংবা সুস্থ প্রকৃতি বিদ্যমান সে কোন ক্রমেই এর প্রতি সমর্থন জ্ঞাপন করতে পারে না। নিজের নামের আগে সৈয়দ, প্রফেসর, মওলানা, ডক্টরেট না হয়েও লেখা, না জেনে চারিত্রিক সার্টিফিকেট দেয়া, ভূয়া মেডিকেল সার্টিফিকেট দেয়া সবই মিথ্যা। জিহাদের প্রকৃত অর্থ সত্যকে সমুন্নত রাখা। দেশ জয় করা নয়। মিথ্যাবাদীরা কখনই জিহাদ করতে পারে না। কারণ তারা নৈতিকভাবেই দূর্বল। আমাদের অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ, চক্ষু, কর্ণ, নাসিকা, জিহ্বা, হাত, পা ইত্যাদির মালিক আমি। সুতরাং আমি যেভাবে খুশি ব্যবহার করবো, তা হতে পারে না। কারণ এগুলো আল্লাহর দেয়া আমানত। এগুলোকে যেভাবে ব্যবহারের নির্দেশ দেয়া হয়েছে, সেভাবেই করতে হবে। অন্যথায় তা হবে আল্লাহর আমানতের প্রতি খেয়ানত।

সরকারের নির্দেশ না মানা, ট্রাফিক আইন না মানা, সবই খেয়ানত। অন্যের প্রাপ্য না দেয়া, সেটাও খেয়ানত। কাজ না করে বেতন নেয়া, সেটাও প্রতারণা। গোপনীয় কথা একটি আমানত, তা প্রকাশ করলে সেটাও খেয়ানত। অথচ আমরা অনবরত মিথ্যা বলে যাচ্ছি, মিথ্যা বর্ণনা করছি। আমরা মূলত দু’টি অপরাধ করছি। একটি হলো মিথ্যা বলার অপরাধ এবং অপরটি হলো মিথ্যাকে মিথ্যা না মনে করার অপরাধ। বর্তমানে আমরা অধিকাংশ মানুষ বুঝে নিয়েছি যে, শুধু নামাজ ও রোজার নামই ধর্ম। নামাজ আদায় করছি, রোজা রাখছি, নামাজ রোজার ইন্তেজাম করছি, এতেই মুসলমান হয়ে গেলাম। এর চেয়ে বেশি আর কোন কিছু আমাদের করণীয় নাই। যার ফলে আমরা যখন বাজারে যাই, তখন মিথ্যা আর প্রতারণার মাধ্যমে মালামাল সংগ্রহ করি। হারাম হালাল একাকার করে দেই। জবানের কোন আস্থা থাকে না। গচ্ছিত মাল আত্মসাৎ করি। অঙ্গীকার পালনের গুরুত্ব দেই না। মোদ্দা কথা বুঝে নিয়েছি যে, ইসলাম কেবল নামাজ রোজার নাম। এটা অত্যন্ত ভয়াবহ ও ভ্রান্ত ধারণা। এ ধরনের মানুষদের জন্য স্বয়ং আমাদের রাসুলুল্লাহ (দঃ) বলেছেন, এমন ব্যক্তি, চাহে নামাজ পড়ক, রোজা রাখুক তথাপি তাকে মুসলমান বলা ঠিক নয়। আবার তাদের উপর কুফরির ফতোয়া দেওয়াও ঠিক নয়। কারণ কুফরির ফতোয়া বড়ই কঠিন বিষয়। ফতোয়া দিয়ে এসব লোককে কাফের বলে চিহ্নিত করবে না। এবং ইসলামের গণ্ডি হতে খারিজও করবে না। যদিও এ প্রকৃতির লোকেরা যাবতীয় কাজ কাফের ও মুনাফিকের ন্যায় করে থাকে। সত্য গোপন করা বিরাট অপরাধ, যা মানুষকে বিভ্রান্ত করে, বিপথে পরিচালিত করে ও অবিশ্বাস সৃষ্টি করে। যুগে যুগে ইসলামের বড় ক্ষতি মুনাফিকদের দ্বারাই হয়েছে। মহা নবীকে মুনাফিকরাই সব চেয়ে বেশি কষ্ট দিয়েছে। মুনাফিকরা মুসলমান পরিচয়ে ধোকা দিয়ে ক্ষতি করেছে। সুতরাং তাদের চিহ্নিত করা যায়নি। আর কাফেরেরা প্রকাশ্যেই মুসলমানদের বিরোধিতা করে। তাই তাদের কাছ থেকে বাঁচাও সহজ ছিল। যারা মিথ্যা ভাষণ, মিথ্যাচার করে বেড়ায় তারা সংসারে, পরিবারে, সমাজে এবং দেশে মহা দুর্যোগ সৃষ্টি করতে পারে। এ ব্যাপারে রাজনীতিবিদদের তুলনা হয়না। মিথ্যাকে সব পাপ ও গুনাহের জননী বলে আখ্যায়িত করা হয়েছে। মোট কথা মিথ্যা সব ধরনের অপরাধের আশ্রয় ও প্রশ্রয় দিয়ে থাকে। মিথ্যা এমন একটি বড় বিষয়, যা লিখে শেষ করা যায় না। তাই মিথ্যা সম্পর্কে আর বেশি কিছু না লিখে মিথ্যা বাদির শাস্তির বিধান সম্পর্কে কিছু বলতে চাই।

ইসলামে মিথ্যাবাদীর শাস্তির বিধান

এবার দেখা যাক, মিথ্যা, মিথ্যাবাদী, তার পরিণতি এবং মিথ্যাবাদীর শাস্তি সম্পর্কে কি বলে। আমরা জানি কোন ধর্মই মিথ্যাকে সমর্থন করে না। তবে ইসলাম ধর্ম বিশেষত পবিত্র কোরআন ও হাদিসে অসংখ্যবার মিথ্যা বলা ও প্রতারণা করার ভয়াবহ পরিণতি ও শাস্তির কথা বলা হয়েছে। মিথ্যাকে কবিরা গুনাহর  সাথে তুলনা করা হয়েছে। আমি এগুলোর কয়েকটি তুলে ধরার চেষ্টা করছি।

* তোমরা আল্লাহর উদ্দেশ্যে ন্যায় সাক্ষ্য দানে থাকিবে অবিচল। আল্লাহ্ তোমাদিগকে ধরিবেন, তোমার দেয়া পরিপক্ক কসম তদবস্থায় তোমরা ভংগ কর। এ জন্য কাফ্ফারা হলো ১০ জন ফকিরকে ভোজন করানো, যদ্রুপ তোমার পরিবারবর্গকে বস্ত্র দান করে থাকো। (সুরা মায়েদা ৮ ও ৮৯ আয়াত)

* আল্লাহ স্বীয় নির্দেশ দ্বারা সত্যকে প্রতিষ্ঠিত করেন এবং কাফেরদের মূল কাটিয়া দেন, যাতে সত্য সুপ্রতিষ্ঠিত হয় এবং অসত্য বিলুপ্ত হয়। যা কাফেরগণ পছন্দ করেনা। (সুরা আনফল ৮ আয়াত)

* যখন তোমরা রণক্ষেত্রে কাফেরদের সম্মুখীন হও তখন তাদের হইতে পৃষ্ঠ প্রদর্শন করিওনা। যে ব্যক্তি তাতে পৃষ্ঠ প্রদর্শন করিতে কৌশল অবলম্বন করিবে তাহাদের জন্য আল্লাহর গজব পড়িবে। তাহাদের ঠিকানা হইবে দোজখ। (সুরা আনফল ১৫ ও ১৬ আয়াত)।

* হে মুসলমানগণ আল্লাহ ও রাসুলের আমানতের খেয়ানত করিওনা। তোমাদের জান, মাল, সম্পত্তি, সন্তান সন্ততি একটি পরিক্ষা বিশেষ। (সুরা আনফল ২৭ ও ২৮ আয়াত)।

* হে ইমানদারগণ তোমরা আল্লাহকে ভয় কর। সত্যনিষ্ঠদের সহযোগী হও। সত্য-মিথ্যার সম্মিলন আদৌ হইতে পারেনা। সত্যবাদিতা মানুষকে পুণ্যবান ও ইমানদার করে। মিথ্যাবাদী হয়, ইমান থেকে বঞ্চিত ও পাপী। সত্য আনে সাফল্য (সুরা তওবা ১১৯ আয়াত)

* প্রত্যেক কওমে আমি রাসুল পাঠাইয়াছি। পরে তাদের কতককে আল্লাহর পথে চালনা কতকের ভাগ্যে থাকে পথভ্রষ্টতা। তাই পৃথিবী ভ্রমন কর এবং দেখ সত্য মিথ্যা প্রতিপালনকারীদের পরিণতি কোথায়। তোমরা মিথ্যা রটনা কর তা প্রশ্ন করা হইবে। ওরা সেদিন আত্মসমর্পণ করিবে। কিন্তু মিথ্যা উদ্ভাবন হেতু তারা নিষ্ফল হইবে। পরস্পরকে ধোকা দেবার জন্য তোমাদের শপথকে ব্যবহার করিওনা। অন্য দল থেকে শক্তিশালী হবার জন্য তোমাদের কসমকে ব্যবহার করিওনা। সুরা নাহলি ৩৬, ৫৭, ৮৭ ও ৮৪ আয়াত)

* তোমরা মূর্তিরূপ, অপবিত্রতা বর্জন কর। বর্জন কর মিথ্যাচার সুরা হাজ্ব- ৩০ আয়াত)।

* পবিত্র চরিত্র মহিলাদের যারা ব্যভিচারের মিথ্যা অপবাদ দিতে কুন্ঠিত হয়না এবং এর সপক্ষে চারজন সাক্ষী উপস্থাপন করতে পারে না, এরা ফাসিক। আশি দোররা এদের প্রাপ্য। এদের সাক্ষ্য গ্রহণযোগ্য নয়। এরা মিথ্যাবাদী। এদের জন্য রয়েছে শক্ত আজাব (সুরা নূর- ৪, ১২ ও ১৩ আয়াত)।

* তোমাদের জ্বলন্ত অগ্নি সাবধান করিয়াছে। নিতান্ত হতভাগ্য তাহারাই ঢুকিবে, যে মিথ্যা ও বিমুখ। তাহা হইতে দূরে রাখা হইবে মুত্তাকিদের। সুরা লাইলী ১৫ ও ১৬ আয়াত।

* যদি কোন কওমের সাথে চুক্তি ভঙ্গের আশঙ্কা থাকে তবে তোমার চুক্তিও যথাযথভাবে বাতিল করিবে। আল্লাহ্ দাগাবাজদিগকে ভালবাসেন না। তাছাড়া তারা যেন মনে না করে যে, তোমরা হতবল এবং সমর্থ নহ (সুরা আনফল ৫৮, ৫৯ ও ৬০ আয়াত)

* নিঃসন্দেহে মুনাফিকরা রয়েছে দোযখের সর্বনিম্ন স্তরে। আর তোমরা তাদের জন্য কোন সাহায্যকারী পাবে না। সুরা নিসা ১৪৫ আয়াত।

* ইহা তোমার প্রতিপালকের অপরিহার্য নির্ধারিত সিদ্ধান্ত। অতঃপর আমি মুত্তাকিদের মুক্তিদান করিব আর জালেমদিগকে অধঃমুখো করিয়া ছাড়িয়া দিব। সুরা মারিয়াম ৭১ ও ৭২ আয়াত।

* মিথ্যাতো তারায় বানায়, যারা আল্লাহ্র নিদর্শন সমূহের উপর ইমান রাখে না। বস্তুতঃ তারায় মিথ্যুক। সুরা নাহাল ১০৫ আয়াত।

* নিশ্চয়ই যারা আল্লাহর  নামে মিথ্যা রটায় তারা সফল হবে না। সুরা নাহাল ১১৬ আয়াত।

এবার দেখা যাক, হাদিস শরিফ ও অন্যান্য বুজুর্গ ব্যক্তিগণ কি বলেন।

ক) অবিশ্বাস লুকিয়ে রেখে জবান দ্বারা ইসলাম প্রকাশ করে তাকে মুনাফিক বলে (আল মুঞ্জিদ পৃষ্ঠা ১০৩৮)।

খ) ধ্বংস তার জন্য যে, লোক হাসানোর জন্য কথা বলে এবং তাতে মিথ্যার আশ্রয় নেয়। (তিরমিজি ২৩৫)।

গ) তোমরা মিথ্যা থেকে সাবধান থাকো। কেননা মিথ্যা ঈমানের পরিপন্থি। রসনা সংযত করা ইসলামের বিধান। কারণ মুখে অনেক সময় এমন কথা বাহির হওয়া বিচিত্র নয়। যদ্দরুন ঈমান বিনষ্ট হয়। (আবু বাক্কার সিদ্দিকী (রাঃ)।

ঘ) একজন মুমিন ব্যক্তির মধ্যে মিথ্যা ও বিশ্বাস ঘাতকতা ব্যতিত সকল চরিত্র থাকতে পারে। (সাদ ইবনে আক্কাস (রাঃ)।

ঙ) কখনোই সত্যিকারের ঈমানে পৌছাতে পারবে না। যতক্ষণ ঠাট্টার ছলে মিথ্যা বলা ত্যাগ না করতে পারো। (হযরত ওমর (রাঃ)।

চ) সত্য পৃথিবীর স্থায়ীত্বের একটি মূল ভিত্তি। প্রশংসাযোগ্য বস্তু নবুয়াতের অংশ ও তাকওয়ার ফল। এ সত্য না থাকিলে শরিয়তের বিধানসমূহ অকেজো হয়ে যেত। মূলত মিথ্যা বলার দোষে দুষ্ট হওয়ার অর্থ হচ্ছে মানবতা থেকে বেরিয়ে যাওয়া। কারণ কথা বলা হচ্ছে মানুষের একটি বৈশিষ্ট্য আর সত্য না হলে তার কোন অর্থই থাকে না। (মোঃ আল খাদেমী বারিকাতুন মাহমুদিয়া ৩/১৮৩)

ছ)       ক্রেতা এবং বিক্রেতা ইচ্ছাধীন যতক্ষণ না তারা পৃথক হয়। যদি তারা সত্য বলে ও দোষগুণ বর্ণনা করে দেয় তবে তাদের মধ্যে বরকত প্রদান করা হয়। আর যদি তারা গোপন রাখে এবং মিথ্যা বলে তাদের বরকত নষ্ট করে দেয়া হয়। (বুখারী ১৯৭৩ মুসলিম ৫৩২)

রাষ্ট্রীয় আইনে মিথ্যাবাদীর শাস্তির বিধান

রাষ্ট্রের বিদ্যমান আইন পেনাল কোড (ধারা ১৯৩-১৯৮) পর্যন্ত মিথ্যা সাক্ষীর সম্পর্কে কি বলা হয়েছে।

* কোন বিচারমূলক কার্যক্রমে মিথ্যা সাক্ষ্য দেয়া বা সৃষ্টি করা, অন্য কোন ক্ষেত্রে মিথ্যা সাক্ষ্য দেয়া বা সৃষ্টি করা, কোন লোককে মৃত্যুদণ্ডে দণ্ডনীয় অপরাধে দন্ডিত করার উদ্দেশ্যে সাক্ষ্য দেয়া, উহার ফলে যদি নিরপরাধ ব্যক্তি দণ্ডিত হয়, যাবজ্জীবন বা ৭ বছর কারাদণ্ডে দণ্ডিত করার জন্য মিথ্যা সাক্ষী দেয়া হয় উল্লেখিত এসব অপরাধে সর্বোচ্চ ৭ বছরের সশ্রম কারাদণ্ড হতে পারে। এ সকল অপরাধীদের বিনা পরোয়ানায় গ্রেফতার করা যাবে না। এদের বিরুদ্ধে অভিযোগ হলে পরোয়ানা বা সমনজারি করা হতে পারে। এ সব মামলা জামিনযোগ্য।

মিথ্যা সাক্ষ্য প্রমান করতে হয়। তার পদ্ধতিগুলো হচ্ছে-

১) অভিযুক্ত ব্যক্তি হলফ লইবার ফলে বা আইনের বিধানের ফলে সত্য কথা বলিতে বাধ্য ছিলেন।

২) তদনুযায়ী তিনি কিছু বলিয়াছিলেন বা ঘোষণা দিয়াছিলেন।

৩) তিনি উহা স্বেচ্ছায় করিয়াছিলেন। ৪) উহা মিথ্যা ছিল।

৫) তিনি মিথ্যা বলিয়া জানিতেন বা উহাকে সত্য বালিয়া বিশ্বাস করিতেন না।

৬) উক্ত মিথ্যা ভাষণ বা ঘোষণায় বিচার বিভাগীয় মামলা করা হয়েছিল। মিথ্যা সাক্ষ্য বা উদ্ভাবনের অভিযোগ প্রতিষ্ঠিত করতে হয়েছে।

৭) উক্ত অভিযুক্ত ব্যক্তি কোন অবস্থা সৃষ্টি করিয়াছিলেন অথবা কোন বহিতে বা রেকর্ডে মিথ্যালিপি করিয়াছিলেন বা মিথ্যা বিবরণ সম্বলিত দলিল সম্পাদন করিয়াছিলেন।

৮)কোন বর্তমান বা ভবিষ্যত বিচার বিভাগীয় অন্য মামলায় ব্যবহার করার অভিপ্রায়ে তিনি উহা করিয়াছিলেন।

৯) মিথ্যা সাক্ষ্য দিলে অপরাধ হয়না। উহা ইচ্ছাকৃত হইতে হইবে। ইচ্ছাকৃত কিনা তাহা অবস্থা হইতে নির্ধারণ করিতে হইবে।

মিথ্যা হলফনামা- যে ক্ষেত্রে বিতর্কিত হলফনামার বিষয়বস্তু রেসপন্ডেন্টের বিশ্বাস এবং জ্ঞানের উপর নির্ভর করে, কিন্তু উহার কোথাও এমন কোন বর্ণনা থাকে না যে, উহার কোন অংশ বিশ্বাসের উপর প্রতিষ্ঠিত এবং কোন অংশ জ্ঞানের উপর প্রতিষ্ঠিত। সেক্ষেত্রে হলফনামায় কোন মিথ্যা আবিষ্কৃত হলে উহার জন্য তাহাকে ১৯৩ ধারায় দায়ী করা যাবে না।

মিথ্যা সাক্ষ্য উদ্ভাবনের উদ্দেশ্য কোন ব্যক্তিকে ১৯৩ ধারার অধীনে শাস্তি দেবার ক্ষেত্রে বাদীকে অবশ্যই উহা প্রমাণ করিতে হইবে যে, আসামি শুধুমাত্র উহা মিথ্যাভাবে উদ্ভাবন করেন নাই বরং তিনি উহা বিচার বিভাগীয় কার্যক্রমে যে কোন অবস্থায় প্রয়োগ করিতে ইচ্ছা ব্যক্ত করিয়াছিলেন।

মিথ্যাবাদীকে মিথ্যাবাদী প্রমাণ করার দায়িত্ব ক্ষতিগ্রস্তের

মিথ্যা নিয়ে এত বড় প্রবন্ধ লেখার মূল উদ্দেশ্য কি? সেটাই এবার বলবো। এতক্ষণ আমরা দেখলাম কোরআন বা ধর্মীয় বিধান এবং রাষ্ট্রীয় আইনে মিথ্যাবাদীর শাস্তি। যেখানে মিথ্যাবাদী সম্পর্কে মতামত, মিথ্যাবাদীর শাস্তি, মিথ্যার পরিণাম সবই মূলত কালো অক্ষরে ঐ সকল গ্রন্থে সীমাবদ্ধ। বাস্তবে প্রয়োগ নাই। এ লেখার মধ্যে বলা হয়েছে মিথ্যা কতবড় অপরাধ এবং মিথ্যাবাদীরা কতবড় অপরাধী। মিথ্যা ও মিথ্যাবাদীর কারণে পরিবার সমাজ এমনকি রাষ্ট্র মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে, হচ্ছে এবং আগামীতে হবে। কিন্তু মিথ্যাবাদীরা এজন্য শাস্তি পেয়েছে এমন নজির নেই বললে চলে। ফলে ক্ষতিগ্রস্তরা দাঁতে দাঁত চিপে রেখে সহ্য করে। অন্যদিকে ক্ষতিকারক মিথ্যাবাদীরা গায়ে বাতাস লাগিয়ে ঘুরে বেড়ায়, কুটনীর হাঁসি হাসে।

সমাজের মানুষ জানে, বিচারক জানে, আদালত জানে উমুক মিথ্যাবাদীর মিথ্যা সাক্ষী দেবার কারণে উমুকের শাস্তি হলো এবং ক্ষতিগ্রস্ত হল। এজন্য তারা মিথ্যাবাদীকে ঘৃণা করে, ক্ষতিগ্রস্তের জন্য বিলাপ করে, চোখের জল ফেলে কিন্তু মিথ্যাবাদীকে কিছুই বলতে পারে না। ফলে মিথ্যা ও মিথ্যাবাদী সমাজকে প্রভাবিত করছে এবং ক্রমশঃ শক্তিশালী হয়ে উঠছে। এর একমাত্র কারণ হচ্ছে মিথ্যাবাদীকে মিথ্যাবাদী প্রমাণ করার জন্যই পৃথক মামলা দায়ের করতে হয়। যেটা মোটেও সহজ সাধ্য নয়। যেমন এক ব্যক্তি দলিল জাল সৃষ্টি করে আপনার সম্পত্তি দখল করে নিয়েছে অথবা দখল করার পায়তারা করছে অথবা ঐ ব্যক্তি ভুমি বিভাগের দুর্নীতিবাজ কর্মকর্তার সহযোগিতায় তার নামে খারিজ করে নিয়েছে ও বড় জটিলতার সৃষ্টি করেছে। এমন পরিস্থিতিতে ঐ জটিলতা থেকে মুক্ত হবার জন্য আপনাকে মামলা করতে হবে। সিভিল কোর্টে ৫/৭ বছর কাঠ খড় পুড়িয়ে অর্থ শ্রাদ্ধ করে প্রমাণ করলেন যে জমিটা আপনারই এবং খারিজটা মিথ্যা। আদালত, বিচারক, উভয় পক্ষের আইনজীবী, পেশকার, ভুমি বিভাগের কর্মকর্তারা সবাই বুঝলেন দলিলটা জাল ছিল। এ জন্য আদালত স্বপ্রণোদিত হয়ে জালিয়াতকে কোন শাস্তি দেবেন না। বরং আপনাকেই পৃথক মামলা করতে হবে জালিয়াত প্রমাণ করার জন্য। আবারো ৫/৭ বছর কোর্ট, উকিল ও অর্থ শ্রাদ্ধ। তারপরও প্রশ্ন থাকে আপনি মামলা করবেন কার বিরুদ্ধে ? জাল দলিল সৃষ্টিকারীর বিরুদ্ধে না খারিজ দানকারী ভূমি বিভাগের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের বিরুদ্ধে অথবা উভয় পক্ষের বিরুদ্ধে। এ যে কত বড় যন্ত্রণা তা ভুক্তভোগী ব্যতিত কেহ জানে না। ধরুন আপনার নামে মিথ্যা জামিন অযোগ্য মামলা দায়ের করা হলো। প্রেক্ষিতে পুলিশ আপনাকে গ্রেফতার করলো (কারণ কোন তদন্ত ছাড়াও পুলিশ আপনাকে গ্রেফতার করতে পারে তেমন আইন আছে)। আপনি এখন জেলহাজতে পচুন ৬ মাস। তার পর হয়তো জামিন পেলেন, দু’চার বছর মামলা চললো এবং অবশেষে রেহাই পেলেন। কোর্ট, বিচারক, পুলিশ জানলো মামলাটা আসলে মিথ্যা অথচ আপনি ও আপনার পরিবার কষ্ট পেল, অর্থ নষ্ট হল। কিন্তু মিথ্যা মামলাকারীর কিছুই হলো না। যারা এর পক্ষে সাক্ষী দিতে এসেছিল তাদেরও কিছু হল না। এর প্রতিকার পেতে হলে আপনাকে মিথ্যাবাদীর উপর পৃথক মামলা দায়ের করতে হবে। শুধু তাই নয়, আপনাকেই সাক্ষ্য প্রমাণ দিয়ে মিথ্যাবাদীকে মিথ্যাবাদী প্রমাণ করতে হবে।

কি ধর্মীয় আইন অথবা রাষ্ট্রীয় আইন। সবক্ষেত্রেই মিথ্যাবাদীকে যেভাবে বিবেচনা করে তা হলো, মিথ্যাবাদী কেন মিথ্যা বললো, কি ভাবে বললো, জীবন বাঁচানোর জন্য না অন্যের ক্ষতি করার উদ্দেশ্যে, কারণে না অকারণে, প্রতারণা করার জন্য না আনন্দ দেবার জন্য, ইচ্ছায় না অনিচ্ছায়, স্বেচ্ছায় না চাপে পড়ে, সুস্থ অবস্থায় না অসুস্থ অবস্থায়, স্বাভাবিক অবস্থায় না মদ্যপ অবস্থায়। এমন অসংখ্য জটিল অবস্থার বিবেচনার প্রেক্ষিতেই মিথ্যাবাদীকে অপরাধী হিসেবে দায়ী করা যেতে পারে। এখানে মনস্তাত্ত্বিক ব্যাপারও আছে। এসব জটিল বিষয় অতিক্রম করার পরই মিথ্যাবাদীর শাস্তি হতে পারে তা প্রমাণ সাপেক্ষে। অন্যথায় আল্লাহর গজব এর উপর নির্ভর করতে হবে ক্ষতিগ্রস্তদের।

তথ্য সূত্র: * পবিত্র কোরআন ও হাদিস এবং *পেনাল কোড ধারা ১৯৩ ।

 

 

 

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *