আশরাফ নুআ’ঈম: বিশ্বায়নের এ যুগে যখন প্রযুক্তি, জ্ঞান ও বৈশ্বিক সংযোগের বিস্ময়কর প্রসার ঘটেছে, তখনই মুসলিম জাতিসত্তা এক চরম অস্তিত্বসংকটে নিপতিত হচ্ছে। এই সংকটের মূল দুই প্রান্তে দাঁড়িয়ে রয়েছে—দক্ষিণ এশিয়ার হিন্দুত্ববাদ ও মধ্যপ্রাচ্যের জায়নবাদ। উভয় মতবাদই কেবল রাজনৈতিক আদর্শ নয়; বরং একটি জাতিগোষ্ঠীকে দমন, উৎখাত ও নির্বাসিত করার সুসংগঠিত প্রকল্প।
☘️হিন্দুত্ববাদ: দক্ষিণ এশিয়ায় মুসলিমদের নিঃশেষ করার নীলনকশা
ভারতের মতো বহুত্ববাদী সমাজকে হিন্দু রাষ্ট্রে পরিণত করার প্রক্রিয়া নতুন নয়। শতাব্দীপ্রাচীন রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সংঘ (RSS) ও এর রাজনৈতিক শাখা ভারতীয় জনতা পার্টি (BJP) আজ হিন্দুত্ববাদের একমেবাদ্বিতীয়ম রূপ। এই মতবাদের মূল লক্ষ্য হলো ভারতকে ‘হিন্দু ভূমি’ রূপে সংজ্ঞায়িত করা এবং মুসলিমদের ‘বিদেশি’ হিসেবে উপস্থাপন করে তাঁদের অধিকারকে প্রশ্নবিদ্ধ করা।
১৯৯২ সালে বাবরি মসজিদ ধ্বংস, ২০০২ সালের গুজরাট দাঙ্গা, ২০২০ সালের দিল্লি দাঙ্গা, আসামের এনআরসি এবং সাম্প্রতিক নাগরিকত্ব সংশোধনী আইন (CAA)—এসবই একই ধারাবাহিকতার অংশ। এগুলোর মাধ্যমে কোটি কোটি মুসলিমকে নাগরিকত্বহীন করে তোলার অপচেষ্টা চলছে। পাশাপাশি, “লাভ জিহাদ”, “গোরক্ষা”, “হালাল বনাম ঝটকা”—এইসব মিথ্যাচারের মাধ্যমে মুসলিম সমাজকে সামাজিকভাবে বিচ্ছিন্ন ও অর্থনৈতিকভাবে বিপর্যস্ত করা হচ্ছে।
এখানে ভয়ানক বিষয় হলো—এই বিদ্বেষ আজ শুধু দলীয় রাজনৈতিক মতাদর্শে সীমাবদ্ধ নয়, বরং আদালত, প্রশাসন, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, এবং মিডিয়ার গভীরে প্রবেশ করে গিয়েছে। মুসলিমদের পরিচয়ই আজ তাঁদের অপরাধ হিসেবে চিহ্নিত হচ্ছে।
☘️জায়নবাদ: মধ্যপ্রাচ্যে মুসলিম জাতিসত্তার বিনাশ প্রকল্প
অন্যদিকে জায়নবাদ একটি ঔপনিবেশিক মতবাদ, যার ভিত্তি পশ্চিমা সাম্রাজ্যবাদ ও ধর্মীয় বিভ্রান্তি। জায়নবাদ ধর্মনিরপেক্ষ ইহুদি জাতির নামে একটি বর্ণবাদী রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার কৌশল, যার বাস্তব রূপ হলো—ইসরায়েল। ১৯৪৮ সালে ফিলিস্তিনিদের মাতৃভূমি ছিনিয়ে নিয়ে গঠিত এই রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠালগ্ন থেকেই মুসলিমদের জন্য এক দুঃস্বপ্ন।
ফিলিস্তিনি জনগণ গত ৭৫ বছর ধরে উচ্ছেদ, দখল, হত্যা ও শোষণের শিকার। ২০২৫ সালের গাজা গণহত্যা এর সর্বশেষ বর্বরতম উদাহরণ। যেখানে আন্তর্জাতিক আইন, মানবাধিকার, এমনকি যুদ্ধের ন্যূনতম নীতিমালাও ভূলুণ্ঠিত হয়েছে। হাজার হাজার শিশু, নারী, বৃদ্ধ নিহত হয়েছেন; হাসপাতাল, মসজিদ, সংবাদমাধ্যম—সবকিছুকেই টার্গেট করা হয়েছে। জায়নবাদের ভয়ংকর রূপ এখানেই—এটি কেবল সামরিক দখল নয়; বরং ইতিহাস মুছে ফেলা, সংস্কৃতি নিশ্চিহ্ন করা, এবং মানুষের মানসিক সত্তাকেও ধ্বংস করার একটি প্রকল্প।
☘️উম্মাহর অবহেলা ও নেতৃত্বের ব্যর্থতা
এই দুটো আঘাতের বিপরীতে আজ মুসলিম বিশ্ব বিভক্ত, দুর্বল এবং অনেকাংশেই নীরব। অনেক রাষ্ট্র কেবল নিজেদের ক্ষমতা রক্ষার লক্ষ্যে জায়নবাদীদের সঙ্গে বন্ধুত্ব করছে, আবার কেউ হিন্দুত্ববাদের সঙ্গে অর্থনৈতিক সম্পর্ককে অগ্রাধিকার দিচ্ছে। ফলে বিশ্ব মুসলিমদের কোনো কার্যকর ঐক্য বা সম্মিলিত প্রতিরোধ গড়ে ওঠেনি।
অথচ মুসলিম উম্মাহর ইতিহাস গৌরবময় প্রতিরোধের গল্পে পরিপূর্ণ—বদর, কারবালা, আল-কুদস মুক্তিযুদ্ধ, উসমানী খেলাফতের প্রতিরক্ষা—এসব কোনো না কোনোভাবে ন্যায় ও সত্যের পক্ষে দাঁড়ানো ইতিহাস। আজ সেই আত্মারই পুনর্জাগরণ দরকার।
☘️প্রতিরোধের নতুন ভাষা: চিন্তা, জ্ঞান ও কৌশল
বর্তমান বিশ্বে প্রতিরোধের ভাষা বদলে গেছে। অস্ত্র একমাত্র সমাধান নয়। বরং প্রাধান্য পাচ্ছে—তথ্য, আদর্শ, কৌশল ও মিডিয়ার যুদ্ধ।
১. তথ্যনির্ভর প্রচার ও জ্ঞানচর্চা:
আজ মুসলিমদের দরকার এক নতুন চিন্তাবলয়, যা ঐতিহাসিক সত্য, আধুনিক বিশ্লেষণ এবং আদর্শিক দৃঢ়তাকে একত্রে দাঁড় করায়। আমাদের সন্তানদের শুধু হাদীস-কুরআন নয়, সঙ্গে আন্তর্জাতিক আইন, মিডিয়া নীতিমালা, ইতিহাস ও রাজনৈতিক অর্থনীতিও জানতে হবে।
২. রাজনৈতিক সচেতনতা ও অংশগ্রহণ:
হিন্দুত্ববাদ ও জায়নবাদ রাজনৈতিক শক্তি। তাদের মোকাবিলা করতে হলে মুসলিমদেরও রাজনৈতিকভাবে সচেতন হতে হবে। যেসব দেশে মুসলিমরা সংখ্যালঘু, সেখানে কৌশলী ভোটব্যবস্থা, রাজনৈতিক জোট এবং আইনি লড়াইয়ের মাধ্যমে অধিকারের দাবিতে সোচ্চার হওয়া জরুরি।
৩. মিডিয়ায় সক্রিয়তা:
আজকের যুগে মিডিয়া যুদ্ধের প্রধান ময়দান। যেসব অসত্য প্রতিপক্ষ ছড়াচ্ছে, তার জবাব দিতে হবে সোশ্যাল মিডিয়া, ডকুমেন্টারি, ব্লগ, ও আন্তর্জাতিক প্ল্যাটফর্মে। নতুন প্রজন্মকে সাংবাদিকতা, চলচ্চিত্র, সাহিত্য, ও ভাষা-অনুবাদের মাধ্যমে সত্য প্রচারে যুক্ত করতে হবে।
৪. আন্তর্জাতিক সম্পর্ক ও লবিং:
আমাদের উচিত সহমর্মী ও ন্যায়প্রিয় অমুসলিম শক্তিগুলোর সঙ্গে সংলাপ ও সহযোগিতা গড়ে তোলা। যেমন দক্ষিণ আফ্রিকার বর্ণবাদবিরোধী আন্দোলন একসময় বিশ্ব জনমতকে পাল্টে দিতে পেরেছিল। ফিলিস্তিনের ক্ষেত্রেও এই কৌশল গুরুত্বপূর্ণ।
☘️আত্মসমালোচনা ও অভ্যন্তরীণ সংস্কার
তবে প্রতিরোধের আগে প্রয়োজন আত্মসমালোচনা। উম্মাহ হিসেবে আমরা কতটা সত্যিকারের মুসলিম? আমাদের অভ্যন্তরীণ দুর্নীতি, দলাদলি, কুসংস্কার, এবং জ্ঞানবিমুখতা—এই সবকিছুর কারণেই আজ আমরা দুর্বল। যদি সত্যিই আমরা আল্লাহর সাহায্য চাই, তাহলে আমাদের নিজেদেরকে পরিবর্তন করতে হবে। আল-কুরআন আমাদের বলে:
“নিশ্চয়ই আল্লাহ কোন জাতির অবস্থা পরিবর্তন করেন না, যতক্ষণ না তারা নিজেদের অবস্থা নিজে পরিবর্তন করে।” (সূরা রা’দ, আয়াত ১১)
☘️সুতরাং, মুসলিম হয়ে বাঁচতে চাইলে লড়াই শিখতেই হবে
এ যুগে মুসলিম পরিচয় নিয়ে বেঁচে থাকা মানে প্রতিদিন এক অদৃশ্য যুদ্ধের সম্মুখীন হওয়া। শুধু নামাজ-রোজা নয়, দরকার আদর্শিক দৃঢ়তা, নৈতিক সাহস, এবং কৌশলগত প্রতিরোধ। হিন্দুত্ববাদ ও জায়নবাদের বিরুদ্ধে দাঁড়ানো মানে কেবল অস্ত্র নয়; বরং সত্য, ন্যায় ও মানবিকতার পক্ষে নির্ভীকভাবে অবস্থান গ্রহণ করা।
চুপ করে থাকা মানেই নিধনের দিকে এগিয়ে যাওয়া। এখন সময় জেগে ওঠার, প্রতিরোধ গড়ার। যদি আমরা না জাগি, তবে হয়তো একদিন শুধু “মুসলমান” পরিচয়টুকুর জন্যই মরতে হবে—নির্বাক ও নিরুপায় হয়ে।
☘️লেখক পরিচিতি
আশরাফ নুআ’ঈম একজন শিক্ষার্থী, সমাজচিন্তক ও ইসলামি রাজনৈতিক অঙ্গনের সক্রিয় লেখক। তিনি সমাজ উন্নয়ন ও আত্মগঠনের বাস্তবভিত্তিক দৃষ্টিভঙ্গিতে কলম চালিয়ে যাচ্ছেন।