মোহাম্মাদ আশিক উজ্জামান: বাংলাদেশ নামক ভৌগোলিক ভূ-খন্ডটি লক্ষ বছরের পুরোনো হলেও তার রাজনৈতিক সীমা নির্ধারিত হয়েছিলো ১৯৪৭ সালে এবং ১৯৭১ সালে এসে তা বর্তমান রাষ্ট্রসীমায় স্থিরতা লাভ করে। পাশ্চাত্যের শেখানো রাষ্ট্রদর্শনের অনুকরণে গড়ে ওঠে ‘গণতন্ত্রের মডেল’ যা ‘জন লক’ এর চিন্তার ফসল। জন লকের দর্শনে প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল জনগণের সার্বভৌমত্ব, যেখানে ঈশ্বরের সার্বভৌমত্বকে জবাই করা হলো। অতঃপর ‘ফরাসি দার্শনিক মন্তেস্কু’ সার্বভৌম রাষ্ট্রের মৌলিক কাঠামোতে যোগ করলেন ‘জনপ্রতিনিধি’ আর ‘আইনসভা’ নামক ব্যবস্থা। ফলে স্রষ্টার শাসনের বিপরীতে প্রতিষ্ঠিত হয়েছিলো জনগণের শাসন। ‘জন লক’ আর ‘মন্তেস্কু;-এর দেখানো পথে গ্রীক মডেলের হাজার হাজার বছরের শাসন ব্যবস্থা আর আমেরিকার আব্রাহাম লিংকনের ‘শিল্প বিপ্লব’ পরবর্তী দেশ পরিচালনার রাষ্ট্রীয় কাঠামো-ই হয়ে উঠলো ‘আধুনিক গণতন্ত্র’। অবশ্য ‘এরর’ এবং ‘ট্রায়াল’ ব্যাসিসে গণতন্ত্রের বিভিন্ন মডেলের কাটছাঁট সবসময় চলমান ছিলো এবং ভবিষ্যতেও চলতে থাকবে। সাম্রাজ্যবাদী ইংরেজরা ১৯০ বছর বৃহত্তর বাংলা-বিহার-উড়িষ্যাকে শাসন করলেও তারা গণতন্ত্রের ধার ধারেন নি। কিন্তু ১৯৪৭ সালে উপমহাদেশ ছেড়ে যাওয়ার সময় আমাদেরকে ‘গণতন্ত্রের লাল মোয়া’ ধরিয়ে দিয়ে গিয়েছিলেন। ৭১-এ আরেক যুদ্ধের মাধ্যমে পূর্ব পাকিস্তান (পূর্ব বাংলা) আলাদা হয়ে নামকরণ করে বাংলাদেশ। লাখো মানুষের আত্নাহুতির বিনিময়ে অর্জিত বাংলাদেশের রাষ্ট্র প্রধান হলেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবর রহমান। খণ্ডিত হলো দেশ কিন্তু অখণ্ড চিন্তা দিয়ে টিকিয়ে রাখতে হবে দেশ ও জাতি। তাই জাতীয়তাবাদের মোড়কে বাংলাদেশের জন্য তৈরি হলো সংবিধান, ঘোষণা করা হলো জাতীয় সঙ্গীত, জাতীয় প্রতীক, জাতীয় পতাকা ইত্যাদি ইত্যাদি। যাতে করে এ ভূখণ্ডের মানুষ একই ধাঁচের চেতনা বোধে জাগ্রত হতে পারে। কিন্তু জাতীয় পতাকা বা জাতীয় সঙ্গীত নিয়ে টুকটাক কানাঘুষা তখন থেকেই চাউর হয়েছিলো।
৫ আগস্ট ২০২৪-এ ছাত্র-জনতার গণঅভ্যুত্থানে জগদ্দল পাথরের মতো চেপে বসা বিশ্বের নিষ্ঠুরতম স্বৈরাচারী, খুনি সরকারের পতন হলে বর্তমানে জাতীয় সঙ্গীত নিয়ে আবার তীব্র আলোচনা-সমালোচনা হচ্ছে। প্রশ্ন হলো- বৈষম্য বিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সাথে জাতীয় সঙ্গীতের সাথে কী বিরোধ? কেনই-বা জাতীয় সঙ্গীত পরিবর্তনের দাবি জোরালো হচ্ছে? চলুন এ প্রসঙ্গে কিছু কথা জেনে নিই।
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের মেধা-মননের ফসল হলো ‘আমার সোনার বাংলা’ নামক কবিতাটি। আমরা সবাই জানি, চতুর ইংরেজ ফিরিঙ্গিরা ১৯০৫ সালে ‘ডিভাইড অ্যান্ড রুল’ এর মারপ্যাঁচে বাংলাকে দ্বি-খণ্ডিত করে ফেলে। এতে পূর্ব বাংলা হয়ে যায় নবগঠিত পূর্ব বাংলা ও আসাম নিয়ে পূণঃবিন্যাসকৃত একটি প্রদেশ। যার রাজধানী ঢাকা (উল্লেখ্য, তখনকার আসাম বলতে বর্তমান সেভেন সিস্টারের বড় একটি অংশ ছিলো যা পরে ভেঙে মেঘালয়, মিজোরাম, নাগাল্যান্ড ও অরুনাচল প্রদেশ হয়েছে)। বাংলা ভেঙে গেলে পশ্চিম বাংলার নব্য ইংরেজী শিক্ষায় শিক্ষিত বাবুরা প্রমাদ গুনতে থাকেন তাদের ব্যবসা-বাণিজ্য, চাকরি, শিল্প, ক্ষমতা প্রভৃতি হারিয়ে ফেলবেন। কিন্তু তখনকার বাস্তবতায় ভারতের পূর্বাঞ্চলের উন্নতির জন্য ঢাকাকে প্রাদেশিক রাজধানী করার বিকল্প ছিলো না। পলাশির যুদ্ধের পরে মুর্শিদাবাদ, ঢাকা, চট্টগ্রাম ও খুলনা তথা সমস্ত পূর্ব বাংলার দিন-মজুরের শোষণের টাকায় গড়ে উঠে ব্রিটিশ ভারতের রাজধানী ‘কলকাতা’। যদিও ঢাকা প্রতিষ্ঠিত হয়েছিলো কলকাতার প্রায় দেড় শত বছর পূর্বে ১৬১০ সালে। ঐ পরিস্থিতিতে শিল্প, সাহিত্য, সংস্কৃতি ও অর্থবিত্তে বলিয়ান জমিদার রবি ঠাকুর রচনা করেন- ‘আমার সোনার বাংলা’। অতঃপর রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর উক্ত কবিতাটি গানে সুরারোপ করে বঙ্গভঙ্গ আন্দোলনকে বেগবান করার জন্য কলকাতার রাস্তা-ঘাটে গণসঙ্গীত হিসেবে গেয়ে মানুষকে উজ্জীবিত করেছেন। সেই আলোকে বলা যায়- গানটি দুই বাংলাকে একত্রিত করার জন্য রচিত হয়েছিলো। কিন্তু বর্তমানে ১৯৪৭ সাল থেকে দুই বাংলা পৃথক অস্তিত্বে বিরাজমান।
আমরা জানি, বাংলার হিন্দু জনগোষ্ঠী বিভিন্ন দেবদেবীর পূজা করে। ঠাকুর পরিবারও সেই ভাবাদর্শ থেকে মুক্ত ছিলো না। তাই রবীন্দ্রনাথ উক্ত ২৫ লাইনের কবিতায় দেবীকে ‘মা’ বলে সম্বোধন করেছেন এবং দেবীর চরণে মাথা ঠেকাবার কথা বলেছেন। কবিতাটি মূলত দেশ ও দেবীর সৌন্দর্য বর্ণন, ধর্মীয় চেতনা ও আত্নমুগ্ধতার বয়ানে রচিত। কিন্তু বর্তমান বাংলাদেশের সিংহভাগ লোকই ঠাকুর পরিবারের ধর্মীয় চেতনার (হিন্দুত্ববাদ) অংশ না। গণতন্ত্রে সংখ্যাগুরুর আদর্শকে ভূ-লণ্ঠিত করা হয় না। কিন্তু এক্ষেত্রে জাতীয় সঙ্গীতে বেশির ভাগ মানুষের ধারণকৃত (ধর্ম) মতামতের প্রতিফলন পাওয়া যায় কি?
প্রখ্যাত বাউল ‘গগণ হরকরা’র বাউল সুর থেকে নকল করে ‘সোনার বাংলা’ গানটিকে জাতীয় সঙ্গীত করার মাধ্যমে ১৮ কোটি মানুষের বুদ্ধিবৃত্তিক দায়হীনতাকে দেখছেন কেউ কেউ। কেননা এটি রবীন্দ্রনাথের মৌলিক সুরারোপিত গান নয়। প্রাগৈতিহাসিক কাল থেকে বাঙালি জাতি শিল্প-সাহিত্য-সংস্কৃতি ও সঙ্গীতে অপরাজেয়। বিশ্ব ইতিহাসে বাংলার ঐতিহ্য ও সংস্কৃতির তুলনা শুধু বাংলার সাথেই চলে। বর্তমানেও আমরা সাহিত্য বা সঙ্গীতে এতো কাঙাল জাতি হয়ে উঠিনি যে, নতুন করে কোনো জাতীয় সঙ্গীত রচনা করতে পারবো না অথবা রচনাকৃত শত শত মৌলিক দেশাত্মবোধক গান হতে একটি গানকে জাতীয় সঙ্গীত হিসেবে বেছে নিতে পারবো না !
১৯০৫ সালের প্রেক্ষাপটে রচিত ‘সোনার বাংলা’ গানটি কলকাতায় বসে থাকা ইংরেজ দোসর, রক্তচোষা জমিদারদের স্বার্থ রক্ষার জন্য লিখিত হয়েছিলো যারা বর্তমান বাংলাদেশ সহ সেভেন সিস্টার্সের বিভিন্ন অংশে জমিদারি কায়েম করে টাকা পাচার করতো কলকাতা বা ইউরোপে। ১৯৭১-এ আমরা পাকিস্তানের ভাঙন ঘটিয়েছিলাম বৈষম্যের বিরুদ্ধে ন্যায় বিচার প্রতিষ্ঠার জন্য। কিন্তু বর্তমান জাতীয় সঙ্গীত আমাদের আবার সেই ১৯০৫-এর বৈষম্যে দাঁড় করিয়ে দেয়। আজ ২০২৪-এর নতুন চেতনায় ৫ আগস্টের ‘জাতীয় মুক্তি দিবস’-এর স্তম্ভে দাঁড়িয়ে এ গানের বাধ্যবাধকতা বা আবেদন-ই বা কতটুকু তা বিজ্ঞ সমাজের কাছে এক অনির্মোহ প্রশ্ন।
দেশের তথাকথিত কিছু শিল্পী, সাহিত্যিক ‘আমার সোনার বাংলা’ গানটিকে আমাদের মুক্তিযুদ্ধের ধারক ও বাহক হিসেবে চালাবার প্রয়াস দেখাচ্ছেন। তাঁদের মতে, এটি শুধু মাত্র একটি গানই নয়, এটি আমাদের জাতীয় চেতনার অংশ। প্রশ্ন হলো, চেতনার এই ‘মাইন্ড ফ্রেমিং’ তাঁদের অন্তরে কীভাবে তৈরি হলো? এটা কি শুনতে শুনতে একটি ভালো লাগার বিষয় আর এটাই মহাচেতনা? তাই নয় কি? কিন্তু এ বিজ্ঞ জনেরা ইতিহাসের আস্তাকুঁড়ে নিক্ষিপ্ত হবেন যদি দেখেন ১৯৭১-এর রণাঙ্গনের যোদ্ধাদের উজ্জীবিত করার গানগুলো। সেখানে মূলত কাজী নজরুল ইসলাম, দীজেন্দ্রলাল রায়, সুকান্ত, জীবনানন্দ, শামসুর রাহমান বা তখনকার দিনের এপার বাংলা – ওপার বাংলার জনপ্রিয় কবি বা শিল্পীদের কবিতা ও গান গাওয়া হতো। পরবর্তীতে ১৯৭২ সালে ‘ভারত-বাংলাদেশ যৌথ বাহিনী’র অলিখিত প্রেসক্রিপশনে গানটিকে বাংলাদেশের জাতীয় সঙ্গীত হিসেবে চাপিয়ে দেওয়া হয়। তাছাড়াও এক গানটিতে ‘বাংলাদেশ’ শব্দটি পর্যন্ত নেই, আছে ‘বাংলা’ শব্দটি, যা দুই বাংলা মিলিত হলেই কেবল সম্ভব।
দেশকে ‘মা’ বলা, এটা আমাদের সংস্কৃতি নয়। কেননা পবিত্র কুরআন অনুসারে ‘মা’ কেবল তিনিই, যিনি জন্ম দেন। আমাদের বর্তমান জাতীয় সঙ্গীতের কথা, চেতনা, ভাবাদর্শ ও আনুষ্ঠানিকতা ইসলামের আক্বীদা ও মানহাজ পরিপন্থি। আবার একই সাথে তার কথা ও চেতনা দেবত্ববাদকে ঘিরে। তাই বলা যায়, এই সঙ্গীত যেমন ‘ননসেক্যুলার’ তেমনি কোটি কোটি মুসলিম তথা এই অঞ্চলের বৃহত্তর জনগোষ্ঠীর ধর্মীয় অনুভূতির সাথে খাপ খায় না এমন একটি সঙ্গীত।
সময় থেমে থাকে না, সময় বদলায়। তেমনি সংস্কৃতিও বদলায়। শুধু বদলায় না সংস্কৃতির একটি উপাদান, আর তা হলো ‘ধর্ম’। এখন প্রশ্ন হলো- জাতীয় সঙ্গীত কি ঐশী বাণী? জাতীয় সঙ্গীত কি ধর্মের মর্যাদায় অভিষিক্ত- যে তাকে পরিবর্তন করা যাবে না? ইতিহাস সাক্ষ্য দেয়, রবীন্দ্রনাথ আমাদের স্বাধীন বাংলাদেশ চাননি, এদেশের মানুষ উচ্চ শিক্ষিত হোক তা-ও তিনি চাননি, তাই তো ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার বিরোধিতা করে বলেছিলেন- “মূর্খের দেশে আবার কীসের বিশ্ববিদ্যালয়? তারা তো (পূর্ব বাংলার লোক) ঠিক মতো কথাই বলতে জানে না।” বর্তমান পৃথিবীর উন্নত বা উন্নয়নশীল দেশ যেমন- জার্মানি, ফ্রান্স, ইংল্যান্ড, অস্ট্রেলিয়া, রাশিয়া, তুরস্ক, ইরাক, নেপাল বা শ্রীলঙ্কার দিকে তাকালে দেখা যায় তারা তাদের জাতীয় সঙ্গীতকে পরিবর্তন করেছেন। তবে কোন্ মানদণ্ডে ‘আমার সোনার বাংলা’ এই গানটি আজও আমাদের জাতীয় সঙ্গীত হিসেবে আছে? একটি দেশের জাতীয় সঙ্গীত হবে সে দেশের জাতি ও জাতীয় সত্তাকে ধারণ ও নির্মাণ করার জন্য। প্রকৃতির ভাসিয়ে দেবার ক্ষমতা আছে। কিন্তু আমরা ‘আশরাফুল মাখলুকাত’। তাই প্রকৃতি আমাদের অনুষঙ্গ। মানুষের জন্য সবকিছু, কিন্তু সব কিছুর জন্য মানুষ নয়। ‘সব কিছুই গতিশীল’- এ সত্যকে সর্বোচ্চ ধারণ করতে পারে একটি জ্ঞান ভিত্তিক সমাজ ব্যবস্থা। ‘সোনার বাংলা’ গানে প্রকৃতির চিত্রকল্প দৃশ্যমান হয়ে ওঠে, তাই ব্যক্তি মাত্রই ‘নস্টালজিক’ হয়। কিন্তু কোনো কিছুই চিরন্তন নয়। যা সত্য ও ভালো তা নতুন বা কালো যা-ই হোক আমরা তার পক্ষে। আমাদের সাংস্কৃতিক চিন্তাধারা যেন ধর্মীয় মূল্যবোধকে পদদলিত না করে।
জাতীয় সঙ্গীত ঘুমন্ত জাতিকে জাগিয়ে তুলবে, রক্তে ছোটাবে প্রগতির জোয়ার, জাতীয় সঙ্গীতে থাকবে উজ্জীবিত হওয়ার মন্ত্রণা, আধ্যাত্মিক চেতনা। তাই বাঙালি ও বাঙালি জাতির শপথ, প্রতিজ্ঞা ও অঙ্গীকার ফুটে উঠবে আমাদের জাতীয় সঙ্গীতে। কেননা দিন শেষে আমরা বাঙালি। এরপরেও যারা খোঁড়া যুক্তিতে গোঁড়াবাদী হয়ে থাকবেন তাদেরকে রবি ঠাকুরের ভাষায়-ই বলবো (কেননা আমি লেখক রবীন্দ্রনাথের বিরোধী নই), “সাতকোটি সন্তানের হে মুগ্ধ জননী, রেখেছো বাঙালি করে মানুষ করোনি।” তাই চেতনার গোঁড়াবাদীরা মনে রাখবেন, আঠারো কোটি মানুষের মধ্যে আপনারা কিন্তু ওই ‘সাতকোটি’। আর বাকিরা সংখ্যাগরিষ্ঠ ! সুতরাং, ‘মানুষ’ হোন আর মেনে নিন ‘জয় গণতন্ত্রের জয়’- এটা আগস্টের ‘গণ বিপ্লব’-এর দাবি।