সামসুল ইসলাম টুকু: আমার বড় ছেলে হাসান মমতাজ ২০০৮ সালের শেষের দিকে বিএডিসিতে সহকারী প্রকৌশলী (সিভিল) হিসেবে যোগদান করে। ২০১৩ সালে পদন্নোতি পেয়ে নির্বাহী প্রকৌশলী হয়। চাকরীতে কর্মরত থাকার সময় ঠিকাদারদের হুমকী এবং উর্ধতন কর্মকর্তাদের খবরদারী তাকে অতিষ্ঠ করে তুলে। তাই তার খেয়াল হলো অষ্ট্রেলিয়া যাওয়ার। এ জন্য কয়েকবার আইইএলটিএস পরিক্ষা দিয়ে প্রয়োজনীয় নম্বর পেলে ২০১৪ সালে মাত্র ১৫% ছাড়ে অষ্ট্রেলিয়ার এডিলেডের একটি বিশ্ববিদ্যালয়ে ইন্টিগ্রেটেড ওয়াটার ম্যানেজমেন্ট বিষয়ে মাষ্টার্স ডিগ্রী নেওয়ার সূযোগ পায়। সেই লক্ষকে সামনে রেখে স্ত্রী সহ পিআর এর জন্য আবেদন করে এডিলেড রাজ্য সরকারের কাছে। প্রায় ৩ বছর চেষ্টা চালানোর পর সফল হয়। এরপর বিএডিসির কাছে দুই বছরের ছুটি মনজুর করে ভিসা পেয়ে ২০১৮ সালে পরিবারের মায়া ত্যাগ করে উড়াল দেয়। আমার পরিবারে একটা শূন্যতার সৃষ্টি হলেও তাকে উৎসাহিত করলাম এবং তার সফলকাম হওয়ার জন্য প্রার্থনা করলাম। ছেলে সেখানে গিয়ে মাষ্টার্স এর একটি সেমিস্টার শেষ হতেই এডিলেড বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন বাঙ্গালী অধ্যাপকের কাছ থেকে পিএইচডি করার অফার পেলেন পুরো স্টাইফেন্ড ও খাওয়া খরচসহ। এ এক অভাবিত অফার। এ সূযোগ ছাড়া যায়না। একদিন ভর্তি হয়ে গেল কংক্রিট বিষয়ে পিএইচডি ডিগ্রী নেওয়ার জন্য। চার বছরে পিএইচডি শেষ হতেই নর্থ সাউথ ওয়েলস রাজ্য সরকারের অধীনে পানি ও পরিবেশ সেক্টরে চাকরীর আবেদন করলে সেখানেও পরিক্ষায় উত্তীর্ন হয়ে চাকরীতে যোগদান করে। ইতোমধ্যে ছেলে তার স্ত্রীকেও অষ্ট্রেলিয়া নিয়ে যায় এবং সিডনীর মিন্টোতে বাসা নিয়ে থিতু হয়। এরপর ছেলে তার বাবা মাকে অষ্ট্রেলিয়া বেড়াতে নিয়ে যাবার জন্য নর্থ সাউথ ওয়েলস রাজ্য সরকারের কাছে আমাদের ভিসার জন্য আবেদন করে। যথারীতি ভিসাও পেলাম কিন্তু ওই রাজ্য সরকারের বৈষম্যমূলক আচরনের কারনে আমার ভিসা হলো এক বছরের জন্য এবং থাকার জন্য কিন্তু আমার স্ত্রীর ভিসা হলো তিন বছরের জন্য তবে তিন মাস পর পর থাকতে পারবে।
তারপরেও আমরা ভীষন খুশি হলাম স্বপ্নের দেশ দেখতে পাবো বলে। ৬ আগাষ্ট হিরোসিমা নাগাসাকি দিবসে আমাদের ফ্লাইট। আমার মেজো ছেলে ও ছোট ছেলে সেদিন আমাদের জিয়া আন্তর্জাতিক বিমান বন্দরে নিয়ে গেল। রাত ৮ টায় আমরা সিঙ্গাপুর এয়ারলাইন্সের বিমানে উড়াল দিলাম। মাঝে সিঙ্গাপুরে ৬ ঘন্টার ট্রাঞ্জিট। ট্রাঞ্জিট শেষে সিঙ্গাপুর এয়ারলসাইন্সের আরেকটি বিমানে উঠলাম। তখন দুপুর বেলা। সাদা তুলার মেঘ ভেদ করে প্রথমে আমরা নিচে প্রশান্ত মহাসাগরের নীল জলরাশি দেখলাম। এরপরে দৃষ্টিগোচর হলো অষ্ট্রেলিয়ার মরুভূমি। এক বিচিত্র অনুভূতি মোহবিষ্ট করে রাখলো আমাদের। আমরা সিডনী পৌছলাম পরদিন সন্ধ্যা ৮টায়। বড় ছেলে আমাদের জন্য গাড়ি নিয়ে অপেক্ষা করছিল। রাত ৯টায় আমরা ছেলের মিন্টোস্থ বাসভবনে পৌছলাম।আমার এই ছেলের সুবাদেই অষ্ট্রেলিয়া দেখার মহাসুযোগ পেলাম।
বহুকাল ধরেই অষ্ট্রেলিয়ার দুটি স্থাপনার কথা শুনে এসেছি। তাহলো সিডনী হারবার ব্রীজ ও অপেরা হাউস। প্রথম ৭দিন কাটলো দীর্ঘ বিমান ভ্রমনের ধকল কাটাতে। এরপর ছেলে তার ছুটির দিন বললো চলেন অপেরা হাউস দেখে আসি। আমরা তো মহা খুশি। সকালের নাস্তা করে এবং দুপুরের খাবার প্লাষ্টিকের বক্সে ভরে আর দুবোতল পানি সাথে নিয়ে আমার বউমা খাদিজা প্রস্তুত। ছেলে গাড়ি নিয়ে মিন্টো রেলষ্টেশনে এলো এবং সেখানে পার্কিং প্লেসে গাড়ি রেখে দিল। কারন সিডনীতে গাড়ি পার্কিং একটা সমস্যা আবার পার্কিং প্লেস থেকে হেঁটে অপেরা হাউস যাতায়াত কষ্টকর হবে। তাই আমরা ট্রেনে যাত্রা করলাম। এমন দোতালা বিদ্যুৎ বাহিত ট্রেন তো বাংলাদেশে দেখিনি। তাছাড়া ট্রেনের বগি ও প্লাটফর্ম একই সমান্তরালে যেন কোনো বিকলাং মানুষ বা তার হুইল চেয়ার উঠাতে কোনোই কষ্ট নাহয়। প্রায় ৪৫ মিনিট পর আমরা সার্কুলার কোয়ে রেলষ্টেশনে পৌছলাম। ষ্টেশন থেকেই দেখা যাচ্ছিল হারবার ব্রীজ।
আমরা আকাশ্চুম্বি ৫০/৬০ তলা বিশিষ্ট বেশ কিছু ভবনের পাশ দিয়ে মিনিট পাচেক হেঁটে অপেরা হাউসের গ্রাউন্ডে পৌছে গেলাম। এই জায়গাটির নাম পোর্ট জ্যাকসন। অর্থাৎ পাশেই অষ্ট্রেলিয়ার সবচেয়ে ব্যাস্ততম সমুদ্র বন্দর এবং হারবার ব্রীজ। অপেরা হাউসের গ্রাউন্ডে এসে দেখলাম হাউসের সামনে সোপানে সোপানে উপরে উঠে গেছে অসংখ্য সিঁড়ি বা গ্যালারী। গ্যালারীতে বসে আছে অসংখ্য রঙ বেরঙ্গের মানুষ। অপেরা হাউসের ছাদের উপরে রয়েছে সাদা চকচকে বিশাল নৌকার পাল সদৃশ্য কয়েকটি সুউচ্চ ছাউনি। সেটাই হচ্ছে অপেরা হাউসের মূল সৌন্দর্য বা আকর্ষন। এ জন্যই অপেরা হাউস বিশ্ববিখ্যাত। শুধু চেয়ে চেয়ে দেখলাম আর অভিভূত হলাম। অভুতপুর্ব এর নির্মান কৌশল। স্থাপত্যের বিশ্বখ্যাত প্রতীক এই অপেরা হাউস। বিশ্বের বিখ্যাত এবং স্বতন্ত্র ভবনগুলির মধ্যে শতাব্দীর শ্রেষ্ঠ নিদর্শন। দূর থেকে দেখলে মনে হবে এটি একটা দ্বীপ। সমুদ্র পৃষ্ঠ থেকে ৬৮ মিটার উঁচু ওই সাদা পালগুলি। যা ২২ তলা ভবনের উচ্চতার সমান। অনেক ক্ষন দেখলাম ভবনটি। তারপরে ভবনটির চারপাশ ঘুরে দেখলাম ,ছবি তুললাম। বাংলাভাষি পর্যটকদের দেখলাম বাংলায় কথা বলতে বলতে চলেছে। দুএ্ক জনের সাথে কথা বললাম।
১৯৫৯ সালের ২ মার্চ অপেরাহাউসের নির্মান কাজ শুরু হয়। উদ্বোধনী দিনে বৃষ্টির মধ্যে ছাতার নিচে দেখা যায় হাজারো মানুষের ভিড়। এ ভবনের নকশা প্রনয়ন করেন ড্যানিস স্থাপত্যবিদ জন উটজেম। প্রায় ১০ হাজার শ্রমিক রাত দিন পরিশ্রম করে ১৪ বছরে নির্মান কাজ সম্পন্ন করে। এতে ব্যয় হয় ১০২ মিলিয়ন মার্কিন ডলার। ১৯৭৩ সালে অপেরা হাউসের দরজা খুলে দেওয়া হয়। তখন সাংস্কৃতিক আবিস্কারের এক নতুন যুগের সূচনা হয়। ৫ দশক পরে এটি দেশের শীর্ষ স্থানীয় পর্যটন গন্তব্য ও বিশ্বের ব্যাস্ততম পারফর্মিং আর্টস সেন্টারগুলির মধ্যে একটি এবং সমস্ত অষ্ট্রেলিয়ার জন্য সকল সম্প্রদায়ের মিলন্সথলে পরিনত হয়। এটি একটি থিয়েটার ভবন যা অপেরা পরিবেশনার জন্য ব্যবহৃত হয়। এখানে একটি সাধারন মঞ্চ , একটি অর্ক্রেষ্টা পিট , গ্রীন রুম ও দর্শকদের বসার জায়গা রয়েছে। এখানে প্রতি রাউন্ডে ২৬৬৪ জন বসতে পারে। প্রতি বছর এখানে ১,২ মিলিয়ন মানুষ অংশ গ্রহন করে এবং ১৫০০ টির বেশি অপেরা প্রদর্শিত হয়। ভবনটি প্রতি বছর ৮০ লাখ মানুষ পরিদর্শন করে। অপেরা হাউস পরিদর্শনের সবচেয়ে উপযুক্ত সময় সেপ্টেম্বর ও অক্টোবর মাস। এ সময় আবহাওয়া মৃদু থাকে।
অপেরা হাউসের পাশে দাঁড়িয়ে দেখলাম অষ্ট্রেলিয়ার অন্যতম স্থাপত্য সিডনী হারবার ব্রীজ। ব্রীজের উপরে গিয়ে দেখার সূযোগ হয়নি তবে যেটুকু দেখলাম তা মোটেও কম নয়। ডয়েস পয়েন্ট দক্ষিন থেকে মিলসন পয়েন্ট পর্যন্ত ১১৪৯ মিটার বা ৩৭৭০ ফুট দীর্ঘ , ৪৮,৮ মিটার বা ১৬০ ফুট প্রস্থ ব্রীজটি দেখে মনে হবে ধনুকের মত বাঁকানো কাঠামোর নিচে ঝুলে আছে। দুই পারে ৪ টি ভারী স্প্যানের মধ্যে দুটি ধনুক আঁটকানো আছে নদীর মাঝখানে কোনো স্প্যান নাই। সিডনী ব্রীজকে এখানে বলা হয় কোট হ্যাঙ্গার ব্রীজ। ব্রীজটির উচ্চতা সমুদ্র পৃষ্ঠ থেকে ৪৪০ ফুট আর এর দীর্ঘতম স্প্যানটির উচ্চতা ১৬৫০ ফুট। ব্রীজটিতে ৫৩ হাজার টন স্টীল ব্যাবহৃত হয়েছে। ব্রীজটির নকশা প্রনয়ন করেন জন ব্রাড ফিল্ড। বিভিন্ন দেশ থেকে আনা দুই হাজার দক্ষ লৌহ কর্মী ৮ বছরে এ ব্রীজটি নির্মান করেন। এ সময় ১৬ জন নির্মাম কর্মী মারা যায়। ১৯২৩ সালের ২৮ জুলাই এর নির্মান কাজ শুরু হয় এবং ১৯৩২ সালের ১৭ জানুয়ারী শেষ হয়।এর নির্মান ব্যয় হয় ৬২ লাখ ৫০ হাজার পাউন্ড। এর আয়ুস্কাল ধরা হয়েছে ৯০ বছর। ব্রীজটি নির্মান করে ডোরম্যান লংকোম্পানী। ব্রীজের উদবোধনী দিনে ব্রীজের দুই পাশে প্রায় ১০ লাখ মানুষ সমবেত হয়। দিনটি ছিল অষ্ট্রেলিয়াবাসীর জাতীয় মিলনমেলা। ব্রীজটি অষ্ট্রেলিয় জাতীর মাইল ফলক হিসেবে চিহ্নিত করা হয়। বর্তমানে এই ব্রীজ ব্যাবহারকারী যানবাহনের সংখ্যা প্রতিদিন প্রায় ১ লাখ ৬০ হাজার।
দৃষ্টি নন্দন এই ব্রীজটি বিশ্ব জুড়ে এতই বিখ্যাত যে এটিকে অষ্ট্রেলিয়ার স্মারক হিসেবে বিবেচনা করা হয়। ব্রীজটির অন্যতম আকর্ষন হচ্ছে ব্রীজ ক্লাইম্বার। ব্রীজের উপরে উঠলে পুরো সিডনী শহরের ভিউ দেখা যায়। এর উপরে উঠতে গেলে ১৩৩২ টি সিঁড়ি বেয়ে যেতে হয়। এর মধ্যে বেশ কয়েকটি ল্যান্ডিং স্টেশন রয়েছে। সেখানে যাত্রীদের সহযোগিতা করার জন্য ডাক্তার সহ প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা রয়েছে। ব্রীজে রয়েছে আপ-ডাউন রেলপথ , সড়কপথ ও ফুট পাথ। প্রতি ৫ বছর পর পর ব্রীজটির সংস্কার করা হয় , আর এ জন্য ২০ মিলিয়ন ডলার বরাদ্দ থাকে।
পরিবার সহ অষ্ট্রেলিয়ার বিখ্যাত দুটি স্থাপনা দেখার দুর্লভ অভিজ্ঞতা অর্জন করলাম। :