এম,এ ইউসুফ শামীম : সিডনির কনকর্ড হাসপাতালের (১৭ জুলাই ২০২৫ বৃহস্পতিবার) নির্জন এক রাতে, দীর্ঘদিনের অসুস্থতা সঙ্গী করে চিরবিদায় নিলেন আমাদের সকলের শ্রদ্ধেয়, প্রিয় মুখ-আবুল বাশার খাঁন। ইন্না লিল্লাহি ওয়া ইন্না ইলাইহি রাজিউন। মৃত্যুকালে তাঁর বয়স হয়েছিল ৬২ বছর। রেখে গেছেন এক পুত্র, এক কন্যা, এবং অসংখ্য আপনজন, আত্মীয়স্বজন, শুভানুধ্যায়ী ও অন্তরঙ্গ বন্ধু-বান্ধব।
বরিশালের মানুষ ছিলেন তিনি — নরম মাটির মত কোমল, অথচ নীতির জায়গায় ছিলেন অটল এক দৃঢ়তা। জীবন তাঁকে ঘুরিয়ে এনেছিল জাপান হয়ে অস্ট্রেলিয়ার সিডনিতে, ১৯৮৬ সালে। তখন থেকেই সিডনির ল্যাকেম্বায় তিনি শুধু একজন বাসিন্দা ছিলেন না, ছিলেন আশেপাশের মানুষদের অভিভাবক, অভয়ারণ্যস্বরূপ এক আশ্রয়। সবাই তাঁকে ভালোবেসে ডাকতেন “দাদু” নামে যেন একটা সম্পর্কের নাম নয়, ভালোবাসার আরেকটি রূপ।
খোলা মনে হাসতেন, দরজা ছিল সবার জন্য উন্মুক্ত। কারো বিপদে নিজে না গিয়ে থাকতে পারতেন না। কোনো দল, মত, ভেদাভেদ তাঁর মানবিক দায়িত্ববোধকে স্পর্শ করতে পারেনি কখনও। প্রয়োজনে পাশে দাঁড়াতেন নীরবে যেন এক ছায়া, নিঃশব্দ তবু অপরিহার্য।
তাঁর মধ্যে ছিল এক অসাধারণ গুণ — মেহমানদারি। তাঁর আতিথেয়তার গল্প সিডনির প্রতিটি বাঙালি পরিবারের মুখে মুখে ফেরে। যিনি দাওয়াতে ডাকলে নিশ্চিত থাকা যেতো, কমপক্ষে ১৪-১৫ রকম পদ মুখরোচক ভাবে সাজিয়ে বসে আছেন তিনি। কেউ আসবে শুনলেই নিজের হাতে তুলে দিতেন সিজনের তাজা লাউ, সিম, ধনেপাতা। এমনকি নিজেই অনেকসময় চলে যেতেন মানুষের বাড়িতে শুধু দেবার জন্য।
এই উদারতা ছিল তাঁর জীবনের ধর্ম। এই ভালোবাসা ছিল তার নেশা।
তিন বছর আগে ওপেন হার্ট সার্জারির পর তাঁর শরীর দুর্বল হয়ে পড়লেও তাঁর মানসিক শক্তি এতটুকু কমেনি। বরং কমিউনিটির উন্নয়নে তিনি ছিলেন আরও নিবেদিত প্রাণ। গত এগারো মাস ধরে লিভার সিরোসিসের কঠিন যন্ত্রণায় ভুগলেও শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত জীবনের প্রতি আশা হারাননি।
শেষবার চিকিৎসার আশায় গিয়েছিলেন কনকর্ড হাসপাতালে — কিন্তু ফিরে আসেননি আর।
ফিরে এসেছে শুধু স্মৃতি, কণ্ঠে ঘোরাফেরা করে সেই ডাক — “দাদু”।
আজ হয়তো আর কেউ তাঁকে সিডনির রাস্তায় “দাদু” বলে ডাকবে না।
কিন্তু তাঁর ছায়া, তাঁর অবদান, আর ভালোবাসার সেই অনন্ত ধারা — কমিউনিটির হৃদয়ে বেঁচে থাকবে অনন্তকাল।
এ ক্ষণজন্মা মহৎপ্রাণ ব্যক্তির শেষ আনুষ্ঠানিকতা সম্পন্ন হয় গত শুক্রবার, ১৮ জুলাই ২০২৫, ল্যাকেম্বার লেবানিজ মুসলিম অ্যাসোসিয়েশনের ব্যবস্থাপনায়। আলী বিন আবি তালিব মসজিদ বা লাকেম্বার বড় মসজিদে জুমার নামাজের পর জানাজা অনুষ্ঠিত হয় এবং এরপর তাঁকে সিডনির কেম্পস ক্রিক কবরস্থানে চিরনিদ্রায় শায়িত করা হয়।
আল্লাহপাক আমাদের এই প্রিয় মানুষটিকে জান্নাতুল ফেরদৌসের সর্বোচ্চ আসনে স্থান দিন,
আর তাঁর শোকসন্তপ্ত পরিবারকে এ শোক সহ্য করার অবলম্বন ও ধৈর্য দান করুন।
আমীন।