স্মৃতির রক্তমাখা পাথরে লেখা স্রেব্রেনিকার নাম

আয়াজ আহমদ বাঙালি : ১৯৯৫ সালের জুলাইয়ে স্রেব্রেনিকায় ঘটে যাওয়া গণহত্যা ইতিহাসের এক বিভীষিকাময় দৃষ্টান্ত। একবিংশ শতাব্দীর দোরগোড়ায় দাঁড়িয়ে এমন নিষ্ঠুর ও পরিকল্পিতভাবে ৮,০০০ মুসলিম পুরুষ ও কিশোরকে হত্যা করা হয়েছিল, যা আজও বিশ্ব বিবেককে প্রশ্নবিদ্ধ করে। ঘটনার ৩০ বছর পরেও নিহতদের আত্মীয়-স্বজনদের বুকের কান্না শুকায়নি বরং আরও গাঢ় হয়েছে। এখনো বহু মৃতদেহ শনাক্ত করা যায়নি, এখনো মা তাঁর সন্তানের হাড় বুকে জড়িয়ে কান্না করেন, এখনো গণকবরে মাটি সরিয়ে উঠে আসে সেদিনের প্রমাণ।

এই গণহত্যা ছিল জাতিগত বিদ্বেষ, ক্ষমতার রাজনীতি ও আন্তর্জাতিক উদাসীনতার এক নির্মম প্রতিফলন। জাতিসংঘের “সেফ জোন” ঘোষণার পরেও স্রেব্রেনিকায় শান্তিরক্ষীদের চোখের সামনেই সংগঠিত হয়েছিল এই হত্যাযজ্ঞ। সেই সময় ডাচ শান্তিরক্ষীরা কার্যত নিষ্ক্রিয় থেকেছিল। জাতিসংঘের ‘রক্ষা’র আশায় আশ্রয় নেওয়া নিরীহ মানুষদের ছেড়ে দেওয়া হয়েছিল হত্যাকারীদের হাতে। ফলে প্রশ্ন ওঠে—মানবতা যখন চরম বিপর্যয়ে, তখন আন্তর্জাতিক সমাজ কতটা কার্যকর?

ত্রিশ বছর পরেও স্রেব্রেনিকার মানুষ বিচার চায়, স্বীকৃতি চায়, চায় সম্মান। যারা হারিয়েছে বাবাকে, ভাইকে, স্বামীকে—তারা কেবল মৃতদেহ নয়, ফিরে পেতে চায় একটি সন্মানজনক স্মৃতি, একটি ঐতিহাসিক স্বীকৃতি, যাতে আগামী প্রজন্ম জানতে পারে—এই সভ্য দুনিয়ায় একদিন শুধুমাত্র ধর্মীয় পরিচয়ের কারণে এমন ভয়ংকর হত্যাযজ্ঞ ঘটেছিল।

স্রেব্রেনিকা আমাদের শেখায়, যুদ্ধ শুধু অস্ত্র দিয়ে হয় না, যুদ্ধ হয় ঘৃণা, দমন-পীড়ন ও জাতিগত বিভেদের বীজ বপন করে। এই গণহত্যা ছিল ইউরোপের হৃদয়ে মুসলিম নিধনের সর্বশেষ কাহিনি, যার পুনরাবৃত্তি হওয়া থেকে মানবতাকে রক্ষা করা আমাদের সকলের দায়িত্ব।

তবে এই ঘটনাকে শুধুই অতীতের একটি ঘটনা হিসেবে মনে করলে চলবে না। বর্তমান বিশ্বে ইসলামোফোবিয়া, বর্ণবিদ্বেষ, শরণার্থী বিদ্বেষ যেভাবে বাড়ছে, তা এই ধরনের নতুন স্রেব্রেনিকার ইঙ্গিত দেয়। তাই স্রেব্রেনিকা শুধু একটি শহরের নাম নয়—এটি আমাদের যুগের বিবেকের প্রশ্ন।

এই গণহত্যা আমাদের মনে করিয়ে দেয়, ঘৃণার রাজনীতি কোথায় গিয়ে পৌঁছাতে পারে। যদি আমরা ইতিহাস ভুলে যাই, তবে ভবিষ্যতেও এমন ঘটনা ঘটার সম্ভাবনা থেকেই যায়। তাই শিক্ষা নেওয়া জরুরি।

আমরা চাই, স্রেব্রেনিকার প্রতিটি শহীদের নাম রাষ্ট্রপুঞ্জের নথিতে চিরস্মরণীয় হোক, যেন বিশ্বের কোথাও, কোনোদিন, কোনো জাতি বা ধর্মের নামে আর একটি গণহত্যা না ঘটে এবং আমরা, যারা বেঁচে আছি—তারা যেন ইতিহাসকে মনে রাখি, ঘৃণার বিরুদ্ধে মানবতার পাশে দাঁড়াতে পারি।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *