বিচিত্র কুমার: একটি পাথরের আঘাতে যখন প্রাণ ঝরে যায়, তখন সেটি আর শুধুই একটি হত্যাকাণ্ড থাকে না, তা পরিণত হয় একটি প্রতীকী চিত্রে—সমাজ, রাষ্ট্র এবং মানবিকতার অবক্ষয়ের এক নির্মম দলিলে। আমরা যখন দেখি, শুনি, জানি, কিন্তু কিছুই করি না—তখন আমাদের চুপ থাকা হয়ে ওঠে সেই অপরাধের নিঃশব্দ সহযাত্রী। এমন এক সময়ে আমরা দাঁড়িয়ে, যেখানে একজন মানুষ প্রকাশ্য দিবালোকে হত্যা হচ্ছে, শত শত চোখ তা দেখছে, কিন্তু কেউ এগিয়ে আসছে না। কেউ প্রতিবাদ করছে না, কেউ বাঁধা দিচ্ছে না। শুধু মোবাইল ক্যামেরার ফ্রেমে বন্দি হচ্ছে আরেকটি মৃত্যু। আর এই মৃত্যুর সাক্ষী হয়ে দাঁড়িয়ে থাকে গোটা রাষ্ট্র।
ঘটনাটি কেবল একজন ব্যক্তির মৃত্যুর গল্প নয়। এটি একটি বৃহৎ রাষ্ট্রীয় ও সামাজিক চিত্রের প্রতিফলন। একজন সৎ ব্যবসায়ী—যিনি চাঁদা দিতে অস্বীকৃতি জানিয়েছিলেন—তাকে নির্মমভাবে হত্যা করা হয়। এই হত্যাকাণ্ডটি সরাসরি সম্প্রচার হয় জনমানুষের চোখের সামনে, এবং পরে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়ে। এই দৃশ্য মানুষের হৃদয় ছুঁয়ে যায় ঠিকই, কিন্তু ততক্ষণে অপরাধ সংঘটিত হয়ে গেছে। আমরা এই মৃত্যুর ‘দর্শক’ হিসেবে যা করলাম, তা হলো—ভিডিও করলাম, লাইভ দিলাম, কিন্তু কিছুই করলাম না। এই নিষ্ক্রিয়তা, এই নির্লিপ্ততা, এই নীরবতা—এই সবই আজকের রাষ্ট্রের এক করুণ প্রতিচ্ছবি।
এই মৃত্যু প্রমাণ করে, রাষ্ট্র নামক কাঠামোটি কোথাও না কোথাও বিপর্যস্ত। রাষ্ট্র যেখানে নাগরিকের নিরাপত্তা দিতে ব্যর্থ হয়, সেখানে গণতন্ত্র কেবল সংবিধানের পাতায় সীমাবদ্ধ থাকে। সমাজের প্রতিটি স্তরে অন্যায়, অবিচার, এবং সহিংসতার দৌরাত্ম্য ছড়িয়ে পড়েছে। রাষ্ট্রযন্ত্র, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী, বিচার ব্যবস্থা এবং রাজনৈতিক কাঠামোর সবগুলো স্তরেই কোথাও না কোথাও অসাড়তা, দুর্বলতা এবং দায়িত্বহীনতা লক্ষ করা যায়। ফলে এমন নির্মম হত্যাকাণ্ড কেবল সম্ভবই নয়, বরং নিয়মিত হয়ে উঠেছে।
রাষ্ট্র যদি নাগরিকের মৌলিক অধিকার রক্ষা করতে না পারে, তবে সেই রাষ্ট্র আসলে নাগরিকের জন্য কতটুকু নিরাপদ? আইনের শাসন শুধু বইয়ের পাতায়, আদালতের দেয়ালে কিংবা নেতাদের বক্তৃতায় সীমাবদ্ধ থাকলে, বিচারহীনতার সংস্কৃতি গড়ে ওঠে। এই সংস্কৃতি অপরাধীদের সাহসী করে তোলে, এবং সাধারণ মানুষকে করে তোলে ভীত, নিরুৎসাহী ও নিঃসঙ্গ। চাঁদাবাজি, দখলদারি, পেশিশক্তির ব্যবহার, রাজনৈতিক মদদে সন্ত্রাস—এইসব রাষ্ট্রের অভ্যন্তরীণ দুর্বলতার ফসল। আর এই দুর্বলতার মাশুল গুনতে হয় সাধারণ মানুষকে, যারা প্রতিনিয়ত অবিচার, নিপীড়ন ও সহিংসতার শিকার হয়ে পড়ে।
আজকাল আমরা এমন এক সমাজে বাস করি, যেখানে অপরাধের ভিডিও ভাইরাল হয়, কিন্তু অপরাধী ধরা পড়ে না। যেখানে মৃত্যুর দৃশ্য বিনোদনের উপকরণ হয়ে ওঠে, কিন্তু জীবনের মূল্য হারিয়ে যায়। একজন মানুষ যখন নির্দয়ভাবে পিটিয়ে হত্যা হয়, তখন সেটা দেখে আমরা বলি, “ভয়ানক!” কিন্তু এই ভয়ানক বলার মধ্য দিয়ে কি দায়মুক্তি পাওয়া যায়? আমাদের সামাজিক অবস্থান, নাগরিক দায়িত্ব এবং মানবিকতা কোথায় হারিয়ে যায়, যখন আমরা দাঁড়িয়ে শুধু দেখি, কিন্তু কিছু করি না?
প্রযুক্তি আমাদের অনেক কিছু দিয়েছে। কিন্তু সেই প্রযুক্তি যখন সহানুভূতির জায়গা দখল করে নেয়, তখন আমরা বুঝতে পারি—আমরা কতটা বিচ্ছিন্ন, আত্মকেন্দ্রিক এবং অসাড় হয়ে পড়েছি। একজনের মৃত্যু আমাদের মনে সাময়িক আলোড়ন তোলে, কিন্তু স্থায়ী চেতনা সৃষ্টি করে না। পরের দিনই আমরা আরেকটি নতুন ভিডিওতে ব্যস্ত হয়ে যাই। এভাবেই একটির পর একটি মৃত্যু ঘটছে, আর রাষ্ট্র কেবল সাক্ষী হয়ে দাঁড়িয়ে আছে।
আরও ভয়ঙ্কর ব্যাপার হলো, এই রাষ্ট্রের আইন ব্যবস্থাও এখন আর বিশ্বাসযোগ্য নয়। একজন নাগরিক যখন আইনের প্রতি আস্থা হারিয়ে ফেলে, তখন সে নিজেই বিচারের হাতিয়ার হয়ে ওঠে, অথবা সম্পূর্ণ নীরব হয়ে যায়। বিচারহীনতা শুধু অপরাধীকে শক্তিশালী করে না, নিরীহ মানুষকেও অসহায় করে তোলে। মামলার দীর্ঘসূত্রতা, সাক্ষীর নিরাপত্তার অভাব, রাজনৈতিক প্রভাবের উপস্থিতি—এসব মিলিয়ে একটি কার্যকর বিচারব্যবস্থা আজ অনেকাংশেই প্রশ্নবিদ্ধ।
এই পরিস্থিতির আরও একটি দিক হলো নৈতিক শিক্ষার অভাব। আমাদের শিক্ষা ব্যবস্থায় মানবিকতার শিক্ষা নেই। আমরা শুধু পরীক্ষা, রেজাল্ট, জিপিএর পেছনে ছুটি। অথচ একজন শিশু যদি সহানুভূতি, দয়া, বিবেক ও প্রতিবাদের মূল্য না শেখে, তবে সে বড় হয়ে আর যাই হোক, মানুষ হতে পারবে না। আজ আমরা সেই ফল ভোগ করছি—শিক্ষিত, স্মার্টফোনধারী, সোশ্যাল মিডিয়ায় সক্রিয় এমন মানুষদের দেখে যারা নির্মমতার দৃশ্য রেকর্ড করে কিন্তু বাধা দেয় না। তারা হয়তো রসিকতা করে, হয়তো কৌতূহল মেটায়, হয়তো ভাইরাল হবার লোভে ক্লিপ তৈরি করে। এই আত্মকেন্দ্রিকতা এক ধরণের বিবেকহীনতা, যা সমাজকে ভেতর থেকে পচিয়ে দিচ্ছে।
গণমাধ্যমেরও এখানে বড় ভূমিকা রয়েছে। একটি ঘটনা ঘটার পর মিডিয়া সেটিকে ‘সংবাদ’ হিসেবে দেখায়, আলোচনার টেবিলে আনে, কিন্তু তারপর কি হয়? শুধু টিআরপি বাড়ানোর জন্য কনটেন্ট তৈরি করলে, সামাজিক দায়িত্ব পালন হয় না। বরং গণমাধ্যমের উচিত ছিল জনমত গঠন করা, মানুষকে সচেতন করা, এবং প্রশাসনের উপর চাপ তৈরি করা। কিন্তু আমরা দেখি, এসব ঘটনা কয়েক দিনের মধ্যেই চাপা পড়ে যায়, আর নতুন কোনো ঘটনার অপেক্ষায় থেকে যায় চ্যানেলগুলো। এই চক্র ভাঙতে হবে। গণমাধ্যমকে হতে হবে দায়বদ্ধ ও মানবিক।
এই রাষ্ট্রব্যবস্থার আরেকটি বড় ব্যর্থতা হলো, নাগরিকদের প্রতিবাদী করে তুলতে না পারা। একজন সচেতন নাগরিক কেবল নিজের পরিবার, আয়, ক্যারিয়ার নয়—সমাজের দায়িত্বও নেয়। কিন্তু আমরা এখন এমন এক সমাজে বাস করি, যেখানে প্রতিবাদ মানে ঝামেলা, প্রতিবাদ মানে বিপদ। ফলে মানুষ নিরাপদ নীরবতায় অভ্যস্ত হয়ে যায়। অথচ ইতিহাস বলে—যেখানে মানুষ প্রতিবাদ করে, সেখানে অন্যায় থামে। ফরাসি বিপ্লব, উপমহাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রাম, আমাদের একাত্তর—সবই মানুষের প্রতিবাদের ফল। আমরা যদি এই মূল্যবোধ ভুলে যাই, তবে শুধুই মৃত্যু নয়, পুরো জাতিই নিঃশেষ হয়ে যাবে আত্মা ও চেতনায়।
এই পরিস্থিতি থেকে উত্তরণের পথ আছে, কিন্তু তার জন্য চাই সম্মিলিত উদ্যোগ। প্রথমত, আমাদের বিচার ব্যবস্থাকে আরও কার্যকর, স্বাধীন ও গতিশীল করতে হবে। অপরাধী যে-ই হোক, তার বিচার নিশ্চিত করতে হবে দ্রুত ও নিরপেক্ষভাবে। দ্বিতীয়ত, প্রযুক্তির ইতিবাচক ব্যবহার নিশ্চিত করতে হবে। সোশ্যাল মিডিয়াকে ব্যবহার করতে হবে সচেতনতা ছড়ানোর জন্য, শুধুমাত্র ভাইরাল কনটেন্ট তৈরির জন্য নয়। তৃতীয়ত, শিক্ষার প্রতিটি স্তরে মানবিকতা, সহানুভূতি ও নাগরিক দায়িত্ববোধের শিক্ষা বাধ্যতামূলক করতে হবে।
সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হলো নাগরিকদের মধ্যে সচেতনতা গড়ে তোলা। প্রতিবেশীর প্রতি দায়িত্ব, সমাজের প্রতি শ্রদ্ধা এবং অন্যায়ের বিরুদ্ধে দৃঢ় অবস্থান নেওয়ার শিক্ষা দিতে হবে পরিবার থেকেই। আমরা যদি প্রতিটি মানুষকে শেখাতে পারি যে, একজন মানুষের মৃত্যু মানে একটি সমাজের মৃত্যু—তবে হয়তো আমরা আবার মানুষ হয়ে উঠতে পারব।
এই একটি মৃত্যুর সাক্ষী হয়ে দাঁড়িয়ে রয়েছে গোটা রাষ্ট্র। এই সাক্ষী থাকা একটি কলঙ্ক, একটি লজ্জা, একটি ব্যর্থতা। আমরা যেন আর একজন মানুষকেও এইভাবে হারাতে না দেখি। যেন আমরা কেবল দর্শক না হই—বরং হই প্রতিরোধ, হই প্রতিবাদ, হই সহানুভূতি।
এই মৃত্যু আমাদের চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দেয়—আমরা কোথায় দাঁড়িয়ে। এখনো সময় আছে মুখোশ খুলে ফেলবার, বিবেক জাগাবার, সাহস দেখাবার। নয়তো প্রতিদিন আমাদের সামনে আরও অনেক মৃত্যু হবে, আর আমরা শুধু নির্লিপ্ত সাক্ষী হয়ে থাকব—একটি রাষ্ট্রের মতো।