-হাফেজ মাওলানা ডা.মো. ইমাম হোসাইন: রাসূলুল্লাহ (সা.)-এর আনুগত্য ও অনুসরণের বিষয়ে সর্বপ্রথম যে বিষয় অনুধাবন ও ইমান আনয়ন জরুরী তাহলো ‘মুহাম্মাদুর রাসূলুল্লাহ’- এ বিশ্বাসের অবিচ্ছেদ্য অংশ এবং তাঁর আনুগত্য বা ইতাআত ও অনুকরণ বা ইত্তিবায়ে বিশ্বাস করা। একথা বিশ্বাস করা যে, একমাত্র তাঁর আনুগত্য ও অনুকরণের মাধ্যমেই আল্লাহর সন্তুষ্টি ও মুক্তি পাওয়া সম্ভব। তাঁর আনুগত্য ও অনুকরণের বাইরে কোনোভাবেই আল্লাহর সন্তুষ্টি, মুক্তি বা সাওয়াব অর্জন সম্ভব নয়। মুমিনের দায়িত্ব হলো জীবনের সকল ক্ষেত্রে সার্বিকভাবে তার আনুগত্য করা। জীবনের সকল বিষয়ে, সকল ক্ষেত্রে মহানবীর শিক্ষা, বিধান ও নির্দেশ দ্বিধাহীন চিত্তে মেনে নেওয়া। সকল মানুষের কথা ও সকল মতের উর্দ্ধে রাসূলুল্লাহ (সা.) –এর কথাকে স্থান দেওয়া । কুরআন ও হাদীসে এ বিষয়ে বারংবার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে ।
আল্লাহ বলেন: “আল্লাহ এবং তাঁর রাসূলের হুকুম মান্য কর- যদি ঈমানদার হয়ে থাক । (সূরা আনফাল: আয়াত-০১)
এভাবে কুরআনে বারংবার আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের (সা.) আনুগত্যকে ঈমানের অবিচ্ছেদ্য অংশ হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে এবং মুমিনের জাগতিক সফলতা ও পারলৌকিক মুক্তির শর্ত হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে। আর আল্লাহর আনুগত্য মূলত তাঁর রাসূলের (সা.) আনুগত্যের মাধ্যমেই সম্ভব । কারণ আল্লাহর আনুগত্য করতে হলে তাঁর আদেশ নিষেধ জানতে হবে। আর আল্লাহর আদেশ-নিষেধ একমাত্র রাসূলুল্লাহ -এর প্রাপ্ত ওহীর মাধ্যম ছাড়া কোনোভাবেই জানা সম্ভব নয় । এজন্য আল্লাহ বলেন: “যে ব্যক্তি রাসূলের হুকুম মান্য করল সে আল্লাহরই হুকুম মান্য করল। আর যে লোক বিমুখতা অবলম্বন করল, আমি আপনাকে, তাদের জন্য রক্ষণাবেক্ষণকারী নিযুক্ত করে পাঠাইনি।” (সূরা নিসা : আয়াত-৮০)
সামাজিক, রাষ্ট্রীয় বা ধর্মীয় “উলূল আমর” বা ‘আদেশের মালিক” নেতৃবৃন্দের আনুগত্য প্রয়োজনীয় । তবে এ বিষয়ে যে কোনো মতভেদ হলে তা রাসূলুল্লাহ বা তাঁর শিক্ষার নিকট নিয়ে আসতে হবে বা কুরআন-সুন্নাহ অনুসারে নিষ্পত্তি করতে হবে । মহান আল্লাহ বলেন:
يَا أَيُّهَا الَّذِينَ آمَنُوا أَطِيعُوا اللَّهَ وَأَطِيعُوا الرَّسُولَ وَأُولِي الأَمْرِ مِنْكُمْ فَإِنْ تَنَازَعْتُمْ فِي شَيْءٍ فَرُدُّوهُ إِلَى اللَّهِ وَالرَّسُولِ إِنْ كُنتُمْ تُؤْمِنُونَ بِاللَّهِ وَالْيَوْمِ الْآخِرِ
“হে ঈমানদারগণ! আনুগত্য কর আল্লাহর, আনুগত্য কর রাসূলের এবং তোমাদের মধ্যে যারা ‘আদেশের মালিক’ তাদের। তারপর যদি তোমরা কোনো বিষয়ে বিবাদে প্রবৃত্ত হয়ে পড়, তাহলে তা আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের প্রতি প্রত্যর্পণ কর, যদি তোমরা আল্লাহ ও শেষ দিবসের উপর বিশ্বাসী হয়ে থাক।”(সূরা (৪) নিসা: আয়াত-৫৯)
ইতা’আত বা আনুগত্যের পাশাপাশি মুমিনের দ্বিতীয় দায়িত্ব ইত্তিবা বা অনুকরণ। ইতা’আত বা আনুগত্য অর্থ আদেশ নিষেধ পালন করা। আর আদেশ-নিষেধের বাইরেও কর্মে ও বর্জনে অনুকরণকে আরবীতে ‘ইত্তিবা’ বলা হয়। ‘মুহাম্মাদুর রাসূলুল্লাহ’ বিশ্বাসের অবিচ্ছেদ্য অংশ ও দাবি হলো কর্মে ও বর্জনে হুবহু তাঁর অনুকরণ করা এবং জীবনের সকল পর্যায়ে কর্মে ও বর্জনে তাঁর অনুসরণ ও অনুকরণ করা । তিনি যা যেভাবে করেছেন তা করা এবং তিনি যা বর্জন করেছেন তা বর্জন করা । কর্মে ও বর্জনে তাঁর সুন্নাত বা জীবনাদর্শই মুসলিমের জন্য সর্বোত্তম আদর্শ। মহান আল্লাহ বলেন: “নিশ্চয় তোমাদের জন্য রাসূলুল্লাহর মধ্যে উত্তম আদর্শ রয়েছে, যারা আল্লাহ ও শেষ দিবসের আশা রাখে এবং আল্লাহকে অধিক স্মরণ করে তাদের জন্য ।”(সূরা আহযাব,আয়াত:২১)
এ থেকে জানা যায় যে, যারা আল্লাহ ও শেষ দিবসের আশা রাখে না শুধু তারাই তাঁর আদর্শ গ্রহণ করে না বা পূর্ণাঙ্গ মনে করে না। শুধু তাদের জন্যই অন্য কারো আদর্শের প্রয়োজন হয়। মুমিনদের জন্য তাঁর আদর্শই পরিপূর্ণ আদর্শ। আর হুবহু তাঁর আদর্শে জীবন পরিচালনাই ঈমানের আলামত । তাঁর আদর্শের অনুসরণই আল্লাহর প্রেম, ক্ষমা ও মুক্তি লাভের একমাত্র পথ । আল্লাহ বলেন : “বল, যদি তোমরা আল্লাহকে ভালবাস, তাহলে আমাকে অনুসরণ কর, যাতে আল্লাহও তোমাদেরকে ভালবাসেন এবং তোমাদেরকে তোমাদের পাপ মার্জনা করে দেন। আর আল্লাহ হলেন ক্ষমাকারী দয়ালু। বল, আল্লাহ ও রসূলের আনুগত্য প্রকাশ কর। বস্তুত যদি তারা বিমুখতা অবলম্বন করে, তাহলে আল্লাহ কাফিরদিগকে ভালবাসেন না। ” (সূরা আল-ইমরান,আয়াত-৩১,৩২)
রাসূলুল্লাহ -এর অনুকরণের অন্যতম দিক হলো, তাঁর কর্ম ও বর্জনের ব্যতিক্রম কিছু না করা। মুমিন বিশ্বাস করেন যে, তিনি যা করেছেন তা বর্জন করে এবং তিনি যা করেন নি তা করে “কোনোরূপ সাওয়াব বা বরকত লাভ করা যায় না। মহান আল্লাহ বলেন: “অতএব যারা তাঁর (রাসূলুল্লাহ -এর) আদেশের মুখালাফাত বা ব্যতিক্রম করে, তারা যেন সতর্ক
হয়, তাদের উপর বিপর্যয় আপতিত হবে, অথবা কোনো কঠিন শাস্তি তাদের উপর আপতিত হবে।” (সূরা (২৪) নূর: আয়াত-৬৩)
‘মুখালাফাহ’ অর্থ ব্যতিক্রম করা বা বিরোধিতা করা। ‘খিলাফ’ অর্থ ব্যতিক্রম, বিপরীত বা অসমঞ্জস । এ থেকে আমরা বুঝি যে, রাসূলুল্লাহ -এর কর্ম, শিক্ষা বা আদর্শের ব্যতিক্রম বা তাঁর পথের ব্যতিক্রম চলা বা তাঁর শিক্ষার ব্যতিক্রম কিছু করাই ভয়ঙ্কর বিপদ ও ধ্বংসের কারণ । রাসূলুল্লাহ অনেক হাদীসে তাঁর পথের বা আদর্শের বাইরে চলতে কঠিনভাবে নিষেধ করেছেন। তিনি যা করেন নি এরূপ কোনো কাজ করলে তাতে কোনো সাওয়াব হবে না এবং তা আল্লাহ প্রত্যাখ্যান করবেন বলে তিনি জানিয়েছেন। এক হাদীসে তিনি বলেছেন: “আমাদের কর্ম যা নয় এমন কোনো কর্ম যদি কোনো মানুষ করে তাহলে তার কর্ম প্রত্যাখ্যাত হবে (আল্লাহর নিকট কবুল হবে না)।” ( বুখারী,মুসলিম)
বিভিন্ন হাদীসে এরূপ নব-উদ্ভাবিত কর্মকে তিনি বিদ’আত নামে অভিহিত করেছেন । তিনি বলেন : “তোমাদের উপর দায়িত্ব হলো আমার সুন্নত ও সুপথপ্রাপ্ত খুলাফায়ে রাশেদীনের সুন্নাত অনুসরণ করা। তোমরা দৃঢ়ভাবে তা আঁকড়ে ধরবে, কোনো প্রকারেই তার বাইরে যাবে না। আর তোমরা (আমার ও খুলাফায়ে রাশেদীনের সুন্নাতের বাইরে) নতুন উদ্ভাবিত সকল বিষয় সর্বতোভাবে পরিহার করবে; কারণ সকল নতুন উদ্ভাবিত বিষয়ই বিদআত এবং সকল বিদআতই বিভ্রান্তি ও পথভ্রষ্টতা। (তিরমিযী, আস-সুনান ৫/৪৪; আবূ দাউদ)
অনেক সময় আবেগী মুমিন আল্লাহর সন্তুষ্টি, বরকত ও সাওয়াব লাভের উদ্দেশ্যে ভাল কাজ বেশি করে করতে চান। এ আবেগে তিনি রাসূলুল্লাহ যা করেছেন তা পালন করা ছাড়াও অতিরিক্ত আরো ভাল কাজ করতে চান। এভাবে তিনি রাসূলুল্লাহ যা করেন নি তা করে সাওয়াব লাভের আশা করেন। এ বিষয়ে উম্মাতকে সাবধান করেছেন । আনাস বিন মালেক (রা.) বলেন : “তিন ব্যক্তি রাসূলুল্লাহ (সা.) -এর স্ত্রীগণের নিকট যেয়ে তাঁর ইবাদত সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করলেন। তাঁরা তাঁর ইবাদত সম্পর্কে জানালেন। মনে হলো প্রশ্নকারীগণ রাসূলুল্লাহ -এর ইবাদত কিছুটা কম ভাবলেন। তাঁরা বললেন : রাসূলুল্লাহ -এর সাথে কি আমাদের তুলনা হতে পারে? আল্লাহ তাঁর পূর্ববর্তী ও পবরর্তী সকল গোনাহ ক্ষমা করে দিয়েছেন (তাঁর কোনো গোনাহ নেই, আর আমরা গোনাহগার উম্মত, আমাদের উচিৎ তাঁর চেয়েও বেশি ইবাদত করা)। তখন তাদের একজন বললেন: আমি সর্বদা সারা রাত জেগে (তাহাজ্জুদের) সালাত আদায় করব। অন্যজন বললেন: আমি সর্বদা সিয়াম পালন করব, কখনই রোযা ভাঙ্গব না। অন্যজন বললেন: আমি কখনো বিবাহ করব না, আজীবন নারী সংসর্গ পরিত্যাগ করব। রাসূলুল্লাহ (সা.) এদের কথা জানতে পেরে এদেরকে বলেন: তোমরা কি এ ধরনের কথা বলেছ? তোমরা জেনে রাখ! আমি তোমাদের সকলের চেয়ে আল্লাহকে বেশি ভয় করি, তাকওয়ার দিক থেকে আমি তোমাদের সবার উপরে অবস্থান করি। তা সত্ত্বেও আমি মাঝেমাঝে (নফল) সিয়াম পালন করি, আবার মাঝেমাঝে সিয়াম পরিত্যাগ করি। রাতে কিছু সময় তাহাজ্জুদ আদায় করি এবং কিছু সময় ঘুমাই। আমি বিবাহ করেছি- স্ত্রীদেরকে সময় প্রদান করি। যে ব্যক্তি আমার সুন্নাত অপছন্দ করল তার সাথে আমার কোনো সম্পর্ক নেই।” (বুখারী)
অন্য হাদীসে আব্দুল্লাহ ইবনু আমর (রা) বলেন, “রাসূলুল্লাহ (সা.) আমাকে ডেকে নিয়ে বলেন: তুমি কি প্রতিদিন সিয়াম পালন কর? আমি বললাম: হাঁ। তিনি বলেন: তুমি কি সারা রাত জেগে সালাত আদায় কর? আমি বললামঃ হাঁ। তিনি বললেন: কিন্তু আমি তো সিয়াম পালন করি, আবার মাঝে মাঝে বাদ দিই, রাতে সালাত আদায় করি, আবার ঘুমাই, স্ত্রীদেরকে সময় প্রদান করি। আর যে ব্যক্তি আমার সুন্নাতকে অপছন্দ করল আমার সাথে তার সম্পর্ক থাকবে না ।… এরপর তিনি বলেন: প্রত্যেক আবেদের কর্মের উদ্দীপনার জোয়ার ভাটা আছে। ইবাদতের উদ্দীপনা কখনো তীব্র হয় আবার এই তীব্রতা এক সময় থেমে যায়, কখনো সুন্নাতের দিকে, কখনো বিদ’আতের দিকে। যার স্থিতি প্রশান্তি সুন্নাতের প্রতি হবে সে হেদায়েত প্রাপ্ত হবে। আর যার স্থিতি- প্রশান্তি অন্য কিছুর দিকে হবে সে ধ্বংসপ্রাপ্ত হবে।”( আহমাদ ইবনু হাম্বাল, মুসনাদ, নং ৬৪৪১)
একটু চিন্তা করুন! এখানে এ সকল সাহাবী মূলত রাসূলুল্লাহ (সা.)-এর রীতিকে অপছন্দ করেন নি। তাঁরা তাঁর রীতি জেনেছিলেন এবং মেনেও নিয়েছিলেন, তবে তাঁদের নিজেদের জন্য অতিরিক্ত কিছু সুন্নাতের ব্যতিক্রম নেক আমলের কথা চিন্তা করেছিলেন। আমরা জানি, সারারাত তাহাজ্জুদ আদায় করা নিষিদ্ধ নয়। হারাম দিবসগুলি বাদ দিয়ে সারা মাস সিয়াম পালনও নিষিদ্ধ নয়। অনুরূপভাবে কোনো পুরুষের প্রয়োজন না থাকলে বা অসুবিধা থাকলে অবিবাহিত থাকাও সর্বাবস্থায় নিষিদ্ধ নয়। কিন্তু রাসূলুল্লাহ (সা.)অত্যন্ত গুরুত্বের সাথে তাঁদেরকে নিষেধ করেছেন। কারণ আল্লাহর নৈকট্য, বেলায়াত, সন্তুষ্টি বা সাওয়াবের জন্য রাসূলুল্লাহ -এর রীতির বাইরে বা অতিরিক্ত কোনো আমলের চিন্তা করাও মুমিনের উচিত নয়। এতে সুন্নাতকে অপূর্ণ মনে হতে পারে। সুন্নাতের অতিরিক্ত আমলের রীতি করলে মানুষের মনে এ ধারণা সৃষ্টি হতে পারে যে, কেবলমাত্র সুন্নাতের মধ্যে সীমাবদ্ধ থেকে কর্ম করলে বোধহয় প্রয়োজনীয় বেলায়াত বা সাওয়াব অর্জন করা সম্ভব হবে না। যেমন, মনে হতে পারে তাহাজ্জুদ খুবই ভাল ইবাদত,কাজেই রাতে কিছু সময় ঘুমিয়ে নষ্ট করার চেয়ে সারারাত এই মহান ইবাদতে মাশগুল থাকাই উত্তম ।
রাতের অনেকখানি সময় ঘুমিয়ে নষ্ট করে কি লাভ? ইত্যাদি। এভাবে রাসূলুল্লাহ -এর প্রতি কোনো অবজ্ঞা না আসলেও, অন্য যে ব্যক্তি অবিকল সুন্নাত অনুসারে রাতে কয়েকঘন্টা ঘুমাচ্ছেন এবং কয়েকঘন্টা তাহাজ্জুদ পড়ছেন তার প্রতি অবজ্ঞা আসতে পারে। আর একেই রাসূলুল্লাহ তাঁর সুন্নাতকে অপছন্দ করা’ বলে আখ্যায়িত করেছেন। যদি কেউ সাময়িক উদ্দীপনায় এরূপ অতিরিক্ত কিছু করে তবে তা মার্জনীয়, তবে যদি তার স্থিতি, রীতি ও অভ্যাস সুন্নাতের ব্যতিক্রম হয় তবে তা ধ্বংসাত্মক ।
মুহতারাম হাযেরীন, সবচেয়ে বড় প্রশ্ন হলো, মুমিন কেন সুন্নাতের অতিরিক্ত বা সুন্নাতের ব্যতিক্রম কাজ করবে? জান্নাতের জন্য তো সুন্নাতই যথেষ্ট। রাসূলুল্লাহ বলেছেন: “যে ব্যক্তি হালাল খাদ্য খেয়ে জীবনযাপন করবে, সুন্নাত অনুসারে আমল করবে এবং কোনো মানুষ তাঁর দ্বারা কষ্ট পাবে না, সে ব্যক্তি জান্নাতী হবে।” (সূনানে তিরমিযী)
তাবেয়ী হাসান বসরী (রাহ.) বলেন : রাসূলুল্লাহ বলেছেন : “সুন্নাতের মধ্যে অল্প আমল করা বিদ’আতের মধ্যে অনেক আমল করার চেয়ে উত্তম। যে আমার সুন্নাত অনুসরণ করবে সে আমার উম্মত, আমার সাথে সম্পর্কিত। আর যে আমার সুন্নাত অপছন্দ করবে তার সাথে আমার কোনো সম্পর্ক নেই ।” (আল-মুসান্নাফ ১১/২৯১, নং ২০৫৬৮। হাসান বসরী পর্যন্ত হাদীসটির সনদ মুরসালরূপে সহীহ)
সুন্নাত মোতাবেক অল্প আমলেই যদি বেশি আমলের চেয়ে বেশি সাওয়াব পাওয়া যায় তাহলে কেন মুমিন কষ্ট করে সুন্নাতের ব্যতিক্রম আমল করবে? অন্য হাদীসে রাসূলুল্লাহ বলেন:
إِنَّ مِنْ وَرَائِكُمْ أَيَّامِ الصَّبْرِ، لِلْمُتَمَسكِ فِيهِنَّ يَوْمَئِذٍ بِمَا أَنْتُمْ عَلَيْهِ أَجْرُ خَمْسِيْنَ مِنْكُمْ
“তোমাদের সামনে রয়েছে ধৈর্যের সময়, এখন তোমরা যে কর্মের উপর আছ সে সময়ে যে ব্যক্তি অবিকল তোমাদের পদ্ধতি আকড়ে ধরে থাকবে, সে ব্যক্তি তোমাদের মধ্যকার পঞ্চাশ জন ব্যক্তির সমপরিমাণ সাওয়াব লাভ করবে।
মুহতারাম হাযেরীন, একটু চিন্তা করুন! সুন্নাতের মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকতে পারলে ৫০ জন সাহাবীর সমান সাওয়াব! তাহলে কেন সুন্নাতের বাইরে যাব? সর্বোপরি সুন্নাত পালন ও জীবিত করলে সবচেয়ে বড় মর্যাদা জান্নাতে রাসূলুল্লাহ -এর সাহচার্য পাওয়া যাবে। রাসূলুল্লাহ বলেন : “যে আমার সুন্নাতকে (পালন ও প্রচারের মাধ্যমে) জীবিত করবে, সে আমাকেই ভালবাসবে । আর যে আমাকে ভালবাসবে, সে আমার সাথে জান্নাতে থাকবে ।(সুনানে তিরমিযী, কিতাবুল ইলম, নং ২৬০২) আমরা অনেক সময় জায়েয, বিদআতে হাসানা, বিদআতে সাইয়েয়াহ ইত্যাদি নিয়ে বিতর্ক করি। এগুলি ইলমী বিষয়, আলিমরা বিতর্ক করবেন। তবে মুমিনের জন্য নিরাপত্তা হলো সুন্নাতের মধ্যে থাকা । কর্মে ও বর্জনে রাসূলুল্লাহ -এর হুবহু অনুসরণই সুন্নাত। যে কর্ম তিনি যেভাবে যতটুকু করেছেন তা ঠিক সেভাবে ততটুকু করাই সুন্নাত। যা তিনি করেন নি তা না করাই সুন্নাত । কর্মে ও বর্জনে অবিকল তাঁর অনুসরণই সুন্নাত। জায়েজ অর্থ তিনি যা করেন নি এবং করতে নিষেধও করেন নি এমন কর্ম, যা করলে গোনাহ হবে না। বিদ’আতে হাসানা অর্থ যে কাজ রাসূলুল্লাহ বা সাহাবীগণ করেন নি বা যে পদ্ধতিতে করেন নি পরবর্তী যুগের মানুষেরা দলীলের ভিত্তিতে সে কর্ম বা রীতি উদ্ভাবন করেছেন। কেউ তা হাসানা বা ভাল বলেছেন এবং কেউ তা সাইয়েয়াহ বা খারাপ বলেছেন। তবে সর্বাবস্থায় বিদ’আত যতই হাসানা বা ভাল হোক তা সুন্নাত নয় । সুন্নাত হলে তো আর তাকে বিদ’আতে হাসানা বলা হতো না, সুন্নাতই বলা হতো। বাধ্য হলে বা জাগতিক প্রয়োজনে আমরা জায়েজ কাজ করতে পারি। সাওয়াব না হলেও গোনাহ তো হলো না। কিন্তু সাওয়াবের জন্য সুন্নাত বাদ দিয়ে জায়েজ বা বিদআতে হাসানার দরকার কী? যেখানে সুন্নাত পদ্ধতি আমল করলে পরিপূর্ণ সাওয়াব, অল্প আমল বেশি সাওয়াব, ৫০ জন সাহাবীর সমপরিমাণ সাওয়াব ও জান্নাতে রাসূলুল্লাহ -এর সাহচার্য, সেখানে সুন্নাত ছেড়ে জায়েয বা বিদ’আতে হাসানার মধ্যে যাওয়ার দরকার কী ? এজন্য মুমিনের দায়িত্ব হলো, সকল ইবাদতে সুন্নাতের অনুসরণ করা। এই হলো আমাদের ঈমানের দাবি। “লা ইলাহা ইল্লাল্লাহু” অর্থ আমরা একমাত্র আল্লাহরই ইবাদত করব। আর “মুহাম্মাদুর রাসূলুল্লাহ” অর্থ আল্লাহর ইবাদত আমরা একমাত্র মুহাম্মাদ (সা.) থেকেই শিখব। প্রতিটি ইবাদতই হুবহু তার পদ্ধতি ও রীতিতে পালন করতে হবে। যে কোনো ইবাদত বন্দেগির বিষয়ে বিতর্ক হলে যুক্তি তর্কের মধ্যে না গিয়ে একটি সহজ প্রশ্ন করতে হবে: এ ইবাদতটি রাসূলুল্লাহ ও সাহাবীগণ কিভাবে পালন করেছেন। সহীহ হাদীসের আলোকে আমি তা জানতে চাই এবং আমি সেভাবেই পালন করতে চাই । জায়েয, বিদআতে হাসানাহ্, বিদআতে সাইয়েয়াহ ইত্যাদি বিতর্কে আমি জড়াতে চাই না ।
আমরা ব্যবসায়ী। আমাদের পুঁজি একটি মাত্র জীবন। এই জীবনে যা অর্জন করতে পারব তাই আমাদের সম্বল হবে। দেখে এসে ভুল শুধরে নিয়ে দ্বিতীয়বার আর বিনিয়োগ করতে পারব না । কী দরকার রিস্ক নেওয়ার? মনে করুন আপনার কাছে এক লক্ষ টাকা পুঁজি আছে। আপনার সামনে দুটি বিনিয়োগের খাত আছে। একটি খাতে লাভ নিশ্চিত। অপর খাতে কেউ বলছেন লাভ হবে; কেউ বলছেন লাভ না হলেও ক্ষতি হবে না, আর কেউ বলছেন ক্ষতি হবে। আপনি কোন্ খাতে বিনিয়োগ করবেন? নিশ্চয় যে খাতে লাভ সুনিশ্চিত। একান্ত বাধ্য না হলে তো আপনি কখনো ঝুকি নিয়ে বিনিয়োগ করবেন না। তাহলে আখেরাতের ক্ষেত্রে একান্ত বাধ্য না হলে ঝুকি নেব কেন ?
আসুন আমরা আমাদের আখেরাতের পুঁজি ও ব্যবসা বিবেচনা করি। কোনোরূপ হ্রাস বৃদ্ধি না করে কর্মে ও বর্জনে সুন্নাত পালন করলে যে লাভ হবে সে বিষয়ে কারো কোনো সন্দেহ বা বিতর্ক নেই। সুন্নাতের ব্যতিক্রম হলেই মতবিরোধ: কেউ বলছেন লাভ হবে, কেউ বলছেন ক্ষতি নেই, কেউ বলছেন ক্ষতি হবে। এখন আমরা কী করব? সাধ্যমতো সুন্নাতের মধ্যে থাকার চেষ্টা করব? না কি সুযোগ পেলেই নতুন খাতে বিনিয়োগ করে ঝুকি নিয়ে দেখব?’
আল্লাহ আমাদেরকে সুন্নাতকে ভালবাসার, পালন করার ও জীবিত করার তাওফীক দিন, আমীন