একই শহরে আমাদের বসবাস। একই বাজার থেকে আমরা পোষাক ও প্রসাধনী ক্রয় করি। এই কেনা বেচার বাজারে অনেক প্রিয় অথবা অপ্রিয় মানুষের সাথে দেখা হয়। অথচ তার সাথে দেখা হয় না। এই চাঁদরাতে ইলিয়ট ব্রিজ থেকে শহীদ সোহরাওয়ার্দী সড়ক হয়ে আনমনে ধীরে ধীরে হাঁটতে থাকি। ব্রিজের পশ্চিম প্রান্তে শামীম কাকার সংবাদ পত্রের দোকান এখন আর নেই। যেখানে সকাল হলেই মানুষ নতুন খবরের স্বাদ নেওয়ার জন্য ভীড় করতো। জানতে পারলাম। কিছুদিন আগে শামীম কাকা গত হয়েছে। আস্তে আস্তে হাঁটতে হাঁটতে বিউটি মোড় পাড় হয়ে বড় বাজারে প্রবেশ পথে ইদ্রিস চাচার চপের দোকানে দাঁড়িয়ে মাটন কাটলেট খেতে খেতে ফিরে যায় বিশ বছর পূর্বের স্মৃতির শহরে। তারপর আবার হাঁটতে থাকি। খুঁজতে থাকি প্রথম যৌবনের প্রথম প্রেমের স্মৃতি।
পথ ও পথিকের হাসফাস ভীড়। কোথাও দাঁড়ানোর জায়গা নেই। এতো এতো মানুষের ভীড়ে আমি তাকে খুঁজি। এই চাঁদরাতে হয়তো সে এসেছে অথবা আসবে। মেহেদী অথবা পারফিউম কিনতে। বিশ বছর পূর্বে আমরা যখন সারা দুপুর- বিকেল এই শহরের অলিগলিতে চুষে বেড়াতাম তখন মোড়কজাত মেহেদীর এতোটা ছয়লাভ ছিল না। তাই তার মেহেদীর রং এবং ঘ্রাণ আমার অজানা। তবে তার পারফিউমের গন্ধ এখনো আমার মনে গেঁথে আছে। যেন সেদিনের কথা। তার শরীরের ঘ্রাণের সাথে পারফিউমের গন্ধ একাকার হয়ে বিশেষ এক ধরণের সুবাস তৈরি হতো। এই রকম বিশেষ ঘ্রাণ শুধু তার শরীরেও লেগে থাকে, যা পৃথিবীর অন্য কোথাও নেই। বিশ বছর প্রবাস জীবনে গোথেনবার্গে কত সুন্দরী সুইডিশ তরুনী দেখেছি। কিন্তু ওই সম্মোহনী ঘ্রাণ কোথাও খুঁজে পায়নি। যে ঘ্রাণ শুকে ভীড়ের মধ্যেই তাকে আলাদা করা যায়। তার প্রস্থানের পরেও ত্যক্ত ভূমিতে কিছুক্ষণ সে ঘ্রাণ লেগে থাকে। চাঁদরাতে উপচে পড়া ভীড়ের মধ্যে আমি সেই ঘ্রাণ খুঁজি।
ঘুরতে ঘুরতে একসের তরল দুঃখ ক্রয় করি। দুঃখগুলো খুব প্রাচীন। এখনো সের দরে বিক্রি হয়। দুঃখ ভর্তি ব্যাগ হাতে নিয়ে হাটতে থাকি। হাটতে হাটতে খেদন সর্দারের মোড় পার হয়ে বাজার স্টেশনের কদম ফুয়ারার পাশে একটু বিশ্রামের জন্য দাঁড়াই। নান্দিক নকল ঝর্ণার পাশে কিছুক্ষণ নিরবে বসে থাকি। কত কথা মনে পড়ে। তার শেষ চুম্বনের স্মৃতি বিস্মৃতি ঘটায় মগজের দেয়ালে। বিশ বছরে অনেকটা বদলে গেছে এই শহর। শুধু বদলায়নি আমার প্রথম প্রেমের প্রথম চুম্বনের স্মৃতি।
ব্যাগ থেকে কিছু দুঃখ বের করে কদম ফুয়ারার জলের সাথে মিশিয়ে পাণ করার পর সিগারেটের নেশা জাগে। পকেট হাত দিয়ে দেখি কোন সিগারেট নেই। থাকার কথাও নয়। সাধারণত আমি সিগরেটে অভ্যস্ত নয়। তাহলে ! সিগারেটের জন্য পকেটে হাত দিলাম কেন? নিজেকে প্রশ্ন করি। তবে কি আমি ভীষণ স্মৃতিকাতর। ভাবতে থাকি। ভাবতে ভাবতে সিরাজের চায়ের দোকানে গিয়ে কড়া মিষ্টি এক কাপ দুধ চা খাওয়ার পর সিগারেটের নেশা আরো তীব্র হয়। এটা কি আসলে সিগারেটের নেশা নাকি হারানো প্রেম খুঁজে পাওয়ার তীব্র আকাঙ্খা ঠিক বুঝতে পারি না। হঠাৎ তরুণ কবি আদিত্যর সাথে দেখা। আদিত্য তুখোর ধুমপায়ী। আদিত্যকে বললাম- ‘দে, ভাই। একটা সিগরেট দে’। আদিত্য অবাক হয়ে আমার দিকে তাকিয়ে রইলো।
-কিন্তু, ভাই আপনি তো সিগরেট খান না।
-উকিলের মতো জেরা করিস না, দে একটা সিগরেট দে।
সিগারেটে ফুঁ ফুঁকতে ফুঁকতে ধীরে ধীরে হাঁটতে থাকি। হাঁটতে হাঁটতে খুঁজতে থাকি। খলিফা পট্টি এসে হঠাৎ থমকে যাই। সেই চেনা ঘ্রাণ ভেসে আসছে বাতাসে। যা আমি হারিয়েছি বিশ বছর আগে এই শহরে। দিগি¦দিক খুঁজতে থাকি। কোথাও চোখে পড়ে না। তবে বাতাসে ভাসমান ঘ্রাণ বলছে আশেপাশে কোথাও আছে সে। আমি আমার তিন চোখ দিয়ে খুঁজতে থাকি। অদূরে একটি রিক্সায় বসে থাকা মেয়েটি হুট তুলে দ্রুত চলে যায়, মনে হলো তার ভীষণ তাড়া আছে। আমি লাইট পোষ্টের আলোয় তার ব্রাউন রংয়ের চুলগুলো শুধু দেখতে পাই। পেছন থেকে তার মুখ দেখতে পাই না। ক্রিং ক্রিং বেল বাজতে বাজতে অদৃশ্য হয়ে যায় দূরের রিক্সা। রাস্তা জুড়ে শুধু পড়ে থাকে সেই বিশেষ ঘ্রাণ। যে ঘ্রাণ আমি গত বিশ বছর ধরে খুঁজছি।