
সুপ্রভাত সিডনি অনুসন্ধান: সম্প্রতি প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূসের যুক্তরাষ্ট্র সফরকে কেন্দ্র করে নিউইয়র্কে যে অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনাগুলো ঘটেছে, তা বাংলাদেশের ভাবমূর্তিকে গভীরভাবে প্রশ্নবিদ্ধ করেছে। নিষিদ্ধ ঘোষিত ফ্যাসিস্ট আওয়ামী লীগ বিদেশের মাটিতে সহিংসতা ও কূটকৌশল প্রয়োগ করে আবারও প্রমাণ করেছে, ক্ষমতা হারালেও তাদের সন্ত্রাসী সংস্কৃতি বদলায়নি।
বিএনপি, জামায়াত ও এনসিপির কিছু কৌশলগত ভুলের সুযোগ নিয়েই আওয়ামী সন্ত্রাসীরা তাণ্ডব চালিয়েছে। অথচ আগে থেকেই জানা ছিল, প্রধান উপদেষ্টা ছাড়া সফরে কোনো রাষ্ট্রীয় প্রটোকল বা নিরাপত্তা থাকবে না। বিকল্প হিসেবে প্রাইভেট সিকিউরিটি নিয়োগ বা আরও কার্যকর প্রস্তুতি নিলে এই বিপর্যয় হয়তো এড়ানো যেত।
দূতাবাসে আওয়ামী আধিপত্য
গত ১৬ বছরে আওয়ামীলীগ বিশ্বের প্রতিটি দূতাবাসে দলীয় লোকজনকে রাষ্ট্রদূত ও কর্মকর্তা হিসেবে বসিয়েছে। অস্ট্রেলিয়া থেকে আমেরিকা, সবখানেই একই চিত্র। কনস্যুলেট, কাউন্সেলর এমনকি ন্যূনতম স্টাফ পর্যন্ত আওয়ামী ঘরানার লোক নিয়োগ দেওয়া হয়েছে। ফলে প্রবাসী বাংলাদেশিরা দূতাবাসে গিয়ে নিরপেক্ষ সেবা না পেয়ে আজও দলীয় প্রভাবের শিকার। নিউইয়র্কের সাম্প্রতিক ঘটনাও সেই ধারাবাহিকতারই অংশ।
উত্তপ্ত নিউইয়র্ক
জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদের ৮০তম অধিবেশনে যোগ দিতে প্রধান উপদেষ্টা নিউইয়র্কে পৌঁছালে প্রবাসী বাংলাদেশিদের মধ্যে উত্তেজনা ছড়িয়ে পড়ে। জ্যাকসন হাইটস থেকে জেএফকে বিমানবন্দর ও ম্যানহাটন সব জায়গায় পাল্টাপাল্টি কর্মসূচি, শ্লোগান আর মিছিল সমাবেশে প্রবাসীরা বিভক্ত হয়ে পড়ে। এরই মধ্যে বিমানবন্দরে এনসিপি নেতা আখতার হোসেনের ওপর ডিম নিক্ষেপ এবং পরে এক যুবলীগ নেতার গ্রেপ্তার পরিস্থিতিকে আরও উত্তপ্ত করে তোলে।
রহস্যজনক প্রটোকল পরিবর্তন
প্রথমে বিএনপি–জামায়াতকে জানানো হয়, অতিথিরা ৮ নম্বর টার্মিনাল দিয়ে বের হবেন। তারা সেখানেই প্রস্তুত ছিলেন। হঠাৎই জানানো হলো, প্রধান উপদেষ্টা ভিভিআইপি গেট দিয়ে বের হবেন। পরে আবার সিদ্ধান্ত বদলে কিছু সফরসঙ্গীকে ৪ নম্বর টার্মিনাল দিয়ে বের করা হলো।
এই সিদ্ধান্ত বদল ঘিরেই তৈরি হয় রহস্য। কেন বিএনপি–জামায়াত নেতাদের বিভ্রান্ত করে শেষ মুহূর্তে টার্মিনাল পরিবর্তন করা হলো? অথচ আওয়ামী লীগের কর্মীরা আগেভাগেই সঠিক তথ্য জেনে প্রস্তুত ছিল। এর মানে দূতাবাসের ভেতর থেকেই তথ্য ফাঁস হয়েছে, যা পরিকল্পিত ষড়যন্ত্রের ইঙ্গিত দেয়।
শোয়েব আবদুল্লাহর ভূমিকা
এই নাটকীয়তার কেন্দ্রে উঠে এসেছেন এক ব্যক্তি: শোয়েব আবদুল্লাহ। বর্তমানে তিনি নেপাল বাংলাদেশ দূতাবাসের ডেপুটি চিফ হলেও অবস্থান করছেন নিউইয়র্কেই। ছাত্রলীগের সাবেক নেতা এই শোয়েব ঢাবি জীবনে বহু নির্যাতনের অভিযোগে কুখ্যাত ছিলেন। পরবর্তীতে বিসিএসে অনৈতিক সুবিধা নিয়ে চাকরিতে প্রবেশ করেন এবং দীর্ঘদিন আওয়ামী লীগের ঘনিষ্ঠ থেকে প্রবাসী মিশনে সক্রিয় থাকেন।
প্রশ্ন হলো: নেপালে দায়িত্বপ্রাপ্ত একজন কর্মকর্তা কীভাবে নিউইয়র্কে থেকে প্রধান উপদেষ্টার সফরে প্রটোকল কার্যক্রমের দায়িত্বে ছিলেন? এবং কেন তিনি বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরকে জোরপূর্বক ভিন্ন পথে নিয়ে গিয়ে আওয়ামী মাস্তানদের হাতে তুলে দিলেন?
পরিকল্পিত হেনস্তা
মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর, আখতার ও তাসনিম জারাকে আলাদা করে নেওয়ার পর গেইটের বাইরে আওয়ামী সন্ত্রাসীরা তাদের অপদস্থ করে। গালাগালি, ধাক্কাধাক্কি, ডিম নিক্ষেপ সবই ছিল পূর্বপরিকল্পিত। পরে জামায়াত নেতাকর্মীরা দৌড়ে এসে তাদের রক্ষা করে গাড়িতে তুলে দেন। পুরো ঘটনাটি ভিডিও ফুটেজে ধরা পড়েছে।
রাজনৈতিক উদ্দেশ্য স্পষ্ট
এই ঘটনার মাধ্যমে বিএনপি, জামায়াত ও এনসিপির নেতাদের মধ্যে বিভাজন সৃষ্টির চেষ্টা স্পষ্ট হয়ে ওঠে। রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা মনে করছেন, একটি “ফর্মুলা” অনুযায়ী তাদের মধ্যে মনস্তাত্ত্বিক ও কৌশলগত ব্যবধান তৈরি করার চেষ্টা চলছে।
অন্যদিকে, ভারতের একটি দৈনিকের প্রতিবেদনে ফখরুল ইসলাম আলমগীরকে নিয়ে ছড়ানো গুজবকে তিনি মিথ্যা ও উদ্দেশ্যমূলক আখ্যা দিয়েছেন।
উপসংহার
নিউইয়র্কে প্রধান উপদেষ্টার সফরে যা ঘটেছে, তা নিছক কোনো আকস্মিক ঘটনা নয়। বরং দূতাবাসে ঘাপটি মেরে থাকা আওয়ামী কূটনীতিক ও প্রবাসী সন্ত্রাসীদের সমন্বিত ষড়যন্ত্রের ফল। এর মাধ্যমে তারা শুধু বিরোধী দলগুলোর মধ্যে বিভাজন তৈরির চেষ্টা করেনি, বরং বাংলাদেশের ভাবমূর্তি ও গণতান্ত্রিক অগ্রযাত্রাকেও ধ্বংস করেছে।