আধ্যাত্মিকতা নিয়ে নেশাত ইসফাহানির তিনটি গজল: ভূমিকা ও রূপান্তর: মীম মিজান

ইসফাহানে জন্ম নেয়া নেশাতের পুরোনাম মির্জা আব্দুল ওয়াহাব মো’তামেদ উদ্দৌলা (১৭৫৯-১৮২৯)। নেশাত নামে প্রখ্যাত এই কবি ফতেহ আলি শাহের (১৭৯৭-১৮৩৪) সময়ে কাসিদা, গজল ইত্যাদি লিখেছেন। মূলত তিনি একটি নতুন আন্দোলনের যুক্ত ছিলেন। যা ‘বাজগাস্তে আদাবি’ বা প্রত্যাবর্তন রীতি নামে বিখ্যাত। ইরানের ইতিহাসে ১৮২১ সনে তিনিই প্রথম পররাষ্ট্র বিষয়ক মন্ত্রী হয়েছিলেন। অতঃপর শেষের দিকে ডি ফ্যাক্টো বা ইরানের প্রধানমন্ত্রীর পদমর্যাদায় ভূষিত হয়েছিলেন। কাজার আমলে তিনি যে কাব্যচর্চা করেছিলেন তা খৈয়াম, সাদি, হাফিজ প্রমুখের ভাবানুসারে। যদিও তিনি কাজার শাসকের প্রশংসায় কাসিদা লিখেছেন। তবুও তিনি গজলের জন্য সবিশেষ বিখ্যাত। গজলে তিনি আধ্যাত্মিকতা, আশেক-মাশুক, শরাব, সাকি, সুফিবাদের নানা অনুষঙ্গ তুলে ধরেছেন। তাঁর কবিতাগুলো ‘গাঞ্জিনিয়ে নেশাত’ বা নেশাতের গুপ্তধন নামে সংকলনে গ্রন্থিত হয়েছে। তিনি দাফতরিক কাজে অনেক চিঠিপত্র লিখেছিলেন যা সংগৃহিত হয়ে গ্রন্থাকারে প্রকাশিত হয়েছে। নেশাত শুধু কবি ছিলেন না। তিনি একজন মননশীল লেখকও ছিলেন। তাঁর বেশি আগ্রহ ছিলো শেখ সাদির সাহিত্যকর্ম নিয়ে। তাই তিনি গুলিস্তান নিয়ে বিশদভাবে লিখেছেন। পশ্চিমা বিশ্বে তিনি ‘প্রখর মেধা সম্পন্ন সরকারি দফতরের কবি ও কর্মকর্তা’ হিশেবে সমাদৃত। রূপান্তরিত গজল তিনটি ‘গাঞ্জুর ডটকম’ থেকে গৃহিত।

আধ্যাত্মিক গুরুর প্রতি

যদি আনুগত্য সম্ভব না হয়, তবে পাপ করাই শ্রেয়

প্রিয়জনের হৃদয়ে পৌঁছাতে যে কোনো উপায়ে পথ খুঁজে পেতে নিজেকে প্রস্তুত করবো

ভিক্ষুকদের পদচারণায় মুখরিত নয়নের লক্ষ্য

মন রাজ্যকে রাজাসনের মতো করবো

আকালমান্দের জন্য যথেষ্ট তীক্ষè ছুরি ও এপ্রেমের শির

হ্যাঁ, এখন হতে মুকুটঅলার সেবা করবো

কীভাবে থাকবে আকাশের আলোকিতদের প্রভাব আমাদের ওপর

কৃষ্ণ চোখের ঘূর্ণন বা ইশারা থেকে নিজেকে সতর্ক করবো

দৃষ্টির আড়ালে রাতে আফতাব যায় লুকিয়ে

সোমের কৌমুদীতে পথটি পার হবে

হে কাফেলার নেতা, তুমি সুন্দরভাবে পথ চলছ

পথ হারা মানুষের দিকে একটু মনোযোগ দেবে

শুধু কালো চোখের সারি থাকা যথেষ্ট নয়

প্রেমিকদের সারিতেও নজর দিতে হবে

বন্ধুর দিকে দৃষ্টিতে মনোযোগ রাখতে হবে

শত্রুর দেশকে সৈন্য দিয়ে ধ্বংস করতে হবে

শুরিখানার পাশে যদি না পারো থাকতে, হে নেশাত

তবে বিহানকালে দূরে থেকেই সেজদা দেবে

(গজল নম্বর-১১৮)

আশেক-মাশুকের আখ্যান

হোন না যদি বিরক্ত আর পড়েন যদি প্রেমে

বলো কী আর খুশির খবর, প্রেম রয়েছে ঠাসি

পাঠান যিনি শত্রুদেরই উপঢৌকন শত

চান যে তিনি, বন্ধুদের সব বিপদ পড়ুক রাশি

মূর্খ এই, জানবো কী গো মন্দ-ভালোর কথা

খোদা আমাদের বাসেন ভালো, সে খবরে ভাসি

হাত বাড়াব কেনো বলো, বলো কেনো নাচবো

খাজা আমার হাত-পা ছাড়া ভালোবাসেন বেশি

রাগ কোরো না ওগো শায়েখ, নগন্যেরই ভুলে

আমার ভুলে ক্ষমা দিয়ে বাজান প্রেমের বাঁশি

হে কবিরাজ, যে যাতনা মনে আমার, করো গো তার হাল

তার দেয়া শেফাহীন ব্যথাই ভালোবাসি

হে নেশাত, বন্ধু তোমার বলবান ও বুঝমান

যাও না গো, অবুঝ বনো, যাতে হয় সে খুশি

(গজল নম্বর ১২০)

বশ্যতা স্বীকার

তোমার প্রেমের বাতাস, আমার মনের পেয়ালা হলো

তোমার চেহারার আলোয় প্রাণের নাম হলো

কষ্টের ওয়াদা আজকেই ভাঙতে হবে

এবার পেয়ালার পালা এলো, শরাবের সাথে সন্ধি হলো

যে হয়ে ওঠে সবিশেষ, আমরা পাপীদের ভীরে

আমরা মহারতিদের মতে, তাকে তুচ্ছ বলো

কেটে গেছে চারকাল তার চুল ও চেহারা ছাড়া

কেটে গিয়ে রাত হলো সকাল, আর দিন শেষে সন্ধ্যা হলো

বিদ্রোহী গুণ ছেড়ে দিলো মন্দ তুর্ক, দেখো না প্রিয়

আস্তে-ধীরে বন্য পাখি, উবে দিয়ে ভাব, বশ্য হলো

আমার জীবন দিয়ে দেব, পথে তার ডেকে বলেছিলাম, নেশাত হে

সেটাও কী করে একটি খবর হলো!

(১২১ নম্বর গজল)

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *