বাংলাদেশের হাসপাতাল গুলোতে ভুল চিকিৎসা: একটি নীরব মহামারি

 

এম,এ ইউসুফ শামীম: বাংলাদেশের স্বাস্থ্যব্যবস্থা উন্নত করার লক্ষ্যে প্রতি বছর হাজার কোটি টাকা খরচ হলেও, বড় বড় সরকারি ও বেসরকারি হাসপাতালগুলোতে ভুল চিকিৎসা এখন এক ভয়ঙ্কর বাস্তবতায় পরিণত হয়েছে। রোগী ও তাদের পরিবার শুধু আর্থিক ক্ষতিই নয়, অনেক ক্ষেত্রে জীবনও হারাচ্ছেন এই অব্যবস্থাপনা ও দায়িত্বহীনতার কারণে।

ভুল চিকিৎসার ধরণ

  • বিশেষজ্ঞদের মতে, ভুল চিকিৎসা বিভিন্নভাবে ঘটছে—
  • ভুল রোগ নির্ণয়: প্রাথমিক পর্যায়ে সঠিক পরীক্ষা না করে অনুমানভিত্তিক ওষুধ দেওয়া।
  • অপ্রয়োজনীয় অস্ত্রোপচার: রোগের অবস্থা না বুঝেই বড় ধরনের অপারেশন করা।
  • ওষুধের ভুল মাত্রা: শিশু, বৃদ্ধ বা গর্ভবতী নারীর জন্য ডোজ মেনে না চলা।
  • পরীক্ষা-নিরীক্ষায় অবহেলা: রিপোর্ট ভুল পড়া বা সময়মতো ফলাফল না দেওয়া।

হাসপাতালের অব্যবস্থাপনা

অনেক বেসরকারি হাসপাতাল রোগী আকর্ষণের জন্য ঝকঝকে অবকাঠামো দেখালেও ভেতরে রয়েছে অপ্রশিক্ষিত স্টাফ, অনভিজ্ঞ ডাক্তার এবং সঠিক যন্ত্রপাতি ব্যবহারের অভাব। সরকারি হাসপাতালগুলোতে রয়েছে জনবল সংকট, দুর্নীতি এবং তদারকির অভাব।

একজন ভুক্তভোগীর ভাষ্য অনুযায়ী—“আমার বাবাকে হারিয়েছি শুধু ভুল ইনজেকশন দেওয়ার কারণে। হাসপাতালে দায়িত্বশীল কেউ ছিল না।”

অন্তঃসত্ত্বা রোগী যে কোনো হাসপাতালে গেলে, অনেক সময় সেটি যেন হাসপাতালের মালিকের জন্য ‘লটারির টিকিট’ হাতে পাওয়া সমান। অর্থাৎ, যেকোনো পরিস্থিতিতে রোগীর অপারেশন করাতেই হবে—এটাই যেন তাদের নীতি। নানা ছলচাতুরি, ভুলভাল উপসর্গের ভয় দেখানো, মিথ্যা যুক্তি ও কৌশলে রোগী বা তার পরিবারকে রাজি করিয়ে অপ্রয়োজনীয় অপারেশন করে ফেলা হয়। কারণ অপারেশন মানেই বাড়তি আয়। মানুষের সরলতাকে পুঁজি করে বিনা কারণে অপারেশন করে তারা মোটা অঙ্কের টাকা হাতিয়ে নিচ্ছে।

রোগীর যেকোনো সমস্যায় ডজনখানেক অপ্রয়োজনীয় পরীক্ষা-নিরীক্ষার তালিকা ধরিয়ে দেওয়া হয়। কারণ, প্রতিটি পরীক্ষার জন্য সংশ্লিষ্ট ডাক্তারদের পকেটে ঢোকে মোটা কমিশন।

এছাড়া আরেকটি বড় সমস্যা হলো—ডাক্তার, দালাল ও কিছু অসাধু কর্মীর যোগসাজশে হাসপাতালের জন্য ফ্রি বা স্বল্পমূল্যে পাওয়া নানা ধরনের ওষুধ, ব্যান্ডেজ, ইনজেকশন ইত্যাদি সরঞ্জাম গোপনে বাজারে বিক্রি হয়ে যায় বা কোনো চক্রের হাতে চলে যায়।

উদাহরণ হিসেবে ধরা যাক—আপনার মাথায় চোট লেগেছে, আপনি চিকিৎসার জন্য হাসপাতালে গিয়েছেন। ডাক্তার চিকিৎসা বা পরীক্ষা-নিরীক্ষার ভান করে হঠাৎ বলবেন—”এখনই ব্যান্ডেজ করতে হবে, কিন্তু আমাদের গজ বা ব্যান্ডেজ শেষ হয়ে গেছে। তাড়াতাড়ি বাইরে থেকে কিনে আনুন, একেবারে এখনই দরকার।” ঠিক তখনই, হাসপাতালের আশেপাশে ওঁত পেতে থাকা দালাল আপনার হাতে বাজারদরের চেয়ে বেশি দামে সেই সরঞ্জাম তুলে দেবে।

আইনের দুর্বল প্রয়োগ

বাংলাদেশে চিকিৎসা অবহেলার বিরুদ্ধে আইন থাকলেও, তা প্রায়ই কার্যকর হয় না। চিকিৎসক ও হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ প্রভাবশালী হওয়ায় মামলা চলমান থাকলেও ভুক্তভোগীরা ন্যায্য বিচার পান না।

সমাধানের পথ

স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা বলছেন—

  • চিকিৎসকদের নিয়মিত প্রশিক্ষণ বাধ্যতামূলক করতে হবে।
  • হাসপাতালগুলোতে তদারকি ও অডিট ব্যবস্থা জোরদার করতে হবে।
  • ভুল চিকিৎসার জন্য শাস্তি নিশ্চিত করতে হবে।
  • রোগীর সচেতনতা বৃদ্ধি করতে হবে, যেন তারা চিকিৎসার প্রতিটি ধাপ বুঝে নেন।

ভারত থেকে আসা কিছু অনভিজ্ঞ চিকিৎসক বর্তমানে বাংলাদেশের বিভিন্ন বড় বড় হাসপাতালে কাজ করছেন। ভুল চিকিৎসার কারণে তারা রোগীর অবস্থা শোচনীয় করে তুলছেন। সম্প্রতি সুপ্রভাত সিডনির অনুসন্ধানে এমনই এক ঘটনা ধরা পড়েছে।

বাংলাদেশ বিমানের এক অবসরপ্রাপ্ত কর্মকর্তা নিউমোনিয়ায় আক্রান্ত হলে তাকে রাজধানীর একটি বড় হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। কয়েকদিন ধরে ভুল চিকিৎসা চালিয়ে রোগীকে ঘুমের ওষুধ দিয়ে অবচেতন অবস্থায় রাখা হয়। রোগীর আত্মীয়রা খোঁজ নিলে হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ জানায়— “চিকিৎসা চলছে।” প্রশ্ন জাগে, নিউমোনিয়ার জন্য দুদিন ধরে রোগীকে অজ্ঞান করে রাখা—এ কেমন চিকিৎসা?

সন্দেহ হলে পরিবার অন্য চিকিৎসকের পরামর্শ নেয় এবং জরুরি ভিত্তিতে রোগীকে এয়ার অ্যাম্বুলেন্সে করে থাইল্যান্ডের একটি হাসপাতালে নিয়ে যায়। সেখানে পৌঁছে চিকিৎসকরা অবাক হয়ে প্রশ্ন করেন— ন্যাশনালের মতো এত বড় হাসপাতালে কীভাবে এমন ভয়াবহ ভুল চিকিৎসা হতে পারে?

তাহলে প্রশ্ন দাঁড়ায়—

-কে দেখবে এই ভুল চিকিৎসার হোতাদের?

-কে তাদের আইনের আওতায় আনবে?

-বাংলাদেশের হাসপাতালগুলোতে ভালো চিকিৎসকের নিশ্চয়তা কে দেবে?

যদি এসব হাসপাতালে সাঁড়াশি অভিযান চালানো হয়, তবে দেখা যাবে অনেকেরই হয়তো চিকিৎসক হিসেবে বৈধ লাইসেন্স নেই। তাই সরকারের উচিত অবিলম্বে দেশের সর্বত্র— অলিগলির ছোট মেডিকেল সেন্টার থেকে শুরু করে সরকারি ও বেসরকারি বড় হাসপাতাল পর্যন্ত— নিয়মিত অভিযান চালানো এবং কঠোরভাবে রুটিন চেক-আপ নিশ্চিত করা।

বাংলাদেশের স্বাস্থ্যখাত যদি এই সমস্যার সমাধান না করে, তবে রোগীর আস্থা পুরোপুরি হারিয়ে যাবে যার প্রভাব পড়বে প্রবাসী চিকিৎসা পর্যটনের প্রবণতা ও দেশের অর্থনীতিতেও।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *