আমি একটি পুরাতন জরাজীর্ণ ডাকবাক্স। দীর্ঘদিন ধরে অনাদর, অবহেলায় অজ পাড়াগাঁয়ের ছোট্ট বাজারের একপ্রান্তে পড়ে আছি। শেরশাহ নামে একজন ভারতীয় শাসক ১৫৪০-১৫৪৫ সালের মধ্যে ভারতবর্ষে ১৭০০টি ডাকঘর ও ৩৪০০টি বার্তাবাহক নিযুক্তের মাধ্যমে একটি শক্তিশালী যোগাযোগ নেটওয়ার্ক গড়ে তোলেন। তিনি সর্বপ্রথম ঘোড়ায় ডাকের প্রবর্তন করেন। ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে সদ্য স্বাধীন হওয়া বাংলাদেশের এই স্থানে আমার প্রতিষ্ঠা হয়। সেই সময় থেকে দীর্ঘ সময় জনগণের মাঝে যোগাযোগ রক্ষায় নিয়োজিত রয়েছি। নিরবিচ্ছিন্নভাবে সেবা প্রদান করে আসছিলাম। কিন্ত নব্বইয়ের দশকের পর থেকে আমার গুরুত্ব কমতে শুরু করে। ডিজিটালাইজেশনের নামে ডাক বিভাগের অস্তিত্ব হ্রাস পেতে থাকে। আর তখন থেকেই আমি একপ্রকার বেকার। মানবেতর জীবন যাপন করছি। আমার পিতা ওয়ারেন হেস্টিংস ১৭৭৪ সালে আমার আর্বিভাব করেন। তখন আমার বেশ সমাদর ছিল। ভারতীয় উপমহাদেশে অবশ্য আমার আগমন ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানীর হাত ধরে। সে সময় ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানী এদেশে ব্যবসা সম্প্রসারণের জন্য আমার উন্নতি সাধন করেন। এরপর ১৮৩৭ সালে রোলান্ড হিল নামে একজন হৈতষী আংকেল ডাকটিকিট আবিস্কারের মাধ্যমে আমাদের মানবসেবার এই মাধ্যমকে আরো আধুনিকীকরণ করেন। এরপর অনেক স্বর্ণালী সময় অতিবাহিত করি। নব্বইয়ের দশক পর্যন্ত আমাদের এরকম স্বর্ণালী সময় কাটে। এর পরবর্তী সময়গুলো আমাদের খুব কষ্টে কাটতে থাকে। মোবাইল ফোন আবিস্কারের মাধ্যমে মানুষজন সেদিকে ঝুঁকে পড়ে। এটি সময়ের পরিবর্তন। হতেই পারে। কিন্তু এতো তাড়াতাড়ি কেউ কাউকে ভুলে যাবে এটি কেমন কথা? আমার সঙ্গে তাই হচ্ছে। তোমরা মানুষরা বড় অকৃতজ্ঞ। তোমরা সহজে উপকারীর উপকারের কথা ভুলে যাও। আর তখন থেকেই আমার মানবেতর জীবন শুরু। কেউ আমার খোঁজ রাখে না। রোদ বৃষ্টিতে ভিজে পুড়ে আমার আর জৌলুস নাই। রঙ উঠে চেহারায় বার্ধ্যকের ছাপ পড়ে গেছে। মাটির মধ্যে ঢুকে গেছে আমার অর্ধেক শরীর। কেউ আর চিঠি ফেলেনা। সময়মতো আর খোলাও হয় না। কদিন পর হয়তো আমার ঠাঁই হবে জাদুঘরে। জীবনে আমার বহু উত্থান পতন এসেছে। বয়স হয়েছে। আর হয়তো বেশিদিন তোমাদের মাঝে নেই। কিন্তু সারাজীবন স্মৃতি হয়ে থাকতে চাই তোমাদের মাঝে। অবহেলা আর অসম্মানের গ্লানিতে জীবনের প্রতি আমার বড় ঘৃণা জন্মেছে। নিলর্জ বেহায়া কিছু লোকজন আমার পাশে দাঁড়িয়ে হিসু করে। পানের পিক ফেলে নোংরা করে আমার শরীর। কাক পক্ষীরাও আজকাল আমার মাথার উপর দাঁড়িয়ে প্রাকৃতিক কার্য সারে। অথচ কয়েক দশক আগেও আমার সম্মান আর কদর ছিল আকাশ ছোঁয়া। মানুষের সুসময় দূঃসময়ে পাশে ছিলাম। একখানা চিঠি পাওয়ার আশায় মানুষ অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করতো। চাকরির নিয়োগপত্র হাতে পেয়ে পোস্টম্যানকে মিষ্টি খাওয়াতো। প্রেমিক প্রেমিকাদের যোগাযোগের একমাত্র মাধ্যম ছিলাম আমি। তারা একটি চিঠি পাওয়ার পর বারবার পড়তো। শুয়ে পড়তো, বসে পড়তো, বারবার চুমু খেত। তারপর সযত্নে তালা দিয়ে ট্রাংকে তুলে রাখতো। কত মাধুরী মেশানো ছিল সে পত্রগুলো। তখনকার দিনের ছেলে মেয়েরা ছিল অনেক সভ্য। এখনকার দিনের মতো বেলাল্লাপনা নয়। আমার থাকার জায়গাখানা এখন বেশ নির্জন ও জঙ্গলে ঘেরা। প্রতিদিন নিয়ম করে কিছু নেশায় আসক্ত বদ ছেলেরা এখানে এসে অনেক রাত অবধি গাঁজা মদ খায়, বেসুরো গলায় গান গায়। গালাগালি করে। মাথার উপর বসে আড্ডা দেয়। লজ্জা ও ঘৃণায় তখন আমার মরে যেতে ইচ্ছে করে।