সালাম হারিয়ে যাওয়া এক সভ্যতার নিঃশব্দ সংকেত

মোহাম্মদ আলম ফরিদ: আমি নামাজে যাওয়ার জন্য মসজিদের দিকে হাঁটছি। কয়েকজন দাড়িওয়ালা লোক কে আমার দিকে হেঁটে আসতে দেখে সালাম দিলাম। মনে হলো উনারা আমার সালাম শুনলো না। উত্তর না দিয়ে চলে গেল। আজ আমি খুবই অবাক হয়ে খেয়াল করলাম, আমিও অনেক সময় মুসলমান দেখলেও সালাম দেইনা। আবার অনেক মুসলমান আমাকে সালাম দেন না। ব‍্যপারটা এমন না যে আমার সুরত দেখে কেউ মনে করবে আমি মুসলমান না। আমি দাড়িওয়ালা, বেশ বড় সুন্নতি দাড়ি। মাথায় বেশীরভাগ সময় টুপি থাকে। তারপরও আমি যদি মানুষের কাছে মুসলমান হিসেবে অদৃশ্য হই, তাহলে তো এটা একটা ভয়াবহ ঘটনা। এক কারন কি জানতে খুবই ইচ্ছে হলো। কিছু গবেষনা পেলাম। মনে হলো সবার সাথে শেয়ার করতে পারলে হয়তো সবার উপকার হবে।

আজকের পৃথিবীতে “আসসালামু আলাইকুম” শুধু একটি সম্ভাষণ নয়, বরং এটি ছিল এক আত্মার ভাষা—একটি সত্ত্বার পরিচয়, যেখানে একজন মুসলমান অপর মুসলমানকে তার অস্তিত্বের নিরাপত্তা, শান্তি ও ভালোবাসার বার্তা দিত। অথচ আজ দেখা যাচ্ছে, মুখে ইসলাম, পোশাকে ইসলাম, পরিচয়ে ইসলাম, কিন্তু চেতনায় নয়। মানুষ একে অপরকে সালাম দেয় না, চোখ ফিরিয়ে নেয়, কিংবা এমনভাবে পাশ কাটিয়ে যায় যেন পরিচয়ের প্রতিটি বিন্দু হারিয়ে গেছে ধুলোর মতো।

এই প্রবণতার শিকড় খুঁজলে তা কেবল ধর্মীয় অবহেলায় নয়, বরং এক জটিল সামাজিক ও মনস্তাত্ত্বিক পরিবর্তনের গভীরে গিয়ে পৌঁছায়। নৃতাত্ত্বিকভাবে, সালাম ছিল একটি সামাজিক আচার যা প্রাচীন ইসলামি সভ্যতায় বিশ্বাস, সমতা, ও পারস্পরিক নিরাপত্তার বন্ধন রচনা করত। নবীজি মুহাম্মদ ﷺ বলেছেন, “তোমরা একে অপরের মধ্যে সালাম ছড়িয়ে দাও।” এটি কেবল অভিবাদন নয়, বরং সামাজিক সংহতির স্থাপনা—একটি মাইক্রো-আচরণ যা সমাজের বন্ধনকে দৃঢ় করত। কিন্তু আধুনিক সময়ে মুসলিম সমাজ সেই মানবিক আচার হারিয়েছে। নগরজীবনের গতি, ব্যক্তিকেন্দ্রিকতা ও গোপন আস্থা-হ্রাস এই সংস্কৃতিকে গিলে খেয়ে ফেলেছে।

সাইকোলজিক্যাল দিক থেকে বিষয়টি আরও গভীর। সালাম দেওয়ার কাজের মধ্যে নিহিত আছে বিনয় ও অন্যের প্রতি গ্রহণযোগ্যতার প্রকাশ। কিন্তু যখন সমাজে “trust deficit” তৈরি হয়, তখন মানুষ অবচেতনে প্রতিরক্ষামূলক হয়। তারা ভাবে, “আমি আগে কেন সালাম দেব?”—এ যেন এক প্রতিযোগিতা, কে আগে দেবে নয়, বরং কে আগে দেবে না। মনস্তত্ত্বে একে বলে ego-defense mechanism—যেখানে ব্যক্তি নিজের অহম রক্ষার জন্য অপরের প্রতি সদয় আচরণে কুণ্ঠাবোধ করে। সালাম না দেওয়ার এই মানসিকতা সেই সামাজিক আত্মরক্ষার প্রতীক, যা আসলে অবচেতনে সমাজে ভয়ের প্রতিফলন।

নৃতাত্ত্বিকভাবে, সালাম ছিল “communal marker”—যেখানে এক মুসলমান অপর মুসলমানকে চেনার জন্য অভিবাদন জানাত। কিন্তু বিশ্বায়নের যুগে “identity fragmentation” বা পরিচয়ের ভাঙন মুসলিম সমাজকে বহু খণ্ডে বিভক্ত করেছে। কেউ আরেকজনকে নিজের ধর্মীয় গোষ্ঠীভুক্ত বলে মনে করে না। একে বলে in-group distrust—যেখানে একই বিশ্বাসের মানুষও একে অপরকে সন্দেহের চোখে দেখে। মুসলিম সমাজের এই অবিশ্বাস একেবারে দৈনন্দিন আচরণে, যেমন সালাম না দেওয়া, দিয়ে প্রকাশ পায়।

বৈশ্বিকভাবে সমাজবিজ্ঞানীরা লক্ষ্য করেছেন, ধর্মীয় চেতনার বাহ্যিক রূপ যেমন পোশাক, দাড়ি, বা টুপি, তা আর সামাজিক আস্থা বা পারস্পরিক সংযোগের প্রতীক নয়। একজন দাড়িওয়ালা মানুষ সালাম না পেলে, সেটি কেবল ধর্মীয় উদাসীনতা নয়—এটি তার সমাজে “symbolic alienation”-এর প্রতিচ্ছবি। অর্থাৎ, তিনি দৃশ্যত সমাজের অংশ, কিন্তু মানসিকভাবে সমাজ তাকে গ্রহণ করছে না।

মনস্তত্ত্ববিদ এরিক ফ্রম তাঁর “Escape from Freedom”-এ বলেন, আধুনিক মানুষ স্বাধীন হলেও নিঃসঙ্গ। সেই নিঃসঙ্গতা থেকে জন্ম নেয় আত্মরক্ষামূলক সামাজিক দূরত্ব। মুসলমানদের মধ্যেও এই একই মানসিক ব্যাধি ছড়িয়ে পড়েছে—স্বাধীনতা আছে, কিন্তু সংহতি নেই। তাই সালাম, যা ছিল একটি উষ্ণ সম্পর্কের সূচনা, এখন নিছক আনুষ্ঠানিক বা অনেকের কাছে অপ্রয়োজনীয় হয়ে পড়েছে।

আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ মনস্তাত্ত্বিক কারণ হলো “spiritual fatigue”—আত্মিক ক্লান্তি। প্রতিদিনের সংগ্রাম, অর্থনৈতিক চাপ, রাজনৈতিক বিভাজন, ধর্মীয় মেরুকরণ মানুষকে এমন অবস্থায় ঠেলে দিয়েছে যেখানে আত্মিক সাড়া বা সহমর্মিতা শুকিয়ে গেছে। যখন অন্তর শুকিয়ে যায়, তখন জিহ্বা থেকে সালামও নিঃশেষ হয়।

এখানে আরেকটি গভীর নৃতাত্ত্বিক সত্য আছে: ইসলামি সমাজে সালাম ছিল “ritual of inclusion”—অর্থাৎ এটি সমাজের প্রতি অঙ্গীকারের একটি প্রতীক। কিন্তু আজকের মুসলমানরা নিজেদের ধর্মীয় সমাজ থেকে মানসিকভাবে বিচ্ছিন্ন। তাই সে যখন সালাম দেয় না, তখন সে কেবল অভিবাদন থেকে বিরত হয় না—সে মূলত সমাজের প্রতি নিজের সংযোগ ছিন্ন করে।

এই প্রবণতা বিশ্বের বিভিন্ন গবেষণায়ও উঠে এসেছে। মুসলিম সমাজে ব্যক্তিকেন্দ্রিকতা ও বিভাজনের কারণে সামাজিক আচারগুলোর অবক্ষয় হয়েছে। মধ্যপ্রাচ্য, দক্ষিণ এশিয়া ও ইউরোপে প্রবাসী মুসলমানদের মধ্যে করা নৃতাত্ত্বিক গবেষণায় দেখা যায়, ধর্মীয় অভিবাদন এখন ‘ritual of nostalgia’—অর্থাৎ এক হারানো ঐতিহ্যের প্রতি স্মৃতিমাত্র।

অবশেষে, এই প্রবণতা এক ভয়াবহ সাংস্কৃতিক রোগের দিকেই ইঙ্গিত করে: “disintegration of communal soul।” সালাম হারিয়ে যাওয়া মানে সমাজ থেকে শান্তি, আস্থা ও মানবিক বন্ধন বিলুপ্ত হওয়া। ইসলাম যেমন আত্মার একীকরণে আহ্বান জানায়, তেমনি সালাম সেই একীকরণের প্রতিদিনের অনুশীলন। তাই যখন কেউ সালাম দেয় না, তখন শুধু একটি শব্দ হারায় না, হারায় একটি সভ্যতার অন্তরস্বর।

আজ যদি কেউ দাড়িওয়ালা, টুপিওয়ালা, কিন্তু তবুও সালাম না পায়—তবে সেটি তার ধর্মীয় পরিচয়ের নয়, বরং আমাদের সম্মিলিত আত্মার মৃত্যুর প্রমাণ। সালাম এখন নিঃশব্দে হারিয়ে যাচ্ছে, আর আমরা ভাবছি—এ কেবল অভিবাদন নয়, এটি তো ছিল একসময়ের মানবতার শ্বাস, যা এখন নীরব হয়ে পড়েছে আমাদের মধ্যে।

তাই চলুন আগে সালাম দেই। আমাদের ঐতিহ্যের সংস্কৃতিকে ফিরিয়ে আনি। একটা হাদিসের বরাত দিয়ে লেখা শেষ করছি।

আবু হুরায়রা (রহ.) বর্ণনা করেছেন, রাসূলুল্লাহ (সা.) বলেছেন:

“তোমরা জান্নাতে প্রবেশ করতে পারবে না যতক্ষণ পর্যন্ত তুমি ঈমান স্থাপন করো না, এবং তুমি সত্যিকারের ঈমান স্থাপন করবে না যতক্ষণ পর্যন্ত একে অপরকে ভালোবাসবে না। আমি কি তোমাদের এমন একটি বিষয় দেখাব না, যা যদি তোমরা কর, তোমাদের মধ্যে ভালোবাসা সৃষ্টি হবে? তা হলো, একে অপরকে সালাম দাও।”

(সহীহ মুসলিম 54) https://sunnah.com/muslim:54a

 

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *