ছাত্র সংসদ নির্বাচন: নতুন রাজনৈতিক সংস্কৃতির আলোকরেখা

শিবলী সোহায়েল: বাংলাদেশের দিগন্তে এক নতুন রাজনৈতিক সংস্কৃতির আলোকরেখা ফুটে উঠছে। না, আমি এখানে কোনো বিশেষ দলের বিজয়, কোনো আদর্শের জয় কিংবা কোনো ব্যক্তি বা গোষ্ঠীর সাফল্যের কথা বলছি না। দেশের প্রধান প্রধান বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে সম্প্রতি অনুষ্ঠিত ছাত্র সংসদ নির্বাচনের মাধ্যমে বাংলাদেশের সামগ্রিক রাজনৈতিক চরিত্রে যে পরিবর্তনের আভাস স্পষ্ট হয়ে উঠছে, আমি সেই পরিবর্তনের কথাই বলছি। বর্তমান সংস্কৃতি কোথায় দাঁড়িয়ে, কোন নতুন আলোকরেখা ধীরে ধীরে ফুটে উঠছে, এর চালিকাশক্তি কারা, নেতৃত্বে আছে কে, আর কী কী প্রতিবন্ধকতা বিরাজ করছে এবং কারা এই বাধা তৈরি করছে—এই নিবন্ধে তারই আলোচনা থাকবে।

বাংলাদেশসহ অনেক উন্নয়নশীল দেশেই রাজনৈতিক সংস্কৃতির কিছু প্রধান বৈশিষ্ট্য হলো:

  • দলবাজি ও নেতাবাজি: ভালো-মন্দ বিচার না করে নিজ দল ও নেতার সবকিছুকে সমর্থন করা।
  • সহিংসতা ও শক্তির প্রদর্শন: রাজনীতি মানে পেশিশক্তি, অস্ত্র, মিছিল ও হুমকির মাধ্যমে ক্ষমতা দখল, ক্ষমতা গ্রহণ নয়।
  • দুর্নীতি, চাঁদাবাজি ও লুটপাট: রাজনীতিকে সেবার ক্ষেত্র নয়, বরং সুবিধা নেওয়ার উপায় বা এক ধরনের ব্যবসা হিসেবে দেখা।
  • ঘৃণার চাষ: ভিন্নমত মানেই শত্রু—তাই রাজনৈতিক প্রতিযোগিতার বদলে ঘৃণা, বিষোদ্গার ও বিদ্বেষের বিস্তার।
  • দায় চাপানো: নিজের ব্যর্থতা ও অন্যায় আড়াল করতে সবকিছুর দায় প্রতিদ্বন্দ্বী দলের ঘাড়ে চাপানো।
  • প্রশাসনিক হস্তক্ষেপ: নির্বাচনে কারচুপি, বিচারব্যবস্থাকে নিয়ন্ত্রণ করা ইত্যাদি।

রাজনৈতিক সংস্কৃতির এই বৈশিষ্ট্যগুলো শুধু রাজনীতিকে কলুষিত করেনি, শুধু গণতন্ত্র ও উন্নয়নের পথে বাধা হয়ে দাঁড়ায়নি। এগুলো ভালো নেতৃত্ব জন্ম নেওয়ার সব দরজা বন্ধ করে দিয়েছে। সৎ ও যোগ্য মানুষকে রাজনীতি থেকে দূরে ঠেলে দিয়েছে, রাজনীতিকে তাদের কাছে ঘৃণার জায়গায় পরিণত করেছে। এর ভয়াবহতম রূপ আমরা দেখেছি গত পনের বছরের শেখ হাসিনার ফ্যাসিবাদী শাসনামলে। দীর্ঘ সেই শাসনকাল আমাদের রাজনৈতিক সংস্কৃতিকে শুধু ক্ষতবিক্ষতই করেনি, সম্পূর্ণভাবে বিষিয়ে দিয়েছে।

আমরা যারা নব্বইয়ের দশকে রাজনীতি দেখে বড় হয়েছি, তাদের কাছে বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্র সংসদ নির্বাচন মানেই ছিল কানফাটা স্লোগান, ধাওয়া–পাল্টাধাওয়া, গলাবাজি, অস্ত্রের ঝনঝনানি আর ককটেলবাজি। হকি স্টিক ও রামদা ছিল সাধারণ দৃশ্য, বরং পিস্তল বা পাইপগান হাতে থাকাই ছিল গর্বের বিষয়। সংবাদপত্রের প্রথম পাতায় সেই ধাওয়া–পাল্টাধাওয়ার খবর ছিল নিত্যদিনের ঘটনা।

সেসময় কবি আল মাহমুদের “কদর রাত্রির প্রার্থনা” কবিতায় আমাদের প্রধান শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের ভয়াবহ অবস্থার ছবি ফুটে উঠেছিল। তিনি সেখানে প্রশ্ন করেছিলেন, “ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কি ডাকাতদের গ্রাম?”

তবে আজ দৃশ্যপট অনেকটাই ভিন্ন। সেই পুরনো দৃশ্য, ধাওয়া–পাল্টাধাওয়া এখন অনুপস্থিত। নেই গোলাগুলি, বোমাবাজি বা সহিংসতার ভয়। সেই একই ক্যাম্পাসে এখন নির্বাচনে অংশ নিচ্ছে অনেক মেধাবী শিক্ষার্থী, যারা একসময় রাজনীতি থেকে শত হাত দূরে থাকত। চারটি প্রধান বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্র সংসদ নির্বাচন হয়ে গেল। দু-একটি ছিটেফোঁটা ঘটনা ছাড়া বড় ধরনের অঘটনের কোনো খবর নেই। এটাই আমাদের জুলাই বিপ্লবের বড় উপহার।

এবারের নির্বাচনগুলো বাংলাদেশের রাজনৈতিক সংস্কৃতিতে এক নতুন অধ্যায়ের সূচনা করেছে বলেই মনে হচ্ছে। নেই পেশিশক্তির প্রদর্শন, নেই অকারণ সংঘর্ষ। তার বদলে আছে আলোচনা, সমালোচনা, প্রশ্ন আর দাবি। শক্তির রাজনীতি আর গ্রহণযোগ্য নয়। প্রতিযোগিতা হচ্ছে এখন যুক্তি, অংশগ্রহণ আর আচরণের মাধ্যমে।

কিন্তু এই পরিবর্তনের কারণ কী? জুলাই বিপ্লবের সময় সাধারণ শিক্ষার্থীরা “ছাত্রলীগ” নামের সেই ডাকাতদের বিশ্ববিদ্যালয়ের হল থেকে পিটিয়ে বের করে দিয়েছিল। আজকের এই সন্ত্রাসমুক্ত ক্যাম্পাস কি শুধু তারই ফল, নাকি এর পেছনে আরও কোনো কারণ আছে?

এই পরিবর্তনের কারণ শুধু ছাত্রলীগের সন্ত্রাসীদের বের করে দেওয়া নয়। এর চেয়েও বড় নিয়ামক হলো বিশ্ববিদ্যালয়ের ভোটার ও দেশব্যাপী ছড়িয়ে থাকা তরুণরা, যাদের আমরা “জেন-জি” নামে অভিহিত করছি। তারা কোনো দলীয় রঙে আবদ্ধ নয়, কোনো একক নেতা বা পরিবারের পূজারী নয়। তারা ভালোকে ভালো আর কালোকে কালো বলার সাহস রাখছে।

চোখের সামনে গড়ে উঠছে এই নতুন প্রজন্ম, যারা দলের নামের আগে নীতিকে অগ্রাধিকার দিচ্ছে। তারা প্রশ্ন করার সাহস রাখছে, জবাবদিহি দাবি করতে পারছে। তারা রাজনীতিকে সেবা ও দায়িত্ব হিসেবে দেখতে চায়, ব্যবসা বা সুবিধা নেওয়ার মাধ্যম হিসেবে নয়। এই তরুণ প্রজন্ম ঘৃণার বদলে ভিন্নমতকে সম্মান করতে বলছে, প্রতিপক্ষকে শত্রু নয়, প্রতিযোগী হিসেবে দেখতে অভ্যস্ত হচ্ছে। এই দৃশ্য আশা জাগায়। মনে হয়, এবার সত্যিই পরিবর্তন শুরু হয়েছে। আর সেই পরিবর্তনের আলোকছটা ছড়িয়ে পড়ছে দেশের বড় বড় বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র সংসদ নির্বাচনে।

এই পরিবর্তন হঠাৎ আসেনি। জুলাই আন্দোলন এর ভিত গড়ে দিয়েছে। তরুণরা আর রাজনৈতিক সহিংসতা, ট্যাগিং, ফ্রেমিং-এর রাজনীতি মেনে নিতে রাজি নয়। ২০২৪ সালের জুলাই বিপ্লব শুধু সরকার পরিবর্তন করেনি, ভেঙে দিয়েছে পুরনো রাজনৈতিক অভ্যাসও।

আগে রাজনৈতিক দলকে সমর্থন করা মানেই ছিল অন্ধ পক্ষপাত। সঠিক-ভুল বিচার না করা, কোনো সমালোচনা না করা। এমনকি মারাত্মক ভুল হলেও, সেটি ঢাকতে বা ন্যায্যতা দিতে প্রবল চেষ্টা করা হতো। এখনও অনেক সক্রিয় কর্মীর ভেতরে এই প্রবণতা দেখা যায়। তবে আমি এখানে সেই জেন-জি প্রজন্মের কথা বলছি, যারা এই গণ্ডি থেকে বের হয়ে এসেছে। তারা স্বাধীনভাবে যাচাই করতে পারছে, সমালোচনা করতে পারছে, এবং ভালো-মন্দ আলাদা করে বলতে দ্বিধা করছে না।

জুলাই–পরবর্তী সময়ে এই তরুণরা দেখিয়েছে তারা আর পুরনো পথে হাঁটবে না। তারা দলীয় নাম নয় বরং কাজের ফলাফলের ভিত্তিতে বিচার করছে। তারা প্রশ্ন তুলছে, জানতে চাইছে প্রার্থীদের আচরণ কেমন। শুধু গলাবাজি শুনতে তারা রাজি নয়। তারা দেখতে চায় দল ও প্রার্থীরা কী করছে, প্রতিশ্রুতি কতটা পূরণ করছে।

এই নতুন দৃষ্টিভঙ্গি ডাকসু, জাকসু, চাকসু ও রাকসু নির্বাচনে প্রতিফলিত হয়েছে। সততা, ন্যায্যতা ও জবাবদিহিতার দাবি তারা শুধু মুখে বলছে না, ভোটের মাধ্যমেই প্রমাণ করছে। এটাই বাংলাদেশের রাজনীতিতে এক নতুন সম্ভাবনার সূচনা—নতুন রাজনৈতিক সংস্কৃতির আলোকরেখা।

এখন দেখা যাক এই চালিকাশক্তি “জেন-জি” নতুন রাজনৈতিক সংস্কৃতির পথ তৈরি করতে কতটা কার্যকর ভূমিকা রাখছে। প্রার্থী ও প্যানেল নির্ধারণের দিকেই আগে নজর দেওয়া যাক। এ ক্ষেত্রে স্পষ্টভাবে দেখা যাচ্ছে, ইসলামী ছাত্র শিবির এক নতুন মানদণ্ড স্থাপন করেছে। তারা একঝাঁক মেধাবী শিক্ষার্থীকে নিয়ে একটি ডাইভার্স ও ইনক্লুসিভ প্যানেল গঠন করেছে। অথচ অতীতে আমরা দেখেছি, পুরোনো রাজনৈতিক সংস্কৃতির প্রধান লক্ষ্য ছিল শিক্ষার পরিবেশ গড়ে তোলার বদলে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে দলীয় প্রভাব বিস্তার করা। তখন মেধাকে উপেক্ষা করে মাস্তান, পেশিশক্তি আর গলাবাজ নেতাদের অগ্রাধিকার দেওয়া হতো। কিন্তু শিবিরের দৃষ্টিভঙ্গি ছিল ভিন্ন। তাদের মূল লক্ষ্য ছিল শিক্ষাঙ্গনে পড়াশোনার পরিবেশ সৃষ্টি করা। আর প্রার্থী নির্বাচনে তাদের অগ্রাধিকার ছিল যোগ্যতা ও মেধা। এখান থেকেই স্পষ্ট হয়ে ওঠে, নতুন রাজনৈতিক সংস্কৃতির সূচনা বাস্তবে রূপ নিতে শুরু করেছে।

আমরা যদি শুধুমাত্র ডাকসুর প্যানেলের দিকেই তাকাই তাহলে দেখতে পাই: সাদিক কায়িম একজন বলিষ্ঠ সংগঠক ও অত্যন্ত বিনয়ী। জুলাই আন্দোলনে তার অসামান্য ভূমিকা ছাত্ররা কাছ থেকে প্রত্যক্ষ করেছে। এসএম ফরহাদ একজন মেধাবী ছাত্র ও বিতার্কিক। মুহাম্মদ মহিউদ্দীন খান অনার্সে ৩.৯৩ সিজিপিএ পেয়ে প্রথম শ্রেণিতে প্রথম হয়েছেন এবং মাস্টার্সের প্রথম সেমিস্টারে অর্জন করেছেন ৪.০০ এর মধ্যে ৪.০০। মাজহারুল ইসলাম ও মু. সাজ্জাদ হোসাইন খান সম্প্রতি ডিনস অ্যাওয়ার্ড পেয়েছেন। আরমান হোসেন একজন প্রতিভাবান স্পোর্টসম্যান। শুধু তাই নয়, শিবির নিজ দলের বাইরে গিয়ে নারী শিক্ষার্থী, পাহাড়ি শিক্ষার্থী এবং জুলাই বিপ্লবে আহতদেরকেও অন্তর্ভুক্ত করে একটি সত্যিকারের বহুমাত্রিক ও অন্তর্ভুক্তিমূলক প্যানেল তৈরি করেছে।

ঐতিহাসিকভাবে বাংলাদেশের রাজনীতিতে ডাকসুর একটি বিশাল গুরুত্ব রয়েছে। তাছাড়া এই ডাকসু নির্বাচন ছিল ফ্যাসিবাদ পতনের পর গণতন্ত্রের পথে যাত্রার প্রথম ধাপ। তাই এটি একই সঙ্গে প্রশাসন, শিক্ষার্থী ভোটার এবং রাজনৈতিক দলগুলোর জন্য একটি বিশাল পরীক্ষা ছিল। প্রশাসনের পরীক্ষা ছিল তারা অবাধ ও নিরপেক্ষ নির্বাচন নিশ্চিত করতে পারে কি না। শিক্ষার্থীদের পরীক্ষা ছিল তারা কি মেধা ও সততার ভিত্তিতে প্রার্থী বেছে নেবে, নাকি আবারও পেশিশক্তি আর গলাবাজির কাছে নতি স্বীকার করবে। আর রাজনৈতিক দলগুলোর জন্য পরীক্ষা ছিল তারা জুলাই বিপ্লবের স্পিরিট অনুযায়ী আচরণ করতে পারে কি না। সেই কারণেই দেশজুড়ে সবার দৃষ্টি ছিল ডাকসু নির্বাচনের দিকে।

শিবিরের এই মেধাবী ও অন্তর্ভুক্তিমূলক প্যানেল দ্রুত দেশব্যাপী জেন-জির কাছে প্রশংসিত হয়। আর সেই প্রশংসা ছাত্রদলকেও ভাবতে বাধ্য করে। শোনা যায়, শেষ পর্যন্ত বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যানের হস্তক্ষেপে ছাত্রদলের প্রথম সারির নেতা রাকিব ও গণেশের মতো অছাত্রদের বাদ দিয়ে নিয়মিত ছাত্র আবিদ-হামিনদের নিয়ে প্যানেল সাজানো হয়। যদিও সেখানে শিবিরের মতো মেধা ও অন্তর্ভুক্তির ছাপ ছিল না, তবু এটি প্রমাণ করে যে নতুন রাজনৈতিক সংস্কৃতির চাপে দলগুলোকে তাদের পথ বদলাতে হচ্ছে। অতীতে আমরা দলগুলোকে দেখেছি বড় কোনো নেতাকে নামমাত্র ভর্তি করিয়ে প্রার্থী বানিয়ে দিত। এবার আর তা সম্ভব হয়নি।

অবশ্য বামপন্থী দলেরা জেন-জির এই পরিবর্তনের আকাঙ্ক্ষাকে মোটেও গুরুত্ব দেয়নি। তারা মেঘমল্লার বসু নামে এমন একজনকে প্রার্থী করেছে, যে নাকি প্রায় দশ বছর ধরে বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ছে অথচ এখনও পাশ করতে পারেনি। দেশের মানুষের করের টাকায় কোনো অছাত্রকে বছরের পর বছর বিশ্ববিদ্যালয়ে পুষে রাখা দুনিয়ার আর কোথাও দেখা যায় না। সাধারণত যে কোনো বিশ্ববিদ্যালয়ের নিয়ম অনুযায়ী তার মতো ছাত্রের এখন একাডেমিক প্রবেশনে থাকার কথা, প্রার্থী হওয়ার কোনো সুযোগই থাকার কথা নয়। এখানেই বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রশাসনিক দুর্বলতা স্পষ্ট হয়ে ওঠে।

ওদিকে ছাত্রদল অন্তত চেষ্টা করেছিল একটি ভালো প্যানেল দিতে। কিন্তু বামরা কেন একেবারেই সচেষ্ট হয়নি? কারণ তারা কখনোই বাংলাদেশের মানুষের প্রত্যাশাকে গুরুত্ব দেয়নি। তাছাড়া ফ্যাসিবাদের দোসর এই বামরা বাস্তবে এ দেশের মানুষের রাজনীতি কোনোদিন করেনি, এখনও করছে না। আর এদের এই গণমানুষ-বিমুখ রাজনীতিই নতুন রাজনৈতিক সংস্কৃতি তৈরির পথে অন্যতম বড় প্রতিবন্ধকতা।

শুধু একটি ভালো প্যানেল গঠন করাই নয়, গণমানুষের প্রয়োজনকেন্দ্রিক রাজনীতিই এখন মুখ্য হয়ে উঠেছে। বিশ্ববিদ্যালয়ের সাম্প্রতিক নির্বাচনের ফলাফলও তা প্রমাণ করেছে। যেসব সংগঠন শিক্ষার্থী–চাহিদা–কেন্দ্রিক ও শিক্ষার্থীবান্ধব কাজ করেছে, তারাই বিজয়ী হয়েছে। এর সঙ্গে যুক্ত হয়েছে শিক্ষাঙ্গনে জ্ঞানচর্চার পরিবেশ (scholarly environment) বজায় রাখার প্রতিশ্রুতি। সব মিলিয়ে এগুলোই আগামী দিনের রাজনীতির জন্য জেন–জির পক্ষ থেকে এক কঠিন বার্তা।

বিষয়টি শিবিরই সবচেয়ে আগে অনুধাবন করেছে। কিন্তু ছাত্রদল ও অন্যরা এখনও সেই পুরোনো ধাঁচের রাজনীতির মধ্যে ঘুরপাক খাচ্ছে। মনে হয়, ছাত্রলীগের বিরুদ্ধে দীর্ঘ সময় রাজনীতি করতে গিয়ে তারা যে আওয়ামী রাজনীতির অশুভ কৌশল রপ্ত করেছিল—সন্ত্রাস, দমন আর প্রভাব বিস্তারের সেই ধারা থেকে আজও তারা নিজেদের মুক্ত করতে পারেনি।

বিপরীতে শিবির জুলাই বিপ্লবের স্পিরিট এবং জেন–জির নতুন রাজনৈতিক সংস্কৃতির আকাঙ্ক্ষাকে সামনে রেখে এগিয়েছে। তাদের ভরকেন্দ্র ছিল সেবামুখী ও শিক্ষার্থী–চাহিদা–কেন্দ্রিক কার্যক্রম, মেধাবী ও অন্তর্ভুক্তিমূলক প্যানেল, নারী–নিরাপত্তা, বিদ্বেষ ও বিষোদ্গারের পরিবর্তে পারস্পরিক শ্রদ্ধার সঙ্গে প্রতিযোগিতা, এবং দৃঢ় সাংগঠনিক শৃঙ্খলা। প্রতিটি ক্যাম্পাসেই এই বৈশিষ্ট্যগুলোর প্রতিফলন ঘটেছে। আর শিবিরের শিক্ষার্থী ও শিক্ষা–বান্ধব কাজের সুদৃঢ় প্রত্যয় জেন–জির হৃদয়ে প্রবল সাড়া জাগিয়েছে।

৫ আগস্টের মুক্তির পর থেকেই দেশের ক্যাম্পাসগুলোতে শিবিরের কর্মীরা নতুনভাবে সক্রিয় হয়ে ওঠে। তাদের মূল লক্ষ্য ছিল শিক্ষার্থীদের পাশে থাকা। শুধু পোস্টার বা স্লোগান নয়, বরং বাস্তব সহায়তা দেওয়া। বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তিপরীক্ষার্থীদের জন্য হেল্প ডেস্ক, শিক্ষার্থীদের জন্য বিনামূল্যে স্বাস্থ্যসেবা দেওয়ার মেডিক্যাল ক্যাম্প, হলে হলে বিশুদ্ধ পানির ফিল্টার—সবই ছিল শিক্ষার্থী–চাহিদা–কেন্দ্রিক কার্যক্রমের অংশ।

আগস্টের মাঝামাঝি শিবির আয়োজন করে “লাল জুলাই” স্মারক প্রদর্শনী ও সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান। জুলাই আন্দোলনের শহীদ ও আহতদের স্মরণে এই আয়োজন সাধারণ ছাত্রদের আবেগ ছুঁয়ে যায়। এতে প্রমাণ হয় শিবির শুধু নির্বাচনী রাজনীতি করছে না, বরং দেশের সাম্প্রতিক ইতিহাস সংরক্ষণেও দায়িত্ব পালন করছে। সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান, বিতর্ক প্রতিযোগিতা, প্রদর্শনী—সব মিলিয়ে ক্যাম্পাসে এক শান্ত ও বুদ্ধিবৃত্তিক পরিবেশ তৈরি হয়।

একই সময়ে তারা ঘোষণা দেয় প্রতিটি আবাসিক হলে আধুনিক আইটি ও ক্যারিয়ার সেন্টার স্থাপন করবে। গবেষণা, ডেটা অ্যানালাইসিস, থিসিস সাপোর্ট, অনলাইন কার্যক্রম সবকিছুর সুবিধা শিক্ষার্থীরা পাবে। এটি শিক্ষার্থীদের কাছে “ভবিষ্যৎমুখী চিন্তার রাজনীতি” হিসেবে প্রতিভাত হয়।

শিবিরের প্রচারণার মূল বার্তা ছিল নারী শিক্ষার্থীদের নিরাপত্তা ও মর্যাদা নিশ্চিত করা। আবাসন সংকট নিরসন, সাইবার হয়রানি প্রতিরোধ, নিরাপদ ক্যাম্পাস গড়ে তোলা—এসব ছিল তাদের স্পষ্ট প্রতিশ্রুতি। সেপ্টেম্বরের প্রথম সপ্তাহে যখন ভোট ঘনিয়ে আসে, শিবির তাদের প্রচারণাকে আরও সুসংগঠিত করে। অন্যরা যেখানে বড় মিছিল কিংবা শক্তি প্রদর্শনে ব্যস্ত ছিল, সেখানে শিবির মনোযোগ দেয় শিক্ষার্থী–চাহিদা–কেন্দ্রিক প্রতিশ্রুতি ও নীরব কিন্তু দৃশ্যমান সেবামুখী কাজে। শিক্ষার্থীরা দেখতে পায় এক নতুন রাজনৈতিক সংস্কৃতির আলোকরেখা। তারা উৎসাহিত হয় ভোটকেন্দ্রে যেতে। এতদিন যারা “আই হেট পলিটিক্স” প্রজন্ম হিসেবে পরিচিত ছিল, তাদের মধ্যেও দেখা যায় বিপুল উদ্দীপনা। অনেক তরুণ–তরুণীকে ভোট দিতে এসে বলতে শোনা গেছে, “ঈদের মতো লাগছে।” এবারের নির্বাচনে তাই ভোটকেন্দ্রগুলোতে রেকর্ডসংখ্যক উপস্থিতি লক্ষ্য করা গেছে।

বিজয়ের পর শিবির কোনো ক্যাম্পাসেই বিজয় উৎসব, রঙ মাখামাখি বা জাঁকজমকপূর্ণ মিছিল আয়োজন করেনি। বরং তারা করেছে দোয়া, মোনাজাত, শহীদদের কবর জিয়ারত এবং সংযত কৃতজ্ঞতার আয়োজন। এরপর যার যার দায়িত্ব নিয়ে তারা সাথে সাথেই কাজে নেমে পড়ে। এতে শিক্ষার্থীরা স্পষ্টভাবে উপলব্ধি করে—এটি এক নতুন ধাঁচের রাজনীতি, যেখানে প্রদর্শন নয়, দায়িত্বই মুখ্য।

তবে একটি নতুন রাজনৈতিক সংস্কৃতি গড়ে তুলতে দীর্ঘ সময় লাগে। এর জন্য শুধু নির্বাচনী পরিবর্তন যথেষ্ট নয়, প্রয়োজন সমাজের প্রতিটি স্তরে আন্তরিক ইচ্ছা ও সম্মিলিত প্রচেষ্টা। কারণ সংস্কৃতি মানে কেবল কিছু নিয়ম নয়, বরং মানুষের চিন্তাভাবনা, অভ্যাস আর আচরণের এক গভীর রূপ। বাংলাদেশের ক্ষেত্রে এটি আরও কঠিন, কারণ বহু দশক ধরে সহিংসতা, দোষারোপ, স্বজনপ্রীতি ও ক্ষমতার লোভ রাজনীতির সাথে জড়িয়ে গেছে। এসব ভাঙতে সময় লাগবে। মানুষকে ধীরে ধীরে শিখতে হবে ভিন্নমতকে সহ্য করা, দায়িত্বশীল নেতৃত্বকে মূল্যায়ন করা এবং সেবামুখী রাজনীতিকে উৎসাহ দেওয়া। বিশ্ববিদ্যালয়ের নির্বাচনে যে নতুন আলোকরেখা দেখা গেছে, তা আশাব্যঞ্জক। কিন্তু সেটিকে টেকসই রাজনৈতিক সংস্কৃতিতে রূপ দিতে প্রজন্মের পর প্রজন্মের একান্ত প্রয়াস দরকার হবে।

আমাদের প্রত্যাশা ছিল দেশের বৃহত্তম দলের ছাত্রসংগঠন ছাত্রদলই জুলাই বিপ্লবের পর নতুন রাজনৈতিক সংস্কৃতি তৈরি ও প্রসারে নেতৃত্ব দেবে। কিন্তু দুঃখজনকভাবে এ মুহূর্তে সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ হলো এই নতুন সংস্কৃতি গ্রহণে তাদের অনীহা, উদাসীনতা কিংবা পুরোনো ধাঁচ থেকে বেরিয়ে আসার অক্ষমতা। হয়তো এর জন্য যে মেধা ও দিকনির্দেশনার প্রয়োজন, তার ঘাটতিও আছে। যদিও তারা কিছু উদ্যোগ নিয়েছিল, যেমন নিয়মিত ছাত্রদের নিয়ে প্যানেল গঠন, ভর্তি পরীক্ষার্থীদের জন্য হেল্প ডেস্ক, বিনামূল্যে চিকিৎসা শিবির ইত্যাদি। কিন্তু তাদের সক্ষমতা ও দীর্ঘ রাজনৈতিক ঐতিহ্যের তুলনায় এগুলো ছিল অতি নগণ্য। শীর্ষ নেতা রাকিব, নাসির, গণেশদের কাছ থেকে কোনো সৃজনশীল রাজনৈতিক কর্মসূচির দিকনির্দেশনা না আসায় প্রার্থী আবিদ, হামিন, মায়েদ অধিকাংশ সময় ব্যয় করেছে শিবিরবিরোধী প্রচারণায়। আর সেই প্রচারণায় তারা হুবহু আওয়ামী লীগের পুরোনো বয়ানই ফেরি করেছে। এদিকে জুলাই বিপ্লবের অন্যতম সমন্বয়ক কাদের ও বাকের, আওয়ামী বয়ান ধার করে বিদ্বেষ ও বিষোদ্গারের রাজনীতি বেছে নেওয়ায় শিক্ষার্থীদের কাছে সম্পূর্ণভাবে প্রত্যাখ্যাত হয়েছে। তাদের কণ্ঠে আওয়ামী লীগের বয়ান শুনে জেন–জির মনে হয়েছে, ছাত্রলীগ বোধহয় আবার অন্য নামে ফিরে আসছে।

এই নির্বাচন ও তার আগে ছাত্রদল ও বাম প্যানেলের নানা আচরণ গণতন্ত্রের পথে গুরুতর বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছে। ৭–৯ আগস্ট টিএসসিতে শিবিরের প্রদর্শনী বন্ধ করার চেষ্টা, জাতীয় শহিদ নেতাদের ছবি সরিয়ে ফেলার দাবি, কাদের ও মেঘমল্লারের নেতৃত্বে বামদের অশ্লীল স্লোগান–বিক্ষোভ ছিল ইতিহাস ও স্মৃতির ওপর সরাসরি আঘাত। প্রদর্শনীতে যেসব জাতীয় নেতাদের ছবি ছিল, তারা ছিলেন আবু সাঈদ, ওয়াসিমসহ জুলাই বিপ্লবের অসংখ্য শহিদদের অনুপ্রেরণার উৎস। এই ছবির দিকে আঙুল তোলা মানে জুলাই শহিদদের রক্তের প্রতিও অবমাননা।

তবে শিবির সেদিন সংঘর্ষ এড়িয়ে ধৈর্যের সঙ্গে ছবি সরিয়ে নেয়। কিন্তু পরদিন তারা সেই সরানো নেতাদের বিষয়ে জুলাই শহিদ ও অন্যান্য নেতৃবৃন্দের বাণী ও মূল্যায়ন বড় বড় অক্ষরে লিখে নতুন পোস্টার প্রদর্শনীতে টাঙিয়ে দেয়। অর্থাৎ, নেতাদের ছবি সরানো গেলেও শহিদদের কণ্ঠে উচ্চারিত শ্রদ্ধা ও স্বীকৃতি কেউ মুছে ফেলতে পারেনি। এই সৃজনশীল জবাব জেন–জির চোখে শিবিরকে আরও মর্যাদাবান করে তুলেছিল।

ছাত্রদলের আচরণেও কিছুটা একই ধারা নজরে পড়ে। নির্বাচনি প্রচারণায় বহিরাগতদের ব্যবহার, ফলাফল ঘোষণার আগেই ঢাবি উপাচার্যকে উদ্দেশ করে গণেশের টেবিল চাপড়ে ধমকানো, দায়িত্বপ্রাপ্ত শিক্ষিকার সঙ্গে হামিনের দুর্ব্যবহার—এসব ছিল চোখে পড়ার মতো ঘটনা। এমনকি জাকসু নির্বাচনের দিন হঠাৎ বয়কট ঘোষণা করে নির্বাচনকে প্রশ্নবিদ্ধ করার চেষ্টা, রাকসুতে সন্ত্রাসী আচরণের মাধ্যমে নির্বাচন কয়েকবার পিছিয়ে দেওয়া, ছাত্রদল নেতা আমানের নিয়মভঙ্গ করে কেন্দ্রে ঘোরাঘুরি ও অপপ্রচার চালানো, নির্বাচনের দিন নীতিমালা ভঙ্গ করে কেন্দ্রে লিফলেট বিলি, আর ফলাফল ঘোষণার রাতে ক্যাম্পাস ঘিরে পেশিশক্তি প্রদর্শন—সব মিলিয়ে এটি ছিল সেই পুরোনো গলাবাজি–নির্ভর, সহিংস ও প্রতিক্রিয়াশীল রাজনীতির পুনরাবৃত্তি।

এর সঙ্গে যুক্ত হয়েছে নারী নেত্রী ফাতিমা তাসনিম জুমাকে কেন্দ্র করে সাইবার বুলিং, সাবিকুন নাহার তামান্নার বোরখার ছবি বিকৃতি, শিবির সমর্থিত পোস্টার–ব্যানার ছেঁড়া, প্রচারণা বোর্ড ভেঙ্গে ফেলা—সবই ছিল গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ার প্রতি চরম অবজ্ঞা।

এখানেই শেষ নয়। টঙ্গীতে শিবির নেতাকে কুপিয়ে জখম করা, চট্টগ্রামে চাঁদাবাজির প্রতিবাদে শিক্ষার্থীদের গুলিবিদ্ধ করা, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ে নারী শিক্ষার্থীর হিজাব নিয়ে কটূক্তি, মুলাদী কলেজে নবীনবরণ অনুষ্ঠানে হামলা, ভর্তি পরীক্ষার্থীদের জন্য স্থাপিত শিবিরের হেল্প ডেস্ক ভাঙচুর।

তাছাড়া দায় চাপানোর রাজনীতিই আজ ছাত্রদলের অন্যতম পরিচয় হয়ে উঠেছে। তাদের কেন্দ্রীয় নেতা রাকিব প্রকাশ্যে বলেছে,“শিবিরের উপর সব দায় চাপিয়ে দাও।” এই একটিমাত্র বাক্যই তাদের নোংরা দোষারোপের রাজনীতিকে উন্মোচিত করে। সামান্য ঘটনা ঘটলেই তারা শিবিরকে দায়ী করেছে। এটাই তাদের কৌশল। অথচ শিবির চাইলে একই কৌশল নিতে পারত। যেমন, ফাতিমা তাসনিম জুমা–কে ঘিরে অনলাইন এবিউজ, কিংবা সাবিকুন নাহার তামান্না–র হিজাব–নিকাব নিয়ে ব্যঙ্গ, শিবিরের পোস্টার–ব্যানার ছেঁড়া, প্রচারণার বিলবোর্ড ভাঙচুর—এসব ঘটনায় শিবিরও সহজেই ছাত্রদলকে দায়ী করে প্রচার চালাতে পারত। এমনকি ছাত্রদলীয় নেতা গণেশ যখন বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যের সঙ্গে প্রকাশ্যে দুর্ব্যবহার করল, তখনও শিবির চাইলে এটিকে বড় রাজনৈতিক ইস্যু বানাতে পারত। কিন্তু তারা তা করেনি। তারা দায় চাপানোর পুরোনো অসুস্থ রাজনীতি পরিহার করে এগিয়েছে দায়িত্বশীলতার পথে।

এসব উদাহরণ জেন–জির চোখে আরও স্পষ্ট করেছে নতুন রাজনৈতিক সংস্কৃতির ভিত্তি আসলে শিবিরই গড়ে তুলছে। যেখানে অভিযোগ নয়, সেবাই মুখ্য। যেখানে প্রতিপক্ষকে দোষারোপ নয়, বরং নিজের কাজ ও আচরণের মাধ্যমেই আস্থা অর্জন করা হয়।

নতুন প্রজন্ম যখন সেবা–মুখী ও শিক্ষার্থী–বান্ধব রাজনীতিকে বেছে নিয়েছে, তখন ছাত্রদল ও বাম সংগঠনগুলো থেকে ভেসে এসেছে হুমকি, অপপ্রচার ও সহিংসতার প্রতিধ্বনি। এই অবস্থান শুধু তাদের রাজনৈতিক ব্যর্থতাই নয়, বরং বাংলাদেশের গণতান্ত্রিক সংস্কৃতির বিকাশে এক মারাত্মক অন্তরায়।

তবে সব বাধা–বিপত্তি সত্ত্বেও আমাদের এগোতে হবে নতুন রাজনৈতিক সংস্কৃতি গড়ে তোলার পথে। এজন্য প্রয়োজন জেন–জির কণ্ঠকে আরও শক্তিশালী করা—যে প্রজন্ম নির্ভয়ে বলতে পারে, “ভালোকে ভালো আর কালোকে কালো।” এদের স্বচ্ছ দৃষ্টি আর সাহসী কণ্ঠই হতে পারে ভবিষ্যৎ রাজনীতির মেরুদণ্ড।

কবি আল মাহমুদ তার “কদর রাত্রির প্রার্থনা” কবিতার শেষে স্রষ্টার উদ্দেশে আকুল মিনতি করেছিলেন—

“প্রভু, ডাকাত, ছিনতাইকারী, পণ্ডিত ও বেশ্যাদের হাত থেকে

তুমি কি ইলমকে রক্ষা করবে না?

—রাব্বি যিদনী ইলমা—

প্রভু, আমাদের জ্ঞানদান করো।”

কবির সেই আর্তি কেবল প্রশ্ন ছিল না, ছিল গভীর আর্তনাদ। বিশ্ববিদ্যালয়, যে জায়গা জ্ঞানের আলো ছড়ানোর কথা, তা যেন অন্ধকারের আখড়ায় পরিণত না হয়—এই ছিল তার আকুতি। তিনি প্রভুর কাছে মিনতি করেছিলেন, বিশ্ববিদ্যালয়কে ডাকাত, ছিনতাইকারী আর ভ্রষ্ট রাজনীতিকদের হাত থেকে রক্ষা করার জন্য। তাঁর প্রার্থনা ছিল, বিশ্ববিদ্যালয় যেন হয়ে ওঠে সত্যিকারের জ্ঞানচর্চার কেন্দ্র যেখানে থাকবে শিক্ষিকের প্রজ্ঞা, গবেষকের সাধনা আর তরুণদের স্বপ্ন।

কবির সেই আহ্বানকে হৃদয়ে ধারণ করে একদল তরুণ শিক্ষার্থী এগিয়ে চলেছে। তারা বিশ্ববিদ্যালয়কে সত্যিকারের বিদ্যাপীঠে রূপ দিতে চায়, তারা জাতির রাজনীতিকে কলুষমুক্ত করতে চায়, তারা নতুন রাজনৈতিক সংস্কৃতি নির্মাণে নিজেদের উৎসর্গ করতে চায়।

ফ্যাসিবাদকে পরাজিত করতে হলে, দেশকে রক্ষা করতে হলে, বিভক্তি–বিদ্বেষ–হানাহানি দূর করতে হলে রাজনৈতিক সংস্কৃতির আমূল পরিবর্তন করতেই হবে। গড়ে তুলতে হবে এক নতুন সংস্কৃতি। সত্য, সাহস, সেবা আর সৌহার্দ্যের সংস্কৃতি। এমন এক সংস্কৃতি যেখানে ভিন্নমত থাকবে, বিরোধিতা থাকবে, প্রতিযোগিতা থাকবে, কিন্তু সবকিছু হবে শালীনতার সঙ্গে, মর্যাদার সঙ্গে। এটি কোনো একদিনের কাজ নয়। এটি দীর্ঘ, কঠিন অথচ অনিবার্য পথচলা। এই দায়িত্ব একা কারও পক্ষে বহন করা সম্ভব নয়। আমাদের সবাইকে এগিয়ে আসতে হবে যার যার জায়গা থেকে। আমাদের কলমে, কণ্ঠে আর কর্মে নতুনের সুরকে বলিষ্ঠ করতে হবে। তরুণদের সেই স্বচ্ছ কণ্ঠস্বরকে শক্তি দিতে হবে, যারা সাহস করে বলে: ভালোকে ভালো, কালোকে কালো। এই নতুন রাজনৈতিক সংস্কৃতিই হতে পারে বাংলাদেশকে সত্যিকার গণতান্ত্রিক ভবিষ্যতের পথে নিয়ে যাওয়ার একমাত্র আলোকবর্তিকা।

(লেখক: একাডেমিক, রাজনৈতিক বিশ্লেষক, মানবাধিকার কর্মী ও এক্সিকিউটিভ ডাইরেক্টর, সাউথ এশিয়ান পলিসি ইনিশিয়েটিভ)    

 

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *