
ড. হুমায়ের চৌধুরী: পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তানের মধ্যে ১৯৭১ সালের সংঘাত, যার পরিণতিতে বাংলাদেশের জন্ম হয়, প্রায়ই ভারতের মানবিক হস্তক্ষেপ হিসেবে উপস্থাপিত হয়। তবে ভূরাজনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গি থেকে দেখলে, ভারতের সম্পৃক্ততাকে স্পষ্ট জাতীয় স্বার্থ দ্বারা পরিচালিত তা নির্ধীদায় বলা যায়। এসব স্বার্থের ভিত্তি ছিল আঞ্চলিক নিরাপত্তা-সংক্রান্ত উদ্বেগ, পাকিস্তানের সঙ্গে দীর্ঘদিনের প্রতিদ্বন্দ্বিতা এবং দক্ষিণ এশিয়ার শক্তির ভারসাম্য নতুনভাবে গড়ে তোলার সুযোগ। পাশাপাশি, ১৯৭১-পরবর্তী বাংলাদেশে কর্তৃত্ববাদী আওয়ামী লীগ-প্রধান শাসনামলে ভারত একাধিক কৌশলগত ও রাজনৈতিক সুবিধা ভোগ করে।
ভারতের অন্যতম প্রধান প্রেরণা ছিল পাকিস্তানকে কৌশলগতভাবে দুর্বল করা। ১৯৪৭ সালে স্বাধীনতার পর থেকে ভারত ও পাকিস্তান একাধিক যুদ্ধে জড়িয়েছে, এবং দুই অংশে বিভক্ত রাষ্ট্র হিসেবে পাকিস্তানের অস্তিত্ব ভারতের জন্য একটি স্থায়ী সামরিক চ্যালেঞ্জ সৃষ্টি করেছিল। পূর্ব পাকিস্তান ভারতের পূর্ব সীমান্তে ভারতীয় বাহিনীকে ব্যস্ত রাখত এবং পাকিস্তানকে কৌশলগত গভীরতা প্রদান করত। পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তানের মধ্যে ভাঙন ত্বরান্বিতকারী শক্তিগুলোকে সমর্থন করে ভারত কার্যত এই পূর্ব ফ্রন্টটি বিলুপ্ত করে, ফলে আঞ্চলিক সামরিক ভারসাম্য তার পক্ষে নির্ণায়কভাবে পরিবর্তিত হয়।
১৯৭১ সালের শরণার্থী সংকট মানবিক উদ্বেগকে ভারতের জাতীয় স্বার্থের সঙ্গে আরও ঘনিষ্ঠভাবে যুক্ত করে। পূর্ব পাকিস্তান থেকে লক্ষ লক্ষ শরণার্থী ভারতে প্রবেশ করে, যা অর্থনৈতিক চাপ ও অভ্যন্তরীণ অস্থিতিশীলতা সৃষ্টি করে। ভারত প্রকাশ্যে তার পদক্ষেপকে মানবিক বিপর্যয় সমাধানের জন্য প্রয়োজনীয় বলে উপস্থাপন করে আন্তর্জাতিক সংস্থা এবং বহীর্বিশ্ব থেকে প্রচন্ড পরিমানে আর্থিক লাভবান হয়। তাছাড়া এই সংকট ভারতের কৌশলগত লক্ষ্য পূরণে সামরিক হস্তক্ষেপের রাজনৈতিক বৈধতাও জুগিয়েছিল। এই যুদ্ধ ভারতকে আঞ্চলিক রক্ষক হিসেবে উপস্থাপনের সুযোগ দেয়, পাশাপাশি দীর্ঘমেয়াদি নিরাপত্তাগত লাভ নিশ্চিত করে।
অর্থনৈতিক ও ভূরাজনৈতিক দিক থেকে, বাংলাদেশের আবির্ভাব পাকিস্তানের বঙ্গোপসাগরে প্রবেশাধিকার কমিয়ে দেয় এবং তার বাণিজ্য ও নৌ-প্রভাব দুর্বল করে। বিপরীতে, ভারত পূর্ব দক্ষিণ এশিয়ায় নিজের প্রভাব বিস্তার করে, সংযোগ উন্নত করে এবং আঞ্চলিক বাণিজ্যপথে আধিপত্য প্রতিষ্ঠা করে। পাকিস্তানের ভাঙন আন্তর্জাতিক পরিসরে দক্ষিণ এশিয়ার প্রধান শক্তি হিসেবে ভারতের অবস্থানও সুদৃঢ় করে।
স্বাধীনতার পর শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বে আওয়ামী লীগ সরকার ভারতের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক গড়ে তোলে। এই সময়ে ভারত উল্লেখযোগ্য কূটনৈতিক ও অর্থনৈতিক প্রভাব অর্জন করে। মৈত্রী, সহযোগিতা ও শান্তি বিষয়ক চুক্তিসমূহ বাংলাদেশের পররাষ্ট্র ও নিরাপত্তা নীতির ওপর ভারতের প্রভাবকে আনুষ্ঠানিক রূপ দেয়। ভারতীয় কোম্পানিগুলো পুনর্গঠনমূলক চুক্তি, বাণিজ্যিক প্রবেশাধিকার ও ট্রানজিট চুক্তি থেকে লাভবান হয়, আর ভারত তার সংবেদনশীল উত্তর-পূর্ব সীমান্তে কৌশলগত সহযোগিতা নিশ্চিত করে।
আওয়ামী লীগ শাসন আমলে ক্ষমতার কেন্দ্রীকরণ এবং রাজনৈতিক বিরোধীদের দমন এমন একটি পরিবেশ সৃষ্টি করেছিল যেখানে ভারতের প্রভাব কার্যত খুব কম প্রতিরোধের মুখে পড়ে। এই রাজনৈতিক সামঞ্জস্য ভারতকে পানি বণ্টন চুক্তি, নিরাপত্তা সহযোগিতা এবং গোয়েন্দা সমন্বয় এগিয়ে নিতে সহায়তা করে, যা প্রধানত ভারতের স্বার্থই রক্ষা করেছিল। কূটনৈতিক ও সামরিক সহায়তার ক্ষেত্রে বাংলাদেশের ভারতের ওপর নির্ভরতা এই অসমতাকে আরও দৃঢ় করে।
উপসংহারে বলা যায়, যদিও ১৯৭১ সালের যুদ্ধকে ব্যাপকভাবে একটি মুক্তিযুদ্ধ হিসেবে স্মরণ করা হয়, সমালোচনামূলক বিশ্লেষণে দেখা যায় যে ভারতের সম্পৃক্ততা তার জাতীয় স্বার্থের সঙ্গেই ঘনিষ্ঠভাবে সংযুক্ত ছিল। এই সংঘাত আঞ্চলিক ক্ষমতার কাঠামো পুনর্গঠন করে, একটি প্রধান প্রতিদ্বন্দ্বীকে দুর্বল করে এবং প্রারম্ভিক আওয়ামী লীগ শাসনামলে ভারতের জন্য স্থায়ী কৌশলগত সুবিধা নিশ্চিত করে—যে ব্যাখ্যা দক্ষিণ এশিয়ার রাজনৈতিক আলোচনায় আজও বিতর্কের জন্ম দেয়।