ড. ফারুক আমিন: ২০২৪ সালে গণঅভ্যুত্থান ও ফ্যাাসিবাদের পতনের মধ্য বাংলাদেশে পরিবর্তনের যে বিপুল এক আশার জন্ম হয়েছিলো, মাত্র দেড় বছরের মাথায় ৩২ বছর বয়সী স্বাধীনচেতা ও দুর্নীতিমুক্ত বিরল এক বাংলাদেশী তরুণ নেতা ওসমান হাদির হত্যাকান্ডের মাধ্যমে সম্ভবত সেই প্রত্যাশার করুণ পরিণতি ঘটেছে। ভবিষ্যতে ইতিহাস আমাদেরকে বলে দেবে বর্তমান বাংলাদেশের ভবিষ্যতযাত্রার যাত্রাপথে এই হত্যাকান্ড কতটুকু প্রভাব রেখেছে, যার জন্য অপেক্ষা করা ছাড়া অন্য কোন উপায় আমাদের মানবিক সাধ্যের ভেতরে নেই, তবে অতীত প্রেক্ষাপটের উপর নির্ভর করে এই হত্যাকান্ডের ঘটনাকে বাংলাদেশের সুদীর্ঘ অর্ধশতকের বেশি দীর্ঘ এবং অস্থির রাজনৈতিক ইতিহাসের প্রক্ষাপটে নিশ্চিতভাবেই একটি গভীর অন্ধকার ও কলঙ্কজনক অধ্যায় হিসেবে চিহ্নিত করা যায়।
ওসমান হাদি হত্যাকান্ডের কার্যকারণ এবং সম্ভাব্য প্রভাবকে বুঝতে হলে আমাদের বাংলাদেশের রাজনৈতিক ব্যবস্থার গভীর ব্যর্থতার দিকে তাকাতেই হবে। ফ্যাসিবাদী স্বৈরশাসকের পতনের পর যে অসমাপ্ত আত্মপর্যালোচনা এখনো বাকি রয়ে গিয়েছে, তার মুখোমুখি হওয়া এখন সময়ের দাবী।
বাংলাদেশের গতানুগতিক এবং প্রতিষ্ঠিত রাজনৈতিক ব্যবস্থা, পদ্ধতি ও সংস্কৃতি তার সুচনালগ্ন থেকেই একটি ক্ষয়িষ্ণু এবং দুর্নীতিগ্রস্থ উত্তরাধিকারের চর্চা করে আসছে। ১৯৭১ সালে দেশের জন্মলাভের পর থেকে, তা স্বাধীনতা হিসেবে হোক কিংবা পাকিস্তান থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে একটি স্বতন্ত্র দেশ গঠন; যে দৃষ্টিভঙ্গি থেকেই দেখা হোক না কেন, এ দেশের রাজনীতি দুর্ভাগ্যজনকভাবে কখনো যোগ্যতা এবং নীতিকে প্রাধান্য দিয়ে চর্চা করা হয়নি। বরঞ্চ বারবার এদেশের ক্ষমতার কেন্দ্রবিন্দুগুলো দুর্নীতিগ্রস্থ ব্যবসায়ী, অসৎ প্রাক্তন সরকারী কর্মকর্তা, চোরাকারবারী, আপোষকামী আমলা, অবসরপ্রাপ্ত সামরিক কর্মকতা, দুর্বত্তপনার চর্চা করে কদাচিত মাঠপর্যায় থেকে উঠে আসার নেতা এবং সর্বোপরি এই নির্দিষ্ট নেটওয়ার্কের পারিবারিক সদস্যরাই দখল করে রেখেছে। এই প্রবণতা দলমত নির্বিশেষে সরকারী কিংবা বিরোধী পক্ষ; সব জায়গাতে গভীরভাবে প্রোথিত হয়ে গেছে।
দীর্ঘদিনের এই রাজনীতি নামের নোংরামি এবং নৈতিক অবক্ষয়ের ধারাবাহিকতায় এর চুড়ান্ত রুপটি ‘প্রস্ফুটিত’ হয় এই মিলেনিয়ামের সুচনালগ্নে, এক-এগারোর পর ইন্ডিয়ার পরিকল্পনায় আওয়ামী লীগের ক্ষমতায় আরোহনের মাধ্যমে। ধীরে ধীরে অতীতের ছদ্ম স্বৈরতন্ত্র এবং তখনকার প্রকাশ্য স্বৈরতন্ত্র বিবর্তিত হয়ে একটি প্রকাশ্য ফ্যাসিবাদী ব্যাবস্থায় রুপ নেয়, পরবর্তীতে যা প্রায় দেড় দশক ধরে টিকে থেকেছে।
অন্যায় কখনো চিরস্থায়ী হয়না। শেষ পর্যন্ত ২০২৪ সালে গণঅভ্যুত্থানের মুখে সেই ফ্যাসিবাদী শাসন কর্তৃত্ব ভেঙে পড়ে। শেখ হাসিনা ও তার অনুসারীরা বাংলাদেশ ছেড়ে পালিয়ে যায়। শেখ হাসিনার এই পরিণতির সাথে প্রায় আট শতাব্দী আগের আরেক অত্যাচারী শাসক লক্ষণ সেনের পলায়নের অলৌকিক সাযুজ্য দেখা যায়। ৫ আগষ্ট ২০২৪ এর পর থেকে বাংলাদেশী ফ্যাসিবাদের এই প্রাণভোমরা বেঁচে আছে তার মালিক দিল্লীর প্রভুদের দয়া এবং আশ্রয়ে।
বাংলাদেশী ফ্যাসিবাদের মাঝে এখানেই এক ধরণের গভীর বৈপরিত্য পাওয়া যায়। ঐতিহাসিকভাবে যে কোন ফ্যাসিবাদী মতাদর্শ অথবা ব্যাবস্থা উগ্র জাতীয়তাবাদের ভিত্তির উপর প্রতিষ্ঠিত হয়। চরমপন্থী এবং গোঁড়া দেশপ্রেমে ফ্যাসিবাদ পুষ্ট হয়। বাংলাদেশেও ক্ষমতা দখল করা আওয়ামী লীগ ও তাদের দোসররা দেশপ্রেমের ভাষা ব্যাবহার করেছে, অন্য যে কোন ফ্যাসিবাদী প্রকল্পের মতো। কিন্তু বাস্তবতা ছিলো সম্পূর্ণ উল্টো। বাংলাদেশের ক্ষেত্রে প্রকৃত সার্বভোমত্ব এবং জাতিগত শ্রেষ্ঠত্বের প্রচেষ্টার পরিবর্তে রাষ্ট্র এবং সমাজ ক্রমেই শক্তিশালী প্রতিবেশী দেশ ইন্ডিয়ার উপর ক্রমেই নির্ভরশীল হয়ে পড়ে। শেখ হাসিনার শাসনামলে বাংলাদেশ বিশেষ করে অর্থনীতি, নিরাপত্তা ও পররাষ্ট্রনীতির ক্ষেত্রে ইন্ডিয়ার অনানুষ্ঠানিক করদরাজ্যে পরিণত হয়।
ভারতের ক্রমাবর্ধমান আঞ্চলিক আধিপত্যবাদী প্রকল্প, যাকে বিশ্লেষকরা হেজিমনি বা সাম্রাজ্যবাদ নামেও আখ্যা দিয়ে থাকেন, দক্ষিণ এশিয়ার অনেকগুলো দেশকেই আক্রান্ত করেছে। নেপাল, মালদ্বীপ, শ্রীলংকা, ভুটান এই সবগুলো দেশেই ইন্ডিয়ান হেজিমনির সমস্যা দেখা যায়। সিকিম তো আনুষ্ঠানিকভাবেই ইন্ডিয়ার করদরাজ্যে পরিণত হয়েছে। তবে বাংলাদেশে ইন্ডিয়ার নিয়মতান্ত্রিক ও দীর্ঘস্থায়ী প্রভাব সম্ভবত সবচেয়ে বেশি গভীর এবং কূটিল। দেশটির স্বাধীনতাযুদ্ধে অবদানের সুযোগে ইন্ডিয়া এই প্রকল্প বাস্তবায়নের সুযোগ নিয়েছে। তথাপি রাজনীতি থেকে শুরু করে রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠান অথবা কৌশলগত সিদ্ধান্তে আরেকটি দেশের এই ধরণের প্রভাব বাংলাদেশের সাধারণ মানুষকে সবসময়েই বিক্ষুদ্ধ করে রেখেছে।
আওয়ামী লীগের পনেরো বছরব্যাপী শাসনের সময়ে তাদের প্রভূ ইন্ডিয়ার সরাসরি সহায়তায় আওয়ামী বিরোধী এবং সার্বভৌমত্বের পক্ষের রাজনীতিকে নির্বিচার গ্রেফতার, নির্যাতন, গুম, বিচারবহির্ভূত হত্যার মতো অস্ত্র ব্যবহার করে দমিত করে রাখা হয়েছিলো। আদালতকে ব্যবহার করে ইন্ডিয়ান হেজিমনি বিরোধী রাজনৈতিক নেতৃত্বকে সরিয়ে দেয়া হয়েছে। ১৯৭১ সালের তথাকথিত যুদ্ধাপরাধকে অজুহাত বানিয়ে বিচারব্যবস্থার এই বিতর্কিত প্রয়োগ পৃথিবীর সমস্ত আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংস্থাগুলো কর্তৃক সমালোচিত এবং নিন্দিত হয়েছে।
এক সময় বাংলাদেশের মানুষের সহ্যের বাঁধ ভেঙে গেলো। দমন-নিপীড়িন শেষ সীমা ছাড়িয়ে গেলে সাধারণ মানুষ রাজপথে নেমে আসে। পেশাগত রাজনীতিবিদদের নেতৃত্বে নয়, বরং বিশ্ববিদ্যালয়, কলেজ, মাদ্রাসার শিক্ষার্থীরা, তরুণ-কিশোর এবং যুবকেরা দাঁড়িয়ে যায় পুরো রাষ্ট্রীয় দমন-নিবর্তনের মুখোমুখি। এক সময় সাধারণ মানুষ, শ্রমিক, চাকরিজীবি, ব্যবসায়ী – সবাই আন্দোলনে শরীক হয়।
চব্বিশের আগে আওয়ামী লীগ অনেকগুলো আন্দোলন দমন করেছে। বেশ কয়েকটি গণহত্যাও তারা চালিয়েছে এই পনেরো বছরে। কিন্তু এবার তারা টিকতে পারেনি। প্রায় এক মাসব্যাপী সহিংসতায় দেড় থেকে দুই হাজার মানুষকে তারা হত্যা করলো। এদের বেশিরভাগই ছিলো শিশু-কিশোর। বাংলাদেশের উপর যেন নিষ্পাপ ও অল্পবয়সীদের রক্ত অনেক ভারী হয়ে গিয়েছিলো। অসংখ্য মানুষ আহত এবং পঙ্গু হয়ে গেলো। অবশেষে চোখের পলকে সব কিছু ভেঙে পড়লো যেদিন ছাত্রজনতার নেতৃত্বে দেশের মানুষ গণভবনের উদ্দেশ্যে তাদের মৃত্যুযাত্রা শুরু করেছিলো। সেদিন অসংখ্য মানুষ জীবন দেয়ার জন্যই রাস্তায় নেমে এসেছিলো।
শেখ হাসিনা পালিয়ে গেলো তার প্রভূদের কাছে। পাশাপাশি তার মন্ত্রী, এমপি, শিক্ষাবিদ, অধ্যাপক, সাংবাদিক, বুদ্ধিজীবি, ব্যাবসায়ী, অনুগত দলীয় গুন্ডাপান্ডা, এমনকি জাতীয় মসজিদের ইমাম পর্যন্ত পালিয়ে গেলো। এদের বেশিরভাগ গিয়েছে ইন্ডিয়ায়। অনেকে গেছে পৃথিবীর অন্যান্য দেশে। এদের কেউ কেউ অস্ট্রেলিয়াতেও নিরাপদ আশ্রয় খুঁজে নিতে সক্ষম হয়েছে।
ফ্যাসিবাদের পলায়নের পরেও বাংলাদেশে আরেকটি অপ্রত্যাশিত ঘটনা ঘটেছে। আওয়ামী নেতাদের অনেকে আশংকা করতো তাদের সম্ভাব্য পতনের পর দেশে রক্তগঙ্গা বয়ে যাবে। অথচ এই প্রচন্ড নাজুক সময়ে বাংলাদেশের মানুষ চুড়ান্ত দায়িত্বশীলতা এবং সংযমের পরিচয় দিয়েছে। ব্যাপক প্রতিশোধের পরিবর্তে সবাই স্থিতিশীলতার জন্য সচেষ্ট এবং সক্রিয় ছিলো। কিছু বিচ্ছিন্ন এবং অন্যায় ঘটনা এরপরেও ঘটেছে, কিন্তু তা নিঃসন্দেহে সীমিত পরিসরে ছিলো। সরকার যেখানে সম্পূর্ণ অনুপস্থিত ছিলো, সাধারণ মানুষ সেখানে পরিস্থিতির সামাল দিয়েছে।
এ সময় ইন্ডিয়ার সরকার ও গণমাধ্যম পূর্ণশক্তিতে তথাকথিত হিন্দু গণহত্যার প্রচারণা চালিয়ে বাংলাদেশের উপর ধর্মীয় সহিংসতার অপবাদ চাপিয়ে দিতে সমস্ত চেষ্টা চালায়। কিন্তু বাস্তবতার সামনে এই মিথ্যা প্রচারণা শেষ পর্যন্ত হালে পানি পায়নি। সারা পৃথিবী দেখেছে কিভাবে বাংলাদেশ ধীরে ধীরে ঘুরে দাঁড়াতে চেষ্টা করেছে।
পুরনো রাজনীতি থেকে বেরিয়ে আসার জন্য এটি ছিলো একটি ঐতিহাসিক সুযোগ। কোন জনগোষ্ঠীর ইতিহাসে এ ধরণের বিপুল বিপর্যয়ের পর নতুন যাত্রা আরম্ভের মূহুর্ত খুব সহজে আসেনা। অনেক প্রজন্মের পর হয়তো এমন সময় আসে। বাংলাদেশেও সংস্কারের কথা উঠেছিলো। নতুন এবং প্রকৃতপক্ষে কার্যকর, অর্থবহ একটি সংবিধানের প্রয়োজনীয়তার কথা উঠেছিলো। নতুন রাজনীতির কথা উঠেছিলো। কিন্তু তা হারিয়ে যেতে, এবং পুরনো দুর্বৃত্তপনার ফিরে আসতে আসলে বেশি সময় লাগেনি। দীর্ঘ পনেরো/ষোল বছরের অসংখ্য মানুষের বলিদান এবং জুলাই বিপ্লবে বিপুল পরিমাণ মানুষের আত্মত্যাগ; সব কিছুই খুব দ্রুত ব্যর্থ হয়ে গিয়েছে। প্রতিষ্ঠিত রাজনৈতিক দলগুলো এবং জুলাই থেকে উঠে আসা যুবকদের নতুন দলগুলো; সবাই মিলে নগ্নভাবে সেই নোংরা রাজনীতি এবং ক্ষমতা দখলের প্রতিযোগিতায় উন্মত্ত হয়ে নেমে পড়েছে।
রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানগুলো দলীয় অনুগতদের বসানো হয়েছে, কোথাও এমনিক টাকার বিনিময়ে আওয়ামী লীগের লোকজনকেও রেখে দেয়া হয়েছে এবং পুনর্বাসিত করা হয়েছে। মেধাভিত্তিক সুযোগ ও যোগ্যতার মূল্যায়নের যে দাবী একসময় এদেশের শিক্ষার্থীরা তুলেছিলো, তা ফানুস হয়ে হাওয়ায় মিলিয়ে গেছে। সামরিক বাহিনীর সমর্থনে এবং শেখ হাসিনার নিকটাত্মীয় সেনাপ্রধানের তত্ত্বাবধানে দুর্বল এবং অক্ষম সাময়িক সরকার রাষ্ট্রের পুনর্গঠনে কোন কার্যকর ভূমিকা রাখতে সম্পূর্ণ ব্যর্থ হয়েছে, একই সাথে ব্যর্থ হয়েছে একটি সুষ্ঠ নির্বাচনের উপযোগী পরিস্থিতি তৈরি করতে। এই ধরণের ব্যর্থ সরকারের উচিত ছিলো আরো আগেই যথাযথ একটি নির্বাচন দিয়ে গণতন্ত্রকে সংহত করার সম্ভাবপর চেষ্টা করা। তা তো তারা করেইনি, আগামী এক মাস পরের সম্ভাব্য নির্বাচন নিয়ে আশাবাদী হওয়ার মতো পরিবেশও তারা তৈরি করতে পারেনি।
কিন্তু ইতিহাস ক্ষমাহীন। ব্যর্থ জাতির সামষ্টিক ব্যর্থতার দাম চুকাতে হয় ওসমান হাদির মতো সৎ এবং নিবেদিত মানুষদেরকে।
পুরনো রাজনৈতিক বন্দোবস্তের প্রতাপশালী চর্চার সমস্ত লক্ষণ দেড় বছরের মাথায় আজ বাংলাদেশে পরিস্কার দেখা যায়, বুঝা যায়। ১২ ডিসেম্বর ২০২৫ শুক্রবার জুমার নামাজের পর ওসমান হাদি ঢাকার রাস্তায় প্রকাশ্য দিবালোকে গুলিবিদ্ধ হয়। এক সপ্তাহ লাইফ সাপোর্টে থাকার পর এবং সিঙ্গাপুরে উন্নত চিকিৎসার চেষ্টার পর ডাক্তাররা তাকে ১৮ ডিসেম্বর ২০২৫ শুক্রবার মৃত ঘোষণা করে। ২০ ডিসেম্বর মানিক মিয়া এভিনিউতে অবস্থিত জাতীয় সংসদ ভবনের দক্ষিণ প্লাজায় জানাযার পর তাকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এলাকায় জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলামের কবরের পাশে দাফন করা হয়।
ওসমান হাদি কে ছিলেন? কেন তাকে বাংলাদেশের নিজস্ব ধারার রাজনৈতিক সংস্কৃতির বলি হতে হলো?
চব্বিশের বিপ্লবে রাজপথ থেকে উঠে আসা তরুণ নেতা ওসমান একজন কবি ও শিক্ষক ছিলেন। গণঅভ্যুত্থানের পর যুবনেতাদের কামড়াকামড়িতে বীতশ্রদ্ধ হয়ে তিনি সাংস্কৃতিক পরিবর্তনের চেষ্টায় মন দেন। ইনকিলাব কালচারাল সেন্টার নামে একটি সংস্কৃতি চর্চা ও বিকাশ প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলার জন্য সমমনা কিছু তরুণ নিয়ে তিনি প্রাণপণ চেষ্টা করছিলেন। একই সাথে সাংস্কৃতিক ও রাজনৈতিক প্লাটফর্ম ইনকিলাব মঞ্চের মুখপাত্র হিসেবে দায়িত্ব পালন করছিলেন। সব কিছু পাশাপাশি রাজনৈতিক সংস্কৃতির পরিবর্তনের গুরুত্ব তিনি ভূলেন নাই। ঢাকা-৮ আসনে একজন স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে প্রতিযোগিতার ঘোষণা দেন। রাস্তাঘাটে পোস্টার না লাগনো, ফজর নামাজের পর মসজিগুলোর সাথে ভোটারদের সাথে জনসংযোগের চেষ্টা, জৌলুশবিহীন সাদামাটা জীবনযাপন এবং অকৃত্রিম আচরণ দিয়ে ওসমান হাদি বাংলাদেশের এই প্রচলিত এবং ফিরে আসা নোংরা রাজনীতিতে একজন নিঃসঙ্গ এবং ব্যতিক্রমী চরিত্র হয়ে উঠছিলেন। বেঁচে থাকতে তিনি খুব বেশি একটা পরিচিতিও পাননি। বরঞ্চ প্রতিটি প্রতিষ্ঠিত রাজনৈতিক দল এবং এমনকি তার নিজ প্রজন্মের সতীর্থদের কাছ থেকেও উপেক্ষা পেয়েছেন, কৌতুকে শিকার হয়েছেন।
তবে বাংলাদেশ-বিরোধী শক্তি এবং ইন্ডিয়ান আধিপত্যবাদের সেবাদাসরা তাদের প্রকৃত শত্রুকে চিনে নিতে এবং নিশ্চিহ্ন করে দিতে ব্যর্থ হয়নি। তারা ঠিকই সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ শিকার খুঁজে নিয়েছে। বাংলাদেশে মুক্তিযুদ্ধের চেতনার ব্যবসা করা পশুরা তাদের স্বভাবজাত পাশবিক নির্মমতায় মাত্র বত্রিশ বছর বয়সী, একটি শিশু সন্তানের বাবা, একজন অন্তঃস্বত্তা স্ত্রীর স্বামী, একটি সাধারণ মধ্যবিত্ত পরিবারের আদরের সন্তান, একজন নিরস্ত্র এবং শান্তিকামী, কিন্তু মুক্তিকামী ওসমান হাদিকে হত্যা করেছে। ইন্ডিয়ান হেজিমনির বিরুদ্ধে সটান দাঁড়ানো নির্ভীক ওসমান তাদের জন্য অনেক বড় হুমকি। যেমন হুমকি ছিলো বুয়েটে ছাত্রলীগের নির্যাতনে শহীদ হওয়া আবরার ফাহাদ। তাকে বাংলাদেশের মানুষ তো পরের কথা, হয়তো তার প্রতিষ্ঠানের অনেক ছাত্রও চিনতো না। অথচ আধিপত্যবাদের গোলামরা তাকে হুমকি হিসেবে নিয়েছিলো। একজন বিপ্লবীর, একজন মুক্তিকামী মানুষের সৎ নিয়ত সম্ভবত এভাবেই তাদেরকে অনন্য করে তুলে।
বর্তমান অন্তর্বতী সরকার ওসমানের হত্যাকারীদেরকে চিহ্নিত করতে পর্যন্ত ব্যর্থ হয়েছে। অন্যদিকে একটি স্বাধীন ও নতুন গণমাধ্যম দ্য ডিসেন্ট নিজেদের উদ্যোগে এ হত্যাকারীদেরকে প্রকাশ্যে চিহ্নিত করেছে। এরপর সামরিক বাহিনীর সাথে ঘনিষ্ঠ একটি সূত্র প্রচারণা চালাতে থাকে হত্যাকারীরা ইন্ডিয়ায় পালিয়ে গেছে। অন্যদিকে পুলিশের উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা বলেন এমন পালিয়ে যাওয়ার নিশ্চিত কোন প্রমাণ তখনো নেই। সব মিলে সংশয়পূর্ণ পরিবেশ তৈরি হয়, অনুমান ভিত্তিক দোষ চাপানোর চর্চা চলতে থাকে। রাজনৈতিক দলগুলোর কর্মীরা আদাজল খেয়ে নিজস্ব এজেন্ডার প্রচারণায় নেমে পড়ে। এ সংশয়পূর্ণ পরিবেশের মাঝেই একদল উত্তেজিত জনতা গিয়ে কিছু চিহ্নিত দেশবিরোধী পত্রিকার কার্যালয়ে আগুন দেয়। এই অরাজকতা তাৎক্ষণিকভাবে বন্ধ এবং প্রতিহত না করে সরকারী আইনশৃংখলা বাহিনী অন্যদিকে তাকিয়ে থাকে রহস্যজনকভাবে।
এইসব ঘটনাবলীর পুনরাবৃত্তি বাংলাদেশে দেশটির জন্মলগ্ন থেকে গত চুয়ান্ন বছর যাবত ঠিক একই ভাবে বারংবার ঘটেছে। সামরিক-সমর্থিত এনজিও-পরিচালিত সাময়িক সরকার কর্তৃক পরিস্থিতির নিয়ন্ত্রণ নিতে এবং হত্যাকান্ডের সুবিচার নিশ্চিত করার জন্য কার্যকর ভূমিকা নিতে অনীহার মাধ্যমে চব্বিশের গণঅভ্যূত্থান পরবর্তী রাষ্ট প্রকৃতপক্ষে তার নিজের চেহারা পরিস্কারভাবে উন্মোচন করেছে। শক্তিশালী কায়েমী এলিট শক্তি এবং প্রতিটি রন্ধ্রে রন্ধ্রে গেঁড়ে বসা স্বার্থান্বেষী মানুষদের মাঝে ওসমান হাদি দীর্ঘদিনের পঁচে যাওয়া রাজনৈতিক শক্তিকে চ্যালেঞ্জ করে একা দাঁড়িয়েছিলেন। নিজের জীবন দিয়ে এর মূল্য তাকে চুকাতে হয়েছে।
ওসমান হাদি হত্যাকান্ডের পরিণতি এর মাঝেই দৃশ্যমান। চলমান লেনদেননির্ভর, সাধারণ মানুষের অংশগ্রহণ বিবর্জিত, স্বার্থান্বেষী নোংরা রাজনীতি পুরোদমে চলমান আছে। এর দীর্ঘমেয়াদী ঝুঁকি বাংলাদেশের জন্য অনেক বেশি ভয়াবহ। কঠোর স্বৈরতন্ত্রের প্রত্যাবর্তন, গুম-খুন-নির্যাতন এবং বিরোধী মতের মুখ বন্ধ করার মতো ফ্যাসিবাদের পরিচিত অস্ত্রগুলোর ফিরে আসা এবং ইন্ডিয়ান হেজিমনির ক্রমবর্ধমান প্রভাব বৃদ্ধি – বাংলাদেশের জন্য এসব বিষয় এখন খুবই বাস্তব এবং অবশ্যম্ভাবী ভবিষ্যত।
সবচেয়ে উদ্বেগজনক বিষয় হলো, যে সাম্প্রদায়িক সহিংসতা ও সংখ্যালঘু নির্যাতনের ভয় দেখিয়ে ইন্ডিয়ান আধিপত্যবাদের সবচেয়ে সক্রিয় সহযোগী শক্তি আওয়ামী লীগ ফেরার চেষ্টা করে যাচ্ছে, অন্য সকল পক্ষের দুর্বলতা এবং নোংরা সংস্কৃতি চর্চার সুযোগ সেই অস্ত্রকে এক সময় বাস্তবে পরিণত করে আওয়ামী লীগ ফিরে আসবে। যদি নোংরা রাজনীতি, বিচারহীনতা এবং প্রাতিষ্ঠানিক অবক্ষয় চলমান থাকে, তাহলে সহিংসতার পরিবেশ এবং পরবর্তীতে সহিংসতা হলো অনিবার্য পরিণতি। ২০২৪ সালে হাসিনার পলায়নের পর দেশের সাধারণ মানুষ যে সংযম এবং নৈতিক দৃঢ়তার পরিচয় দিয়েছিলো, তারা কিন্তু এই ভবিষ্যত পরিণতির জন্য দায়ী কেউ না। বরং এর জন্য প্রকৃত দায়ী হলো রাজনৈতিক সুযোগসন্ধানীরা এবং ক্ষমতার জন্য নোংরামীতে প্রতিযোগিতায় নেমে পড়া মানুষগুলো।
বাংলাদেশের সাধারণ মানুষ হয়তো তাদের অনুভূতি এবং চিন্তাগুলোকে সবসময় ভাষা দিতে পারেনা। কিন্তু মুক্তির জন্য তাদের চিরকালীন আকাঙ্খা সহজাত, অধিকারের জন্য তাদের আকুতি মানবিক। ওসমান হাদিকে হত্যার পর ধর্ম-বর্ণ-লিঙ্গ-বয়স কিংবা এমনকি রাজনৈতিক সমর্থন নির্বিশেষে মানুষদের মাঝে এক সর্বগ্রাসী শোক এবং কষ্ট পরিস্কারভাবে দেখা গেছে। মানুষের তাৎক্ষণিক স্মৃতি থেকে দেড় বছর আগের অসংখ্য মৃত্যুর বর্বরতা হয়তো হারিয়ে গেছে বা ক্ষীণ হয়ে হয়ে এসেছে। কিন্তু আবু সাঈদের বীরত্বপূর্ণ আত্মত্যাগ, শিশু রিয়া গোপের নির্মর মৃত্যু কিংবা আসহাবুল ইয়ামিনের বুলেটে জর্জরিত মৃত্যপথযাত্রী দেহকে এপিসির উপর থেকে টেনে হিচড়ে ফেলে দেয়া, অসংখ্য মানুষের দেহকে পুড়িয়ে ফেলা, নাম জানা কিংবা না জানা শহীদদের স্মৃতি কোন স্বাভাবিক ও সচেতন মানুষ কখনো ভুলবে না। বাংলাদেশের মানুষের অবচেতনে এই স্মৃতি একটি চিরস্থায়ী মাইলফলক। এসব হত্যারও কোন সুষ্ঠ বিচার ও প্রতিকার বাংলাদেশে হয়নি নোংরা রাজনীতির আবর্তনের পাকচক্রে। সাধারণ মানুষের এই হতাশা এবং অপ্রাপ্তিই এখন হাদির জন্য শোক তৈরি করেছে। মানুষ বুঝে, চব্বিশে তারা যে সম্ভাবনার স্বপ্ন দেখেছিলো, সেই স্বপ্ন এবং প্রত্যাশা পূরণ না হওয়ার কারণেই মূলত সেই স্বপ্নের নিঃসঙ্গ পতাকাবাহী ওসমান হাদিকে হত্যার শিকার হতে হয়েছে। বাংলাদেশে যদি আইনের শাসন প্রতিষ্ঠিত হতো, তাহলে এভাবে তাকে হত্যার সুযোগ তৈরি হতো না। মানুষ বুঝতে পারে তাদের রাজনৈতিক নেতৃত্ব যদিও মুখে বলে চব্বিশ শেষ হয়ে গেছে, এখন অন্য কিছুর সময়, কিন্তু চব্বিশের সংগ্রাম প্রকৃতপক্ষে এখনো অসম্পূর্ণ, চলমান।
সুতরাং ওসমান হাদির মৃত্যু কোন বিচ্ছিন্ন ঘটনা না। আধিপত্যবাদী আগ্রাসী প্রতিবেশীর শিকার এবং আভ্যন্তরীণ দুর্বৃত্তপনা নির্ভর রাজনীতির বিরুদ্ধে মুক্তিকামী মানুষের দুর্বল কিন্তু অর্থবহ প্রচেষ্টার এক ঐতিহাসিক প্রকাশ শহীদ ওসমান হাদি। ভবিষ্যতের প্রতিটি সংকটে অধিকারহারা স্বাধীনতাহারা মজলুম মানুষেরা ওসমান হাদিকে তাদের দোয়ায় স্মরণ করবে। যদি কোনদিন ওসমান হাদির মতো মানুষেরা ক্ষমতার লাগাম টেনে ধরতে পারে এবং নোংরা রাজনীতির সংস্কৃতিকে নির্মূল করতে পারে, কেবল তখনই এদেশের মানুষ স্বাধীনতা এবং অধিকারের চর্চায় মানুষের জীবন কেমন হয়ে উঠতে পারে, সেই স্বাদ আস্বাদন করার সুযোগ পাবে।