728 x 90

এই মুহুর্তে ভারত বয়কট বাংলাদেশীদের জন্য কেন গুরুত্বপূর্ণ? – ড. ফারুক আমিন

চলতি বছরের জানুয়ারী মাস থেকে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে বাংলাদেশীদের মাঝে ভারত বর্জন অথবা বয়কট ইন্ডিয়া’র আহবান জোরদার হয়ে উঠতে শুরু করে। এটি হঠাৎ করে কোন কারণ ছাড়াই শুন্য থেকে শুরু হওয়া কোন আহবান ছিলো না। বরং এই সভ্য ও নাগরিক আন্দোলনের পেছনে নানা আন্তর্জাতিক ঘটনা অনুপ্রেরণা হিসেবে কাজ করেছে। ফিলিস্তিনের গাজায় অক্টোবর ২০২৩ থেকে শুরু

চলতি বছরের জানুয়ারী মাস থেকে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে বাংলাদেশীদের মাঝে ভারত বর্জন অথবা বয়কট ইন্ডিয়া’র আহবান জোরদার হয়ে উঠতে শুরু করে। এটি হঠাৎ করে কোন কারণ ছাড়াই শুন্য থেকে শুরু হওয়া কোন আহবান ছিলো না। বরং এই সভ্য ও নাগরিক আন্দোলনের পেছনে নানা আন্তর্জাতিক ঘটনা অনুপ্রেরণা হিসেবে কাজ করেছে।

ফিলিস্তিনের গাজায় অক্টোবর ২০২৩ থেকে শুরু হওয়া্ ইসরায়েলী গণহত্যা, মানবতার নির্মম বিসর্জন ও জায়নবাদীদের কাপুরেুষোচিত যুদ্ধপরাধের প্রতিবাদে সারা বিশ্ব জুড়ে দেশে দেশে অনেক পুরনো বিডিএস মুভমেন্ট বা বয়কট, ডাইভেস্টমেন্ট এন্ড স্যাংশন মুভমেন্ট জোরদার হয়ে উঠে। পুরো পৃথিবীর মানবতাবাদী মানুষরা নিজেদের ক্রয়ক্ষমতাকে জায়নবাদীদের বিরুদ্ধে ব্যবহার করে সচেতন ভোক্তা হিসেবে তাদের অধিকার প্রয়োগ করলে সারা পৃথিবী জুড়েই এ জায়নবাদীদের পৃষ্ঠপোষক অনেক বড় বড় ব্যাবসায়িক প্রতিষ্ঠানের ভিত্তি নড়বড়ে হয়ে উঠে।

পাশাপাশি বিগত কয়েক বছর যাবত এ অঞ্চলেরই আরেকটি দেশ মালদ্বীপে ভারতের আধিপত্যবাদী আচরণ ও হস্তক্ষেপের প্রতিবাদে ইন্ডিয়া আউট আন্দোলন চলমান ছিলো। গত বছরের শেষদিকে দেশটিতে এই আন্দোলন তীব্রতা পায় এবং ভারতবিরোধী রাজনৈতিক মোহাম্মদ মুইজু নির্বাচনে বিজয়ী হয়ে এ আন্দোলনের স্বার্থকতা ও জনপ্রিয়তা প্রমাণ করেন।

বাংলাদেশে ভারতের হস্তক্ষেপের বিষয়টি এখন সবচেয়ে নগ্নভাবে প্রকাশিত। ভারতের করদরাজ্য সিকিমও বাংলাদেশের মতো করে ভারতের স্বার্থের সেবা করে না। মানবাধিকার ও গণতন্ত্র বাংলাদেশে ফ্যাসিবাদের কবলে পড়ে পুরোপুরি ধ্বংস হয়ে গিয়েছে। সারা পৃথিবীতে বাংলাদেশ আজ গুম-খুন ও দুর্নীতির জন্য পরিচিত। গুমের সাথে জড়িত থাকার কারণে বাংলাদেশের রেপিড একশন ব্যাটালিয়ন ও পুলিশ বাহিনী কুখ্যাত। জাতিসংঘের শান্তিরক্ষী বাহিনীতে তাদের অন্তর্ভূক্তির যৌক্তিকতা নিয়ে সম্প্রতি আলোচনা শুরু হয়েছে। সেনাবাহিনীর প্রাক্তণ প্রধান জেনারেল আজিজকে সারা পৃথিবীর সামনে আমেরিকা দুর্নীতির দায়ে নিষিদ্ধ করেছে। আফ্রিকার পশ্চাতপদ ও যুদ্ধজর্জরিত দেশের দুর্নীতিবাজ জেনারেলদের ঘটনা প্রকাশ পেলে সেসব দেশের যে ভাবমূর্তি দাঁড়াতো, বাংলাদেশ আজ সে অবস্থায় চলে গিয়েছে। দুর্নীতির পাহাড়সম বোঝা সামলাতে না পেরে বরং অতিষ্ঠ হয়ে দেশের ভেতরে দুর্নীতিবাজদের পারস্পরিক কামড়াকামড়িতে আজ সাবেক পুলিশ প্রধান ও আওয়ামী লীগ সরকারের একনিষ্ঠ খাদেম গোপালগঞ্জের বেনজিরের সম্পত্তি নিয়ে টানাটানি শুরু হয়েছে।

বাংলাদেশের চলমান এই পরিস্থিতিকে দীর্ঘায়িত করার জন্য আওয়ামী লীগ সরকার জাতীয় নির্বাচনগুলোকে সাইনবোর্ড হিসেবে ব্যবহার করছে। চলতি বছরের শুরুতে যখন এমনই আরেকটি প্রহসনের নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয় তখন সাধারণ মানুষের নীরব ও সভ্য প্রতিবাদের হাতিয়ার হিসেবে ভারত বয়কটের আহবান জানান নির্বাসিত একটিভিস্ট, লেখক ও ইউটিউবার ডাক্তার পিনাকী ভট্টাচার্য্য। বাংলাদেশের মানুষ যেন এমনই একটি আহবানে প্রতীক্ষায় ছিলো। ফ্যাসিবাদের নিষ্পেষণে মরিয়া কিন্তু অসহায় মানুষের মাঝে এই আহবান বিগত মাসগুলোতে দাবানলের মতো ছড়িয়ে গেছে।

বাংলাদেশে স্বাভাবিকভাবেই প্রচুর সংখ্যক ফ্যাসিবাদের দালাল ও নানা সুবিধাভোগী মানুষ রয়েছে। এরা ভারত বয়কট আন্দোলনকে ভারত বিদ্বেষী আন্দোলন হিসেবে চিহ্নিত করে নানা অপযুক্তির পসরা সাজিয়েছে। কিন্তু সাধারণ মানুষের কাছে দীর্ঘদিনের অভিজ্ঞতার ফলে পরিস্কার হয়ে গিয়েছে যে বাংলাদেশের দুরবস্থার জন্য সবচেয়ে বেশি দায়ী হলো ভারতের আধিপত্যবাদী নীতি। পাশাপাশি এই বয়কট আন্দোলনের উদ্যোক্তারা সবসময়েই পরিস্কারভাবে বলে যাচ্ছেন যে ভারতের সাধারণ মানুষের সাথে বাংলাদেশের কোন শত্রুতা নেই। বরঞ্চ প্রতিবেশী হিসেবে যথাযথ শান্তি ও সম্প্রীতির সাথে বসবাস করতে বাংলাদেশের মানুষ সবসময়েই উদ্যোগী ছিলো এবং থাকবে। কিন্তু বর্তমান বাংলাদেশের দুরবস্থা কাটিয়ে উঠে গণতন্ত্র ও মানবাধিকার প্রতিষ্ঠার সংগ্রামে, বাংলাদেশের স্বাধীনতা ও আত্মমর্যাদা পুনরুদ্ধারের সংগ্রামে ভারতীয় পণ্য ও আগ্রাসন বয়কটের কোন বিকল্প নেই।

ভারত বয়কট আন্দোলনের উদ্যোক্তারা পরিস্কারভাবে জানান, চলতি ফ্যাসিবাদের প্রধান পৃষ্ঠপোষক হলো প্রতিবেশী ভারতের সরকার। আধিপত্যবাদী ভারতের মূল উদ্দেশ্যই হলো সিকিম, ভুটানের মতো বাংলাদেশকেও করদরাজ্য কিংবা অনুগত গোলাম দেশ বানিয়ে রাখা। বর্তমানে বাংলাদেশ একটি দাসখত লিখে দেয়া ভৃত্য দেশ। ফ্যাসিবাদীরা নির্লজ্জভাবে ভারতের সাথে বাংলাদেশের সর্ম্পককে স্বামী-স্ত্রীর সম্পর্কের সাথে তুলনা দেয়। যদিও প্রকৃতপক্ষে এই সম্পর্ক এখন প্রভু ও গোলামের সম্পর্ক। প্রতিবেশী দেশ হিসেবে ভারতের সাধারণ মানুষের সাথে আমাদের কোন শত্রুতা নেই। কিন্তু যখন কোন আধিপত্যবাদী শক্তি আমাদের জাতীয় পরিচয়, সাংস্কৃতিক অস্তিত্ব এবং ধর্মীয় সত্ত্বার উপর সামগ্রিকভাবে দখল নিয়ে আমাদেরকে অনুগত দাস বানাতে সর্বশক্তি নিয়োগ করে, তখন স্বাধীন মানুষ হিসেবে এই দখলদারীকে প্রতিহত করা আমাদের মৌলিক ও মানবিক অধিকার হয়ে দাঁড়ায়।

বিগত বছরগুলোতে বাংলাদেশের মানুষ পরিস্কারভাবে দেখতে পেয়েছে ভারতের আগ্রাসন নিয়ে কথা বলার অপরাধে আবরার ফাহাদের মতো মেধাবী ছাত্রকে নির্মমভাবে পিটিয়ে হত্যা করা হয়েছে। তারা দেখেছে বাংলাদেশ-ভারত সীমান্তে বিএসএফ এর গুলিতে নিহত ফেলানীর লাশকে ঝুলে থাকতে। ভারতের সীমান্তরক্ষী বাহিনী বিএসএফ এর গুলিতে সীমান্তে পাখির মতো মানুষ মারা যায় এবং এসব হত্যাকান্ডের কোন বিচার হয় না। হিন্দুত্ববাদী ভারতের স্বার্থে বাংলাদেশেও ছড়িয়ে পড়ছে সাম্প্রদায়িক ভেদাভেদ এবং উগ্র হিন্দু জনতার হাতে নির্মমভাবে দরিদ্র মুসলমান শ্রমিক নিহত হচ্ছে। হিন্দুত্ববাদী ভারতের প্রভাবে বাংলাদেশে এখন ইফতার মাহফিলের মতো ধর্মীয় অনুষ্ঠান আয়োজন করা সম্ভব হয় না। ভারতের নদী দখলের কারণে বাংলাদেশের বিস্তীর্ণ অঞ্চল মরুভূমিতে পরিণত হচ্ছে। ভারতীয় বাণিজ্যিক আগ্রাসনে দেশের শিল্পখাত ধ্বংস হয়ে পরনির্ভরশীল একটি অর্থনীতিতে পরিণত হয়েছে।

দীর্ঘ সময়ের পুঞ্জিভূত এই সব ঘটনার প্রতিক্রিয়াতেই সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে শুরু হওয়া এ আন্দোলন বাংলাদেশে বর্তমানে একটি শক্তিশালী সামাজিক আন্দোলনে রুপ নিয়েছে। বয়কট অত্যন্ত শক্তিশালী একটি কৌশল যেখানে সহিংসতার প্রয়োজন হয় না, বরং মানুষরা নীরবে তাদের ভোক্তা অধিকার প্রয়োগ এবং সচেতনতার মাধ্যমেই শত্রুর বুকে আঘাত করতে পারে। এই আন্দোলনের পরিণতি বুঝতে পেরেই আওয়ামী লীগ ও ভারতীয় দালালরা কখনো ঠাট্টা, কখনো যুক্তির ছলে নিরাশা ছড়ানো, কখনো উপহাস নানা কৌশলে ভারত বয়কটকে প্রশ্নবিদ্ধ করার চেষ্টা করে যাচ্ছে। কিন্তু বাস্তবে যারা সচেতন ও চিন্তাশীল, তারা যতটুকু সামর্থ্যে কূলায় ততটুকু হলেও করার মাধ্যমে এতে অংশগ্রহণ করছেন এবং এই অংশগ্রহণ নিয়মিত বেড়েই চলছে। অস্ট্রেলিয়া, নর্থ আমেরিকা, কানাডা, ব্রিটেন, ইটালি, সৌদি আরব, কাতার, আরব আমীরাত সহ পৃথিবীর প্রতিটি দেশে যেখানে প্রবাসী বাংলাদেশীরা বসবাস করেন, সেখানেই এ আন্দোলনের প্রভাব দেখা গিয়েছে। আমরা সিডনিতে বেশ কয়েকজন বাংলাদেশী ব্যবসায়ীর সাথে কথা বলে জেনেছি বিপুল সংখ্যক মানুষ এখন ভারতীয় চালের পরিবর্তে পাকিস্তানী চাল কেনা শুরু করেছে এবং তারা দোকানে গিয়ে বিভিন্ন পণ্য কেনার আগে তা ভারতীয় কি না তা প্রশ্ন করতে শুরু করেছে। আত্মমর্যাদার সাথে বাঁচার অধিকার যে কোন মানুষ চায়। সুতরাং বাংলাদেশের মানুষের আত্মমর্যাদা পুনরুদ্ধারের সংগ্রামে নিজ স্বার্থেই এ আন্দোলনে অংশীদার হবে এ নিয়ে কোন সংশয় নেই।
এই প্রসঙ্গে গত ২৩ জানুয়ারী ২০২৪ তারিখে আমার দেশ ইউকে’র ওয়েবসাইটে অকুতোভয় ও নির্বাসিত সম্পাদক ড. মাহমুদুর রহমানের লেখা “এবার স্বাধীনতা পুনরুদ্ধারের লড়াই” শিরোনামের উপসম্পাদকীতে তিনি ভারত বয়কট প্রসঙ্গে যে দশটি সংক্ষিপ্ত কিন্তু লক্ষ্যভেদী প্রস্তাবনা উপস্থাপন করেছেন, অস্ট্রেলিয়া প্রবাসী ও অস্ট্রেলিয়ার বাইরেও সুপ্রভাত সিডনি’র পাঠকদের জন্য তার হুবহু পুনরাবৃত্তি করছি।

“১) দেশের অভ্যন্তরে ভারতের দালাল গোষ্ঠীর (সামরিক ও বেসামরিক আমলাশ্রেণি, বিচার বিভাগ, ব্যবসায়ী, মিডিয়া, সাংস্কৃতিক কর্মী এবং সুশীল) একটি তালিকা প্রস্তুত করুন।

২) ভারতীয় পণ্য, যেমন, নারীপুরুষের পোষাক, গহনা, এবং অন্যান্য বিলাস দ্রব্য বর্জন করুন।

৩) ভারতীয় সিনেমা এবং টেলিভিশন চ্যানেল বর্জন করুন। বাংলাদেশে ভারতীয় শিল্পীদের অনুষ্ঠান বয়কট করুন।

৪) বিভিন্ন শিল্প প্রতিষ্ঠানে ভারতীয় নাগরিকদের পরিবর্তে বাংলাদেশি তরুনদের নিয়োগ দিন। বিদেশি বিশেষজ্ঞদের একান্ত প্রয়োজন হলে ভারত ব্যতীত সার্কভূক্ত অন্যান্য দেশের নাগরিকদের নিয়োগ দিন।

৫) ভারতীয় চ্যানেলে বাংলাদেশি পণ্যের বিজ্ঞাপন দেওয়া বন্ধ করুন।

৬) কেনাকাটা করতে অথবা বেড়ানোর উদ্দেশ্যে ধনবানরা ভারত গমন বন্ধ করুন। আপনারা দেশের শত্রুকে সহায়তা করছেন।

৭) যতটা সম্ভব নিজের দেশে চিকিৎসা নিন। অধিকতর চিকিৎসার প্রয়োজনে ভারতের পরিবর্তে কাছের অন্যান্য দেশে যান।

৮) বাংলাদেশের হাসপাতালসমূহে সেবার মান বৃদ্ধি করুন, দক্ষতা বাড়ান এবং চিকিৎসার ব্যয় কমান।

৯) বাংলাদেশে ভারতের চিহ্নিত দালাল শিল্প গোষ্ঠীসমূহের প্রস্তুতকৃত পণ্য ও সেবা কেনা বন্ধ করুন।

১০) ভারতের দালাল মিডিয়াসমূহকে বয়কট করুন। এই সব প্রতিষ্ঠানের পত্রিকা কিনবেন না, টেলিভিশন দেখবেন না।”

ইতিহাস সাক্ষ্য দেয়, ফ্যাসিবাদ থেকে মুক্তির পথ অনেক দীর্ঘ সংগ্রামের হয়। তথাপি আমরা বিশ্বাস করি অন্যায় চিরস্থায়ী হতে পারে না। আমাদেরকে এও বুঝতে হবে, খুব সহজেই এই চলমান অন্যায়কে হটানো যাবে না। সুতরাং দেশের ও মানুষের ঘাড়ে সিন্দাবাদের দৈত্যের মতো চেপে বসা এই দানবকে টেনে নামানোর জন্য এবং সমূলে ধ্বংস করার জন্য আমাদের সবাইকে সামর্থ্য অনুযায়ী কিছু না কিছু অবদান রেখেই যেতে হবে। ভারত বয়কট আন্দোলন হলো ব্যক্তিগত, পারিবারিক ও সামাজিক পর্যায়ে সাধ্য অনুযায়ী সেই অবদান রাখার একটি উত্তম উপায়।

Read More

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked with *

সর্বশেষ পোস্ট

Advertising