728 x 90

রাসুলুল্লাহ (সঃ): এক বিপ্লবী জীবন ও তার প্রভাব 

ইমাম হোসেন ইকবাল: বংশ পরিচিতি : জন্ম ও বাল্যকাল: যরত মুহাম্মদ (স)-এর সম্মানিত পিতার নাম আবদুল্লাহ । তিনি কা’বার মুতাওয়াল্লী আবদুল মুত্তালিবের পুত্র ছিলেন। তাঁর বংশ-পরম্পরা উর্ধ্বদিকে প্রায় ষাট পুরুষ পর্যন্ত পৌঁছে ইব্রাহীম (আ)-তনয় হযরত ইসমাঈল (আ)-এর সাথে মিলিত হয়েছে। তাঁর খান্দানের নাম কুরাইশ। আরব দেশের অন্যান্য খান্দানের মধ্যে এটিই পুরুষানুক্রমে সবচেয়ে শ্রেষ্ঠ ও সম্মানিত খান্দান

ইমাম হোসেন ইকবাল: বংশ পরিচিতি : জন্ম ও বাল্যকাল: যরত মুহাম্মদ (স)-এর সম্মানিত পিতার নাম আবদুল্লাহ । তিনি কা’বার মুতাওয়াল্লী আবদুল মুত্তালিবের পুত্র ছিলেন। তাঁর বংশ-পরম্পরা উর্ধ্বদিকে প্রায় ষাট পুরুষ পর্যন্ত পৌঁছে ইব্রাহীম (আ)-তনয় হযরত ইসমাঈল (আ)-এর সাথে মিলিত হয়েছে। তাঁর খান্দানের নাম কুরাইশ। আরব দেশের অন্যান্য খান্দানের মধ্যে এটিই পুরুষানুক্রমে সবচেয়ে শ্রেষ্ঠ ও সম্মানিত খান্দান বলে পরিগণিত হয়ে আসছে। আরব দেশের ইতিহাসে এই খান্দানের অনেক বড়ো বড়ো মান্য-গণ্য ব্যক্তির নাম দেখতে পাওয়া যায়। এদের ভেতর আদনান, নাযার, ফাহার, কালাব, কুস্সী প্রমুখের নাম বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। কুস্সী তাঁর জামানায় কা’বা শরীফের মুর্তাওয়াল্লী ছিলেন। তিনি অনেক বড়ো বড়ো স্মরণীয় কাজ করে গেছেন। যেমন : হাজীদের খাবার পানি সরবরাহ করা, তাদের মেহমানদারীর ব্যবস্থা করা ইত্যাদি। তাঁর পরেও তাঁর খান্দানের লোকেরা এই সকল কাজ আঞ্জাম দিতে থাকে। এসব জনহিতকর কাজ এবং কা’বা শরীফের মুতাওয়াল্লী হবার কারণে কুরাইশরা সারা আরব দেশে অতীব সম্মানিত ও গুরুত্বপূর্ণ খান্দান হিসেবে স্বীকৃতি লাভ করে। সাধারণভাবে আরবে লুটতরাজ, রাহাজানি ইত্যাকার দুষ্কৃতি প্রচলিত ছিলো এবং এ কারণে রাস্তাঘাট আদৌ নিরাপদ ছিলো না । কিন্তু কা’বা শরীফের মর্যাদা ও হাজীদের খেদমতের কারণে কুরাইশদের কাফেলার ওপর কখনো কেউ হামলা করতো না। তারা শান্তিপূর্ণভাবে নিজেদের ব্যবসায়ের পণ্য এক জায়গা থেকে অন্য জায়গায় নিয়ে যেতে পারতো ।

আবদুল মুত্তালিবের দশটি (মতান্তরে বারোটি) পুত্র ছিলো। কিন্তু কুফর বা ইসলামের বৈশিষ্ট্যের দিক দিয়ে তাঁদের মধ্যে পাঁচজন মাত্র খ্যাতিলাভ করেন। প্রথম, আবদুল্লাহ, ইনি হযরত মুহাম্মদ (স)-এর পিতা। দ্বিতীয়, আবু তালিব; ইনি ইসলাম কবুল করেননি বটে, তবে কিছুকাল হযরতের সাহায্য ও পৃষ্ঠপোষকতা করেছেন ।

তৃতীয়, হযরত হামযা (রা) এবং চতুর্থ, হযরত আব্বাস (রা)-এঁরা দুজনই ইসলামের সুশীতল ছায়ায় আশ্রয় নেন এবং ইসলামের ইতিহাসে অতীব উচ্চ মর্যাদা লাভ করেন। আর পঞ্চম হচ্ছে আবু লাহাব; ইসলামের প্রতি বৈরিতার কারণে ইতিহাসে যার নাম সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য ।

২. ঐতিহাসিক ইবনে খালদুনের মতে, হযরত মুহাম্মদ (স)-এর পিতা আবদুল্লাহ ছিলেন আবদুল মুত্তালিবের দশ পুত্রের মধ্যে সবার চেয়ে প্রিয়। – সম্পাদক

কুরাইশদের একটি গোত্রের নাম হচ্ছে জাহারা। এই গোত্রের ওহাব বিন্ আবদুল মানাফের কন্যা আমিনার সঙ্গে আবদুল্লাহ্র বিবাহ হয়। সমগ্র কুরাইশ খান্দানের ভেতর ইনি একজন বিশিষ্ট মহিলা ছিলেন। বিবাহ কালে আবদুল্লাহ্ বয়স ছিলো মাত্র সতেরো বছর। বিয়ের পর খান্দানী রীতি অনুযায়ী তিনি তিন দিন শ্বশুরালয়ে অবস্থান করেন। অতঃপর ব্যবসায় উপলক্ষে সিরিয়া গমন করেন। ফিরবার পথে মদীনা পর্যন্ত পৌঁছেই তিনি অসুস্থ হয়ে পড়েন এবং সেখানেই ইন্তেকাল করেন। ঐ সময় আমিনা অন্তঃসত্তা ছিলেন ।

জন্ম-তারিখ

ঈসায়ী ৫৭১ সালের ২০শে এপ্রিল, মুতাবেক ৯ রবিউল আউয়াল সোমবারের সুবহে সাদেক। এই স্মরণীয় মুহূর্তে রহমতে ইলাহীর ফয়সালা মুতাবেক সেই মহান ব্যক্তিত্ব জন্মগ্রহণ করলেন, সারা দুনিয়া থেকে জাহিলিয়াতের অন্ধকার বিদূরিত করে

হেদায়েতের আলোয় গোটা মানতাকে উদ্ভাসিত করার জন্যে যাঁর আবির্ভাব ছিলো একান্ত অপরিহার্য এবং যিনি ছিলেন কিয়ামত পর্যন্ত এই দুনিয়ায় বসবাসকারী সমগ্র মানুষের প্রতি বিশ্বপ্রভুর পরম আশীর্বাদ স্বরূপ। জন্মের আগেই এই মহামানবের পিতার ইন্তেকাল হয়েছিলো। তাই দাদা আবদুল মুত্তালিব এঁর নাম রাখলেন মুহাম্মদ (স)।

শৈশবে লালন-পালন

সর্বপ্রথম হযরত মুহাম্মদ (স)-এর স্নেহময়ী জননী আমিনা তাঁকে দুধ পান করান । দু-তিন দিন পর চাচা আবু লাহাবের বাঁদী সাওবিয়াও তাঁকে স্তন্য দান করেন। সে জামানার রেওয়াজ অনুযায়ী শহরের সম্ভ্রান্ত লোকেরা তাদের সন্তান-সন্ততিকে দুধ পান করানো এবং তাদের লালন-পালনের জন্যে গ্রামাঞ্চলে পাঠিয়ে দিতেন। সেখানকার খোলা আলো-হাওয়ায় তাদের স্বাস্থ্য ভালো হবে এবং তারা বিশুদ্ধ আরবী ভাষা শিখতে পারবে বলে তাঁরা মনে করতেন। কেননা, আরবের শহরাঞ্চলের তুলনায় গ্রামাঞ্চলের ভাষা অধিকতর বিশুদ্ধ বলে ধারণা করা হতো। এই নিয়ম অনুযায়ী গ্রামের মেয়েরা শহরে এসে বড়ো বড়ো অভিজাত পরিবারের সন্তানদের লালন-পালনের জন্যে সঙ্গে নিয়ে যেতো। তাই হযরত মুহাম্মদ (স)-এর জন্মের কয়েক দিন পরই হাওয়াযেন গোত্রের কতিপয় মহিলা শিশুর সন্ধানে মক্কায় আগমন করেন। এদের মধ্যে হালিমা ★ হযরত মুহাম্মদ (স)-এর জন্ম-তারিখ সম্পর্কে ইতিহাসকারদের মধ্যে মতভেদ আছে। কারো মতে, হযরত মুহাম্মদ (স)-এর জন্ম হয়েছিলো ১২ রবিউল আউয়াল, ঈসায়ী ৫৭০ সালে ।

এই মতটি দুনিয়ায় বেশি প্রচলিত। আবার কারো মতে, হযরত মুহাম্মদ (স)-এর জন্ম-তারিখ ১২ নয়, ৯ রবিউল আউয়াল, ঈসায়ী ৫৭১ সাল। এই মতটি অপেক্ষাকৃত কম প্রচলিত হলেও ঐতিহাসিক তথ্যের দিক থেকে বেশি নির্ভরযোগ্য বলে মনে হয় । এখানে এ কারণেই শেষোক্ত মতটি গ্রহণ করা হয়েছে। — সম্পাদক

সাদিয়া নাম্নী এক মহিলাও ছিলেন। এই ভাগ্যবতী মহিলা অপর কোনো বড়ো লোকের শিশু না পেয়ে শেষ পর্যন্ত আমিনার ইয়াতীম শিশু সন্তানকে নিয়ে ফিরে যেতে বাধ্য হন । দু’বছর পর আমিনা তাঁর শিশু পুত্রকে ফেরত নিয়ে আসেন। এর কিছুদিন পর মক্কায় মহামারী বিস্তার লাভ করলো। তাই আমিনা আবার তাঁকে গ্রামে পাঠিয়ে দিলেন। সেখানে তিনি প্রায় ছ’বছর বয়স পর্যন্ত অতিবাহিত করেন।

হযরত মুহাম্মদ (স)-এর বয়স যখন ছ বছর, তখন আমিনা তাঁকে নিয়ে মদীনায় গমন করেন। সম্ভবত স্বামীর কবর জিয়ারত অথবা কোনো আত্মীয়ের সঙ্গে দেখা-সাক্ষাত করার জন্যে তিনি এই সফরে বের হন। মদীনায় তিনি প্রায় এক মাসকাল অবস্থান করেন। কিন্তু ফিরবার পথে আরওয়া নামক স্থানে তিনি মৃত্যুবরণ করেন এবং সেখানেই চিরতরে সমাহিত হন ।

আম্মার মৃত্যুর পর হযরত মুহাম্মদ (স)-এর লালন-পালন ও দেখা-শোনার ভার দাদা আবদুল মুত্তালিবের ওপর অর্পিত হয়। তিনি হামেশা তাঁকে সঙ্গে-সঙ্গে রাখতেন । হযরত মুহাম্মদ (স)-এর বয়স যখন আট বছর, তখন দাদা আবদুল মুত্তালিবও মৃত্যুবরণ করেন। মৃত্যুকালে তিনি হযরত মুহাম্মদ (স)-এর লালন-পালনের ভার পুত্র আবু তালিবের ওপর ন্যস্ত করে যান। তিনি এই মহান কর্তব্য অতীব সুষ্ঠু ও সুন্দরভাবে পালন করেন। আবু তালিব এবং আবদুল্লাহ (হযরতের পিতা) সহোদর ভাই ছিলেন।

এদিক দিয়েও হযরত মুহাম্মদ (স)-এর প্রতি আবু তালিবের গভীর মমত্ব ছিলো। তিনি নিজের ঔরসজাত সন্তানদের চাইতেও হযরত মুহাম্মদ (স)-কে বেশি আদায়-যত্ন করতেন। শোবার কালে তিনি হযরত মুহাম্মদ (স)-কে সঙ্গে নিয়ে শুইতেন; বাইরে

বেরুবার সময়ও তাঁকে সঙ্গে নিয়ে বেরুতেন।

হযরত মুহাম্মদ (স)-এর বয়স যখন দশ-বারো বছর, তখন তিনি সমবয়স্ক ছেলেদের সঙ্গে মাঠে ছাগলও চরান। আরবে এটাকে কোনো খারাপ কাজ মনে করা হতো না । ভালো ভালো সম্ভ্রান্ত ঘরের ছেলেরাও তখন মাঠে ছাগল চরাতো ।

আবু তালিব ব্যবসায় করতেন। কুরাইশদের নিয়ম অনুযায়ী বছরে একবার তিনি সিরিয়া যেতেন। হযরত মুহাম্মদ (স)-এর বয়স তখন সম্ভবত বারো বছর; এ সময়

৪. ইবনে খালদুন লিখেছেন : এখানে অবস্থানকালে তিনি আপন দুধভাইদের সঙ্গে মাঠে বকরীও চরাতেন। একদিন তিনি জঙ্গলের মাঝে দুধ ভাইদের সঙ্গে খেলাধূলা করছিলেন। এমন সময় সাদা পোশাকধারী দুটি লোক এসে তাঁকে মাটিতে শুইয়ে তাঁর বক্ষ বিদীর্ণ করলো এবংতাতে নূর ভরে দিল। – সম্পাদক

৫. আরওয়া থেকে উম্মে আইমান নাম্নী এক মহিলা হযরত মুহাম্মদ (স)-কে মক্কায় নিয়ে আসেন (ইবনে খালদুন)। -সম্পাদক

একবার আবু তালিব সিরিয়া সফরের ইরাদা করলেন। সফরকালীন কষ্টের কথা স্মরণ করে তিনি হযরত মুহাম্মদ (স)-কে সঙ্গে তিনি অনিচ্ছুক ছিলেন। কিন্তু হযরত মুহাম্মদ (স)-এর প্রতি তাঁর অত্যন্ত প্রগাঢ় মমতা ছিলো; তাই সফরে রওয়ানা করার সময় তাঁর সঙ্গে যাবার জন্যে হযরত মুহাম্মদ (স) পীড়াপীড়ি শুরু করলে আবু তালিব তাঁর মনে আঘাত দিতে পারলেন না। তিনি হযরত মুহাম্মদ (স)-কে সঙ্গে নিয়ে গেলেন।

৬. ইবনে খালদুন লিখেছেন : বাণিজ্য কাফেলা সিরিয়ার দক্ষিণে বসরা নামক স্থানে পৌঁছলে খ্রিস্টান পাদ্রী বহিরা নিজের অন্তর্দৃষ্টিতে গাছপালা, পাথর ইত্যাদিকে হযরত মুহাম্মদ (স)-এর উদ্দেশ্যে সিজদা করতে দেখে স্বগতোক্তি করলেন : এতো সেই সাইয়্যেদুল মুরসালীন, অতীতের সমস্ত নবী যাঁর আগমন সম্পর্কে ভবিষ্যৎবাণী করে গেছেন। — সম্পাদক

 

নবুয়্যাতের আগে ফুজ্জারের যুদ্ধ নবুয়্যাতের আগে ইসলাম-পূর্ব যুগে আরবদের মধ্যে যুদ্ধ-বিগ্রহের এক সুদীর্ঘ ও অসমাপ্য ধারা বর্তমান ছিলো। এর ভেতর সবচেয়ে ভয়ংকর ও মশহুর ছিল ফুজ্জারের যুদ্ধ। এই যুদ্ধ কুরাইশ ও কায়েস গোত্রসমূহের মধ্যে সংঘটিত হয়। এতে কুরাইশদের ভূমিকা ছিলো সম্পূর্ণ ন্যায়ানুগ; তাই হযরত মুহাম্মদ (স)ও কুরাইশদের পক্ষ থেকে এতে অংশগ্রহণ করেন। কিন্তু তিনি কারো ওপর আঘাত হানেন নি। এ যুদ্ধে প্রথমে কায়েস এবং পরে কুরাইশরা জয়লাভ করে । শেষ অবধি সন্ধি মারফত এর পরিসমাপ্তি ঘটে।

হিলফুল ফুযুল

এভাবে অবনরত যুদ্ধ-বিগ্রহের ফলে আরবের শত শত পরিবার ধ্বংস হয়ে যাচ্ছিলো। লোকদের না ছিলো দিনের বেলায় কোন স্বস্তি আর না ছিলো রাত্রে কোনো আরাম । ফুজ্জারের যুদ্ধের পর এই পরিস্থিতিতে অতিষ্ঠ হয়ে কিছু কল্যাণকামী লোক এর প্রতিকারের জন্যে একটা আন্দোলন শুরু করেন। হযরত মুহাম্মদ (স)-এর চাচা জুবাইর ইবনে আবদুল মুত্তালিব পরিস্থিতি দ্রুত শোধরাবার জন্যে কিছু বাস্তবধর্মী কাজের প্রস্তাব নিয়ে এগিয়ে এলেন। এর কিছুদিন পর কুরাইশ খান্দানের নেতৃস্থানীয় ব্যক্তিগণ জমায়েত হয়ে নিম্নোক্ত চুক্তি সম্পাদন করেন :

১. আমরা দেশ থেকে অশান্তি দূর করবো ।

২. পথিকের জান-মালের হেফাজত করবো ।

৩. গরীবদের সাহায্য করতে থাকবো।

৪. মজলুমের সহায়তা করে যাবো।

৫. কোনো জালেমকে মক্কায় আশ্রয় দেব না ।

এই চুক্তিতে হযরত মুহাম্মদ (স)ও অংশগ্রহণ করেন এবং তিনি অত্যন্ত আনন্দিত হন। নবুয়্যাতের জামানায় এ চুক্তি সম্পর্কে তিনি মন্তব্য করেন : ‘আমাকে ঐ চুক্তির বদলে যদি একটি লাল রঙ-এর মূল্যবান উটও দেয়া হতো, তবুও তা আমি কবুল করতাম না। আজো যদি কেউ ঐরূপ চুক্তির জন্যে আমাকে আমন্ত্রণ জানায়, তাতে সাড়া দিতে আমি প্রস্তুত ।

৭. এই যুদ্ধের সময় হযরত মুহাম্মদ (স)-এর বয়স ছিলো ১৫ বছর। -সম্পাদক

কা’বা গৃহের সংস্কার

তখন কা’বা গৃহের শুধু চারটি দেয়াল বিদ্যমান ছিলো। তার ওপর কোনো ছাদ ছিলো না। দেয়ালগুলোও বড়োজোর মানুষের দৈর্ঘ্য সমান উঁচু ছিলো। পরম্ভ গৃহটি ছিলো খুব নীচু জায়গায়। শহরের সমস্ত পানি গড়িয়ে সেদিকে যেতো। ফলে পানি

প্রতিরোধ করার জন্যে বাঁধ দেয়া হতো। কিন্তু পানির চাপে সে বাঁধ বারবার ভেঙে যেতো এবং গৃহ প্রাঙ্গনে পানি জমে উঠতো। এভাবে গৃহটি দিন দিন ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছিলো। তাই গৃহটি ভেঙে ফেলে একটি নতুন মজবুত গৃহ নির্মাণের সিদ্ধান্ত নেয়া

হলো। সমগ্র কুরাইশ খান্দান মিলিতভাবে নির্মাণ কাজ শুরু করলো। কেউ যাতে এ সৌভাগ্য থেকে বঞ্চিত না হয়, সেজন্যে বিভিন্ন গোত্রের লোকেরা গৃহের বিভিন্ন অংশ ভাগ করে নিলো। কিন্তু কা’বা গৃহের দেয়ালে যখন ‘হাজরে আসওয়াদ’ (পবিত্র কালো পাথর) স্থাপনের সময় এলো, তখন বিভিন্ন গোত্রের মধ্যে তুমুল ঝগড়া বেঁধে গেলো । প্রত্যেক গোত্রই দাবি করছিলো যে, এ খেদমতটি শুধু তারাই আঞ্জাম দেবার অধিকারী। অবস্থা এতদূর পর্যন্ত গড়ালো যে, অনেকের তলাওয়ার পর্যন্ত কোষমুক্ত হলো । চার দিন পর্যন্ত এই ঝগড়া চলতে থাকলো। পঞ্চম দিন আৰু উম্মিয়া বিন্ মুগীরা নামক এক প্রবীণ ব্যক্তি প্রস্তাব করেন যে, আগামীকাল প্রত্যুষে যে ব্যক্তি এখানে সবার আগে হাযির হবে, এর মীমাংসার জন্যে তাকেই মধ্যস্থ নিয়োগ করা হবে। সে যা সিদ্ধান্ত করবে,তা-ই পালন করা হবে। সবাই এ প্রস্তাব মেনে নিলো ।

পরদিন আল্লাহ্ কুদরতে সর্বপ্রথম যে ব্যক্তির ওপর সবার নজর পড়লো, তিনি ছিলেন রাহমাতুল্লিল আলামীন হযরত মুহাম্মদ (স)। ফয়সালা অনুযায়ী তিনি ‘হাজরে আসওয়াদ’ স্থাপন করতে ইচ্ছুক প্রতিটি খান্দানকে একজন করে প্রতিনিধি নির্বাচন

করতে বললেন। অতঃপর একটি চাদর বিছিয়ে তিনি নিজ হাতে পাথরটিকে তার ওপর রাখলেন এবং বিভিন্ন গোত্রের প্রতিনিধিগণকে চাদরের প্রান্ত ধরে পাথরটিকে ওপরে তুলতে বললেন। চাদরটি তার নির্দিষ্ট স্থান বরাবর পৌছলে তিনি ‘হাজরে আসওয়াদ’কে যথাস্থানে স্থাপন করলেন। এভাবে তিনি একটি বিরাট সংঘর্ষের সম্ভাবনা বিনষ্ট করে দিলেন। এ সংঘর্ষে কতো খুন-খারাবী হতো, কে জানে!

এবার কা’বার যে নয়া গৃহ নির্মিত হলো, তার ওপর যথারীতি ছাদও দেয়া হলো; কিন্তু পুরো ভূমির ওপর গৃহ নির্মাণের উপযোগী উপকরণ না থাকায় এক দিকের ভূমি কিছুটা বাইরে ছেড়ে দিয়ে নয়া ভিত্তি গড়ে তোলা হলো। এই অংশটিকেই এখন ‘হিত্তিম’ বলা হয় । ব্যবসায়ে আত্মনিয়োগ আরবদের, বিশেষত কুরাইশদের পুরানো পেশা ছিলো ব্যবসায়। হযরত মুহাম্মদ

(স)-এর চাচা আবু তালিবও একজন ব্যবসায়ী ছিলেন। এ কারণেই হযরত মুহাম্মদ (স) যখন যৌবনে পদার্পণ করেন, তখন তিনিও ব্যবসায়কে অর্থোপার্জনের উপায় হিসাবে গ্রহণ করেন। কিশোর বয়সে চাচার সঙ্গে তিনি ব্যবসায় উপলক্ষে যে সফর করেন, তাতে তাঁর যথেষ্ট অভিজ্ঞতা সঞ্চিত হয়। অতঃপর তিনি নিজ কারবার শুরু করলে তাঁর লেন-দেনের সুখ্যাতি চারদিকে ছড়িয়ে পড়ে। এ ব্যাপারে তিনি লোকদের কাছে অত্যন্ত বিশ্বস্ত প্রতিপন্ন হলেন। লোকেরা তাঁর ব্যবসায়ে অংশগ্রহণের উদ্দেশ্যে নিজ নিজ মূলধন তাঁর কাছে জমা করতে লাগলো। পরন্তু ওয়াদা পালন, সদাচরণ, ন্যায়পরায়ণতা, বিশ্বস্ততা ইত্যাদি কারণেও তিনি লোকদের অত্যন্ত শ্রদ্ধা অর্জন করলেন। এমন কি, লোকেরা তাঁকে ‘আস্-সাদিক’ (সত্যবাদী) ও ‘আল-আমীন’ (বিশ্বস্ত) বলে সাধারণভাবে অভিহিত করতে লাগলো। ব্যবসায় উপলক্ষে তিনি সিরিয়া, বসরা, বাহরাইন ও ইয়েমেনে কয়েক বার সফর করেন।

খাদীজার সাথে বিবাহ তখন খাদীজা” নামে আরবে এক সম্ভ্রান্ত ও বিত্তশালী মহিলা ছিলেন। তিনি হযরত মুহাম্মদ (স)-এর দূর সম্পর্কের চাচাতো বোন ছিলেন। প্রথম বিবাহের পর তিনি বিধবা হন এবং দ্বিতীয় বিবাহ করেন। কিন্তু কিছু দিন পর তাঁর দ্বিতীয় স্বামীও মৃত্যুবরণ করেন · এবং পুনরায় বিধবা হন। তিনি অত্যন্ত সম্মানিত ও সচ্চরিত্রের অধিকারী মহিলা ছিলেন। লোকেরা তাঁর চারিত্রিক বৈশিষ্ট্যে মুগ্ধ হয়ে তাঁকে ‘তাহিরা’ (পবিত্রা) বলে ডাকতো। তাঁর অগাধ ধন-দৌলত ছিলো। তিনি লোকদেরকে পুঁজি ও পণ্য দিয়ে ব্যবসায় চালাতেন।

হযরত মুহাম্মদ (স)-এর বয়স তখন পঁচিশ বছর। ইতোমধ্যে ব্যবসায় উপলক্ষে তিনি বহুবার সফর করেছেন। তাঁর সততা, বিশ্বস্ততা ও সচ্চরিত্রের কথা জনসমাজে ছড়িয়ে পড়েছিলো। তাঁর এ খ্যাতির কথা শুনে হযরত খাদীজা তাঁর কাছে এই মর্মে এক পয়গাম পাঠান ঃ ‘আপনি আমার ব্যবসায়ের পণ্য নিয়ে সিরিয়া গমন করুন। আমি

অন্যান্যকে যে হারে পারিশ্রমিক দিয়ে থাকি, আপনাকেও তা-ই দেবো।’ হযরত মুহাম্মদ (স) তাঁর এই প্রস্তাব কবুল করলেন এবং পণ্যদ্রব্য নিয়ে সিরিয়ার অন্তর্গত বসরা পর্যন্ত গমন করলেন ।  খাদীজা হযরত মুহাম্মদ (স)-এর অসামান্য যোগ্যতা ও অতুলনীয় চারিত্রিক বৈশিষ্ট্যে মুগ্ধ হয়ে প্রায় তিন মাস পর তাঁর কাছে বিয়ের পয়গাম প্রেরণ করেন। হযরত মুহাম্মদ (স) তাঁর পয়গাম মঞ্জুর করলেন এবং বিয়ের দিন-ক্ষণও নির্ধারিত হলো । নির্দিষ্ট দিনে আবু তালিব, হযরত হামজা এবং খান্দানের অপরাপর বিশিষ্ট ব্যক্তিদের নিয়ে হযরত মুহাম্মদ (স) খাদীজার বাড়িতে উপস্থিত হলেন। আবু তালিব বিয়ের খোতবা পড়লেন।

পাঁচ শো তালায়ী দিরহাম (স্বর্ণ-মুদ্রা) বিয়ের মোহরানা নির্ধারিত হলো । বিবাহকালে হযরত খাদীজার বয়স চল্লিশ বছর এবং তাঁর পূর্বোক্ত দুই স্বামীর ঔরসজাত দুই পুত্র ও এক কন্যা ছিলো।*

অসাধারণ ঘটনাবলী

দুনিয়ায় যতো বিশিষ্ট লোকের আবির্ভাব ঘটে, তাঁদের জীবনে শুরু থেকেই অসাধারণ কিছু নিদর্শনাবলী লক্ষ্য করা যায়। এ দ্বারা তাঁদের উজ্জ্বল ভবিষ্যতের কথা সহজেই অনুমান করা চলে। এ কথা অবশ্য এমন সব লোকের বেলায়ই প্রযোজ্য, যাঁরা পরবর্তীকালে কোনো বিশেষ খান্দান, কওম বা দেশের কোনো উল্লেখযোগ্য সংস্কার সাধন করে থাকেন। কিন্তু যে মহান সত্তাকে কিয়ামত অবধি সারা দুনিয়ার নেতৃত্বের জন্যে সৃষ্টি করা হয়েছে এবং যাঁকে মানব জীবনের প্রতিটি দিক ও বিভাগের পূর্ণ সংস্কারের জন্যে প্রেরণ করা হয়েছে, তাঁর জীবন-সূচনায় এমন অসাধারণ নিদর্শনাবলী তো প্রচুর পরিমাণে দৃষ্টিগোচর হওয়াই স্বাভাবিক। তাই স্বভাবতই তাঁর জীবনী গ্রন্থগুলোয় এ ধরনের নিদর্শনাবলীর প্রচুর উল্লেখ দেখা যায়। কিন্তু যে সকল ঘটনা প্রামাণ্য এবং বিশুদ্ধ রেওয়ায়েতসহ উল্লিখিত হয়েছে, তার কয়েকটি নিম্নে উদ্ধৃত হলো:

হযরত মুহাম্মদ (স) বলেছেন : ‘আমি যখন আমার মায়ের গর্ভে ছিলাম, তখন তিনি স্বপ্নে দেখেন যে, তাঁর দেহ থেকে একটি আলো নির্গত হয়েছে এবং তাতে সিরিয়ার রাজপ্রাসাদ পর্যন্ত আলোকিত হয়ে গেছে।’ বহু রেওয়ায়েত থেকে এ-ও জানা যায় যে, তখন ইহুদী ও খ্রিস্টানগণ এক নতুন নবীর আগমন প্রতীক্ষায় ছিলো এবং এ ব্যাপারে তারা নানারূপ ভবিষ্যৎবাণী করছিলো।

তাঁর বাল্যকালের একটি ঘটনা। তখন কা’বা গৃহের কিছুটা সংস্কার কার্য চলছিলো এবং এ ব্যাপারে বড়োদের সাথে ছোট ছোট ছেলেরাও ইট বহন করে নিয়ে যাচ্ছিলো। এই ছেলেদের মধ্যে হযরত মুহাম্মদ (স) এবং তাঁর চাচা হযরত আব্বাসও ছিলেন।

হযরত আব্বাস তাঁকে লক্ষ্য করে বললেন : ‘তোমার লুঙ্গি খুলে কাঁধের ওপর দিয়ে নাও, তাহলে ইটের চাপে ব্যথা পাবে না।’ তখন তো বড়োরা পর্যন্ত নগ্ন হতে লজ্জানুভ করতো না । কিন্তু হযরত মুহাম্মদ (স) যখন এরূপ করলেন, নগ্নতার অনুভূতিতে সহসা তিনি বেহুঁশ হয়ে পড়লেন। তাঁর চোখ দুটো প্রায় ফেটে বেরিয়ে যাবার উপক্রম হলো ।

সম্বিত ফিরে এলে তিনি শুধু বলতে লাগলেন : আমার লুঙ্গি, আমার লুঙ্গি”। লোকেরা *রাসূল্লাহ্ (স)-এর পুত্র-কন্যাদের মধ্যে একমাত্র মাবিয়া কিবতিয়ার গর্ভজাত ইবরাহীম ছাড়া বাকী সবাই হযরত খাদীজা (রা)-এর গর্ভে জন্মগ্রহণ করেন। এরা হলেন : কাসেম, তৈয়্যেব, তাহির জয়নাব, রুকাইয়া, উম্মে কুলসুম ও ফাতিমা জাহরা। এদের মধ্যে একমাত্র ফাতিমাই হযরত আলী (রা) স্ত্রী এবং ইমাম হাসান হুসেনের জননীরূপে খ্যাতি লাভ করেন।— সম্পাদক

তাড়াতাড়ি তাঁকে লুঙ্গি পরিয়ে দিলো। কিছুক্ষণ পর আবু তালিব তাঁর অবস্থা জানতে চাইলে তিনি বললেন : ‘ আমি সাদা কাপড় পরিহিত এক লোককে দেখতে পাই। সে আমাকে বললো, শীগগীর সতর আবৃত করো।’ সম্ভবত এই প্রথম হযরত মুহাম্মদ (স) গায়েবী আওয়াজ শুনতে পান ।

আরবে তখন আসর জমিয়ে কিস্সা বলার একটা কুপ্রথা চালু ছিলো। লোকেরা রাত্রি বেলায় কোনো বিশেষ স্থানে জমায়েত হতো এবং কাহিনীকাররা রাতের পর রাত তাদেরকে নানারূপ উদ্ভট কিস্সা-কাহিনী শোনাতো। বাল্য বয়সে হযরত মুহাম্মদ (স) একবার এই ধরনের আসরে যোগদান করার ইরাদা করেন। কিন্তু পথিমধ্যে একটি বিয়ের মজলিস দেখার জন্যে তিনি দাঁড়িয়ে যান এবং পরে সেখানেই ঘুমিয়ে পড়েন ।

অতঃপর চোখ মেলে দেখেন যে, ভোর হয়ে গেছে। এরূপ ঘটনা তাঁর জীবনে আরো একবার সংঘটিত হয় । এভাবে আল্লাহ তা’আলা তাঁকে কুসংসর্গ থেকে রক্ষা করেন ।

রাসূলুল্লাহ (স) যে যুগে জন্মগ্রহণ করেন, তখন মক্কা মূর্তি-পূজার সবচেয়ে বড়ো কেন্দ্রস্থলে পরিণত হয়েছিলো। খোদ কা’বাগৃহে তখন তিন শ’ ষাটটি মূর্তির পূজা হতো এবং তাঁর নিজ খান্দানের লোকেরা অর্থাৎ কুরাইশরাই তখন কা’বার মুতাওয়াল্লী বা  পূজারী ছিলো। কিন্তু এতৎসত্ত্বেও হযরত মুহাম্মদ (স) কোনো দিন মূর্তির সামনে মাথা নত করেননি এবং সেখানকার কোনো মুশরিকী অনুষ্ঠানেও অংশ নেননি। এছাড়া কুরাইশরা আর যে সব খারাপ রসম-রেওয়াজে অভ্যস্ত ছিলো, তার কোনো ব্যাপারেই হযরত মুহাম্মদ (স) কোনো দিন তাঁর খান্দানের সহযোগিতা করেননি। ★

★ ঐতিহাসিক ইবনে খালদুন এ প্রসঙ্গে আরো দু-একটি ঘটনার উল্লেখ করেছেন। হযরত খাদীজা (রা)-এর ভ্রাতুষ্পুত্র হাকীম বিন খাজাম হযরত মুহাম্মদ (স)-কে জায়েদ বিন হারেসা নামক একটি গোলাম উপহার দেন। হযরত মুহাম্মদ (স) তাঁর বিশাল হৃদয় ও উন্নত চরিত্রের তাগিদে জায়েদকে অতি প্রিয়জনের ন্যায় লালন-পালন করেন। ইত্যবসরে জায়েদের পিতা হারেসা এবং চাচা কা’ব তাঁর সন্ধানে মক্কায় আসে এবং জায়েদকে ফেরত দেয়ার অনুরোধ জানায়। হযরত মুহাম্মদ (স) তাদেরকে জানান যে, জায়েদ ফেরত যেতে চাইলে তাঁর কোন আপত্তি নেই। কিন্তু জায়েদ তাদেরকে স্পষ্টত জানিয়ে দেন, ‘আমি হযরতকে ছেড়ে কক্ষনো যাবো না; কারণ তিনি আমার কাছে আপন বাপ-চাচার চাইতেও প্রিয়।’ এতে জায়েদের পিতা ক্রুদ্ধ হয়ে বলেন : ‘তুমি কি স্বাধীনতার চাইতে গোলামীকে

শ্রেয়ঃ মনে করো?’ জবাবে জায়েদ বলেন : ‘হ্যা তা-ই করি। কারণ আমি হযরত মুহাম্মদ (স)-এর মধ্যে এমন কিছু দেখেছি, যাতে তাঁর চাইতে আর কাউকে শ্রেয়ঃ ভাবতে পারি না।’ একথা শুনে হযরত মুহাম্মদ (স) জায়েদকে কা’বা গৃহের কাছে নিয়ে মুক্ত করে দেন এবং তাকে পুত্র বলে ঘোষণা করেন। এ দৃশ্য দেখে জায়েদের পিতা ও চাচা তাঁকে হযরত মুহাম্মদ (স)-এর কাছে রেখে সন্তুষ্ট চিত্তে বাড়ি ফিরে যান।

হযরত মুহাম্মদ (স)-এর চাচা আবু তালিবের পরিবারের লোকসংখ্যা ছিলো যেমন বেশি, তেমনি তাঁর আর্থিক অবস্থা ছিলো খুবই খারাপ। হযরত মুহাম্মদ (স) একদিন তাঁর অপর চাচা আব্বাস বিন্ মুত্তালিবকে বললেন : ‘আপনার ভাই আবু তালিবের আর্থিক অবস্থা খুব খারাপ। এমতাবস্থায় তাঁর একটি ছেলেকে আপনি এবং অপর একটি ছেলে আমি নিয়ে গেলে খুব ভালো হয় ।’ আব্বাস সানন্দে এতে রাযী হলেন এবং আবু তালিবের অনুমতিক্রমে জাফরকে তিনি এবং আলীকে হযরত মুহাম্মদ (স) নিয়ে এলেন। আলীর বয়স ছিল তখন ৫/৬ বছর নবুয়্যাতের সূচনা হযরত মুহাম্মদ (স)-এর বয়স প্রায় চল্লিশের কাছাকাছি পৌছলো। তাঁর জীবনে এবার আর একটি বিপ্লবের সূচনা হতে লাগলো। নির্জনে বসে একাকী আল্লাহ্ ধ্যানে

মগ্ন থাকা এবং আপন সমাজের নৈতিক ও ধর্মীয় অধঃপতন সম্পর্কে চিন্তা-ভাবনায় তিনি মশগুল হয়ে পড়লেন। তিনি ভাবতে লাগলেন : তাঁর কওমের লোকেরা কিভাবে হাতে-গড়া মূর্তিকে নিজেদের মা’বুদ ও উপাস্য বানিয়েছে। নৈতিক দিক থেকে তারা কতো অধঃপাতে গিয়ে পৌঁছেছে! তাদের এই সব ভ্রান্তি কি করে দূরীভূত হবে? খোদা-পরস্তির নির্ভুল পথ কিভাবে তাদের দেখানো যাবে? এই বিশ্ব-জাহানের প্রকৃত স্রষ্টা ও মালিকের বন্দেগী কিভাবে করা উচিত? এমন অসংখ্য রকমের চিন্তা ও প্রশ্ন তাঁর মনের ভেতর তোলপাড় করতে লাগলো। ঘন্টার পর ঘন্টা ধরে এসব বিষয়ে তিনি গভীরভাবে চিন্তা করতে লাগলেন ।

হেরা গুহায় ধ্যান মক্কা মুয়াজ্জমা থেকে তিন মাইল দূরে অবস্থিত জাবালুন নূর-এ ‘হেরা’ নামে একটি পর্বত-গুহা ছিলো। ★ হযরত মুহাম্মদ (স) প্রায়শ সেখানে গিয়ে অবস্থান করতেন এবং নিবিষ্ট চিত্তে চিন্তা-ভাবনা ও খোদার ধ্যানে মগ্ন থাকতেন। সাধারণত খানাপিনার দ্রব্যাদি তিনি সঙ্গে নিয়ে যেতেন, শেষ হয়ে গেলে আবার নিয়ে আসতেন। কখনো কখনো হযরত খাদীজা (রা)ও তা পৌঁছে দিতেন । সর্বপ্রথম ওহী নাযিল এভাবে দীর্ঘ ছয়টি মাস কেটে গেলো। হযরত চল্লিশ বছর বয়সে পদার্পণ করলেন।

একদা তিনি হেরা গুহার ভেতর যথারীতি খোদার ধ্যানে মশগুল রয়েছেন। সময়টি তখন রমযান মাসের শেষ দশক। সহসা তাঁর সামনে আল্লাহ্র প্রেরিত এক ফেরেশতা আত্মপ্রকাশ করলেন। ইনি ফেরেশতা-শ্রেষ্ঠ জিবরাঈল (আ)। ইনিই যুগ যুগ ধরে জলজ বা क ।

হযরত জিবরাঈল (আ) আত্মপ্রকাশ করেই হযরত মুহাম্মদ (স)-কে বললেন : ‘পড়ো’। তিনি বললেন : ‘আমি পড়তে জানি না।’ একথা শুনে জিবরাঈল (আ) হযরত মুহাম্মদ (স)-কে বুকে জড়িয়ে ধরে এমনি জোরে চাপ দিলেন যে, তিনি থতমত খেয়ে ★পবর্ত-গুহাটি এখনো সেখানে বর্তমান রয়েছে। প্রতিদিন অসংখ্য মানুষ সেটি পরিদর্শন করছে। —সম্পাদক

গেলেন। অতঃপর হযরত মুহাম্মদ (স)-কে ছেড়ে দিয়ে আবার বললেন : ‘পড়ো’। কিন্তু তিনি আগের জবাবেরই পুনরুক্তি করলেন। জিবরাইল (আ) আবার তাঁকে আলিঙ্গন করে সজোরে চাপ দিলেন এবং বললেন : ‘পড়ো’। এবারও হযরত মুহাম্মদ (স) জবাব দিলেন : ‘আমি পড়তে জানি না।’ পুনর্বার জিবরাঈল (আ) হযরত মুহাম্মদ (স)-কে বুকে চেপে ধরলেন এবং ছেড়ে দিয়ে বললেন :  পড়ো তোমার প্রভুর (রব) নামে, যিনি মানুষকে সৃষ্টি করেছেন; সৃষ্টি করেছেন জমাট-বাঁধা রক্ত থেকে। পড়ো এবং তোমার প্রভু অতীব সম্মানিত, যিনি কলম দ্বারা শিক্ষা দিয়েছেন। তিনি মানুষকে এমন জিনিস শিখিয়েছেন যা সে জানতো না ।

এই হচ্ছে সর্বপ্রথম ওহী নাযিলের ঘটনা। এ ঘটনার পর হযরত মুহাম্মদ (স) বাড়ি চলে এলেন। তখন তাঁর পবিত্র অন্তঃকরণে এক প্রকার অস্থিরতা  বিরাজ করছিলো। তিনি কাঁপতে কাঁপতে খাদীজা (রা) কে বললেন : ‘আমাকে শীগগীর কম্বল দ্বারা ঢেকে দাও।’ খাদীজা (রা) তাঁকে কম্বল দিয়ে ঢেকে দিলেন। অতঃপর কিছুটা শান্ত ও স্বাভাবিক হয়ে এলে তিনি খাদীজা (রা)-এর কাছে সমস্ত ঘটনা প্রকাশ করলেন; বললেন : আমার নিজের জীবন সম্পর্কে ভয় হচ্ছে।’ খাদীজা (রা) বললেন : ‘না, কক্ষনোই নয়। আপনার জীবনের কোনো ভয় নেই। খোদা আপনার প্রতি বিমুখ হবেন না। কেননা আপনি আত্মীয়দের হক আদায় করেন; অক্ষম লোকদের ভার-বোঝা নিজের কাঁধে তুলে নেন; গরীব-মিসকিনদের সাহায্য করেন; পথিক-মুসাফিরদের মেহমানদারী করেন। মোটকথা, ইনসাফের খাতিরে বিপদ-মুসিবতের সময় আপনিই লোকদের উপকার করে থাকেন ।

এরপর খাদীজা (রা) হযরত মুহাম্মদ (স)-কে নিয়ে প্রবীণ খ্রিস্টান ধর্মবেত্তা অরাকা বিন্ নওফেলের কাছে গমন করলেন। তিনি তওরাত সম্পর্কে খুব ভালো পাণ্ডিত্যের অধিকারী ছিলেন। হযরত খাদীজা (রা) তাঁর কাছে সমস্ত ঘটনা আদ্যন্ত বর্ণনা করলেন ।

তিনি সব শুনে বললেন : ‘এ হচ্ছে মূসার ওপর অবতীর্ণ সেই ‘নামূস’ (গোপ রহস্যজ্ঞানী ফেরেশতা)। হায়! তোমার কওমের লোকেরা যখন তোমাকে বের করে

★ এই অস্থিরতা ছিলো তাঁর ওপর অর্পিত আকস্মিক দায়িত্বানুভূতির প্রতিক্রিয়া মাত্র। এ প্রসঙ্গে তিনি যা কিছু বলেছেন এবং খাদীজা (রা) যেভাবে তাঁকে সান্ত্বনা দিয়েছেন তা নিছক একটি স্বাভাবিক ব্যাপার ছাড়া কিছুই ছিলো না। -সম্পাদক

দেবে, তখন পর্যন্ত আমি যদি জিন্দা থাকতাম! হযরত মুহাম্মদ (স) জিজ্ঞেস করলেন : ‘আমার কওমের লোকেরা কি আমায় বের করে দেবে’? অরাকা বললেন : “তুমি যা কিছু নিয়ে এসেছো, তা নিয়ে ইতঃপূর্বে যে-ই এসেছে, তার কওমের লোকেরা তার সঙ্গে দুশমনী করেছে। আমি যদি তখন পর্যন্ত জিন্দা থাকি, তাহলে তোমায় যথাসাধ্য সাহায্য করবো।’ এর কিছুদিন পরই অরাকার মৃত্যু ঘটে। এরপর কিছুদিন জিবরাঈলের আগমন বন্ধ রইলো। কিন্তু হযরত মুহাম্মদ (স) যথারীতি হেরা গুহায় যেতে থাকলেন। এই অবস্থা অন্তত ছয় মাস চলতে থাকলো। এই বিরতির ফলে কিছুটা ফায়দা হলো। মানবীয় প্রকৃতির দরুণ তাঁর অন্তঃকরণে এখন ওহী নাযিলের ঔৎসুক্য সঞ্চারিত হলো। এমন কি, এই অবস্থা কিছুটা বিলম্বিত হলে তাঁকে সান্ত্বনা দেবার জন্যে জিবরাঈলের আগমন শুরু হলো। তবে ঘন ঘন নয়, মাঝে মাঝে জিবরাঈল এসে তাঁকে এই বলে প্রবোধ দেন যে, আপনি নিঃসন্দেহে আল্লাহ্র রাসূল মনোনীত হয়েছেন। এরপর হযরত মুহাম্মদ (স) শান্ত চিত্তে প্রতীক্ষা করতে লাগলেন। কিছুদিন পর জিবরাঈল ঘন ঘন আসা শুরু করলেন। হেরা গুহায় প্রথম ওহী নাযিলের পর কিছুদিন পর্যন্ত আর কোনো ওহী আসেনি । এরপর সূরা মুদ্দাস্সিরের প্রারম্ভিক আয়াতসমূহ নাযিল হলো ।  হে কম্বল আচ্ছাদনকারী! ওঠো এবং (ভ্রষ্টাচারী লোকদেরকে ) ভয় দেখাও। আর আপন প্রভুর শ্রেষ্ঠত্ব ঘোষণা করো। লেবাস-পোশাক পরিষ্কার রাখো এবং নোংরামি ও অপবিত্রতা থেকে দূরে থাকো। বেশি পাওয়ার উদ্দেশ্যে কারো প্রতি অনুগ্রহ করো না এবং আপন প্রভুর খাতিরে বিপদ-মুসিবতে ধৈর্য ধারণ করো ।

নবুয়্যাতের মর্যাদায় অভিষিক্ত হবার এটা ছিলো সূচনা মাত্র। এবার তিনি যথারীতি হুকুম পেলেন যে, ওঠো এবং ভ্রষ্ট মানবতাকে কল্যাণ পথ দেখাও। লোকদেরকে সতর্ক করে দাও যে, সফলতার পথ মাত্র একটি এবং তা হচ্ছে এক খোদার বন্দেগী ও আনগত্য । যারা এই পথ অবলম্বন করবে. পরিণামে তারাই সফলকাম হবে। আর যারা প্রথম স্তর: গোপন দাওয়াত নবুয়্যাতের দায়িত্বে অধিষ্ঠিত হবার পর হযরত মুহাম্মদ (স)-এর সামনে প্রথম সমস্যা ছিলো ঃ এক খোদার বন্দেগী কবুল করার ও অসংখ্য মিথ্যা খোদার অস্তিত্ব অস্বীকার করার দাওয়াত প্রথম কোন্ ধরনের লোকদের দেয়া যাবে? দেশ ও জাতির লোকদের তখন যে অবস্থা ছিলো, তার একটি মোটামুটি চিত্র ইতঃপূর্বে পেশ করা হয়েছে। এহেন লোকদের সামনে তাদের মেজাজ, পসন্দ ও অভ্যাসের সম্পূর্ণ বিপরীত কোনো জিনিস পেশ করা বাস্তবিকই অত্যন্ত কঠিন কাজ ছিলো। তাই যে সব লোকের সঙ্গে এতদিন হযরত মুহাম্মদ (স)-এর খুব ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক ছিলো এবং যাঁরা তাঁর স্বভাব-প্রকৃতি ও নৈতিক চরিত্র সম্পর্কে সরাসরি অবহিত ছিলেন, তাঁদেরকেই তিনি সর্বপ্রথম দাওয়াতের জন্যে মনোনীত করলেন। কারণ, এরা হযরত মুহাম্মদ (স)-এর সততা ও বিশ্বস্ততা সম্পর্ক নিঃসংশয় ছিলেন এবং তিনি কোন কথা বললে তাকে সরাসরি অস্বীকার করা এঁদের পক্ষে সম্ভবপর ছিলো না। এঁদের মধ্যে সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য হচ্ছেন হযরত খাদীজা (রা)। তারপর হযরত আলী (রা), হযরত জায়েদ (রা), হযরত আবু বকর (রা) প্রমুখের নাম উল্লেখ করা যেতে পারে। আলী (রা) হযরত মুহাম্মদ (স)-এর চাচাত ভাই, জায়েদ (রা) গোলাম এবং আবু বকর (রা) ঘনিষ্ঠ বন্ধু ছিলেন। এঁরা বছরের পর বছর ধরে হযরত মুহাম্মদ (স)-এর সাহচর্য লাভের সুযোগ পেয়েছিলেন। তাই সর্বপ্রথম হযরত খাদীজা (রা) এবং পরে অন্যান্যদের কাছে তিনি তাঁর দাওয়াত পেশ করেন। এঁরাই ছিলেন উম্মতের মধ্যে পয়লা ঈমানদার—ঈমানের আলোয় উদ্ভাসিত প্রথম ভাগ্যবান দল। এঁরা হযরত মুহাম্মদ (স)-এর কথা শুনে সঙ্গে সঙ্গেই তার সত্যতা স্বীকার করেন। এঁদের পর হযরত আবু বকর (রা)-এর প্রচেষ্টায়

হযরত উসমান (রা), হযরত জুবাইর (রা), হযরত আবদুর রহমান বিন আওফ (রা), হযরত সাদ বিন আবী ওয়াক্কাস (রা), হযরত তালহা (রা) প্রমুখ ইসলাম গ্রহণ করেন । এভাবে গোপনে গোপনে ইসলামের দাওয়াত ছড়াতে লাগলো এবং মুসলমানদের সংখ্যাও দিন দিন বৃদ্ধি পেতে লাগলো ৷

কুরআনের অনন্য প্রভাব এ পর্যায়ে কুরআনে যে অংশগুলো নাযিল হয়েছিলো, তা ছিলো আন্দোলনের প্রথম স্তরের উপযোগী ছোট-খাটো বাক্য-সমন্বিত। এর ভাষা ছিলো অতীব প্রাঞ্জল, কবিত্বময় ও হৃদয়গ্রাহী। পরন্তু এতে এমন একটা সাহিত্যিক চমক ছিলো যে, শোনার সঙ্গে সঙ্গেই তা শ্রোতার মনে প্রভাব বিস্তার করতো এবং এক একটি কথা তীরের ন্যায় বিদ্ধ হতো । এসব কথা যে শুনতো তার মনেই প্রভাব বিস্তার করতো এবং বারবার তা আবৃত্তি করার ইচ্ছা জাগতো ।

আকীদা-বিশ্বাসের সংশোধন

কুরআন পাকের এই সূরাগুলোতে তওহীদ ও আখিরাতের তাৎপর্য বর্ণনা করা হচ্ছিলো। এ ব্যাপারে এমন সব প্রমাণাদি পেশ করা হচ্ছিলো, যা প্রতিটি শ্রোতার মনে বদ্ধমূল হয়ে যাচ্ছিলো । এসব দলীল-প্রমাণ শ্রোতাদের নিকটতম পরিবেশ থেকেই পেশ করা হচ্ছিলো। পরন্তু এসব কথা এমন ভঙ্গিতে পেশ করা হচ্ছিলো, যে সম্পর্কে শ্রোতারা পুরোপুরি অভ্যস্ত ও অবহিত ছিলো। তাদেরই ঐতিহাসিক ঘটনাবলী ও ঐতিহ্যের পরিপ্রেক্ষিতে এসব কথা বোঝাবার চেষ্টা করা হচ্ছিলো। আকীদা-বিশ্বাসের যে সব ভ্রান্তি সম্পর্কে তারা ওয়াকিফহাল ছিলো, সেগুলো সম্পর্কেই আলোচনা করা হচ্ছিলো । এ কারণেই খোদার এই কালাম শুনে কেউই প্রভাবিত না হয়ে পারছিলো না । খোদার নবী প্রথমে একাকীই এই আন্দোলন শুরু করেছিলেন। কিন্তু কুরআনের এই প্রাথমিক আয়াতসমূহ এ ব্যাপারে অত্যন্ত কার্যকর হাতিয়ার হিসাবে কাজ করে। ফলে গোপনে গোপনে আন্দোলন অত্যন্ত দ্রুততার সাথে বিস্তার লাভ করতে থাকে ।

এ পর্যায়ে দাওয়াত প্রচারের জন্যে তওহীদ ও আখিরাতের দলীল-প্রমাণের সঙ্গে সঙ্গে প্রথম স্তর :  গোপন দাওয়াত বুয়্যাতের দায়িত্বে অধিষ্ঠিত হবার পর হযরত মুহাম্মদ (স)-এর সামনে প্রথম সমস্যা ছিলো : এক খোদার বন্দেগী কবুল করার ও অসংখ্য মিথ্যা খোদার অস্তিত্ব অস্বীকার করার দাওয়াত প্রথম কোন্ ধরনের লোকদের দেয়া যাবে? দেশ ও জাতির লোকদের তখন যে অবস্থা ছিলো, তার একটি মোটামুটি চিত্র ইতঃপূর্বে পেশ করা হয়েছে। এহেন লোকদের সামনে তাদের মেজাজ, পসন্দ ও অভ্যাসের সম্পূর্ণ বিপরীত কোনো জিনিস পেশ করা বাস্তবিকই অত্যন্ত কঠিন কাজ ছিলো। তাই যে সব লোকের সঙ্গে এতদিন হযরত মুহাম্মদ (স)-এর খুব ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক ছিলো এবং যাঁরা তাঁর স্বভাব-প্রকৃতি ও নৈতিক চরিত্র সম্পর্কে সরাসরি অবহিত ছিলেন, তাঁদেরকেই তিনি সর্বপ্রথম দাওয়াতের জন্যে মনোনীত করলেন। কারণ, এরা হযরত মুহাম্মদ (স)-এর সততা ও বিশ্বস্ততা সম্পর্ক নিঃসংশয় ছিলেন এবং তিনি কোন কথা বললে তাকে সরাসরি অস্বীকার করা এঁদের পক্ষে সম্ভবপর ছিলো না। এঁদের মধ্যে সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য হচ্ছেন হযরত খাদীজা (রা)। তারপর হযরত আলী (রা), হযরত জায়েদ (রা), হযরত আবু বকর (রা) প্রমুখের নাম উল্লেখ করা যেতে পারে। আলী (রা) হযরত মুহাম্মদ (স)-এর চাচাত ভাই, জায়েদ (রা) গোলাম এবং আবু বকর (রা) ঘনিষ্ঠ বন্ধু ছিলেন। এঁরা বছরের পর বছর ধরে হযরত মুহাম্মদ (স)-এর সাহচর্য লাভের সুযোগ পেয়েছিলেন। তাই সর্বপ্রথম হযরত খাদীজা (রা) এবং পরে অন্যান্যদের কাছে তিনি তাঁর দাওয়াত পেশ করেন। এঁরাই ছিলেন উম্মতের মধ্যে পয়লা ঈমানদার—ঈমানের আলোয় উদ্ভাসিত প্রথম ভাগ্যবান দল। এঁরা হযরত মুহাম্মদ (স)-এর কথা শুনে সঙ্গে সঙ্গেই তার সত্যতা স্বীকার করেন। এঁদের পর হযরত আবু বকর (রা)-এর প্রচেষ্টায় হযরত উসমান (রা), হযরত জুবাইর (রা), হযরত আবদুর রহমান বিন আওফ (রা), হযরত সাদ বিন আবী ওয়াক্কাস (রা), হযরত তালহা (রা) প্রমুখ ইসলাম গ্রহণ করেন ।এভাবে গোপনে গোপনে ইসলামের দাওয়াত ছড়াতে লাগলো এবং মুসলমানদের সংখ্যাও দিন দিন বৃদ্ধি পেতে লাগলো ৷

কুরআনের অনন্য প্রভাব এ পর্যায়ে কুরআনে যে অংশগুলো নাযিল হয়েছিলো, তা ছিলো আন্দোলনের প্রথম স্তরের উপযোগী ছোট-খাটো বাক্য-সমন্বিত। এর ভাষা ছিলো অতীব প্রাঞ্জল, কবিত্বময় ও হৃদয়গ্রাহী। পরন্তু এতে এমন একটা সাহিত্যিক চমক ছিলো যে, শোনার সঙ্গে সঙ্গেই তা শ্রোতার মনে প্রভাব বিস্তার করতো এবং এক একটি কথা তীরের ন্যায় বিদ্ধ হতো ।

এসব কথা যে শুনতো তার মনেই প্রভাব বিস্তার করতো এবং বারবার তা আবৃত্তি করার ইচ্ছা জাগতো ।

কুরআন পাকের এই সূরাগুলোতে তওহীদ ও আখিরাতের তাৎপর্য বর্ণনা করা হচ্ছিলো। এ ব্যাপারে এমন সব প্রমাণাদি পেশ করা হচ্ছিলো, যা প্রতিটি শ্রোতার মনে বদ্ধমূল হয়ে যাচ্ছিলো । এসব দলীল-প্রমাণ শ্রোতাদের নিকটতম পরিবেশ থেকেই পেশ করা হচ্ছিলো। পরন্তু এসব কথা এমন ভঙ্গিতে পেশ করা হচ্ছিলো, যে সম্পর্কে শ্রোতারা পুরোপুরি অভ্যস্ত ও অবহিত ছিলো। তাদেরই ঐতিহাসিক ঘটনাবলী ও ঐতিহ্যের

Read More

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked with *

সর্বশেষ পোস্ট

Advertising