এম এ ইউসুফ শামীম : বাংলাদেশের গণতন্ত্রের চূড়ান্ত পরীক্ষা:
বাংলাদেশের বর্তমান রাজনৈতিক পরিস্থিতিতে “শেখ হাসিনার বিচার আগে – তারপর নির্বাচন” স্লোগানটি একটি গুরুত্বপূর্ণ রাজনৈতিক বক্তব্য হিসেবে আবির্ভূত হয়েছে। এই দাবির পেছনে রয়েছে এক দীর্ঘ রাজনৈতিক ইতিহাস, যেখানে স্বেচ্ছাচারিতা, দমন-পীড়ন, নির্বাচন ব্যবস্থার বিকৃতি এবং মানবাধিকার লঙ্ঘনের অভিযোগ রয়েছে। স্বৈরাচারী হাসিনা একের পর এক বিতর্কিত নির্বাচন আয়োজন করেছে, রাজনৈতিক বিরোধীদের দমন করেছে এবং প্রশাসন ও বিচার ব্যবস্থাকে দলীয়করণ করেছে, সেই সরকারের উচ্ছিষ্টভূগীরা যারা আজও দেশের বিভিন্ন সংস্থায় লুকিয়ে আছে , আগে তাদের বিচার করা প্রয়োজন। ফ্যাসিস্ট শেখ হাসিনা ও আওয়ামী লীগের প্রত্যেক আমলা, নেতা, শহর-মহল্লা থেকে শুরু করে গ্রাম-উপজেলা পর্যায়ের রাজনৈতিক ও অরাজনৈতিক সহযোগী, তথাকথিত সুশীল সমাজের সদস্য এবং সকল সহায়তাকারীদের জবাবদিহির আওতায় আনা জরুরি। বিচারের আওতায় আনতে হবে সকলকে—তারপরই নির্বাচন। কারণ, এটিই বাংলাদেশের গণতন্ত্রের চূড়ান্ত পরীক্ষা।
বিচারের দাবি কেন?
বিগত প্রায় ১৭ বছর আওয়ামী দুঃশসাশনে শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন সরকার সম্পর্কে যেসব অভিযোগ প্রমাণিত হয়েছে, তার মধ্যে রয়েছে:
নির্বাচন ব্যবস্থার নিয়ন্ত্রণ: ২০১৪ এবং ২০১৮ সালের জাতীয় নির্বাচন দুইটিই ছিল আন্তর্জাতিক ও অভ্যন্তরীণভাবে বিতর্কিত। বিরোধীদল ছাড়া নির্বাচন, ভোটের আগের রাতেই ব্যালট পূর্ণ হওয়া এবং প্রশাসনের পক্ষপাতিত্ব সাধারণ মানুষের আস্থা নষ্ট করেছে।
বাংলাদেশে মানবাধিকার পরিস্থিতি ভুলন্ঠিত :
বাংলাদেশে গুম, খুন, বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড, ‘আয়না ঘর’ নামক নির্যাতনকেন্দ্র, শাপলা চত্বরে গণহত্যা এবং গুলশানের হোলি আর্টিজানে সংঘটিত নৃশংস সন্ত্রাসী হামলাসহ একাধিক ঘটনা আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে দেশের ভাবমূর্তিকে মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত করেছে। এসব বিষয়ে আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংস্থাগুলো একাধিকবার গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করেছে।
বিডিআর ষড়যন্ত্র কেন্দ্র করে ৫৭ জন সেনা কর্মকর্তার নির্মম হত্যাকাণ্ড, ভারতীয় সন্ত্রাসীদের সরাসরি সহযোগিতায় পরিকল্পিত হত্যাকান্ড যা আন্তর্জাতিকভাবে সমালোচিত হয়েছে।
এছাড়াও, দেশের অভ্যন্তরে বিভিন্ন সময় ভারতীয় মদদপুষ্ট সন্ত্রাসীদের সহায়তায় সৃষ্ট অগ্নিসন্ত্রাস, মসজিদে হামলা, মুয়াজ্জিন ও ইমামদের হত্যা, মাদ্রাসায় গুলি চালনা এবং ইসলামী সংগঠনের নামে সাজানো ‘সন্ত্রাসী পাকড়াও অভিযান ‘ নাটক দেশের ধর্মীয় ও সামাজিক স্থিতিশীলতা হুমকির মুখে ফেলেছে। যার মাধ্যমে সারা বিশ্বে বাংলাদেশকে একটি মুসলিম জঙ্গিবাদে লিপ্ত রাষ্ট্র হিসেবে চিহ্নিত করার অপপ্রয়াস চালানো হয়েছে।
তথাকথিত আল-কায়েদা বা আইএস-এর হুমকি চিঠির গল্প দিয়ে জনগণের মাঝে আতঙ্ক ছড়িয়ে বিরোধী দল দমন নীতিও প্রমাণ করে যে, নিরাপত্তা ব্যবস্থাকে রাজনৈতিক স্বার্থে ব্যবহার করা হয়েছে।
দুর্নীতি ও রাষ্ট্রীয় সম্পদের অপব্যবহার :
দেশীয় ও আন্তর্জাতিক বিভিন্ন সংস্থার তদন্তে প্রমাণিত হয়েছে—সরকারি প্রকল্প, ব্যাংক খাত এবং অবকাঠামো নির্মাণে বিপুল পরিমাণ দুর্নীতি হয়েছে। এসব দুর্নীতির মূল সুবিধাভোগী হয়েছে সরকার-ঘনিষ্ঠ ব্যক্তি ও গোষ্ঠী। বিশেষ করে ফ্যাসিস্ট হাসিনার পরিবারের প্রতিটি সদস্য দেশের সম্পদ লুটে পুটে আমেরিকা, ইংল্যান্ডে,কানাডা, অস্ট্রেলিয়াসহ বিভিন্ন দেশে আলিশান প্রাসাদ গড়ে তুলেছে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের রিজার্ভ চুরি, স্বর্ণ ভান্ডার পাথারে পরিণত , রাষ্ট্রীয় কোষাগার থেকে অর্থ আত্মসাৎসহ একাধিক আর্থিক কেলেঙ্কারি দেশের অর্থনীতিকে দুর্বল করে দিয়েছে।
নিষিদ্ধ আওয়ামী সরকারের কিছু বাহিনীর বিরুদ্ধে সাদা পোশাকে অপহরণ, জুলুম, ধর্ষণ, ডাকাতি ও বেআইনি তল্লাশির অভিযোগ দীর্ঘদিনের। দেশের বিভিন্ন স্থান থেকে তরুণীদের লাশ উদ্ধার, গণধর্ষণের ঘটনা, বাস-ট্রেন-পার্কে সংঘটিত যৌন সহিংসতা সমাজে গভীর অনাস্থার পরিবেশ সৃষ্টি করেছে। এক সময়ে ভারত থেকে আসা কিছু বাক্তিকে এফবিআই সদস্য পরিচয়ে বাংলাদেশের একটি তদন্তে যুক্ত করা হয়েছিল। তবে জনমনে প্রশ্ন রয়েছে—তারা কি প্রকৃতপক্ষে যুক্তরাষ্ট্রের এফবিআই সদস্য ছিলেন, নাকি ভারতের কোনো গোয়েন্দা সংস্থার কর্মকর্তা? জনগণ এ বিষয়ে স্বচ্ছ ও বিস্তারিত তথ্য জানতে আগ্রহী।
এই প্রেক্ষাপটে বলা যায়, দেশব্যাপী মানবাধিকার লঙ্ঘন, রাজনৈতিক নিপীড়ন ও দুর্নীতির বিরুদ্ধে একটি নিরপেক্ষ, আন্তর্জাতিক মানের তদন্ত এবং জবাবদিহি নিশ্চিত করা অপরিহার্য হয়ে উঠেছে।
এই সব অভিযোগের নিরপেক্ষ তদন্ত এবং বিচার না হলে, একটি গ্রহণযোগ্য নির্বাচন যে সম্ভব নয়, তা বাংলাদেশের সাম্প্রতিক ইতিহাসই প্রমাণ। আমি দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করি যে, দেশের গণতান্ত্রিক ও সুষ্ঠু রাজনৈতিক ধারা বজায় রাখতে ‘বিচার আগে, নির্বাচন পরে’ নীতির প্রয়োজনীয়তা বিএনপি ও জামায়াতসহ সকল রাজনৈতিক দল অনুধাবন করবেন।
নির্বাচন কি বিচারকে রুদ্ধ করার কৌশল?
বিএনপি ও জামায়াতের অভ্যন্তরে ভারতের হয়ে কাজ করা কিছু ব্যক্তি—কেউ প্রকাশ্যে, কেউ বা গোপনে—আওয়ামী লীগের এজেন্ডা বাস্তবায়নে প্রতিযোগিতায় নেমেছে। সাম্প্রতিক পরিস্থিতি বিশ্লেষণে মনে হয়, তারা কোনোভাবেই ফ্যাসিবাদী শেখ হাসিনার বিচার কার্যক্রম মেনে নিতে প্রস্তুত নয়। ঠিক যেমন অতীতে অনেকেই চাননি ফ্যাসিস্ট আওয়ামী লীগকে নিষিদ্ধ করা হোক।
তাই এখন সময় এসেছে—ভারতীয় স্বার্থে কাজ করা এসব ব্যক্তির একটি তালিকা প্রস্তুত করার, যারা তড়িঘড়ি করে নির্বাচন চায়। কারণ, তারা মনে করছে নির্বাচন শুরু হলে শেখ হাসিনা ও আওয়ামী লীগের বিরুদ্ধে বিচার প্রক্রিয়া বিলম্বিত বা স্তগিত হতে পারে, যা তারা চাইছে।
আমরা বিশ্বাস করি, একটি গণতান্ত্রিক সরকার প্রতিষ্ঠার জন্য অবশ্যই নির্বাচনের প্রয়োজন রয়েছে। তবে তার আগে দেশের জনগণ ন্যায়বিচার চায়—হাসিনা ও আওয়ামী লীগের ফ্যাসিবাদী অপরাধের বিচার ছাড়া এই দেশে প্রকৃত গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা সম্ভব নয়। যদি এখন বিচার না হয়, তবে হয়তো আর কখনোই তা হবে না।
এই পরিস্থিতিতে “শেখ হাসিনার বিচার আগে”—এই দাবি একটি নৈতিক প্রশ্নও তুলে ধরে: অপরাধের দায় থেকে রেহাই দিয়ে কিভাবে একটি গণতান্ত্রিক নির্বাচন সম্ভব?
রাজনৈতিক ভবিষ্যৎ: বিচার নাকি নির্বাচন?
বাংলাদেশের জনগণ এখন রাজনৈতিক পরিবর্তনের জন্য উদগ্রীব। তারা চায় একটি স্বচ্ছ, দায়িত্বশীল সরকার—যার জবাবদিহিতা থাকবে এবং যারা অপরাধ করলে তাদের বিচার হবে। তাই নির্বাচন আয়োজনের আগে রাষ্ট্রীয় অপরাধের বিচার হওয়া দরকার, যাতে ভবিষ্যতে কেউ ক্ষমতার অপব্যবহার করতে সাহস না পায়।
এখানে কোনো দল বা ব্যক্তিবিশেষকে আক্রমণ করাই উদ্দেশ্য নয়; বরং বিচারহীনতার সংস্কৃতি থেকে বেরিয়ে এসে একটি সত্যিকার গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র গড়ে তোলার আহ্বানই এই স্লোগানের মূল উদ্দেশ্য।
মিডিয়ার লাগাম টেনে ধরা :
ফ্যাসিস্ট শেখ হাসিনা প্রথম দফায় ২০ কোটি এবং পরবর্তী পর্যায়ে আরও ১০ কোটি—মোট ৩০ কোটি টাকা বাংলাদেশের বিভিন্ন গণমাধ্যমে বিতরণ করে একটি বড় অংশকে বশীভূত করতে সক্ষম হয়েছেন। এই সুবিধাভোগী গোষ্ঠী আজও নানা মোড়কে ও কৌশলে শেখ হাসিনার পক্ষে প্রচার চালিয়ে যাচ্ছে। এর ফলে দেশে প্রকৃত বাকস্বাধীনতা ক্ষুণ্ন হয়েছে, অথচ হলুদ সাংবাদিকতার বিপক্ষে কোনো দৃশ্যমান পদক্ষেপ দেখা যাচ্ছে না—বিশেষ করে প্রফেসর ইউনুস সকল মিডিয়াকে বাক স্বাধীনতা দিয়েছেন। বাক স্বাধীনতার নামে ক্ষমতার অপব্যবহার তথা হলুদ সাংবাদিকতা রুখতে সরকারকে আরো সচেতন হতে হবে। ইতোমধ্যে কিছু হলুদ সাংবাদিক নিজেদের অবস্থান পুনর্মূল্যায়ন করে মত পরিবর্তন করতে শুরু করেছেন, যা একটি ইতিবাচক দিক।
এই প্রেক্ষাপটে, একটি স্বচ্ছ, আধুনিক এবং সময়োপযোগী গণমাধ্যম নীতিমালা প্রণয়ন এবং তা বাস্তবায়নের লক্ষ্যে একটি কার্যকর মনিটরিং সেল গঠন অত্যন্ত জরুরি। যাতে ভুয়া, বিভ্রান্তিকর, মনগড়া ও উদ্দেশ্যপ্রণোদিত সংবাদ পরিবেশন বন্ধ হয় এবং নিরপেক্ষ, তথ্যভিত্তিক ও বস্তুনিষ্ঠ সাংবাদিকতা নিশ্চিত করা যায়—যা জনগণের ন্যায্য প্রত্যাশা।
শেষ কথা :
“শেখ হাসিনার বিচার আগে – তারপর নির্বাচন”—এই দাবির পেছনে যে ন্যায়বিচারের আকাঙ্ক্ষা রয়েছে, তা অগ্রাহ্য করা মানে জনগণের ইচ্ছা ও অধিকারকে অস্বীকার করা। একটি ন্যায়ভিত্তিক সমাজ গড়তে হলে বিচার প্রক্রিয়া আগে শুরু হতে হবে। তারপরে নির্বাচনের মাধ্যমে জনগণ সিদ্ধান্ত নেবে কে শাসন করবে। এই ধারাই পারে বাংলাদেশকে একটি সত্যিকারের গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে রূপান্তর করতে।