728 x 90

ধারাবাহিক উপন্যাস: ট্রেন্স থেকে ফিরে এসে

রউফ আরিফ: রোজি তখন ফাষ্ট ইয়ারে পড়ে। দেখতে মোটামুটি সুন্দরী। উজ্জল ফর্সা গায়ের রং। হালকা লতানো শরীর। বেশ লম্বা। মাথায় একমাথা দীর্ঘ কালো চুল। চোখ দুটো টানা টানা। ঠোটের ওপরে একটা কালো তিল। এমন একটা মেয়েকে ভালোবাসতো আলি আরমান। কিন্তু ওদের ভালোবাসায় কোনো রং ছিল না। কারণ, ওরা ছোটবেলা থেকে পাশাপাশি বড় হয়ে উঠেছে। একসাথে

রউফ আরিফ:

রোজি তখন ফাষ্ট ইয়ারে পড়ে। দেখতে মোটামুটি সুন্দরী। উজ্জল ফর্সা গায়ের রং। হালকা লতানো শরীর। বেশ লম্বা। মাথায় একমাথা দীর্ঘ কালো চুল। চোখ দুটো টানা টানা। ঠোটের ওপরে একটা কালো তিল।

এমন একটা মেয়েকে ভালোবাসতো আলি আরমান। কিন্তু ওদের ভালোবাসায় কোনো রং ছিল না। কারণ, ওরা ছোটবেলা থেকে পাশাপাশি বড় হয়ে উঠেছে। একসাথে যেমন খেলাধুলা করেছে। তেমনি ঝগড়া মারামারি করেছে। আবার নিজেরাই তার মিটমাটও করেছে। ফলে তাদের সম্পর্কটাকে ঠিক প্রেম ভালোবাসার ছাদে ফেলা বেশ কঠিন। তবে পরস্পরের প্রতি পরস্পরের যে আলাদা একটা টান আছে তা দু’জনই অনুভব করতো।

পাশাপাশি দুই বাসার বাসিন্দা তারা। দুজনেরই বাবা ডাক্তার। দুই বাড়ির দোতালার ব্যালকুনীতে দাঁড়িয়ে তারা কত খুনসুটি করেছে তার ঠিক নেই। সেই প্রীতিমধুর সম্পর্কে একটা নতুন মোড় নিলো হঠাৎই।

সময়টা উনিশশো একাত্তর সালের এপ্রিল মাস। ঢাকায় তখন পাকিস্তানি সৈন্যদের বর্বর অত্যাচার শুরু হয়ে গেছে। মহল্লার যুবক ছেলেরা সব দলে দলে ইন্ডিয়ায় চলে যাচ্ছে। মুক্তি ফৌজে নাম লেখাচ্ছে।

আরমানও ঠিক করে ফেলল সে মুক্তিফৌজে যোগ দেবে। বিষয়টা নিয়ে তার বাবার সাথে কথা বলল। বাবা বললেন, চলে যা। এখানে থাকলে বাঁচতে পারবি না। পাকসেনারা কাউকেই বাঁচতে দেবে না। দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে বোকার মতো মরার চেয়ে মরতে হলে বীরের মতো যুদ্ধ করে মরবি। দেশের জন্য, জাতির জন্য মরবি।

আলি আরমান বাবা মায়ের এক মাত্র সন্তান। বাবা ঔদত্য কণ্ঠে যুদ্ধে যাওয়ার ঘোষণা দিলেও মা আমতা আমতা করছিল। কিন্তু মায়ের কান্নাকাটিতে আরমান কান দিলো না। সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলল সে যুদ্ধে যাবে।

যেদিন রাত্রে চলে যাবে সেদিন সকালবেলা কথাটা সে রোজিকে জানালো। রোজি ক্ষণকাল আরমানের চোখের পানে চেয়ে থেকে মোলায়েম স্বরে বলল, তাহলে তো একটা কাজ করতে হবে।

-কি কাজ?

-আমাকে একটা চুমু খাওয়ার সখ তোমার। কোনো বেগানা পুরুষের চুমু খাওয়া শরিয়ত বিরুদ্ধ বলে, তোমার সেই ইচ্ছা আমি পূরণ করতে পারিনি। তুমি যুদ্ধে যাচ্ছ, তোমার সেই ইচ্ছাটা তো অপূর্ণ রেখে যেতে দেওয়া যায় না। চলো, আজই আমরা বিবাহ করি, এবং তোমার ইচ্ছা পূরণ করি।

রোজির কথা শুনে আরমান অবাক হয়। তুমি এসব কি বলছ যা তা!

-যা তা হবে কেন?

-বর্তমান সিচুয়েশনে বিবাহ করার কথা মনে আসছে তোমার? আমি তো যাচ্ছি জীবন মৃত্যুর সাথে লড়াই করতে। এই দেখাই আমাদের শেষ দেখা হতে পারে। তা কি জানো?

-জানি। আর জানি বলেই একথা বলছি।

-পাগলামি।

-পাগলামি বলো, আর ছাগলামি বলো, যা ইচ্ছা তাই বলো। কিন্তু আমি জানি, এটাই এখন আমার জন্য বাস্তব। তুমি যুদ্ধে যাবে। দেশের জন্য জীবন বাজি রেখে ফ্রন্টে ফ্রন্টে যুদ্ধ করবে। ফিরে আসবে কি না, তা তোমার নিয়তিই বলতে পারে। এমতাবস্থায় আমার ভালোবাসার মানুষটার কোনো সাধ আমি অপূর্ণ রেখে বিদায় জানাতে পারি না।

-এর পরিণাম কত ভয়াবহ হতে পারে তা ভেবে দেখেছ?

-ভবিষ্যতের ভাবনা ভবিষ্যতের জন্য রেখে দাও। বর্তমানের ভাবনা বর্তমানে ভাবো।

-যদি আর ফিরে না আসি।

রোজি আরমানের মুখে হাত চাপা দেয়। অমন অলক্ষুণে কথা বলো না। আর যদি একান্তই না ফের, বাকী জীবন তোমার স্মৃতি বুকে নিয়ে কাটিয়ে দেবো। একজন মুক্তিযোদ্ধার স্ত্রী হিসাবে গর্ব করে বলতে পারবো, আমার স্বামী যুদ্ধে শহীদ হয়েছে।

রোজির যুক্তি মনে মনে মানতে পারছিল না আরমান। তবে এও ঠিক, রোজির সাথে আরমান কোনোদিন পেরে ওঠেনি। ঝগড়া কলহ যা-ই করুক না কেন, শেষ পর্যন্ত রোজিরই জয় হয়েছে। তবে, আজ সে রোজিকে পাত্তা দিলো না। তুমি যা বলছ, এই অবস্থায় বাড়ির কেউই রাজি হবে না।

-বাড়ির কাউকে জানাবার দরকার নেই। শুধু তুমি আমি জানবো।

-বলো কি! লুকিয়ে বিয়ে! অসম্ভব।

-তাহলে আমাকেও তোমার সঙ্গে নিয়ে চলো।

-তুমি একটা আস্ত পাগল। এই অনিশ্চয়তার মাঝে তোমার মতো একটা মেয়েকে সঙ্গে নিয়ে কোথায় যাবো!

-তাহলে আমি যা বলছি তাই কর।

শেষ পর্যন্ত রোজির কথায় রাজি হতে হলো। রোজির এক বান্ধবীর বাসায় কাজী ডেকে ওরা বিবাহ রেজেস্ট্রি করে ফেলল। তাদের এই বিয়ে বাসায় কেউ জানলো না। তবে একটা কাজ হলো, আরমান যে দলের সাথে ভারতে যাওয়ার প্রোগ্রাম করেছিল, পথ ঘাটের অসুবিধার কারণে একসপ্তাহ পিছিয়ে গেলো। এই এক সপ্তাহ যতটা সম্ভব ওরা কাছাকাছি থাকার চেষ্টা করলো।

আরমান যুদ্ধে চলে গেলো। রোজি খুব মন মরা হয়ে রইলো। ওর কেনোকিছুই ভালো লাগতো না। আরমানের কোনো সংবাদও সে পেতো না। আরমানের সাথে যুদ্ধে গিয়েছিল রোজির মেজ ভাই নজরুল। তারও কোনো সংবাদ পাওয়া যাচ্ছিল না।

যুদ্ধের উত্তাল সময়গুলো ওদের কাটলো অন্যরকম উত্তেজনায়, জীবন মৃত্যু হাতের মুঠোয় নিয়ে। তারপর স্বাধীনতার রক্তিম সূর্য উঠলো দেশের ভাগ্যাকাশে।

বীরের তাজ মাথায় নিয়ে ফিরে এলো আরমানরা। আরমান বাড়ি ফিরে দেখল তার বাবা মাকে পাকিস্তানি বর্বররা হত্যা করেছে। আরমান যে স্বপ্ন নিয়ে যুদ্ধে গিয়েছিল, নয়মাস যুদ্ধ করেছিল, সে স্বপ্ন তার চোখ থেকে মুছে গেছে। দেশ স্বাধীন হয়েছে। ঘরবাড়ি ছাড়া মানুষেরা আবার সব ঘরে ফিরতে শুরু করেছে। কিন্তু ঢাকা শহর তখন প্রায় মৃতের শহর। যেদিকে চোখ যায় চোখে পড়ে ভাঙ্গাচোরা বাড়ি আর ক্ষুধাতুর মানুষের শ্রীহীন মুখের মিছিল।

কল কারখানা আছে কিন্তু মেসিনপত্র নেই। প্রডাকশন চালানোর রসদ নেই। ওরা সরকারী বাড়িতে থাকত, বাবা মারা যাওয়ায় সেই বাড়িতে থাকার পারমিশনও নেই। ব্যাংকে বাবার যেসব টাকা পয়সা ছিল সেই ব্যাংক ধ্বংস হয়ে গেছে। ব্যাংকের কাগজপত্র নষ্ট হয়ে গেছে।

এক কথায় আলি আরমান পথের ভিখারি হয়ে গেছে। আরমানের মামা বাড়ি কোলকাতায়। শেষ পর্যন্ত ঠিক করলো সে আবার কোলকাতায় ফিরে যাবে। কারণ, ঢাকায় তার একদম মন বসছিল না। তার সিদ্ধান্তের কথা রোজিকেও জানালো। বলল, আমাদের বিয়ের কথাটা বাড়িতে জানিয়ে দাও। চলো, আমরা কোলকাতায় চলে যাই। সেখানে আমার মামারা আছে, চাচারা আছে। বাবার কিছু বিষয় আশয় আছে। সেখানে গেলে অন্তত না খেয়ে মরবো না।

রোজি বলল, না। এখনি একটা বাড়তি ঝামেলা তোমাকে ঘাড়ে নিতে হবে না। তার চেয়ে তুমি একা যাও। আগে সেখানকার পরিবেশ পরিস্থতি আয়ত্বে আনো। যদি ভালো মনে কর তাহলে আমাকে নিয়ে যেও। আমিও এদিকে চাকরি বাকরির চেষ্টা করবো। যদি সুইটেবল কিছু মিলে যায় তাহলে আমরা ঢাকাতেই থাকবো।

-ঠিক আছে। তুমি যখন বলছ তখন তাই হবে।

২.

আরমানের বিরহে রোজির দিনকাল মোটেও ভালো যাচ্ছিল না। আরমান ঢাকা ছাড়ার পরে রোজি খুব একা হয়ে যায়। একমাস দুই মাস তিন মাস পার হয়ে যায় আরমানের কোনো চিঠিপত্র আসে না। রোজি ভেবে পাচ্ছিল না, আরমান হঠাৎ এমন নিখোঁজ হয়ে গেলো কিভাবে। সে যেখানে থাকুক, যে অবস্থায় থাকুক চিঠি লিখতে তার তো কোনো অসুবিধা থাকার কথা নয়।

সব চিন্তা ভাবনার অবসান ঘটিয়ে শেষ পর্যন্ত আরমানের চিঠি এলো। আরমানের চিঠি পেয়ে রোজির অবস্থা হলো এরকম, বর্ষার মাতাল মেঘ সরে গিয়ে যেমন শরতের নির্মল তারা ভরা আকাশ বেরিয়ে আসে, তেমনি রোজির অন্তরাকাশ থেকেও নিরাশার গুমোট আবহাওয়া বিদায় নিলো। মনের অলিতে গলিতে জমে ওঠা দুশ্চিন্তার জঞ্জাল পচে যে দুষিত পরিবেশ সৃষ্টি করেছিল, তা আস্তে আস্তে শুকিয়ে গেলো। সৃষ্টি হলো উর্বর পলিমাটি। মাথা তুলে জেগে উঠল নতুন ঘাসের সবুজ গালিচা। বুনোফুলে গন্ধ ছড়ালো। ভোরের পাখিরা প্রভাতি গান গাইলো। সকালটাকে অর্থবহ মনে হলো রোজির কাছে।

আরমানের একখানা চিঠিই রোজির ভেতরে বাইরে যে পরিবর্তন এনে দিলো, তা তার পরিজনদের অনেকেরই নজর এড়ালো না। বিশেষ করে তার বড় দুই বোনের। আরমান লিখেছে, কোলকাতায় তার চাচাদের সাথে বেশ ঝামেলা হচ্ছে। বাবার যেসব জমাজমি চাচারা ভোগ দখল করছিল, তারা তা এখন ছাড়তে চাইছে না। নানা রকম টাল বাহানা করছে। তাই সে ঠিক করেছে এখানকার সব বিষয় আশয় বিক্রি করে দিয়ে ঢাকায় ফিরে আসবে।

এখন সমস্যা হচ্ছে এইসব ঝামেলা শেষ করতে তার আরও বেশ কিছুদিন এখানে থাকতে হবে। সে জন্য যেন রোজি মন খারাপ না করে।

আরমানের এই চিঠি রোজির জন্য দারুন সুখবর। কিন্তু রোজি পড়েছে আরেক ঝামেলায়। যদিও বিষয়টা এখনো বাসায় জানাজানি হয়নি, কিন্তু আর বেশিদিন চেপে রাখা যাবে না।

সে মা হতে চলেছে। এই কথাটা বাসায় জানাজানি হওয়ার আগে আরমানকে জানানো দরকার। 

রোজির চিন্তায় ছেদ পড়ল। হন্তদন্ত হয়ে ঘরে প্রবেশ করল বড় আপা। নিলুফা ইয়াসমিন। তার হাতে মিষ্টির বাকস। নে হা কর। আ-হা, তাড়াতাড়ি কর।

রোজি হা করতে করতে জিজ্ঞাসা করে, এই অসময়ে কিসের মিষ্টি?

-তোর দোলাভাই এসেছে।

-ও! তাই বল।

-আমরা সিনেমায় যাচ্ছি, তুই যাবি আমাদের সাথে?

-না। আমার ভালো লাগছে না। তোরা যা।

বড়আপা রোজির দিকে তেরছা নয়নে চেয়ে বলে, ভালো লাগছে না বলেই তো যেতে বলছি। সারাক্ষণ ঘরে বসে থাকলে কি কারো ভালো লাগে। তার চেয়ে চল, বাইরে বের হলে মনটা ফুরফুরে হবে।

-রাগ করিস না বড়আপা। আমার শরীরটা ভালো নেই।

বড়আপা এবার রোজির পাশে বসে পড়ে। আচ্ছা, ঠিক করে বল তো, তোর কি হয়েছে?

-আমার যা হয়েছে তা এখন আমি কারো কাছে বলতে পারছি না। তবে তোকে সব বলবো। জীবনে কোনো কিছুই তোকে আমি লুকাইনি। এখন একখানে যাচ্ছিস, যা। পরে এ বিষয়ে তোর সাথে আলাপ করবো।

-এরকম রহস্যময়তার মধ্যে থাকলে আমার ভীষণ টেনশন হয়। এখনি বলনা।

-আমার কথা শুনে রেগে উঠবি না তো?

-না না, রাগ করবো কেন?

-রাগ করার মতো কথা যে।

নিলুফা ইয়াসমিনের চোখ ছোট হয়ে যায়। তোর কথা আমি ঠিক বুঝলাম না।

-না বোঝারই তো কথা।  শোন আপা, আমি মা হতে চলেছি।

-বলিস কি! বড় আপার মাথায় যেন বজ্রপাত হলো। কতদিন হচ্ছে?

-চার মাস।

-ব্যাপারটা ঘটলো কি করে? কে ঘটালো?

-আরমান।

-আরমান! আরমানকে তো খুব ভালো ছেলে বলেই জানতাম।

-তার কোনো দোষ নেই।

-বিষয়টা বাড়িতে জানাজানি হলে তোকে তো আস্ত রাখবে না। এখন উপায়?

-আমিও তো সেইটা ভাবছি। আরমান এদেশে থাকলে কোনো সমস্যা হোতো না।

-সমস্যা হোতোনা মানে!

-আমি অন্যায় বা অবৈধ কিছু করিনি। আজ থেকে প্রায় দেড় বছর আগে আমরা বিয়ে করেছি।

-বিয়ে করেছিস? তোরা নিজেরা। রোজির কথা লিলুফা বিশ্বাস করতে পারছিল না। কারণ, তার এই সাদাসিধা ছোট বোনটি যে এমন কাজ করতে পারে তা তার কল্পনারও অতীত। আচ্ছা, তোরা যে বিয়ে করেছিস এটা আর কেউ জানে? ডকুমেন্টারী কিছু আছে?

-হা। আমাদের বিয়ে কাজী আফিসে রেজিস্ট্রি করে হয়েছে। কাগজপত্র সব আমার কাছে আছে।

লিলুফা কিছুক্ষণ থম মেরে বসে থেকে বলল, কাজটা তুই ভালো করিসনি রোজি। তুই ছিলি আমাদের সকলের আদরের। মা বাবাও তোকেই বেশি স্নেহ করেন। তুই তাদের কথা একবারও না ভেবে এমন একটা কাজ করে বসলি। ঠিক আছে, তুই মন খারাপ করিসনে। আমি মাকে সব বুঝিয়ে বলবো। তোর এই অবস্থার কথা আরমান কি জানে?

-না।

-ওকে জানাসনি কেন?

-ইচ্ছা করেই জানাইনি। ভাবছিলাম, বেচারা এমনিতেই বেশ ঝামেলায় আছে।

-পরিস্থিতি যাই হোক, বিষয়টা তাকে জানানো উচিত। মানুষের মন, কিছু বলা যায় না। বেশি দেরি হলে উল্টো পাল্টা কিছু ভেবে নিতে পরে। তখন সমস্যা আরও বাড়তে পারে।

-ঠিক আছে। ওকে কালই চিঠি লিখবো।

লিলুফা আর বসল না। মিষ্টির ঠোঙ্গা হাতে নিয়ে বেরিয়ে গেলো। যাবার আগে বলল, তাড়াতাড়ি গুছিয়ে নে। আমদের সাথে সিনেমায় যাবি। এই পৃয়ডে মেয়েদের একটু বেশি হাটা চলা করতে হয়। তা না হলে নানা ধরনের জটিলতা দেখা দিতে পারে।

বড়আপা ঘর থেকে বেরিয়ে গেলে সে চিন্তা করতে লাগল, এখন সে কি করবে। বড় আপার সাথে না গেলে সে মাইন্ড করবে। না, বড় আপাকে চটানো যাবে না। এই দুঃসময়ে বড় আপাই তাকে সবচেয়ে বেশি সাহায্য করতে পারে।

রোজি বিছানা থেকে নামলো। প্রথমে ভাবলো সালোয়ার কামিজ পরবে। কিন্তু পেটের স্ফিতি তাকে মত বদলাতে বাধ্য করলো। সালোয়ার কামিজ ছেড়ে শাড়ি ব্লাউজ পরলো। সব কিছু ম্যাচিং করে পরতে তার বেশ সময় লেগে গেলো। রোজি পোশাক পরিচ্ছদের ব্যাপারে বেশ খুতখুতে স্বভাবের মেয়ে। যতক্ষণ তার পছন্দ মতো না হয় ততক্ষণ সে একটার পর একটা বদলাতে থাকে।

রোজি নিচে নেমে এলে লিলুফা তাকে মৃদু ভৎসনা করলো। তোর এত সময় লাগল? ছবি তো শুরু হয়ে যাবে।

আপার ধমক খেয়েও রোজি রাগ করলো না। মৃদু হেসে বলল, রাগ করছিস কেন? আমি কি রেডি হয়ে বসে ছিলাম যে ডাকামাত্র নিচে নেমে আসবো। দুলাভাইকে সেলাম জানিয়ে বলল, মেজো আপাকে দেখছি না, সে যাবে না?

বড় আপা তাচ্ছিল্যের সঙ্গে বলল, কোন বন্ধুর বাড়ি যাবার নাম করে বেরিয়েছে এখনো ফেরেনি।

রোজি ঠোট ওলটালো। চোখে মুখে ঝলকে উঠল এক পশলা রহস্যময় হাসি। বলল, বন্ধুর বাড়ি না ছাই। দেখগে রমনা পার্কে অথবা সরওয়ার্দি উদ্যানের কোনো ঝোপের পাশে বসে আকবরের সাথে পিটিস পিটিস করছে।

-তোর মাথা।

-তুই তো চিরকাল আমাকে ধমক ধামক দিয়ে থামিয়ে দিলি। অথচ এই অধমের কথাগুলো দুদিন যেতে না যেতেই সত্যি বলে প্রমানিত হয়।

-ওকে হিংসা করা তোর একটা স্বভাবে দাঁড়িয়ে গেছে। বড় আপার কণ্ঠে বিরক্তির ছাপ।

-স্যরি আপা, আমাকে এভাবে আন্ডারস্টিমেট করা তোর ঠিক হলো না। সে আমার বোন, তাকে আমি হিংসা করতে যাবো কেন? তবে সে আমাদের গোপন করে এই যে কাজটা করছে, এটা আমার ভালো লাগে না। আমাকে না বলুক, অন্তত তোকে সবকিছু বলা উচিত।

-হয়তো লজ্জা পায়। বড়বোন বলে সম্মান করে, কিছুটা ভয়ও করে। যেহেতু রক্ষণশীল পরিবারের সন্তান আমরা।

দুলাভাই রোজির মুখের দিকে চেয়েছিল। তার চোখে মুগ্ধতা। রোজির পরনে আজ সাদা পোশাক। শাড়ি ব্লাউজ থেকে শুরু করে সব কিছু। ফলে ভেতরের অর্ন্তবাস পর্যন্ত স্পষ্ট ফুটে উঠেছে। চুলগুলো ঢিলা করে বিনুনি গাথা। পিঠের ওপরে সাপের মতো ঝুলে আছে। কানে ঝুরি দেওয়া দুল, নাকে পাথর বাসানো নাকফুল। মুখে কোনো প্রসাধন নেই। ওর এই একটা বিশেষ বৈশিষ্ট। কখনো কোনো প্রসাধনী ব্যবহার করে না। এই ব্যাপারে বোনেরা কোনো কথা বললে, আল্লাহ যে চেহারা দিয়েছে, তার ওপরে ঘষামাজা করে কোনো লাভ নেই।

ওর এই সিম্পল বেশবাসই ওকে যেন বেশি সুন্দরি করে তুলেছে। দোলাভাইকে মুগ্ধদৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকতে দেখে রোজি দোলাভাইয়ের নাক ধরে আলতো টান দিয়ে বলল, অত লোভ কেন মিয়া? বড়বোন থাকতে ছোটবোনের দিকে নজর দিলে বড়বোন তো চটবেই, ছোটবোনও কলা দেখাবে। তখন একুল ওকুল দুই-কুলই হারিয়ে পথে পথে কেঁদে বেড়াতে হবে। সে খেয়াল আছে?

রোজির কথায় টুকু হোহো করে হেসে উঠল। হাসি থামিয়ে বলল, না তাকিয়েই বা করি কি। শালীকে যা দেখাচ্ছে তাতে দোলাভাইয়ের নোলার জল ঠেকিয়ে রাখাই মুশকিল।

-ভালো দেখাচ্ছে বলেই অমন হাভাতের মতো চেয়ে থাকলে নোলা কেটে দেবো। যাতে আর জল না পড়ে।

টুকু চাপা গলায় গান ধরে দিলো, ‘তুমি সুন্দর তাই চেয়ে থাকি প্রিয়া। সে কি মোর অপরাধ।’

লিলুফা স্বামীকে ধমক দিলো, এই কি শুরু করলে? থামো।

রোজি বলল, দোলাভাই তুমি পিছনের সিটে আমার বোনটার পাশে বসে তার মান ভাঙ্গাতে থাকো। আমি ড্রাইভ করছি।

-পারবে তুমি?

রোজি কাঁধ ঝাকিয়ে বলল, এই বাড়িতে যে কটা মেয়ে বা মহিলা আছে তার মধ্যে এই যোগ্যতাটা আমারই আছে। বৈধ লাইসেন্সসহ।

-তাই নাকি! কনগ্রাচুলেশসন।

৩.

প্রতিদিন ঝড় আসে। ভাগ্যের উঠোনে নানা রকম জঞ্জাল জমে। লন্ডভন্ড করে দিয়ে যায় গোছানো স্বপ্নগুলো। সময়ের সাথে সাথে নিজেকে গুছিয়ে তোলার কাজটি সবাই সুচারু রূপে সম্পন্ন করতে পারেনা। যেমন পারছে না রোজি। বাড়িতে বিষয়টা প্রকাশ হওয়ার সাথে সাথে সে একটা বিশাল প্রতিকুলতার মুখোমুখি হয়েছে।

গতরাতে লিলুফা তার মাকে রোজির মা হওয়ার কথা জানিয়েছে। মা তখনি রোজির মুখোমুখি হয়েছে। রোজি এসব কি শুনছি? তোর বড় আপা যা বলল, তা কি সত্যি?

-হাঁ মা।

মা রোজির আপদমস্তক অবলোকন করে অনেকটা স্বগোতুক্তির মতো বলল, নির্বোধ। আমি একটা মহা নির্বোধ। তা না হলে, এত বড় একটা বিষয় আমার নজর এড়িয়ে যেত না। মা হিসাবে, সত্যিকার অর্থে, সঠিকভাবে আমার দায়িত্ব-কর্তব্য সম্পর্কে আমি সচেতন নই। আমি একজন অপদার্থ মা।

-এসব তুমি কি বলছ মা?

-নিজের এবং পরিবারের এত বড় একটা সর্বনাশ করার আগে একবারও ভাবলে না তুমি?

-শোনো মা। আমি যে অন্যায় করেছি সেটা পরিবেশ পরিস্থিতির শিকার হয়ে। যে পরিবেশে আমি আরমানকে বিয়ে করেছিলাম, ওই সময়ে তোমাদের গোচরে আনলে, আমার অন্তরের ইচ্ছাকে তোমরা সফল হতে দিতে না।

-তোমরা বিয়ে করেছ তার প্রমান কি?

-বিয়ের সমস্ত কাগজপত্র আছে আমার কাছে।

-দেখাতে পারবে?

-অবশ্যই। মা তোমার বোঝা উচিত, আমি কখনোই তোমার সাথে মিথ্যা বলি না।

-সে বিশ্বাস তুমি নিজেই নষ্ট করে ফেলেছ। তাই আমি তোমার কাগজপত্রগুলো দেখতে চাই।

-দেখতে ইচ্ছা হলে দেখ। রোজি তার বিয়ের কাবিননামা মায়ের হাতে দিলো। কাবিননামার ওপরে নজর বুলিয়ে মায়ের কপালে যে কুঞ্চন রেখা ফুটে উঠলো সেটা রোজির একেবারোই অপরিচিত। রোজি তার প্রকৃত পাঠোদ্ধার করতে পারলো না।

মা কাবিননামাটা হাতে নিয়ে কিছুক্ষণ চুপ করে দাঁড়িয়ে রইলেন। হয়তো কিছু ভাবলেন। তার ভাবনাটা এইরকম হতে পারে যে, রোজি একটা রক্ষণশীল পরিবারের মেয়ে হয়ে তাদের অপত্য স্নেহের সুযোগ নিয়ে এভাবে নষ্ট হয়ে গেলো! যা তিনি মা হয়ে জানতে পারলেন না। অথচ তিনি এতদিন বুক ফুলিয়ে বলে এসেছেন, তিনি তার ছেলেমেয়েদের যথেষ্ট বোঝেন। তার চোখকে ফাঁকি দিয়ে তারা কোনোকিছু করতে পারে না। তার সেই অহংকরে রোজি কুঠারাঘাত করেছে।

তবে মায়ের মনে একটাই সান্ত্বনা যে, তার মেয়ে অবৈধ পথে পা বাড়ায়নি। সে  অন্তত ধর্মীয় বিধি-মোতাবেক আরমানকে বিয়ে করে, নিজের জৈবিক ক্ষুধা মিটিয়েছে। কাবিননামা হাতে নিয়ে মা নিজের ঘরে গেলো। বাবা সেখানে মায়ের অপেক্ষা করছিল। প্রচন্ড রাগি মানুষ তিনি। তিনি তার ছেলেমেয়েদের স্বাধীনভাবে বেড়ে ওঠার সুযোগ দিয়েছেন। যেটা তার পারিবারিক নিয়ম বহির্ভূত।

তারপরও দিয়েছেন, এই জন্য যে, তিনি তার বাচ্চাদের সেইসব আন্ধা কানুন অনুস্মরণ করে মেয়েদের ঘরের চার দেওয়ালের মধ্যে গন্ডিবদ্ধ করে রেখে, তাদের প্রতিভা বিকাশে বাধা সৃষ্টি করতে চাননি। তিনি চেয়েছেন, শিক্ষার আলোকে আলোকিত করে, প্রাগঐতিহাসিক নারী সমাজ থেকে বের করে আনতে।

তার প্রতিটা সন্তান সমাজে মাথা উচু করে চলুক। দেশ ও জাতির উন্নয়নে ভূমিকা রাখুক। অথচ সেই সন্তানদের একজন তার মাথাটা এভাবে নিচু করে দিলো। এটা তিনি কি করে মেনে নেবেন?

নিজে ডাক্তার। প্রথিতযশা ডাক্তার। মেয়ের এমন অধঃপতনের কথা জানাজানি হলে, তিনি কি করে সমাজে মুখ দেখাবেন। সবাই ভাববে ডাক্তার খলিলুর রহমানের মেয়ে কুমারী অবস্থায় গর্ভবতী হয়েছে। ছি ছি! কি লজ্জা!

ডাক্তার খলিলুর রহমানের চিন্তায় হোঁচট খেলো।

রোজির দেওয়া কাবিননামা স্বামীর হাতে তুলে দিলেন আফরোজা বেগম। ডাক্তার খলিল অনেকক্ষণ কাবিননামা খানা ঘুরিয়ে ফিরিয়ে উল্টে পাল্টে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে পরীক্ষা করলেন।

-সবই তো ঠিক আছে বানু। কিন্তু এইকথা সমাজের লোকদের বোঝাবে কি করে? সবাই ভাববে ডাক্তার খলিল তার মেয়ের অধঃপতনের কেচ্ছা ঢাকবার জন্য এই রকম একটা নাটক তৈরী করেছে।

-তাহলে এখন কি করবে?

-তাই তো ভাবছি। একটা কাজ করলে হয় না।

-এ্যাবরশনের কথা বলছ?

-হাঁ।

-সেটা কি ঠিক হবে? ভ্রুণ হত্যা মহা পাপ।

-জানি। কিন্তু এই ছাড়া আমি তো আর কোনো পথ দেখছি না।

-অধৈর্য হোয়ো না। বিপদে মাথা ঠান্ডা রেখে কাজ করতে হয়। ধৈয্য ধর, দেখবে আল্লাহ তালা কোনো না কোনো পথ বাতলে দেবেন।

-সবই ঠিক আছে। তারপরও আমি কোনো কিছুই ভেবে স্থির করতে পারছি না। আমার সব কিছু গোলমাল হয়ে যাচ্ছে।

ডাক্তার খলিল অস্থিরভাবে পায়চারি করতে থাকেন। তার অস্থিরতা, উৎকণ্ঠা আফরোজা বেগমের হৃদয়ে ঝড় তোলে। খুব ছোটবেলায় আফরোজা বেগম এই মানুষটার ঘরে এসেছে। নানা ঘাত প্রতিঘাতের মধ্যদিয়ে এতটা বছর কাটিয়েছে। তবে মানুষটাকে কখনো এতটা বিচলিত হতে দেখেনি।

পায়চারি থামিয়ে ডাক্তার খলিল আফরোজা বেগমের মুখোমুখি দাঁড়ায়। ক্ষীণকণ্ঠে বলে, বানু তুমি মেয়েটাকে আরেকটু বোঝাও। দেখ রাজি করাতে পারো কি না।

আফরোজা বেগম স্বামীর মুখের পানে ফ্যাল ফ্যাল করে চেয়ে থাকে। ডাক্তার খলিল জিজ্ঞাসা করে, নিলুর মা, তুমি কিছু বলো। অমন চুপ করে থেকো না।

-আমি ভাবছি অন্য জিনিস।

-কি ভাবছ?

-এ্যাবরশন করার মতো পরিস্থিতি আর নেই।

-কেন?

-পাঁচ মাস অলরেডি পার হয়ে গেছে। এ অবস্থায় এ্যাবরশন করাতে গেলে মেয়েটার জীবনের ঝুকি এসে যাবে।

-তাহলে কি করবে?

-রোজিকে বলি। আরমান আসুক। ওকে নিয়ে যাক। রোজি আমাদের কাছে না থাকলে বিষয়টার গুরুত্ব কমে যাবে। এই নিয়ে তখন আর কোনো ঝামেলা হবে না। তাছাড়া আরমান তো ছেলে হিসাবে মোটেও খারাপ না। সে তো আমাদের হাতের ওপরেই বড় হয়েছে। লেখাপড়ায়ও সে খুব ভালো ছিল। ওর রেজাল্ট ভালো। ইন্ডিয়ায় ওর চাচারা থাকে। সেখানে ওদের অনেক জমাজমিও আছে। সে এখন সেই জমিজমা উদ্ধারের চেষ্টা করছে।

-তাহলে তুমি বলছ বিষয়টা নেগেটিভ হিসাবে না নিয়ে পজেটিভলি চিন্তা করবো?

-সেটা করলেই বোধহয় ভালো হয়।

-ঠিক আছে। এ ব্যাপারে আমি তোমাকে কোনো সাহায্য করতে পারবো না। তোমার ছেলেরা আছে। জামাই আছে, তাদের নিয়ে যা ভালো বোঝ তাই কর।

-ঠিক আছে। তুমি মাথা ঠান্ডা করে নিজের কাজ কর। রোজির বিষয়টা আমিই সামলাবো।

৪.

শেষ বিকেলটা অন্ধকারে ভরে আসছিল। দুপুরের পর থেকেই আকাশ মেঘলা। মাঝে মাঝে দলছাড়া মেঘেরা উড়ে যাচ্ছিল উচু উচু বাড়িগুলোর মাথা ছুয়ে। অথচ এখন বৃষ্টির সময় নয়। কার্তিকের শেষ। আর কিছুদিন পরেই হাড় কাঁপানো শীতের বাতাস উড়ে এসে ঢুকে যাবে অস্তিমজ্জায়।

দক্ষিণের জানালা খুললে অনেকটা দূর পর্যন্ত দেখা যায়। এখান থেকে সোজা বড় রাস্তার সংযোগস্থলের তেমাথা পর্যন্ত। রোজি জানালার ধারেই বসেছিল। রোজকার মতো এই ঘর, এই জানালা, সামনের ওই অনন্ত নীলাকাশ, এই হলো রোজির পৃথিবী।

নিজের অভ্যন্তরে বাচ্চাটা যত বড় হচ্ছে, রোজি নিজেকে লোকালয় থেকে ততটাই গুটিয়ে নিচ্ছে। কারণ, সে চায় না তাকে নিয়ে এই পাড়ায় মুখরোচক গছিপ তৈরী হোক। বাবা মা ভাই বোনদের কারো সামনে প্রতিবেশিরা নাক উচিয়ে কথা বলুক।

হঠাৎই ঝমঝম করে বৃষ্টি এলো। এই ধরনের বৃষ্টির সময়ে সাধারণত মনটা উদাস হয়ে যায়। কোনো কিছুই গভীরভাবে যেমন ভাবা যায় না, তেমনি কোনো কাজও করা যায় না। রোজির মধ্যেও তেমনি বাউল বাউল উদাসীনতা ভর করেছিল। ওর মনে কোনো কিছুই তেমন স্পষ্ট ছাপ ফেলছিল না।

ওর পেছনে এসে দাঁড়ালো লিলুফা। লিলুফার মুখটা বেশ থমথমে। রোজি তার বড় আপার মুখের দিকে চেয়েই বুঝে ফেলল কেউ তাকে বকাঝকা করেছে। সে লিলুফাকে জিজ্ঞাসা করল, কি হয়েছে বড় আপা?

-শোন। তুই কালই আমার সাথে সিলেটে চলে যাবি। ঠিক আছে?

-কালই! কেন?

-আব্বা ভীষণ ক্ষেপেছে। তোর বাচ্চা হওয়ার দিন ঘনিয়ে আসছে, অথচ আরমানের কোনো খোঁজ নেই, শুধু চিঠি লিখেই দায় সারছে, এটা আব্বা মেনে নিতে পারছেন না।

রোজি কোনো কথা বলে না। শুধু একটা গভীর দীর্ঘনিশ্বাস ত্যাগ করে, ও-হ। রোজিকে চুপ করে থাকতে দেখে লিলুফা জিজ্ঞাসা করে, কি হলো, কথা বলছিস না কেন?

– কি বলবো। পরিস্থিতি এখন আমার প্রতিকুলে। লড়াইটা কীভাবে করবো তাই ভাবছি।

লিলুফা আর কিছু না বলে কিছুক্ষণ চুপ মেরে বসে থেকে উঠে চলে গেলো। বড়আপা ঘর ছেড়ে চলে যাবার পরে রোজি আবার জানালার সামনে এসে দাঁড়ালো। বাইরে খোলা আকাশ যেন গলাছেড়ে কাঁদছে। তার চোখের অশ্রু ঝরছে ফোটায় ফোটায়। রোজির বুকের মাঝেও এমন এক আবেগ উথাল পাথাল দিয়ে উঠল যে, সে আর চোখের পানি ধরে রাখতে পারল না। সেখানে দাঁড়িয়ে একা একা নীরবে চোখের জল বিসর্জন করলো। আরমানের ওপরে প্রচন্ড অভিমানে ভরে গেলো মন। ভাবতে লাগলো এমন বিপদের মাঝে ঠেলে দিয়ে কেমন নির্বিকার হয়ে আছে সে। কিভাবে আছে?

এদিকে বাবা মা যা করছে, তাদের দিক থেকে সেটাই করা উচিৎ। আরমান কাছে থাকলে এটা হোতো না। সবাই জানতো আমরা বিবাহিত। আমরা স্বামী-স্ত্রী। আমাদের ঘরে সন্তান আসবে এটাই ন্যাচারাল। রোজি মনে মনে সিদ্ধান্ত নিলো যে, এই অবস্থায় সে তার বড় আপার শ্বশুর বাড়িতে যাবে না। যাবে নিজের শ্বশুর বাড়িতে।

পরদিন সকালে উঠে সত্যি সত্যিই রোজি তার নিজের অতি প্রয়োজনীয় জিনিসপত্রসহ জামাকাপড় গুছিয়ে নিলো। ডাক্তার খলিল ড্রয়িংরুমে বসে খবরের কাগজ পড়ছিল। ব্রিফকেস হাতে তার সামনে গিয়ে দাঁড়ালো। বাবা একপলক তার দিকে চেয়ে চোখ নামিয়ে নিলো।

ডাক্তার খলিল তার এই মেয়েটাকেই সবচেয়ে বেশি ভালোবাসে। মেয়েটার অনেক গুণ ছিল। ছোটবেলা থেকেই সে লেখাপড়ায় যেমন মেধাবী তেমনি সুন্দর গান গাইতে পারতো। ওর গানের গলা এত ভালো যে বন্ধুরা অনেকেই বলেছে ওকে গান শেখাতে। কিন্তু ডাক্তার খলিল নিজের মনের কাছে সায় পায়নি।

ডাক্তার খলিল গোড়া মুসলিম পরিবারের ছেলে। তাদের পরিবারের মেয়েরা কখনো পর্দার বাইরে যায়নি। ধর্মীয় শিক্ষা ছাড়া স্কুল কলেজে লেখাপড়ার সুযোগও পায়নি। ডাক্তার খলিল নিজ দেশগ্রাম ছেড়ে এই সিটিতে এসে সেই দেয়াল টপকাতে পারলেও একেবারে ভিত উপড়ে ফেলতে পারেনি।

রোজি বাবার মুখের পানে চেয়ে বলল, আব্বা, আমি তোমাদের অনেক কষ্ট দিয়েছি। তোমাকে না জানিয়ে আরমানকে বিয়ে করেছি। আমি জানি, তাতে তুমি খুব কষ্ট পেয়েছ। তবে একটা জিনিস জেনো, আমি নিজের কাছে স্বচ্ছ থাকতে, আল্লাহর নির্দেশিত পথ থেকে বিচ্যুত না হয়ে ইসলামী বিধান মতেই আরমানকে আমি স্বামী হিসাবে বরণ করে নিয়েছিলাম। তখন সে যুদ্ধে যাচ্ছিল। আমাকে একটা চুমু খেতে চেয়েছিল। আমি ওকে প্রচন্ড ভালোবাসি। আর আমার সেই ভালোবাসার ভিত রচিত হয়েছিল পারিবারিকভাবেই। তোমরাই আমাকে আশ্বস্ত করেছিলে। নানা সময়ে নানাভাবে মায়ের মুখে শুনেছি তোমরা আমাকে আরমানের সাথেই বিয়ে দেবে। আমার মা এবং শ্বাশুড়ি এই মর্মে অঙ্গিকারাবদ্ধ আছে। তাছাড়া আরমানের সাথে মেলামেশাতেও তোমরা কখনো বাধা দাওনি। ফলে, আমার মনে কোনো দ্বিধা, ভয় কিম্বা সংশয় ছিলনা। তাই এমন একটা সিদ্ধান্ত নিতেও আমার বুক কাঁপেনি। অথচ, তোমরা এমন আচরণ করছ, যা দেখে আমি বুঝতে পারছি যে তোমরা মুখে যা বলো, তার অনেক কিছুই মন থেকে বলো না।

তোমাদের কথা সামাজিক মান মর্যাদার ছকে সময় উপযোগি করে পরিবেশন কর। তার সত্য মিথ্যা এবং ভুত ভবিষ্যত- লায়াবিলিটিস নিয়ে কোনো চিন্তা ভাবনা কর না। আমি তোমাদের মতো করে ভাবতে শিখিনি। চলতে শিখিনি। বলতেও শিখিনি। তাই আমি তোমাদের মতো স্টেজ ফিটিং নই। কিছুটা ব্যাকডেটেড, কিছুটা আলাভোলা। যাক। যা হবার হয়েছে। আমার নিয়তি আমাকে পরিণতির দিকে টানছে। তাই আমি চলে যাচ্ছি। তোমরা ভালো থেকো, পারলে আমাকে ক্ষমা করে দিও।

কথা শেষ করে রোজি তার বাবার সামনে আর এক মুহূর্ত দাঁড়ালো না। বাবাকে কোনো কথা বলারও সুযোগ দিলো না। বাবার ঘর থেকে বের হবার সাথে সাথে লিলুফা তাকে টেনে নিজের বেডরুমে নিয়ে গেলো। এসব কি পাগলামি শুরু করেছিস বলতো?

-বড় আপা। পাগলামি আমি একদম পছন্দ করি না। আমার জীবন আমাকেই পরিচালনা করতে হবে। যেহেতু আমি আব্বা আম্মার কথা মেনে চলতে পারছি না। সেহেতু আমার ভাবনা আমাকেই ভাবতে দে।

-কিন্তু সামনে তোর দুঃসময়। এই সময়ে মেয়েদের খুব সাবধানে চলাফেরা করতে হয়।

-কি বলতে চাইছিস?

-বলতে চাইছি বাচ্চাটা সুস্থভাবে পৃথিবীতে না আসা পর্যন্ত তুই আমার কাছে থাক। এরমধ্যে আরমান যদি তোকে নিয়ে যায় আমার কোনো আপত্তি থাকবে না। তবে এই অবস্থায় তোকে একা একা কোথাও যেতে দিতে চাই না।

রোজি ক্ষণকাল ভাবলো। তাহলে এখনি আমাকে এই বাড়ি থেকে নিয়ে যেতে হবে। পারবি?

-কেন পারবো না । আমি তো কাল সকালেই চলে যাবো। তোকেও আমার সাথে নিয়ে যাবো। তাহলে তুই খুশি তো?

-হাঁ।

-চলবে

Read More

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked with *

সর্বশেষ পোস্ট

Advertising