728 x 90

সেইতো এলে ফিরে: -আহমদ রাজু

আলমারির গোপন ড্রয়ারের ভেতরে থাকা হলুদ খামের চিঠিটা যখন রুনার হাতে উঠে আসে তখনও তার মন ছিল ফুরফুরে। কিছুক্ষণ আগেই সে গোসল সেরে বিয়ের সাজে সেজেছিল। সেই টুকটুকে লাল বেনারশি শাড়ি, ব্লাউজ আর কপালে মেরুন কালারের বড় একটা টিপ। অবশ্য লাল রঙের টিপ বরাবরই পছন্দ রুনার। বিয়ের পর সব পছন্দ সপে দিয়েছে সজলের কাছে। সজল

আলমারির গোপন ড্রয়ারের ভেতরে থাকা হলুদ খামের চিঠিটা যখন রুনার হাতে উঠে আসে তখনও তার মন ছিল ফুরফুরে। কিছুক্ষণ আগেই সে গোসল সেরে বিয়ের সাজে সেজেছিল। সেই টুকটুকে লাল বেনারশি শাড়ি, ব্লাউজ আর কপালে মেরুন কালারের বড় একটা টিপ। অবশ্য লাল রঙের টিপ বরাবরই পছন্দ রুনার। বিয়ের পর সব পছন্দ সপে দিয়েছে সজলের কাছে। সজল যে তাকে বোঝে না তা নয়; বোঝে- প্রচণ্ড বেশি বোঝে। আর বোঝে বলেইতো দু’জনের ভাললাগা একাকার হয়ে মিশে আছে নদীমাতৃক বাংলাদেশের মতো। এমনিতেই স্বাভাবিকভাবে সুন্দর বলতে যা বোঝায় রুনা তার থেকেও অনেক বেশি। কাঁচা হলুদ গায়ের রং, দীঘল কালো চুল তার কীর্তনখোলার মতো, চোখ দুটি একবিংশ শতাব্দীর বনলতাকে হারা মানাবে। আর তার চলার ছন্দে খুঁজে পাওয়া যায় কোন এক গাঁয়ের মেঠো পথের অস্তিত্ব।

বারো বছরের ক্ষীপ্র গতির সংসার হলেও নতুনের আগমন ঘটেনি এখনও। এজন্যে কেউ কাউকে দোষারোপ করে না। দু’জন সমানতালে চিকিৎসকের স্মরণাপন্ন হলেও তেমন অগ্রগতি এখনও চোখে পড়েনি। যে যা বলেছে- যেখানে যেতে বলেছে সেখানে গিয়েছে। সজল ব্যক্তিগতভাবে তাবিজ-কবজে বিশ্বাস না করলেও এক্ষেত্রে সে সুবোধ বালকের মতো চলে গিয়েছে ফকির বাড়িতে। তাবিজ বেঁধেছে গলায়-হাতে। পানিপড়াও খেয়েছে নিয়ম করে; যদি কোন ফল হয়। হয়নি; কোন ফল হয়নি। বাড়িতে যে অদৃশ্য শূন্যতা, সে শূন্যতা রয়েই গেছে। অবশ্য শূন্যতা বোঝার উপায় নেই দু’জনের দাম্পত্যে- দু’জনের একাগ্রতায়।

খামের উপরে প্রাপক- সজল আহমেদ লেখা দেখে আগ্রহ বাড়ে রুনার। তাছাড়া এই গোপন ড্রয়ারের কথা সে জানতো না। আজ আলমারি পরিষ্কার করতে যেয়ে ড্রায়ারের অস্তিত্ব অনুভব করে কৌতুহলবসতঃ সেটি খোলে। সেখানে আহামরি কিছু না থাকলেও কিছু কাগজের সাথে পরম মমতায় চিঠিটা রাখা ছিল।

সে চিঠিটা ঘুরিয়ে-ফিরিয়ে দেখতে থাকে। না খামের মুখ খোলা বা ছেঁড়া নেই। তবে হয়তো সজল সাবধানে খুলে চিঠিটা পড়ে আবারো আঠা দিয়ে মুখ আটকিয়ে রেখেছে; মনে মনে ভাবে রুনা। তার চোখ পড়ে খামের ডান পাশটা খোলা, আপাত দৃষ্টিতে যা দেখা যায় না। সে তড়িঘড়ি ভেতর থেকে কাগজটা বের করে এক নিমেষে পড়ে শেষ করে। ভালবাসার কথা লেখা এটা নিশ্চিত। তবে তা কাব্যিক ভাষায়। সজলের সাথে অন্য কারো সম্পর্ক আছে? যদি তার মনে এতকিছু থেকে থাকে তাহলে বলতে পারতো; আমি পথ ছেড়ে দিতাম।

মুহূর্তে চোখ দুটি লাল হয়ে ওঠে। তবে কী এত বছর শূন্যের ওপর ভালবাসা নামক ইমারত নির্মাণ করে চলেছে! সজল একবার অন্তত তাকে কথাটা বলতে পারতো! একটা শূন্যতা এ সংসারে রয়েছে সত্য, তাইবলে তলে তলে এতকিছু! সে কেঁদে ওঠে। মুহূর্তে তার জীবনটা উলট পালট হয়ে যায়। কী উৎসাহ-উদ্দিপনা নিয়ে সেজেছিল! সজলের প্রিয় মোরগ পোলাও রান্না করে অপেক্ষায় ছিল তার! আজ যে তাদের বারো তম বিবাহ বার্ষিকী! একটু পরেই ফিরে আসার কথা সজলের। অন্যদিন দুপুরে বাড়ি খেতে না আসলেও আজ সে সকালে বের হবার সময় বলেই গিয়েছিল দুপুরে খেতে আসবে। রুনা মনে মনে সিদ্ধান্ত নেয়, এ সংসারে সে আর এক মুহূর্ত থাকবে না। মিছেমিছি কেন সজলের সুখের মাঝে অন্তরায় হবে? তার চেয়ে তাদের পথ থেকে সরে দাঁড়িয়ে সংসারটাকে ভরিয়ে দেবার জন্যে সহযোগিতা করা তার কর্তব্য। এমনিতে এত বছরে একটা সন্তানের মুখ দেখাতে সে ব্যর্থ হয়েছে। এখন আর জায়গা আকড়িয়ে কোন লাভ নেই। তার চেয়ে ভাল বাবার বাড়িতে চলে যাওয়া। ভাইয়েরা অন্তত তাকে তাড়িয়ে দেবে না এটুকু বিশ্বাস আছে। আর যদি একান্তই তাদের কাছে না থাকতে পারে তাহলে ছোটখাট একটা চাকুরী জোগাড় করা খুব একটা কঠিণ কিছু হবে না বলে মনে হয় তার।

সে চোখ মুছে উঠে দাঁড়ায়। বিয়ের শাড়ি কাপড় খুলে খাটের ওপর রাখে। কপালের টিপ খুলে নিচে ফেলে দেয়। মনের মাঝের কষ্টটাকে সে যথাসম্ভব চেপে রেখে স্বাভাবিক হবার চেষ্টা করে। সজলের আসার সময় ঘনিয়ে আসছে- বেশি আর দেরি নেই। হয়তো এক থেকে দেড় ঘন্টার মধ্যে সে ফিরে আসবে। তার আগে রুনাকে চলে যেতে হবে।

খাবার টেবিলে খাবার সাজিয়ে পাশে একটা কাগজের চিরকুট রেখে সে এক কাপড়ে ঘর থেকে বেরিয়ে যায়। ঘর থেকে বের হবার সময় তার হৃদয় থেকে কান্না জোয়ারের মতো উছলিয়ে উঠছিল; যা সে অনেক কষ্টে সামাল দিয়েছে।

হাতে একটা ফুলের ডালি নিয়ে সজল বাড়ি আসে। কলিংবেল চাপ দেয় বার কয়েক। ভেতর থেকে কোন সাড়াশব্দ শুনতে পায় না। তবে কী রুনা বাইরে কোথায় গিয়েছে? সে না বলে কোথাও কোনদিন গিয়েছে অন্তত এই বারো বছরে এমনতো মনে হয়নি! নিজের মনের সাথে কথা বলে সজল। আর অপেক্ষা না করে নিজের ব্যাগে রাখা চাবি দিয়ে ঘরে ঢোকে। ঘরের ইলেকট্রিক বাতিগুলো তখনও জ্বলছিল। না এ ঘরে-ও ঘরে কোথাও নেই। খাটের ওপর যত্রতত্র ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে বিয়ের শাড়ি, ব্লাউজ আর তার পছন্দের মেরুন কালারের লাল টিপের পাতা। ডাইনিং টেবিলের ওপর খাবার ঢেকে রাখা। সেখানে থাকা সাদা কাগজের দিকে নজর যায় তার। কাগজটা হাতে তুলে নেয় সে। তাতে লেখা-

সজল,

আমি চলে যাচ্ছি। আমাকে খোঁজার বৃথা চেষ্টা করো না। তোমরা সুখি হও।

-রুনা

কথাগুলো স্রেফ এটুকুই। সজল বুঝতে পারে না সে হঠাৎ কেন এমন সিদ্ধান্ত নিল রুনা। কী এমন ঘটলো যে, যার জন্যে তাকে কঠিণ সিদ্ধান্ত নিতে হলো? গত বারো বছরে তার সাথে এমন কিছু হয়েছে বলে তার মনে পড়ে না। কোন অভিমানে সে ঘর ছাড়লো? আকাশ-পাতাল ভেবে কোন সন্তোষজনক বিষয় মাথায় আসে না সজলের।

রুনা যদি বাবার বাড়ি যায় তাহলে সজলের পক্ষে সেখানে যাওয়া সম্ভব নয়। কারণ সে শ্বশুর বাড়ির ঠিকানা জানে না। বিয়ের পরে একদিনও সেখানে যায়নি। শুধু বরিশাল বাড়ি, এটুকু শুধু জানে। মাঝে মধ্যে শ্বশুর বাড়ির লোকজন এখানে বেড়াতে আসতো ঠিকই তবে একদিনও তার বরিশালে যাওয়া হয়ে ওঠেনি। আজ বুঝেছে, না যাওয়াটা মস্তবড় ভুল ছিল। গেলে অন্তত এই বিপদের সময়ে একটা গতি হতো নিশ্চয়। সে বুঝতে পারে না কী হচ্ছে আর কী হয়েছে। সে এখন কী করবে- কার কাছে যাবে?

সজলের মনে খটকা লাগে। চিঠিতে রুনা লিখেছে- “তোমরা সুখে থেকো” এই তোমরা বলতে রুনা কাকে বোঝাতে চেয়েছে? তবে কী সে তাকে সন্দেহ করছে? নাকি অন্য কিছু! তবে আর যাই হোক, রুনা অন্তত সজলকে সন্দেহ করতে পারে না এ ব্যাপারে একশো ভাগ নিশ্চিত সজল। বারো বছরের সংসার- চার বছর কেটেছে কলেজে। মোট ষোল বছরের চেনা জানায় একদিনও তার সাথে মনোমালিন্য হয়নি। তবে আজ কিসের জন্যে….। তার মাথা চক্কর দিয়ে ওঠে। চোখের সামনে অস্পষ্ট হয়ে যায় সবকিছু। সে কোন রকম সোফার হাতল ধরে তার ওপর বসে নিজেকে সামলিয়ে নেয়।

শীতের শুরু। কুয়াশা ভেজা ভোর। গাছের পাতারা ভিজে চুপষে আছে যেন। মটরশুটির ক্ষেতে নতুনের আগমন। গাছিরা খেজুর গাছ তৈরিতে ব্যস্ত। আর ক’দিন পরেই গাছ থেকে সংগ্রহ করবে নতুন রস। দূরে রাখাল সারিবদ্ধভাবে গরু নিয়ে মাঠের মাঝ দিয়ে কোথাও যেন যাচ্ছে। এমনি ক্ষণে রুনা মেঠো পথ বেয়ে গ্রামের দিকে রওনা দিয়েছে; যেখানে তার বাবা-মা, ভাইদের সংসার। অধিকাংশ রাস্তা ধূলিময় হলেও জায়গা বিশেষ দুবলা ঘাসে ভরে আছে। সেখানে জমে থাকা শিশির বিন্দু পা ভিজিয়ে দেয় রুনার। মন তার ভারাক্রান্ত হলেও মুখে তা প্রকাশ পায় না। সে হেঁটেই চলেছে। ঢাকা থেকে বরিশাল লঞ্চে। লঞ্চঘাট থেকে বাসে উজিরপুর বাজার। তারপর এই দীঘল পথে হাঁটা।

সকালে রুনাকে দেখে বাড়ির সকলে অবাক! কোন চিঠিপত্র নেই। একদম স্বশরীরে উপস্থিত! মা এগিয়ে আসে উঠানে দাঁড়িয়ে থাকা রুনার দিকে।

“রুনা; মা তুই…!” রুনাকে উদ্দেশ্য করে বলল তার মা।

“কেন মা? আমাকে কী আশা করোনি?”

“না তা নয়। অন্তত একটা চিঠিতো দিতে পারতিস?”

“তা হয়তো পারতাম। আসলে আমি অপ্রস্তুতভাবে চলে এসেছি।”

“রুনা কোন সমস্যা?”

কেঁদে ওঠে রুনা। “আমি আর ওখানে ফিরে যাবো না মা।”

রুনার মা ভূত দেখার মতো চমকে ওঠে। “বলিস কি?”

“আমি ঠিকই বলছি মা। আমি আর ফিরে যাবো না ওঘরে।”

“জামাই কী কিছু বলেছে?”

রুনা কান্নাজড়িত কণ্ঠে বলল, “সে কী বলবে? যা করেছে তা বলার ওপর দিয়ে গেছে।”

“জামাই অন্যায় কিছু করতে পারে আমি তো ভাবতেই পারি না। ”

“আমিও কি ভাবতে পেরেছি মা? সে আর একজনের সাথে…” কথা শেষ করতে পারে না রুনা। সে শব্দ করে কাঁদতে থাকে। তার বুক যেন ভেঙে খান খান হয়ে যায়।

“তোর কোথাও ভুল হচ্ছে হয়তো…।”

“আমার কোন ভুল নেই। আমি হাতে নাতে প্রমাণ পেয়েছি।”

মা শান্ত¡না দেয় মেয়েকে। “থাম মা থাম। তোর আর কী করার আছে বল। নিয়তি ভেবে সব মেনে নে। এ তোর কপালে লেখা ছিল। তা না হলে তুই নিজেই কেন তাকে পছন্দ করে বিয়ে করবি। আর কেনইবা এত বছর পরে সেখান থেকে ফিরে আসবি?”

রুনার হঠাৎ অন্তর্ধানে সজল নিজেকে সামলাতে পারে না। সে ভেঙে পড়ে খুব। দিন যত গড়াতে থাকে শরীর তার ততই খারাপের দিকে ধাবিত হয়। তার মা-বাবা আর ছোট দুই ভাই মীরপুরে থাকলেও অফিসের কাছে থাকার জন্যে বাবা মায়ের অনুমতি নিয়ে সজল থাকতো সাভারে। এখানে বাড়িটা পরে সে নিজেই কিনেছিল। সজলের শরীর খারাপ জানতে পেরে তারা সাভারে এসেছে। সেবা-যত্ন করে সজলকে সুস্থ করে তোলার চেষ্টা করলেও কিছুতেই কাজ হয় না। দিন যতই পার হয় ততই তার শরীর খারাপ থেকে খারাপতর হয়েই চলেছে। শেষপর্যন্ত তাকে হাসপাতালে ভর্তি করতে হয়। কি এক অদৃশ্য কারণে তার শরীর শুকিয়ে শীর্ণকায় হয়ে যাচ্ছে। এ টেস্ট সে টেস্ট করে অসুখ ধরা পড়ে না। শরীরের হাড়গুলো সব এক নিমেষে গুনে শেষ করা যায় এখন। হৃদযন্ত্র টিনটিন করে চললেও মনে তার ভাবনা আকাশ কুসুম। সে ভাবনা রুনাকে নিয়ে। এতদিনে ভাবনার গতিতে একটুও ভাটা পড়েনি। কেন কী কারণে কিসের মোহে তাকে সে ছেড়ে গেল? কোন অপরাধেইবা এই অকূল পাথারে ভাসিয়ে দিয়ে নিজে সুখের সাম্পানে ভেসে বেড়াচ্ছে? এখন সে কেমন আছে? নাকি ভুলের অনুতপ্তে দহন জ্বালায় জ্বলে পুড়ে মরছে নিরবধি? কোন সদুত্তর নেই সজলের কাছে। সে হাসপাতালের বিছানায় শুয়ে শুয়ে ভাবে আর তার দু’চোখের কোন বেয়ে অশ্রুধারা গড়িয়ে পড়ে নীরবে। পাশে বসে থাকা মায়ের চোখ যা এড়ায় না। সে সজলের চোখের পানি মুছিয়ে দিতে দিতে বলল, “অত চিন্তা করিস কেন বাপ? তোকে ছেড়ে যদি সে ভাল থাকে তাহলে তুই কেন ভাল থাকবি না? একটা স্বার্থপর মানুষের জন্যে তুই কেন নিজেকে শেষ করছিস তিলে তিলে? আগে সুস্থ হয়ে ওঠ তারপর আমরা রুনার চেয়ে সুন্দরী মেয়ে দেখে তোকে আবার বিয়ে দেবো।”

সজল মায়ের কথার কোন উত্তর দেয় না। শুধু ফ্যাল ফ্যাল করে তাকিয়ে থাকে তার মুখের দিকে।

“একটু বোঝার চেষ্টা কর, এতদিন যে ফিরে আসেনি, তোর একবারও খোঁজ দেয়নি, তার জন্যে কেন নিজেকে শেষ করছিস? তুই কিছু কী বুঝিস না? তোর জন্যে- তোর সাথে আমরা সবাই কষ্ট পাচ্ছি!” ছেলের মাথায়-কপালে হাত বোলায় মা।

সজলের কথা বলতে ইদানীং কষ্ট হয় খুব। সে হাঁপাতে হাঁপাতে বলল, “আমি জানি মা, তোমরা সবাই আমার জন্যে কত কষ্ট করছো। আমিতো ভাল আছি মা। আমাকে এখানে কেন রেখেছো?”

ছেলের মাথাটা আলতো করে নিজের কোলের উপর নিয়ে চুলে বিলি কাটতে কাটতে বলল, “তুই বাড়ি ফেরার মত এখনও হসনি। ডাক্তার বলেছে, আরো কিছুদিন হাসপাতালে থাকতে হবে।”

“তোমরা আমাকে বাড়িতে নিয়ে চলো। আমার এখানে মোটেও ভাল লাগছে না।”

“তুই দুশ্চিন্তা বাদ দে। দেখবি সব ঠিক হয়ে গেছে।”

দীর্ঘশ্বাস ছাড়ে সজল। বলল, “আচ্ছা মা; বলতে পারো, মানুষ মানুষকে এভাবে ভুলে যায় কী করে?”

“চুপ কর; একটু চুপ কর।” বলে ছেলের মুখে- মাথায় হাত বোলায় তার মা।

“কেন চুপ করবো মা? কেউ যদি এভাবে চলে যেতে পারে আমি কেন বলতে পারবো না?” চোখ বেয়ে তার অশ্রুধারা গড়িয়ে পড়ে নিচে।

ছেলেকে অসুস্থ দেখে মায়ের মনের অবস্থা যে কেমন তা একজন মা-ই বুঝতে পারে। ছেলেকে নিজের সামনে এভাবে কষ্ট পেতে দেখেও কিছু করতে পারে না সে। ডাক্তার অবশ্য বলেছে, দুশ্চিন্তামুক্ত হলেই সে ভাল হতে পারে নতুবা সামনে তার কঠিন সময়। তাইতো ছেলেকে সে সময়-অসময় বিগত অতীতকে ভুলিয়ে রাখার বৃথা চেষ্টা করে যা সম্ভব হয় না বুঝতে পারে সজলের মা।

কবিতা স্বামীর সাথে ইতালী চলে গিয়েছিল বিয়ের তিন মাসের ভেতর। বিয়ের দিনই তার সাথে শেষ দেখা রুনার। আজ এত বছর পর সে নিজের দেশে- নিজের বাবার বাড়িতে এসেছে। এসেই যখন শুনেছে রুনা এখানে আছে সে আর দেরি করেনি; সোজা রুনাদের বাড়ি উপস্থিত। পুরোনো সেই সইকে পেয়ে আনন্দে আত্মহারা হয়ে ওঠে কবিতা। তবে সে মনে মনে যতটা আনন্দ পেয়েছে ঠিক ততটাই দুঃখ পায় রুনার মুখ দেখে-শরীরের অবস্থা দেখে। “এ কী অবস্থা হয়েছে তোর!” রুনাকে উদ্দেশ্য করে বলল কবিতা।

রুনা মুখে হাসির রেখা ফুটিয়ে বলল, “আমার কথা বাদ দে; তুই কেমন আছিস?”

“আমি তো বেশ ছিলাম। কিন্তু তোকে দেখার পরে কেন যেন সেই ভালটা উবে গেছে।”

“কেনরে আমার আবার কি হলো?”

“তুই সত্যি করে বলতো কী হয়েছে?”

“না; কিছু হয়নি। চল ঘরে চল।” বলে কবিতার হাত ধরে রুনা ঘরের ভেতরে নিয়ে খাটের ওপর বসায়।

“আচ্ছা সজল ভাইয়ের সাথে তোর কি কিছু হয়েছে?”

রুনা নিশ্চুপ, কোন কথা বলে না।

রুনাকে আলতো করে ধাক্কা দিয়ে কবিতা বলল, “কী রে, কিছু বললি না যে..”

ক্ষণেক আনমনা হয়ে গিয়েছিল রুনা। সঞ্চিৎ ফিরে পায় সে। বলল, “আছে।”

“আছে মানে? আমি কি বলেছি তুই কি বুঝতে পেরেছিস?”

রুনা আসলে কবিতার কথা খেয়াল করেনি। তাইতো বলল, “আবার বল।”

“বলছি সজল ভাইয়ের সাথে কি কিছু হয়েছে? আর ছেলে-মেয়ে…..”

কবিতার কথা শেষ করতে না দিয়ে রুনা বলল, “আমি তিন বছর হলো সজলের ওখান থেকে চলে এসেছি।”

বিস্মিত কবিতা। বলল, “কেন?”

“সে অনেক কথা।”

“ছেলে-মেয়ে?”

“নারে হয়নি।”

“কী বলিস!”

“ডাক্তার-কবিরাজ কম দেখাইনি। কিছুতেই কিছু হয়নি।”

“শুনেছিলাম আমার বিয়ের কিছুদিন পরেই নাকি তোর বিয়ে হয়েছিল?”

“তুই ঠিকই শুনেছিলি।”

“তাহলেতো প্রায় পনের বছর হতে চললো।”

“হু; ওই রকম।”

“তাহলে এতদিন পর কী এমন হলো যে, একেবারে ছেড়ে চলে এলি? নাকি সে নিজেই তোর সাথে সমস্ত সম্পর্ক শেষ করেছে?”

“না, তা করেনি। আমি নিজেই এসেছি। ভেবে দেখলাম, আর যাই হোক কোন চরিত্রহীন মানুষের সাথে সংসার করা সম্ভব নয়।”

বিস্ময় প্রকাশ করে কবিতা। বলল, “বলিস কী! সজল ভাইয়ার চরিত্রে সমস্যা! আমি দেখলেও বিশ্বাস করবো না।”

“আমিও তাকে দেবতার মত বিশ্বাস করতাম। কিন্তু সেদিন আমি যে প্রমাণ হাতে পেয়েছিলাম তাতে বিগত দিনগুলির সমস্ত বিশ্বাস আমার ধুলির সাথে মিশে গিয়েছিল।”

“সে তোকে আটকানোর চেষ্টা করেনি।”

“আমি তো তাকে না জানিয়েই বাড়ি থেকে চলে এসেছিলাম।”

“পরে তোকে কোনদিন নিতে আসেনি?”

“আসবে কীভাবে? এখানকার ঠিকানাতো সে জানেই না।”

“আমার মনে হয় তোর কোন একটা ভুল হয়েছে। আসলে বিয়ের আগে সজল ভাই সম্পর্কে তোর মুখে যত কথা শুনেছি তাতে আমার মনের ভেতরে সে দেবতা হয়ে আসন গেড়ে আছে আজো। আর তুই তার সাথে বারো বছর সংসার করেও চিনতে পারিসনি মনে হচ্ছে।

রাগান্বিত হয়ে ওঠে রুনা। বলল, “চিনতে পারিনি তাই না। অপেক্ষা কর, তোকে প্রমাণ দেখাচ্ছি।” বলে খাট থেকে উঠে সোকেচের ড্রয়ারের ভেতর থেকে একটা হলুদ খাম বের করে কবিতার হাতে দিয়ে বলল, “এই দ্যাখ, এর চেয়ে বড় প্রমাণ আমার আর কী কিছু দরকার আছে?”

কবিতা খামটা হাতে নিয়ে প্রাপকের ঠিকানার ওপর চোখ ফেলতেই চমকে ওঠে। এ যে তারই হাতের লেখা! সে তড়িঘড়ি ভেতর থেকে চিঠিটা বের করে সামনে মেলে ধরে। তার মনে পড়ে যায় ষোল/সতের বছর আগে ফেলে আসা এক ঈদের এক সপ্তাহ আগের কথা। রুনা হাতে মেহেদী লাগিয়েছিল। এদিকে পোস্ট অফিসে সেদিন চিঠি পোস্ট না করলে ঈদের আগে প্রাপকের কাছে পৌছাবে না। তখন রুনা কবিতাকে বলেছিল তার হয়ে যেন একটা চিঠি সজলকে লেখে। তাইতো রুনার কথামত কবিগুরুর শেষের কবিতার চারটি লাইন লিখে খামে ভরে পোস্ট করেছিল-

“যে আমারে দেখিবার পায়

অসীম ক্ষমায়

ভালো মন্দ মিয়ায়ে সকলি,

এবার পূজায় তারি আপনারে দিতে চাই বলি”

“এই কী তোর সেই প্রমাণ?” রুনাকে উদ্দেশ্য করে বলল কবিতা।

“কেন, তোর কাছে কিছু মনে হচ্ছে না?”

“তুই কি এই প্রমাণের কথা বলছিস?”

“কবিতা আমার আর ভাল লাগছে না। বাদ দেতো এসব কথা।” বিষয়টাকে অন্য দিকে ঘুরাতে চেষ্টা করে রুনা।

কবিতা বলল, “তুই এ কী করেছিস রুনা! মানুষ ভুল করে, তবে কারো ভুলের মাত্রা যে এত বেশি হয় তা তোকে না দেখে কেউ বিশ্বাস করবে না।”

কবিতার হঠাৎ এমন ব্যবহারে হতবাক রুনা। সে বলল, “তুই কি বুঝতে পারছিস, চিঠিটা কী ইঙ্গিত করছে?”

“আমার যা বোঝার বুঝেছি। তোর কি মনে আছে, একবার ঈদের দু’দিন আগে তুই হাতে মেহেদি লাগিয়েছিলি? শুকাচ্ছিল না মোটেও। এদিকে পোস্ট অফিস বন্ধের সময় হয়ে গিয়েছিল। তুই রবীন্দ্রনাথের শেষের কবিতার বই এনে চারটি লাইন দেখিয়ে দিয়ে বলেছিলি- আমি যেন তোর হয়ে সজল ভাইয়ের কাছে চিঠিটা লিখি।”

রুনার মুহূর্তে এক এক করে চোখের সামনে ভেসে ওঠে সেদিনের কথা। এতো সেই চিঠি! এতদিন ভালবাসার স্মৃতিচিহ্ন হিসেবে পরম যত্ন করে রেখেছিল সজল! অথচ সেই চিঠিটাকে ভুল বুঝে তাকে ফেলে গত তিন বছর এখানে রয়েছে! রাগে- লজ্জায় নিজেকে আর স্থির রাখতে পারে না সে। কেঁদে ওঠে। কবিতা তাকে থামানোর চেষ্টা করে না। কাঁদুক- মন ভরে কাঁদুক। কেঁদে কেঁদে হালকা হোক সে। মেয়ের কান্না শুনে রান্না ঘর থেকে তার মা ছুটে আসে।

মাকে দেখে তার কান্নার মাত্রা আরো বৃদ্ধি পায়। সে মাকে জড়িয়ে ধরে অঝোর ধারায় কাঁদতে থাকে।

“আমি যে সীমাহীন ভুল করেছি মা। এ ভুল আমি কিভাবে শুধরাবো?”

“কী হয়েছে মা তোর? এভাবে কাঁদছিস কেন?”

রুনা কাঁদতে কাঁদতে বলল, “তোমার জামাইয়ের কাছে অনেকদিন আগে ওই চিঠি আমিই পাঠিয়েছিলাম। আজ মনে পড়েছে।”

“তোর চিঠি তুই চিনতে পারিসনি! তোর মতো হতভাগা আর কেউ নেই রে।”

“আমি বুঝতে পারিনি মা। আমাকে তুমি ক্ষমা করে দাও।”

“আমি তোকে বলেছিলাম, সজলের খোঁজ নে। সে এখানকার ঠিকানা জানে না। জানলে অবশ্যই চলে আসতো।”

“আমি এখন কী করবো মা? সে কী আমাকে ক্ষমা করবে?”

মেয়ের কান্না দেখে মা তার নিজের চোখ সংবরণ করতে পারে না। “চুপ কর মা। যে ভুল তুই করেছিস তার প্রায়শ্চিত্ত কোনভাবেই সম্ভব নয়। তাছাড়া তোকে যে ফিরে যেতে বলবো তারও উপায় নেই। সে যে এতদিনে বিয়ে করে সংসার করছে না তাইবা বুঝবো কীভাবে?”

শাড়ীর আঁচল দিয়ে চোখ মুছতে মুছতে বলল, “অমন কথা বলো না মা। সজল দ্বিতীয়বার বিয়ে করতে পারে না। সে আমাকে ছাড়া কাউকে কোনদিন ভাবেনি- ভাবতেই পারে না।”

“এই বিশ্বাসটার মর্যাদা তুইতো দিস নি। আমি তোকে অনেকবার বুঝিয়েছিলাম, ফিরে যা তার কাছে। তুই আমার কোন কথা তখন রাখিস নি। যখন সবকিছু বুঝলি তখন অনেক দেরি হয়ে গেছে।”

“যতই দেরি হোক মা, সে অবশ্যই আমার আশায় পথ চেয়ে আছে।”

কবিতা এই পরিস্থিতিতে কী বলবে বুঝতে পারে না। সজল যে এতদিন বিয়ে করে নতুন সংসার শুরু করেনি তারইবা গ্যারান্টি কী? আর বিয়ে না করলে তার মনের মাঝে যে দাগ রুনা কেটে চলে এসেছে সে দাগ ভরাট করবে কী দিয়ে? রুনাকে এখন সে গ্রহণ করবে তার ভিত্তি কী? সে আকাশ পাতাল ভাবতে থাকে। ভাবনায় ছেদ পড়ে রুনার কথায়। “কবিতা আমি এখনি যাবো সজলের কাছে। আর এক মুহূর্ত ভুলের মাত্রা বাড়াবো না।” বলল রুনা।

“ধৈর্য্য ধর রুনা। একটু খোঁজ খবর নিলে হতো না…।”

“কিসের খোঁজ খবর?” চোখ মুছতে মুছতে প্রশ্ন করে রুনা।

“আসলে দিন কিন্তু অনেক পেরিয়ে গেছে। এই সময়ের মধ্যে গণতান্ত্রিক অনেক দেশের সরকারও পরিবর্তন হয়ে যায়। আর মন? সেতো ক্ষণে ক্ষণে পরিবর্তন হতেই থাকে।”

“তুই কি বলতে চাচ্ছিস?”

“বলছি, সে যে আবার বিয়ে করেনি, এ গ্যারান্টি পাচ্ছিস কোথায়? তাছাড়া এতদিন পরে সে যে তোকে গ্রহণ করবে তাই-ইবা ভাবছিস কিভাবে? তুই গেলে দূর দূর করে তাড়িয়েওতো দিতে পারে।”

একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে রুনা বলল, “আমার বিশ্বাস আমাকে সে ফেরাবে না।” সে আর কথা না বাড়িয়ে ব্যাগে কাপড় চোপড় ভরে যখন ঢাকার উদ্দেশ্যে লঞ্চ ঘাটের দিকে রওনা দেয় তখন বিকাল পাঁচটা। আজ সারাদিন শ্রমিকদের দাবী আদায়ের লক্ষে লঞ্চ ধর্মঘট। লঞ্চঘাটে এসে বসে থাকে টার্মিনালে। লঞ্চ ছাড়তে ছাড়তে রাত ন’টা বেজে যায়। সারা রাত তার ঘুম আসে না। আকাশ-পাতাল ভাবনা তার মনকে গ্রাস করে নিয়েছে। একবার ভাবছে- সজল তাকে দেখে আনন্দে আত্মহারা হবে। আর একবার ভাবছে- তাকে সে গ্রহণ করবে না; দূর দূর করে তাড়িয়ে দেবে! আবার ভাবে, যদি সে আবারো বিয়ে করেই থাকে তাহলে সতীনের সাথে থাকা কী তার পক্ষে সম্ভব? নাকি বরিশালে ফিরে যাবে? শেষ পর্যন্ত সিদ্ধান্ত নেয়, সতীনের সাথে থাকতে হলেও সে থাকবে। কারণ ভুলতো তারই। সেজন্যে ভুলের প্রায়শ্চিত্ত তারই করতে হবে। ক্লান্তি আর অবসাদে তার চোখ বুজে আসে। সদরঘাটে যখন এসে লঞ্চ পৌঁছায় তখন সকাল সাতটা।

ঢাকার রাস্তায় যানজট খুব। বিশেষ করে সকালে আর বিকেলে এর মাত্রা বৃদ্ধি পায়। এ সময় তিন কিলোমিটার পথ পাড়ি দিতে কখনও কখনও এক দেড় ঘন্টাও লেগে যেতে পারে। যাইহোক, সদরঘাট থেকে সাভারে পৌঁছাতে রুনার এগারোটা বেজে যায়। এই শহরের অনেককিছু পরিবর্তন হয়েছে। নতুন করে তৈরি হচ্ছে দালান কোঠা। যেখানে সেদিন ছিল বুক সমান পানি সেখানে এখন স্কুল ঘর-হাসপাতাল ইত্যাদি!

বুক তার দুরু দুরু। কী হয়-কী হয়! এতদিনে সজলের নিশ্চয় শহরের মত পরিবর্তন হয়েছে। দরজার সামনে দাঁড়িয়ে কলিংবেল টিপতেই ক্ষণেক পরে ঘর থেকে বেরিয়ে আসে তার শাশুড়ী। সে রুনাকে দেখে স্বাভাবিকভাবে বলল, “বৌমা এসেছো?”

রুনা হাতের ব্যাগটা নিচে রেখে শাশুড়ীর পায়ে হাত দিয়ে সালাম করে। বলল, “আপনি কেমন আছেন মা?”

তার শাশুড়ী মুখে উত্তর না দিয়ে সম্মতিসূচক মাথা নাড়ে।

“আমি ভুল করেছি মা। আমাকে আপনি ক্ষমা করে দিন।” বলে কেঁদে ওঠে রুনা।

দীর্ঘশ্বাস ছাড়ে তার শাশুড়ী। ক্ষীণ স্বরে বলল, “এসো, ভিতরে এসো।”

শাশুড়ীর কথায় রুনা ব্যাগ নিয়ে ঘরের ভেতরে যায়। সে মনে মনে পুলকিত। যেহেতু শাশুড়ী তাকে ঘরের ভেতরে ডেকে নিয়ে যাচ্ছেন তাহলে আর কোন চিন্তা নেই। রুনা ঘরের ভেতরে যেয়ে সোকেচের পাশে ব্যাগটা রেখে চারিদিকে একনজর তাকায়। না সব ঠিকঠাক আছে। কোন পরিবর্তন হয়নি। দু’এক জায়গায় মাকড়শায় জাল বুনেছে এই যা। যদি নতুন কেউ এই সংসারে আসতো তাহলে সব ঝকঝকে তকতকে থাকতো। তা নেই যখন তখন সজল বিয়ে করেনি সেটা নিশ্চিত সে।

“মা, আপনার ছেলে কোথায়? অফিসে গিয়েছে নিশ্চয়। জানিনা সে আমাকে ক্ষমা করবে কি না। সে যদি আমাকে ক্ষমা না করে তাহলে আমি মরেও শান্তি পাবো না।” চোখে তার পানি, মুখে তার কান্নার স্বর।

রুনার শাশুড়ী কোন কথা বলে না। এতক্ষণ সে দাঁড়িয়ে ছিল; এবার সোফার ওপর যেয়ে বসে। পাশে যেয়ে বসে রুনা।

“মা আমাকে আপনি ক্ষমা করে দিন। সব ভুল আমার- সব দোষ আমার।” রুনার কথার কোন উত্তর না দেওয়ায় সে আবারো বলল, “মা আপনার ছেলে কোথায় গেছে বলছেন না যে..? এখনও কী আমার ওপর রাগ করে থাকবেন?”

তার শাশুড়ী আবারো দীর্ঘশ্বাস ছাড়ে। বলল, “বাইরে এসো।” সে খাটের ওপর বিছানো তোষক উল্টিয়ে তার তলা থেকে একটা ভাঁজকরা চিরকুট নিয়ে বাইরে বেরিয়ে যায়। রুনা তার পেছন পেছন। ঘরের দক্ষিণ পাশে যেয়ে দাঁড়ায়। আঙ্গুল উঁচিয়ে সামনে শিউলি তলায় নতুন একটি কবর দেখিয়ে বলল, “ঐযে, ঐ শিউলি তলায় ঘুমিয়ে আছে সজল- গভীর ঘুমে। আমার ছেলেটা তোমার জন্যে তীলে তীলে শেষ হয়ে গেল! কেন করলে তার সাথে এমন? কী ক্ষতি করেছিলাম আমরা তোমার? সেতো মৃত্যুর আগে জানতেও পারেনি তার অপরাধ কি ছিল! এই নাও, এটি তোমার জন্যে।” বলে চিরকুটটি রুনার হাতে দিয়ে চোখ মুছতে মুছতে সেখান থেকে চলে যায় সে।

রুনার ইতিমধ্যে চোখ ভরে গেছে জলে। বুক তার ফেটে যায় কষ্টে-নিঃশ্বাস যেন আর চলতেই চায় না। এখন-এই মুহূর্তটা নিজের আয়ত্বের বাইরে চলে গেছে তার। কতটা দুঃখ-কতটা ব্যথা পেলে একটা মানুষ আর একটা মানুষের জন্যে দুনিয়া ছেড়ে চলে যেতে পারে! সে বুঝতে পারে না তার কী এখন কাঁদা উচিৎ নাকি এখনও বেঁচে থাকা? রুনা নিশ্চুপ। কোন কথা বলে না। পিনপতন নীরবতায় সে যখন ঢলে পড়ে মাটিতে তখন কবরের নতুন মাটির সোঁদাগন্ধ নাকে আসে তার।

Read More

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked with *

সর্বশেষ পোস্ট

Advertising