অতুনুর সাথে যখন আমার শেষবার দেখা হয়েছিল তখন আকাশে দেখা গিয়েছিল পূর্ণিমার চাঁদ। বাতাসে নতুনের গন্ধ। দিগন্ত বিস্তৃত সাগর পাড়ে এক মোহনীয় আবেশ সৃষ্টি হয়েছিল সেদিন। আমি আপন মনে চন্দ্রস্নানে মগ্ন ছিলাম। হঠাৎ সামনে এসে দাঁড়ায় অতুনু। আমি বিস্মিত হয়ে বললাম, “অতুনু তুই!” আমার কথা শুনে সে কিছু একটা বলতে যাচ্ছিল। আমি তাকে কথা বলার
অতুনুর সাথে যখন আমার শেষবার দেখা হয়েছিল তখন আকাশে দেখা গিয়েছিল পূর্ণিমার চাঁদ। বাতাসে নতুনের গন্ধ। দিগন্ত বিস্তৃত সাগর পাড়ে এক মোহনীয় আবেশ সৃষ্টি হয়েছিল সেদিন। আমি আপন মনে চন্দ্রস্নানে মগ্ন ছিলাম। হঠাৎ সামনে এসে দাঁড়ায় অতুনু। আমি বিস্মিত হয়ে বললাম, “অতুনু তুই!”
আমার কথা শুনে সে কিছু একটা বলতে যাচ্ছিল। আমি তাকে কথা বলার সুযোগ না দিয়ে বললাম, “ভগবান সত্যিই আছে রে। না হলে তোকে এভাবে পাবো বুঝতেই পারিনি।”
অতুনু আমার মতো বিস্মিত হলো কিনা বুঝতে পারি না। বলল, “আমিও তো ভাবতেই পারিনি তোর সাথে এই পূর্ণিমা তিথীতে দেখা হতে পারে। অবশ্য সে আশা কখনও করি না।”
আমি বললাম, “কিন্তু আমি তোকে আশা করেছিলাম; জানিস?”
“কেন, আমাকে আবার তোর কী প্রয়োজন?” অনেকটা তাচ্ছিল্যের সুর অতুনুর কন্ঠে।
“প্রয়োজনতো অনেক। তোকে কোথায় না খুঁজেছি। আমার বিশ্বাস ছিল, তোকে একদিন না একদিন খুঁজে পাবোই। তবে আজ এই সময়ে পাবো, তা অবশ্য ভাবিনি।”
“তোর কথা শুনে ভাল লাগছে। আমাকে যে কেউ খুঁজতে পারে তা এখন আর মনেই হয় না।”
“তোর এই অলীক ধারণা যে ভুল, তা বুঝতে পারিস? আমার মন ডেকে বলছিল, তুই এবার হয়তো আসবি। অবশ্য প্রতিবছর তেমনটাই মনে হয়েছে।”
কোন কথা বলে না অতুনু। সে আনমনে আকাশের দিকে তাকিয়ে থাকে। ছেলেবেলায় আমি আর অতুনু প্রতি বছর পূর্ণিমা তিথীতে সাগরপাড়ে আসতাম। পুণ্যস্নান- চন্দ্রস্নান আরো কত কী। যে কারণে আমার বরাবরই মনে হয়েছিল, অতুনু বাড়িতে না ফিরলেও একদিন না একদিন এখানে আসবেই। তাইতো আমি প্রতি বছর এখানে আসতে ভুল করি না; যতই কাজ থাকুন না কেন। যদিও আগেকার দিনে এমন জমজমাট ছিল না। বছর যত পার হয় লোক সমাগম ততই বাড়ে। থাকার ব্যবস্থা-খাবার ব্যবস্থা সবই আছে।
অতুনু ক্ষণেক পরে প্রসঙ্গ পাল্টিয়ে বলে, “জানিস, আমরা কেউ কখনও ঐ চাঁদের মতো হতে পারি না। কত সজীব, কত বিশ^স্ততা তার!”
আমি একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বললাম, “তুই ঠিকই বলেছিস, আমাদের মতো ওর কোন চাওয়া নেই-পাওয়া নেই, আকাক্সক্ষাও নেই।”
ক্ষণেক নীরব থেকে বললাম, “অতুনু, কেমন আছিস বন্ধু?”
সে একটা চাপা শ্বাস নিয়ে বলল, “তুইতো একটা কঠিণ প্রশ্ন করে ফেললি। পূর্ণিমার চাঁদের কাছে প্রশ্ন করতো, সে কী বলে? হয়তো বলবে, ভাল আছি- খুব ভাল আছি; ইত্যাদি ইত্যাদি।”
প্রসঙ্গের বাইরে কথা বলতে দেখে আমার ধৈর্যের বাঁধ ভেঙে যায়। বললাম, “অতুনু তুই কি পাগল হয়ে গেলি?”
সে এবার অট্টহাসিতে ফেটে পড়ে। বলল, “পাগল! হ্যা, পাগল-ই। এই একই কথা বহু বছর আগে কেউ একজন বলেছিল।”
আমি অতুনুর দুই বাহু শক্ত করে ধরে ঝাঁকি দিয়ে বললাম, “অতুনু আমার দাদা, বন্ধু আমার; বলনা, কেমন আছিস তুই? এখন কী করছিস?”
অতুনু বিদ্রুপের ছলে হেসে বলল, “ভাল আছিরে।”
“কী করছিস এখন?” প্রশ্ন করলাম।
“কিছু না, অথচ অনেক কিছু। এতবড় আকাশের নিচে আমাকে কিছু করতে হয় না। কর্মই আমাকে চালিয়ে নেয়।”
আমি সুযোগ বুঝে কথাটা বললাম, “নিরু এখনও তোর অপেক্ষায় আছে।”
হঠাৎ যেন বিদ্যুৎ খেলে যায় অতুনুর শরীরে যা চাঁদের আলোয় স্পষ্ট বুঝতে পারি। এতক্ষণ সে চাঁদের দিকে তাকিয়ে ছিল। কথাটা শোনামাত্র আমার দিকে ঘুরে অপ্রস্তুত হয়ে বলল, “কে নিরু?” যেন এই নামটা সে আজই প্রথম শুনলো।
“নিরুপমা। তোর নিরু।”
“কী আবল তাবল বকছিস! আমিতো ঐ নামে কাউকে চিনি না!”
“আমি সব জানি। আমার কাছে তুই কিছু আর লুকাতে পারবি না। সে আজও তোর অপেক্ষায় আছে।”
“বাদ দে তো এসব।”
“আমি সত্যি বলছি অতুনু, নিরুপমা আজও তোর পথ চেয়ে আছে।”
“যতসব ফালতু কথা- সব আজগুবি কথা।” অতুনু আমার কথা বিশ্বাস করে না।
বললাম, “তুইতো জানিস, আমি মিথ্যা কথা বলি না।”
“না; এ হয় না- হতে পারে না!”
“কেন? কেন হতে পারে না?”
“কেন হতে পারে না অন্তত তুই ভাল করেই জানিস।”
“আমি যেটা জানি সেটা তোর জানা থেকে সম্পূর্ণ আলাদা। যেটা জেনে তুই নিজেকে আড়াল করেছিস তা তোর একতরফা সিদ্ধান্ত।”
“আমি আসিরে।” বলে আবারো নিজেকে আড়াল করতে উদ্যত হয় অতুনু। আমি ওর হাত টেনে ধরে বললাম, “আজ কোনভাবেই তুই পালাতে পারবি না। শুনতেই হবে, সেদিনের কথা। যে দিনটা তোকে উদভ্রান্ত পথিক করেছিল।”
“আমি কিছু শুনতে চাই না প্লিজ।”
“সত্যটা তোকে আজ জানতেই হবে। এটা আমার আত্মতৃপ্তি। ওর নীরবতা দেখে বললাম, ”নিরুপমা আমার স্ত্রী তাইতো?”
অতুনু সম্মতিসূচক মাথা নাড়ে।
বললাম “না। সে আমার স্ত্রী নয়।”
কথাটা শুনে অতুনুর হৃদয়ে অন্য এক বাতাস বইতে থাকে। বলল “তাহলে সেদিন যে,,,,”
“নিরুপমার সাথে তোর যে সম্পর্ক ছিল সেকথা আমাকে কখনও জানতেও দিসনি। না তুই- না সে। যখন আমার সাথে নিরুপমার বিয়ের পাকা কথা হলো তখনও না। সাত পাকে বাঁধা পড়ার পর বাসর ঘরে যাবার আগেই তোর দীর্ঘ অনুপস্থিতি আর ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র দু’একটা বিষয় আমার মনে অনেক প্রশ্নের জন্ম দেয়। কিছু একটা হয়েছে বুঝতে পারি। সে কারণে বাসর ঘরে যেয়ে নিরুপমার ডান হাত টেনে আমার মাথার ওপর নিয়ে দিব্যি দিয়ে বলি আসল সত্যটা বলার জন্যে। তখন নিরুপমা তোর সাথে সম্পর্কের বিষয়টা জানায়। এমনকি তুই তাকে নিরু বলে ডাকিস সেটাও। তখন থেকে তাকে আমি আলাদাই রেখেছি-আলাদা থেকেছি। সমাজে-সংসারে নামে মাত্র আমরা স্বামী-স্ত্রী। কিন্তু আদতে সে আমার আশ্রয়ে থেকে তোর অপেক্ষায় দিন গোনে রোজ।”
অতুনু আমার কথা শুনে বিস্মিত হয়ে বলল, “পুষ্পক তুই….”
বললাম, “সত্যি; নিরুপমা তোর ছিল- তোর আছে।”
নিরুপমা মূল অনুষ্ঠানস্থলের পাশে ছিল। আমার আসতে দেরি দেখে হাঁটতে হাঁটতে কাছে এসে দাঁড়ায়। একেবারে অতুনুর সামনে। দু’জনার চোখাচোখী হতেই আনন্দে নিরুপমার চোখ ভিজে যায় অথচ মুখ দিয়ে তার কোন প্রকাশ পায় না। সে নিশ্চুপ দাঁড়িয়ে থাকে।
আমি চাইনি ওদের মাঝে থাকতে। সত্যি কথা বলতে কী, আমার নিজেকে আজ বেশ হালকা হালকা লাগছে। কারো মুখে কোন কথা নেই দেখে আমি নীরবতা ভেঙে বললাম, “তোরা কথা বল, আমি আসছি।”
হোটেলের দিকে পা বাড়াতেই অতুনু আমার হাত টেনে ধরে সকল ভাবনাকে পেছনে ফেলে বলল, “পুষ্পক, তুই নিরুকে গ্রহণ কর। আর হ্যাঁ, আমার জন্যে অপেক্ষার এই বছরগুলো তো ফিরিয়ে দিতে পারবো না; তবে শুভ কামনা তো করতেই পারি। আমার ভালবাসা রইল। ভাল থাকিস তোরা।” কথা শেষ করে কিছু বুঝে ওঠার আগেই আঁধারের মাঝে হারিয়ে যায় অতুনু। আমি আর নিরুপমা অতুনু বলে বার কয়েক চিৎকার করে ডাকলেও সে পেছন ফিরে একবারও তাকায় না।
Leave a Comment
Your email address will not be published. Required fields are marked with *