728 x 90

মাতৃভাষায় কুরআন বুঝা কেন গুরুত্বপূর্ণ

প্রফেসর ড. মুহাম্মদ ইউসুফ আলী: অনেকদিন আগের কথা। আমি একবার ক্লাসের এক ছাত্রকে জিজ্ঞাস করলাম, তোমার নাম কি? সে বলল, মুতাফফিফীন। আমি বললাম, বেশ সুন্দর নাম তো, তা এর অর্থ কি? সে বলল, আমি এর প্রকৃত অর্থ জানিনে, তবে এই নামে কুরআনে একটি সূরা আছে; আমার আব্বু এই নামটি রেখেছেন। আমিও বললাম, ভেরি গুড (খুব

প্রফেসর ড. মুহাম্মদ ইউসুফ আলী: অনেকদিন আগের কথা। আমি একবার ক্লাসের এক ছাত্রকে জিজ্ঞাস করলাম, তোমার নাম কি? সে বলল, মুতাফফিফীন। আমি বললাম, বেশ সুন্দর নাম তো, তা এর অর্থ কি? সে বলল, আমি এর প্রকৃত অর্থ জানিনে, তবে এই নামে কুরআনে একটি সূরা আছে; আমার আব্বু এই নামটি রেখেছেন। আমিও বললাম, ভেরি গুড (খুব ভাল)। আমি আসলে না বুঝেই বলেছিলাম, ভেরি গুড। অনেকদিন পর যখন এই সূরাটির অর্থ আমি বাংলায় দেখলাম তখন তো আমার চোখ ছানাবড়া। কয়েকবার বললাম, আসতাগফিরুল্লাহ (আমি আল্লাহর কাছে মাফ চাচ্ছি)। আসলে মুত্বফফিফীন শব্দের বাংলা অর্থ যে ওজনে কম দেয় বা প্রতারণা করে। মুতাফফিফীনরা ধ্বংস হোক, এই কথা পবিত্র কুরআনে মহান আল্লাহ রব্বুল আলামীন ঘোষণা করে এরশাদ করেছেন, “যারা মাপে কম করে, তাদের জন্যে দুর্ভোগ, যারা লোকের কাছ থেকে যখন মেপে নেয়, তখন পূর্ণ মাত্রায় নেয় এবং যখন লোকদেরকে মেপে দেয় কিংবা ওজন করে দেয়, তখন কম করে দেয়। তারা কি চিন্তা করে না যে, তারা পুনরুত্থিত হবে। সেই মহাদিবসে, যেদিন মানুষ দাঁড়াবে বিশ্ব পালনকর্তার সামনে। এটা কিছুতেই উচিত নয়, নিশ্চয় পাপাচারীদের আমলনামা সিজ্জীনে থাকবে (সূরা মুতাফফিফীন:১-৭)”। এখন তাহলে আমার মত পাঠক বুঝতে পেরেছেন এই ‘মুতাফফিফীন’ নামটা কত মারাত্মক। অনেক ব্যবসায়ী মুসল্লী আছেন যারা এই সূরা নামাজে শুনছেন, আবার ঠিক একটু পরেই দোকানে গিয়ে মাপে কম দিচ্ছেন। তারা যদি এই সূরার অর্থ মাতৃভাষা বাংলায়  বুঝতেন তাহলে হয়তবা তারা মাপে কম দেয়া ছেড়ে দিতেন।  প্রকৃত পক্ষেই মাতৃভাষায় কুরআন বুঝা এবং জীবনে তার বাস্তবায়ন করা অতীব গুরুত্বপূর্ণ। চলছে ভাষার মাস। ভাষা মহান আল্লাহতায়ালার এক বিরাট নেয়ামত। এ প্রসঙ্গে আল্লাহ তায়ালা এরশাদ করেছেন, “তোমাদের ভাষার বিভিন্নতা আল্লাহর এক অন্যতম নিদর্শন (৩০:২২)। সূরা আর রহমানে আল্লাহপাক বলেন, “করুণাময় আল্লাহ, শিক্ষা দিয়েছেন কোরআন, সৃষ্টি করেছেন মানুষ, তাকে শিখিয়েছেন ভাষা (আয়াত ১-৪)”। ইসলামে মাতৃভাষার গুরুত্ব অপরিসীম। মহান আল্লাহ তায়ালা সকল নবীকেই পাঠিয়েছেন তার নিজস্ব মাতৃভাষায়। আল্লাহ তায়ালা পবিত্র কুরআনে বলেন, “আমি সব পয়গম্বরকেই তাদের স্বজাতির ভাষাভাষী করেই প্রেরণ করেছি, যাতে তাদেরকে পরিষ্কারভাবে বোঝাতে পারেন (সূরা ইব্রাহিম:৪)। ইতিহাস সাক্ষ্য দেয় প্রধান চারটি আসমানী কিতাবের মধ্যে হজরত মুসা (আ.)-এর প্রতি ‘তাওরাত’ ইবরানী বা হিব্রু ভাষায়, হজরত ঈসা (আ.)-এর প্রতি ‘ইঞ্জিল’ সুরিয়ানী বা সিরিয়ার ভাষায়, হজরত দাউদ (আ.)-এর প্রতি ‘যাবুর’ ইউনানী বা আরামাইক ভাষায় এবং বিশ্বনবী হজরত মুহাম্মদ মুস্তফা (সা.)-এর প্রতি ‘আল-কুরআন’ আরবী ভাষায় অবতীর্ণ হয়। যদি আল্লাহ তায়ালা এভাবে নবী-রাসূলদের কাছে নিজ নিজ মাতৃভাষার মাধ্যমে আসমানী কিতাব প্রেরণ না করতেন, তবে দেশবাসী ঐশী ধর্মগ্রন্থের হেদায়ত ও সর্বাঙ্গীণ কল্যাণ থেকে বঞ্চিত হতো। মহানবী (সা.) মাতৃভাষা বিশুদ্ধভাবে শিক্ষা ও চর্চার প্রতি অত্যন্ত গুরুত্ব দিতেন। মাতৃভাষার প্রতি আমাদের কখনই অবহেলা করা উচিত নয়। কারণ মাতৃভাষা ছাড়া মহান আল্লাহর কোন কথাই আমরা বুঝতে পারব না। নামাজে ইমাম সাহেব সাধারণত কুরআনের শেষ দিকের ছোট ছোট সূরাগুলো পড়ে থাকেন। এগুলোর অর্থ কি আমরা সাধারণ মুসল্লী বুঝি? বুঝলে ভয়ে দীল কেঁপে উঠত; চোখে পানি চলে আসত। উদাহরণস্বরুপ, নামাযে বহুল পঠিত যিলযাল (ভূমিকম্প), তাকভীর (গুটিয়ে নিস্প্রভ করে ফেলা), ইনফিতার (বিদীর্ণকরা), আল ক্বরিয়াহ (করাঘাতকারী মহাসংকট) প্রভৃতি সূরাতে কেয়ামতের যে ভয়াবহ বর্ণনা দেয়া হয়েছে তাতে কোন মুমিনের অন্তর প্রকম্পিত না হয়ে পারে না। সূরা মাউন (আরআইতাল্লাজি) জানেন না এমন মুসল্লি খুব কম আছেন। কিন্তু অর্থ জানেন কয় জন? এই একটি ছোট্ট সূরা মানুষের আখলাককে পরিবর্তন করতে পারে; পারে গরীব ও প্রতিবেশীর প্রতি তার মনোভাবকে পরিবর্তন করতে। মাউন শব্দের বাংলা অর্থ, সামান্য সহযোগিতা, যেমন নিত্যপ্রয়োজনীয় কোন জিনিস প্রতিবেশীকে ধার দেয়া। এ প্রসঙ্গে মহান আল্লাহ কি বলেন দেখুন- “ আপনি কি দেখেছেন তাকে, যে বিচারদিবসকে মিথ্যা বলে? সে সেই ব্যক্তি, যে এতীমকে গলা ধাক্কা দেয় এবং মিসকীনকে অন্ন দিতে উৎসাহিত করে না। অতএব দুর্ভোগ সেসব নামাযীর, যারা তাদের নামায সম্বন্ধে বে-খবর; যারা তা লোক-দেখানোর জন্য করে এবং নিত্য ব্যবহার্য্য বস্তুু অন্যকে দেয় না (সূরা মাউন:১-৭)।” কি চিত্তাকর্ষক বাণী তাই না? এই সূরাতে এতিম ও গরিবদের সাহায্য করার পাশাপাশি নিত্য ব্যবহৃত জিনিস, যেমন পানি, লবণ, কাস্তে, কোদাল, বাসনপত্র ইত্যাদি প্রয়োজনের সময় প্রতিবেশীকে ধার দেবার উৎসাহ দেয়া হয়েছে। আসলেই, আমরা যদি অর্থ জেনে কুরআন পড়ি তাহলে তা আমাদের জীবনকে বদলিয়ে দিতে পারে। সংশোধন হতে পারে আমাদের খারাপ চরিত্র। সূরা ইউসুফে আল্লাহপাক এরশাদ করেন, আমি এই আরবী ভাষায় কুরআন রূপে অবতীর্ণ করেছি, যাতে তোমরা বুঝতে পার (সূরা ইউসুফ:২)।

মাতৃভাষার মাধ্যমে যত সহজে মানুষকে কোনো বিষয় বোাঝানো যায়, অন্য কোনো ভাষায় তা বোঝানো সম্ভব নয়। মহান সৃষ্টিকর্তা সব ভাষাভাষী মানুষের কথা শোনেন ও বোঝেন। মাতৃভাষা শুদ্ধ করে চর্চা করা বিশেষত তা বিশুদ্ধভাবে উচ্চারণ করা নবীর অনুপম সুন্নত। রসুলুল্লাহ (সা.) নিজে তার মাতৃভাষা আরবীকে ভালবাসতেন। হাদিস শরীফে বর্ণিত আছে যে, নবী করীম (সা.) বলেছেন,  ‘আমি আরবদের মধ্যে সর্বাপেক্ষা বিশুদ্ধ ভাষার অধিকারী।’ মাতৃভাষার মাধ্যমে কুরআন শিক্ষা ও ইসলাম চর্চার প্রতি আমাদের ভারত উপমহাদেশের বিজ্ঞ ওলামায়ে কেরামও যথেষ্ঠ গুরুত্ব দিয়েছেন। হজরত আনোয়ার শাহ কাশ্মীরি (রহ.) তাঁর এক ছাত্রকে উপদেশ দিতে গিয়ে বলেন, ‘যদি হিন্দুস্থানে দ্বীনি খেদমত করতে চাও, তবে নিজ ভাষায় যোগ্যতা অর্জন করো।’  প্রখ্যাত মনীষী সৈয়দ আবুল হাসান আলী নদভী (রহ.) বলেন, ‘কোনো দেশে দ্বীনি খেদমত করতে আগ্রহী ব্যক্তিকে সে দেশের মানুষের ভাষা ও সংস্কৃতি বোধ পূর্ণ মাত্রায় অর্জন করতে হবে’। শাইখুল হিন্দ হুসাইন আহমদ মাদানী (রহ.) বলেন, ‘যতক্ষণ না তোমরা আপন ভাষা সাহিত্যের অঙ্গনে বলিষ্ঠ ভূমিকা রাখবে, ততক্ষণ সমাজে প্রতিষ্ঠিত হতে পারবে না।’ এছাড়া প্রখ্যাত সমাজবিজ্ঞানী ইবনে খালদুন বলেন, ‘প্রত্যেকেরই শিক্ষার মাধ্যম তার মাতৃভাষা হওয়া উচিত। অপর ভাষায় শিক্ষা গ্রহণ ও শিক্ষাদান অসম্পূর্ণ শিক্ষারই নামান্তর’। এ ব্যাপারে বিশ্বখ্যাত দার্শনিক ইমাম গাজ্জালী (রহ.) বলেন, তোমার বন্ধুর পত্র পেলে কত আগ্রহ ভরে পড়। না বুঝলে বোঝার চেষ্টা করো। তোমার মালিক মহান আল্লাহ তায়ালা কুরআন আকারে তোমার কাছে একটি পত্র পাঠালেন, অথচ  তুমি তা কখনও পড়ে দেখলে না, বুঝলে না। আল্লাহতায়ালা যেন বলেন, আমি কি তোমার বন্ধুর চেয়েও নিকৃষ্ট হয়ে গেলাম?

লেখক: মৎস্য-বিজ্ঞানী ও অধ্যাপক, খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়, পোস্ট-ডক্টরাল ভিজিটিং ফেলো, সিডনী

Read More

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked with *

সর্বশেষ পোস্ট

Advertising