728 x 90

ট্রেন্স থেকে ফিরে এসে: -রউফ আরিফ

পূর্ব প্রকাশের পর- পরী হেসে উঠে বলল, ছেলের মার দিকে একবার চেয়ে দেখেন। দুটো কথা কন। বেচারি কেমন করে চেয়ে আছে। আট নয় মাস এই বাড়িতে এসে আছে, এক বিছানায় ঘুমাই আমরা। কত কথাই তো হয় আমাদের- -তাহলে তো তুমি আমাদের সব কথাই জানো। -সব জানি না। তবে- রোজি পরীকে ধমক দেয়। আহ পরী কি

পূর্ব প্রকাশের পর-

পরী হেসে উঠে বলল, ছেলের মার দিকে একবার চেয়ে দেখেন। দুটো কথা কন। বেচারি কেমন করে চেয়ে আছে। আট নয় মাস এই বাড়িতে এসে আছে, এক বিছানায় ঘুমাই আমরা। কত কথাই তো হয় আমাদের-

-তাহলে তো তুমি আমাদের সব কথাই জানো।

-সব জানি না। তবে-

রোজি পরীকে ধমক দেয়। আহ পরী কি প্যাচাল পাড়িস। মানুষটা কোথা থেকে কত কষ্ট করে এলো, আগে তাকে ভেতরে নিয়ে বসা, হাত মুখ ধোয়ার পানি দে। খাবার দাবার দে। খেয়ে দেয়ে বিশ্রাম নিক। তারপরে তোর গল্পের ঝাপি খুলে বসিস।

পরী বাঁকা চোখে চেয়ে এক ঝলক হাসে। তারপরে আর কোনো কথা না বলে সুড়ুত করে বাড়ির ভেতরে ঢুকে যায়। আলি আরমান রোজির চোখে চোখ ফেলে কাঁপা কাঁপা গলায় বলে, কেমন ছিলে রোজি?

রোজি জবাব দেয় না। সে যে কেমন ছিল, সেই দীর্ঘ ইতিহাস এই উঠোনের মাঝে দাঁড়িয়ে বর্ণনা করা যায় না। অথবা উত্তাল বিক্ষিপ্ত দিনগুলোর ছবি দেখাবার মতো মনের অবস্থা রোজির এই মুহূর্তে নেই। তাই সেদিকে না গিয়ে বলে, চলো বাড়ির ভেতরে চলো।

অন্দরে পা রেখেই আরমান নিলুফার মুখোমুখি হয়ে যায়। লিলুফা হাসি মুখে সামনে দাঁড়িয়ে বলে, কেমন আছ আরমান ভাই?

আরমান তার বড় ভাইয়ের বন্ধু। চিরকাল তাকে শ্রদ্ধা সমীহ করে এসেছে। তাই আজ ছোট ভগ্নিপতি হলেও সেভাবে কথা বলতে পারে না। পুরোনো অভ্যাস মতোই কথা বলে।

আরমান কোনো ভুমিকা না করে বলে, আমার কথা পরে শুনো। আগে বলো, তোমরা কেমন আছ?

-আমরা যে কষ্টে নেই তা তো নিজের চোখেই দেখতে পাচ্ছ। তবে উৎকণ্ঠা আর উদ্বেগে ছিলাম।

-আমার জন্য?

-হাঁ।

-আসলে আমার কপাল খারাপ। তা না হলে তোমাদের এত কষ্ট দিতাম না। নিরুপায় হয়েই-

-যাক, এসে যখন পড়েছ তখন নিশ্চিন্ত হলাম। সব দোষত্রুটি ক্ষমা করে দেওয়া গেলো।

-তোমরা আমার আপনজন। তোমরা যদি সহানুভূতিশীল না হও তাহলে তো আমার আর সহানুভূতি পাবার জায়গাটাও অবশিষ্ট থাকে না।

-ছোটবেলা থেকে যে মানুষটাকে দেখে এসেছি আজকের মানুষটার সাথে তাকে মিলাতে পারছি না।

-কি করে মিলবে। তখন তো তুমি ছিলে পাশের বাড়ির সুন্দরী মেয়ে। বন্ধুর ইমিডিয়েট ছোট বোন। তাইতো তখন হম্বিতম্বি ছিল, ডাট ফাট ছিল, প্রেষ্টিজ ইসু ছিল। সব মিলিয়ে অন্যরকম একটা আবহাওয়া ছিল। আর এখন তুমি হলে বউয়ের বড়বোন। বিধায় এখন সম্পর্কে আমি ছোট মানুষ।

-ও ও। তাই তো! আসলে, চিরকালই তুমি কথার যাদুকর। তোমার সাথে পারবো না। যাও, হাত মুখ ধুয়ে ফ্রেশ হও। পরে আবার কথা হবে। রোজি ছেলেটাকে ওর কোল থেকে নে। দেখছিস না, খোকাকে কেমন চেপেচুপে ধরেছে। মনে হছে ওরকম শক্ত করে না ধরলে লাফিয়ে পড়ে ওর কোল থেকে পালাবে।

আরমান অপ্রস্তুত হয়ে বোকা বোকা চোখে ছেলের মুখের পানে এক পলক চেয়ে মৃদু হেসে বলল, মিছে বলনি। আমর ভয় করছে, ও আমার হাতের ফাঁক গলে পড়ে না যায়। এত ছোট বাচ্চা এর আগে আমি কোলে নিইনি।

-সে সব তো আমার বেশ ভালোই জানা আছে। ছোট ছেলেপুলে দেখলে তিন হাত দূরে থাকতে। পাছে তোমার পোশাক আশাক নোংরা করে দেয়।

-তুমি দেখি আমার সব কিছু মুখস্ত করে রেখেছ বড় আপা?

বড়আপা জবাব দেয় না। শুধু ঠোটের কোণায় হাসি ঝুলিয়ে রাখে। রোজি হাত বাড়ায়। দাও, ওকে আমার কোলে দাও।

ছেলেকে রোজির কোলে সমর্পণ করে ওর পিছে পিছে ঘরে ঢোকে আরমান। ছেলেকে দোলনায় শুইয়ে দিয়ে আরমানের মুখোমুখি দাঁড়ায়। নিচুকণ্ঠে জিজ্ঞাসা করে, কেমন ছিলে?

-ভালো না, সারাক্ষণ প্রচন্ড টেনশনে কেটেছে। আমার আপনজনেরা যেভাবে আমাকে ঠকাতে চেষ্টা করেছে তা শুনলে তুমি অবাক হবে।

রোজি আরমানকে থামিয়ে দিলো। থাক, যা হবার হয়েছে। এখন আর তা নিয়ে মাথা গরম কোরো না। আগে হাত মুখ ধুয়ে খেয়ে দেয়ে সুস্থ হও, তারপর ধীরে সুস্থে সব শুনবো।

আরমান থেমে যায়। রোজির মুখের দিকে চেয়ে আর কিছু বলতে পারে না। আসলে আরমানের মুখে আর কোনো কথা যোগায় না। এখানে আসবার আগে, যখন কোলকাতায় ছিল তখন কত কথাই না ভেবেছে। রোজির সামনে কিভাবে দাঁড়াবে। কি কি বলবে, মনে মনে কতবার তার রিহার্সেল দিয়েছে। কিন্তু রোজির সামনে এসে দাঁড়ানোর সাথে সাথে সেই সাজানো গোছানো কথাগুলো কোথায় যে হারিয়ে গেছে তা আরমান বুঝে উঠতে পারছে না।

আরমান রোজির মুখের পানে অপলক চেয়ে থাকে। একটা কিশোর উত্তীর্ণ মেয়েকে সে রেখে গিয়েছিল। সেই মেয়েটা এখন জননী হয়ে গেছে। হালকা পাতলা শরীরের গভীরে আরেকটা জীবনের অঙ্কুরোদগম হয়ে পৃথিবীর বুকে এসেছে; অথচ ধরিত্রী-রূপিনী সেই মাতার শরীরে তো কোনো পরিবর্তন তার চোখে পড়ছে না। শুধুমাত্র বুকের ওপরে সজ্জিত দুগ্ধভান্ডার দুটি আরও একটু স্ফীত হয়েছে। ওটা প্রকৃতির দান। শিশুর প্রয়োজনে খোদাতালা ওটাকে সমৃদ্ধ করেছে।

আরমানকে ওভাবে চেয়ে থাকতে দেখে রোজি জিজ্ঞাসা করে, কি দেখছ অমন করে?

-তোমাকে।

-আমি কি নতুন কিছু?

-তা তো বটেই। তুমি আমার কাছে চির নতুন।

-ধ্যাত।

আরমান দুই হাত প্রসারিত করে। রোজির চোখেমুখে ফুটে ওঠে অন্য এক আকাঙ্ক্ষার মোহময় আলোছায়া, যা কামনার আদিরসে সিক্ত। হারিয়ে যাওয়া সম্পদ ফিরে পেলে মানুষ যেমন তা পরম যত্নে কুড়িয়ে নেয়, রোজিও তেমনি আরমানের বুকে ঝাপিয়ে পড়ে। দুই হাতে উভয়ে উভয়ের কোমর জড়িয়ে ধরে। বুকের সাথে বুক চেপে ধরে। আরমানের কাধে মাথা রেখে হুহু করে কেঁদে ফেলে।

আরমান রোজির চুলের জঙ্গলে হাত বুলিয়ে বলে, কেঁদো না। আমি মনে করি, আমাদের দুঃসময় কেটে গেছে। আমাদের সামনের দিনগুলো খুবই সুখের হবে।

রোজি নরম গলায় বলে, হয়তো হবে। হয়তো হবে না।

-এভাবে বলছ কেন?

-ভবিষ্যত অনিশ্চিত। তাই আগ বাড়িয়ে সুখ-স্বপ্নের জাল বুনতে চাইনা।

ওদের কথা আর এগোয় না, দরোজার বাইরে পরীর গলা শোনা যায়। রোজি আপা, ভাবী তোমাকে ডাকছে। বেয়াইকে নিয়ে খেতে এসো।

৭.

কয়েকদিন আনন্দ উচ্ছলতায় হেসে খেলে পেরিয়ে গেলো। তবে এই কয়দিনে আলি আরমান একটা জিনিস নিয়ে বার বার রোজির সাথে আলাপ আলোচনা করেছে। তা হলো, কিভাবে তাদের আগামি দিনগুলো কাটবে। কিভাবে তারা তাদের নতুন জীবন শুরু করবে। চার পাঁচদিন পরে এক রাতে আরমান রোজিকে বলল, এবার আমাদের ঢাকায় ফিরতে হবে। এখানে এভাবে আর কতদিন থাকবে। লিলুফা আপা তোমার জন্য যা করেছে সে ঋণ আমরা কোনোদিন শোধ করতে পারবো না।

-তা ঠিক। ওই সময়ে আপা পাশে এসে না দাঁড়ালে কি যে হোতো তা কেবলমাত্র খোদাতালাই জানেন।

-তাহলে আর কেন? তাদের কাছে আর ঋণ বাড়িয়ে কাজ নেই। চলো আমরা ঢাকায় ফিরে যাই।

-ঢাকায় গিয়ে থাকবে কোথায়?

-এখনো নিশ্চিত না। তবে উপায় একটা হয়েই যাবে।

-তাহলে এক কাজ করো না।

-কি?

-তুমি আগে ঢাকায় গিয়ে একটা বাসা ভাড়া করো। একটা চাকরি বাকরি দেখ। কোনো কিছু জুটে গেলেই আমাকে নিয়ে যেও।

-তোমার কথা আমি বুঝতে পারছি না এমন নয়। এখন আমাদের সবচেয়ে বড় সমস্যা তোমার বাচ্চাটাকে নিয়ে। নিজেরা খাই না খাই, যেখানে যে অবস্থায় থাকি কোনো সমস্যা ছিল না। কিন্তু ওকে নিয়ে তো……

-হাঁ। আমি শুধু বাবুর কথা ভাবছি।

-তুমি তো আব্বা আম্মার ওখানে গিয়েও কয়েকদিন থাকতে পারো।

-না। বাবুকে নিয়ে আমি সেখানে কোনোদিনই যাবো না, যদি তারা নিজেরা এসে না নিয়ে যায়।

রোজির এই দৃঢ় সিদ্ধান্তে আলি আরমান শুধু খুশি হয় না, মনে মনে রোজিকে নিয়ে গর্ববোধও করে। তাই রোজিকে রেখে সে আবারও ঢাকায় ফিরে আসে। তবে মনে মনে যে পরিকল্পনা করে সে ঢাকায় আসে সেরকম উল্লেখযোগ্য কিছু পাবার আগেই একটা ঘর ভাড়া করে ফেলে, এবং রোজিকে ঢাকায় নিয়ে আসে।

এক বন্ধুর সহযোগিতায় একটা প্রাইভেট কোম্পানিতে চাকরিও জুটিয়ে ফেলে। যদিও বেতন তেমন বেশি না। তারপরও সেই সামান্য বেতনকে সম্বল করে শুরু হয় তার সংসার জীবন।

রোজি তার জেদ বজায় রাখে। একই শহরে বাস করেও সে একটা মুহূর্তের জন্য বাবার বাসায় যায় না। এভাবেই কেটে যায় দু’বছর। রোজি বাবার বাসায় না গেলেও তার বোনেরা মাঝে মাঝে রোজির বাসায় আসে। তাদের এই আসা যাওয়ায় বাপের বাড়ির সমস্ত খবরাখবর রোজি যেমন পায়, তেমনি বাবা মাও রোজির খবর জানতে পারে।

স্বাধীনতার বছরে ছেলের জন্ম বলে রোজি তার ছেলের নাম রেখেছিল জয়। এটা ছিল তার নিক নেম। আলি আরমান নিজের নামের সাথে মিলিয়ে ছেলের নাম রাখল আলি আহসান। তবে তারা দু’জনই ছেলেকে জয় বলেই সম্বোধন করত। (চলবে…)

 

Read More

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked with *

সর্বশেষ পোস্ট

Advertising